সাম্প্রতিক মানব পাচার প্রেক্ষিত: সময়োপযোগী উদ্যোগ

বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস–২০২৪ উপলক্ষে সুইজারল্যান্ড দূতাবাস, বাংলাদেশ–এর সহযোগিতায় উইনরক ইন্টান্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্প ও প্রথম আলোর আয়োজনে “সাম্প্রতিক মানব পাচার প্রেক্ষিত: সময়োপযোগী উদ্যোগ” শীর্ষক এক গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ জুলাই ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজ ও উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেনছবি: খালেদ সরকার

অংশগ্রহণকারী

দীপ্তা রক্ষিত

কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, বাংলাদেশ ও প্রকল্প পরিচালক, আশ্বাস, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল

সি আর আবরার 

নির্বাহী পরিচালক, রামরু  

এ কে এম মাসুদ আলী

নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন বাংলাদেশ

শাহীন আনাম

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন 

সালমা আলী

সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

তারিকুল ইসলাম

কান্ট্রি ডিরেক্টর, জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার

নাসির চৌধুরী

প্রকল্প পরিচালক  বি-পেমস্ অগ্রযাত্রা (জলবায়ু পরিবর্তন) প্রকল্প, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল

ফুয়াদ চৌধুরী

চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, দীপ্ত টিভি

বি এম মইনুল হোসেন

পরিচালক ও অধ্যাপক, আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শরিফুল হাসান

সহযোগী পরিচালক,মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম, ব্র্যাক

রাহনুমা সালাম খান

ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার, আইএলও বাংলাদেশ  

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

দীপ্তা রক্ষিত

কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, বাংলাদেশ ও প্রকল্প পরিচালক, আশ্বাস, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল

৩০ জুলাই বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘কোনো শিশুকে বাদ দিয়ে মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই নয়’। মানব পাচারের ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কোভিড–পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে সাইবারভিত্তিক মানব পাচারের বেশ কিছু নতুন প্রবণতা  দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে একটি অপরাধী চক্র অভ্যন্তরীণ, আন্তসীমান্ত বা আন্তদেশীয় মানব পাচারে সক্রিয় রয়েছে, যার প্রধান শিকার কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা।

মানব পাচারের শিকার অনেক ভিকটিমের সঙ্গে আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তদেশীয় শ্রম পাচারের বিষয়টিকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অভ্যন্তরীণ পাচারকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখানেও শ্রম শোষণ, গৃহস্থালিতে জবরদস্তিমূলক শ্রম, যৌন শোষণ ও শিশুশ্রমের মতো নেতিবাচক চিত্র দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দালাল চক্র মেয়েদের অধিক উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে বড় বড় শহরে অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত করছে। আন্তসীমান্ত মানব পাচারের ক্ষেত্রেও এ প্রবণতা লক্ষণীয়।

কোভিডের সময় পাচারকারী টিকটক হৃদয়ের কথা আমরা সবাই জেনেছি। এখন কিন্তু সেই হৃদয়ের জায়গায় অনেক হৃদয় যুক্ত হয়েছে। এখানে কেবল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এই ফাঁদে পড়ছে তা নয়, অনেক স্মার্ট তরুণ-তরুণী ও শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ফাঁদে পড়ছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এসেছে, বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে মিথ্যা বিয়ের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশি নারীরা বিদেশে পাচারের শিকার হচ্ছেন। আবার বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের পাচার করে জোরপূর্বক সাইবার স্ক্যামিংয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।  সামাজিক মাধ্যমের যুগে আমাদের সচেতনতা কার্যক্রম কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে ভাবতে হবে। পাচারকারীরা প্রযুক্তিনির্ভর যেসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে, তা ব্যবহার করেই কাউন্টার ক্যাম্পেইন করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনও মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। এ বিশালসংখ্যক জনসংখ্যা কোনো না কোনোভাবে মানব পাচারের ঝুঁকির মধ্যে থেকে যাচ্ছে। আমরা ‘আশ্বাস’ প্রকল্পের কর্ম এলাকায় এমন অনেক ভুক্তভোগী পেয়েছি।

ঝুঁকিপূর্ণ যেসব জনগোষ্ঠীর কথা আমরা বলছি, তাদের শুধু চিহ্নিত করলে চলবে না, বাজারমুখী দক্ষতা উন্নয়ন করে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। জলবায়ু সহনশীল জীবিকায়নের সুযোগ সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। কমিউনিটি পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাইবার মনিটরিংয়ের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করা জরুরি। অভিবাসন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও নিরাপদ করতে হবে। এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে আগামী দিনে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা মিলে একযোগে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সি আর আবরার 

নির্বাহী পরিচালক, রামরু  

২৭ বছর আগে আমরা যখন কাজ করা শুরু করি, তখন পাচার বিষয়ে আমাদের ধারণা ছিল নারী ও শিশুকেন্দ্রিক। আইন থেকে শুরু করে এ সংক্রান্ত চুক্তিগুলোর মধ্যেও এর প্রাধান্য ছিল। শ্রম অভিবাসনের মধ্যেও যে পাচারের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এটা তখন আমাদের ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না। পাচারের সংজ্ঞার দিকে তাকালে দেখা যায়, যখন একজন লোককে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে, তাঁর যে শ্রমের ফসল তা তিনি পাচ্ছেন না, তিনি দাসসুলভ একটা অবস্থার মধ্যে রয়েছেন, তাঁর পরিচয়ের ডকুমেন্টস (পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি) তাঁর কাছে নেই, তাঁর খাওয়া–দাওয়া অনেক সময় অনিশ্চিত।

আমাদের যে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে এ ধরনের একটা অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। তারা যে পাচারের শিকার হয়েছেন বা তাঁদের ঘটনাটি পাচারের সঙ্গে মিল রয়েছে এটিকে প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অভিবাসনের মধ্যেও যে পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা অনেক সময় বিবেচনায় নেওয়া হয় না। বরং মানব পাচার বিরোধী আইনের পরিবর্তে ২০১৩ সালের অভিবাসন আইনে এ ধরনের ঘটনার বিচার করতে    বলা হয়।

মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধের ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি বেশির ভাগ সময় হয় না, হলেও তাতে দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ করা যায়। একটি উদাহরণ দিই: কোভিডের সময় তিন শতাধিক অভিবাসী শ্রমিকের একটা দল ভিয়েতনাম থেকে ফেরত এসেছিল, যারা তিন দফা কোয়ারেন্টিন শেষ করার পরও তাদের আটকে রাখা হয়েছিল। পরে হাইকোর্টে রিট করে তাঁদের বিষয়টি সুরাহা করা হয়। কিন্তু এর জন্য কে দায়ী, তা আজও জানা যায়নি। অথচ তারা নিরাপদ অভিবাসনের সকল প্রক্রিয়া মেনেই কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়েছিলো।

আজকে আমরা মানব পাচারের নতুন ধারাগুলো নিয়ে আলাপ করছি, অথচ মানব পাচারের ক্ষেত্রে আমরা অ্যানালগ সমস্যাগুলোই এখনো সমাধান করতে পারিনি, ডিজিটাল সমস্যা তো আরও পরের বিষয়। তবে এ জন্য রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে এ অপরাধগুলো সংঘঠিত হতে না পারে।

এ কে এম মাসুদ আলী

নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন বাংলাদেশ 

পাচারকারীরা এখন ফেসবুক, টিকটকের মতো  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পাচারের টুল হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। নতুন এই ধারা সম্পর্কে আমি দুটি বিষয়ে বলতে চাই। প্রথমত, যে কাঠামোর মধ্যে সামাজিক মাধ্যম আমাদের দেশে অবারিত হয়েছে,

সে কাঠামোর কোনো দুর্বলতা রয়েছে কি? দ্বিতীয়ত, যাদের নিয়ে আমরা কথা বলছি, অর্থাৎ কিশোর-কিশোরীদের আকৃষ্ট করার জন্য কী উপকরণ ওখানে রয়েছে, এর ঝুঁকিটা কোথায়, তাও আলোচনায় আসতে হবে।

‘টিকটক হৃদয়’ নামের একজন মানব পাচারকারীর কথা আমরা জানি, যিনি দাবি করেছেন, তিনি একাই এক হাজার জনকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাচার করেছেন। অনেক সামাজিক মাধ্যম বলে থাকে, শিশু সুরক্ষার নীতি তারা অনুসরণ করে। কিন্তু শিশু বলতে তারা বোঝায় ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত। অর্থাৎ তারা নিজেদের বিজ্ঞাপনের আইন দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু সনদ যা দ্বারা রাষ্ট্রসমূহ শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করে, সে আইনে ১৮ বছরের নিচের সবাই শিশু। বাণিজ্যিক পরিসরে থাকা সামাজিক মাধ্যমগুলোর জন্য আমরা আমাদের দেশে এখনো কোনো দায়বদ্ধতার জায়গা তৈরি করতে পারিনি।

সরবরাহ কাঠামোর মধ্যে আইনি এ গোলকধাঁধা আরেকটু সম্প্রসারিত। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান আইনি নিবন্ধন ছাড়া সেবা প্রদান করে, তাহলে জাতীয় পরিসর থেকে তাকে দায়বদ্ধ করা খুব কঠিন। এখানে সুরক্ষার একটি ফাঁক আমরা দেখছি। দেশে শিশুদের ডিজিটাল সুরক্ষারও উদ্যোগ রয়েছে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের যে অবকাঠামো ও সেবাকাঠামোর মধ্যে শিশুরা বিচরণ করছে, জাতীয় পরিসরে তার কোনো পরিচয় বা নিবন্ধন না থাকায় তাকে আমরা শনাক্ত করতে পারছি না।      তাই আমাদের জাতীয় আইনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও এককভাবে দায়বদ্ধ করতে পারছি না।

সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো লাইক পাওয়া, নিজেদের ফ্যান-ফলোয়ার বাড়ানো। তাই খুব সহজে কিশোর–কিশোরীদের ফাঁদে ফেলা যায়। শিশুরা কীভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা একমাত্র দায়বদ্ধ থাকছে তাদের পিতামাতার ওপর, যাঁদের বেশির ভাগই এ জগৎ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না! কোন সাইটে শিশুরা প্রবেশ করতে পারবে, আর কোনটিতে পারবে না, তা পশ্চিমা দেশের অভিভাবকেরা অ্যাপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন; কিন্তু আমাদের এখানে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলেও তার প্রচার খুবই সীমিত।

যাকে আমরা মানব পাচার বলি, তার মধ্যে স্থানান্তর বা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। কিন্তু যখন ডিজিটাল মাধ্যমের দ্বারা পাচার সংঘটিত হচ্ছে, তখন কিন্তু এ স্থানান্তরের প্রয়োজন অনেকাংশেই হচ্ছে না। আমি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গেলাম না; কিন্তু পাচার হয়ে গেলাম—বিদ্যমান আইন একে সমর্থন করে কি? পাচারকারীরা আমার ঘরের মধ্যেই আমার দৃশ্য ও আচরণ দ্বারা অন্যের কাছে বিনোদনের সমাগ্রী হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে অর্থের আদান-প্রদান হচ্ছে। আমার ছবি প্রকাশ করে দেবে বলে আমাকে আবদ্ধ করছে, অপহরণ করার প্রয়োজন হচ্ছে না। ভীতি ও ভালোবাসা—এ দুটিকে ব্যবহার করে তারা এ ফাঁদটা তৈরি করেছে। কাজেই আমাদের কিশোর-কিশোরীদের এ জগতের গোলকধাঁধা সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে, যেন তারা সাবধান হতে পারে।

শাহীন আনাম

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন  

পরিবারে ও সমাজে নারী ও কন্যাশিশুর অবস্থা কী, তাদের কী চোখে দেখা হয়, তা বোঝা দরকার। কুসংষ্কার, সামাজিক রেওয়াজ ও রীতিনীতিকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে নারীকে খাটো করা হয়, তার প্রতি সহিংসতা ও অত্যাচার করা হয়। পরিবারে নারী ও কন্যাশিশুর অবস্থানের পরিবর্তন ব্যতীত সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, পাচার কমানো খুব কঠিন।

নারীর প্রতি আমাদের ধ্যানধারণা বদলাতে হবে। বাল্যবিবাহের সময় কন্যাশিশুর যেমন কোনো মতামত থাকে না, আবার বিয়ের পরও তার কোনো মত থাকে না। অনেক সময় তারা কোলে একটি শিশু নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসে এবং তাদের এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাচার করার জন্য অনেকে বসে থাকে। আমরা বলি দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার কারণে বাল্যবিবাহ হয়। কিন্তু একটা মেয়েকে যখন চাকরির জন্য দেশে-বিদেশে পাঠানো হয়, তখন নিরাপত্তার কথা ভাবে না কেন! তখন তো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না যে আমার মেয়ে নিরাপদ থাকবে কি না।

আমরা অনেক বছর ধরে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করছি। কিন্তু এটা অন্তহীন একটা প্রক্রিয়া। এখনো মা–বাবা ও পরিবারকে সচেতন করা দরকার বিপদগুলো কোথায় হতে পারে। পাচার কখনো থেমে নেই, আগে একভাবে হতো, এখন অন্যভাবে হচ্ছে। ভালো একটা জীবনের স্বপ্নে অনেক কিছু বুঝতে না পেরে তারা পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে। অভিভাবকেরা লাভের কথা ভেবে ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করে না। তাদের বোঝাতে হবে, এর পরিবর্তে তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে দক্ষ করে তুললে সে এর চেয়ে অনেক গুণ ফিরিয়ে দিতে পারবে। তাদের জন্য অনেকগুলো অপশন তৈরি করে অভিভাবকদের সে সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

মানব পাচার যে কত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন, তা আমাদের দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করতে হবে, ধারণ করতে হবে। শক্তিশালী অনেক সামাজিক রীতিনীতি আছে, যা আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এখানে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বিষয়ও রয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করে দায়বদ্ধতার আওতায় আনতে হবে। পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

সালমা আলী

সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি 

আমরা আঞ্চলিক পর্যায়ে শিশুদের পাচার ও বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করছি। এনজিওর অ্যাডভোকেসির কারণে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন–২০১২ প্রণীত হয়েছে। যদিও সর্বক্ষেত্রে আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। পাচারকরীদের সঠিক তথ্য বেশির ভাগ সময়ে সামনে আসে না। আইনে মানব পাচারের সাক্ষীদের নিরাপত্তার কথা বলা আছে। কিন্তু লোকবল–সংকটসহ নানা কারণে এটি করা যাচ্ছে না।

সরকারের সদিচ্ছা আছে, তাদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। ভারতে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় পাচার নিয়ে কাজ করে। অপর দিকে আমাদের দেশে এর দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আমাদের দেশেও পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করা দরকার। পাচার প্রতিরোধ, নিরাপত্তা, আইনি প্রক্রিয়া ও প্রত্যাবাসনে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের সরকারের মধ্যে সমঝোতা জরুরি। এতে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা সহজ হবে।

আমরা মাইগ্রেশনের বিরুদ্ধে বলছি না, আমরা চাই নিরাপদ মাইগ্রেশন। মধ্যপ্রাচ্য আমাদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। তাই মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।

আমরা কয়েকটি ঘটনায় দেখেছি, ১৪ বছরের মেয়েদের ২১-২৩ বছরের দেখিয়ে নিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মিথ্যা আইডি কার্ড বানানো হয়। এ চক্র এখন এত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে আমাদের মতো

এনজিওর পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও ভারতের হোটেলগুলোয় অনেক বাংলাদেশি মেয়ে পাচারের শিকার হয়ে জোরপূর্বক অবৈধ কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে চাহিদা ও জোগান অনেক বড়, তাই আমাদের আঞ্চলিক পর্যায়ে কাজ করতে হবে। সরকারের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা জরুরি।

তারিকুল ইসলাম

কান্ট্রি ডিরেক্টর, জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার 

সম্প্রতি আমরা পাচারের যেসব ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি, তার ৪০ শতাংশ ভুক্তভোগীই ফেসবুক, টিকটকের মতো কোনো সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংযুক্ত হয়েছিল। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, যারা পাচারকারী অথবা পাচারকারী চক্রের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে, তারা তাদের কাজের ধরনে পরিবর্তন এনেছে। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি চৌকস। তারা জানে কীভাবে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট লুকাতে হয়। ফলে দেখা যায় আমাদের এখানে মামলার তদন্ত কার্যক্রম বেশি দূর এগোয় না। কারণ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট অনুসরণ করা প্রায়শই সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের ডিজিটাল ফরেনসিক সক্ষমতাও সীমিত।

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে আমরা এখনো অনেক আগের অবস্থাতেই আছি, কিন্তু পাচারকারীরা অনেক এগিয়েছে। তারা অন্য দেশের সিম দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে ব্যবহার করে। ফলে তাদের ট্র্যাক করা সম্ভব হয় না। এতে বিচারিক প্রক্রিয়া ও তদন্ত বড়ভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

আমরা হয়তো প্রতিরোধ বা ভুক্তভোগীদের সেবা ও পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছি। মানব পাচারে মানুষ পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরাই মানব পাচারের শিকার হয়ে থাকে। সাইবারভিত্তিক মানব পাচারের ঘটনায় যেসব মামলা হয়, তার অধিকাংশই মানব পাচার আইনে করা হয় না। আন্তসীমান্ত পাচারের ক্ষেত্রে দুটি দেশ জড়িত থাকে। ফলে যখন কোনো অপরাধ সীমানা অতিক্রম করে, তখন তা সমাধান করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আন্তসীমান্ত পাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত এখন পর্যন্ত একসঙ্গে কোনো মানব পাচারের মামলা তদন্ত করেছে বলে আমার জানা নাই।  এনজিওরা সরকারকে তথ্য দিতে পারে, কিন্তু এটা আক্ষরিক অর্থে তদন্তে রূপ নেবে কিনা তা নির্ভর করে দুই সরকারের সংস্থাগুলোর ওপর। এ নিয়ে আমরা সরকারের আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করি।

নাসির চৌধুরী

প্রকল্প পরিচালক  বি-পেমস্ অগ্রযাত্রা (জলবায়ু পরিবর্তন) প্রকল্প, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল 

আমরা অনেক সময় ধীরগতির দুর্যোগকে এড়িয়ে যাই। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়; কিন্তু লবণাক্ততা বা খরার ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। একটা ধীরগতির  দুর্যোগের ক্ষেত্রে অভিযোজনে চারটি ফলাফল দেখা যায়।

একটি হচ্ছে, মানুষ জেনেবুঝে অভিযোজনের চেষ্টা করে। এ জন্য অনেক সময় সে স্থানান্তরিত হয়, এতে কোনো ঝুঁকি দেখছি না। দ্বিতীয়ত, অভিযোজনের ক্ষেত্রে না জেনেবুঝে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া। তখন আসলে মানব পাচারের ঝুঁকিটা তৈরি হয়। তৃতীয়ত, জেনে-বুঝে স্থানান্তর না হওয়া। দিন শেষে তার অভিযোজন সফল হয়। এখানেও কোনো সমস্যা থাকে না। চতুর্থ বিষয়টি সবচেয়ে ভয়ংকর। এখানে কেউ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে ন এবং সে স্থানান্তরিত হতেও পারছে না। সে বাধ্য হচ্ছে থেকে যেতে। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষজন। তাঁরাই আন্তসীমান্ত পাচারের অন্যতম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।

বাধ্যতামূলক স্থানান্তরে পুনর্বাসন ব্যর্থ হলে পাচারের ঘটনা ঘটে। মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর- এ অঞ্চলের মানুষ লিবিয়া, তিউনিসিয়া হয়ে গ্রিস ও ইতালিতে পাচার হওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যায়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম একটি কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বাল্যবিবাহের হার বেশি। এসব অঞ্চলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও অনেক বেশি। অনানুষ্ঠানিক পোশাক কারখানার শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশই এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে। সংগত কারণে এখান থেকে পাচারের ঝুঁকিও বেশি।

এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে: প্রথমত, জলবায়ুসহিষ্ণু জীবিকার ব্যবস্থা করা। জলবায়ুসহিষ্ণু বা জলবায়ু স্মার্ট কৃষিচর্চাকে উৎসাহিত করা। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, জলবায়ুবান্ধব মাইক্রো ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা করা। এ জন্য ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে পলিসিগত সহায়তা করতে হবে। সর্বশেষ, সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়।

ফুয়াদ চৌধুরী

চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, দীপ্ত টিভি  

গণমাধ্যমের কাজই হচ্ছে, মানুষকে সচেতন করা। আমি নিজে মেঘনা কন্যা নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি, যার মূল বিষয় নারী পাচার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। উইনরক ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় এখন জেলা পর্যায়ে শিল্পকলাসহ বিভিন্ন মিলনায়তনে আমরা এটির প্রদর্শনের ব্যবস্থা করছি।

গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত আরেকটি উদ্যোগের কথা বলা দরকার। এক বছর আগে নিকষ নামে একটা ওয়েব ফিল্ম নির্মিত হয়েছে, যেখানে টিকটক ব্যবহারকারীর মাধ্যমে পাচারের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমাটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হওয়ায় দারুণ দর্শকপ্রিয়তা পায়, মিলিয়ন ভিউ ছাড়িয়েছে। একজন ফিল্মমেকার একজন সাংবাদিকের সঙ্গে বসে এটার স্টোরি লিখেছেন।

আমি পাচারের শিকার অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার মনে হয়েছে, তাঁরা পুরোপুরি অসহায়। সমাজে তাঁদের নতুন করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো একটি বড় যুদ্ধের শামিল। সরকারের চেষ্টা রয়েছে; কিন্তু তাদের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। তাই আমার মনে হয়, সরকার, উন্নয়ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের ত্রিমুখী পার্টনারশিপ দরকার।

গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে পাচারবিরোধী খবর তুলে আনতে হবে। সংবাদপত্রে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন বেশি করে প্রকাশিত হওয়া দরকার, যেগুলো ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগবে। এর পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্য ছোট ছোট প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা যেতে পারে। এসব প্রামাণ্য দলিল সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিচারিক প্রক্রিয়া ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।

বি এম মইনুল হোসেন

পরিচালক ও অধ্যাপক, আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একজন পাচারকারীর প্রধান চাওয়া থাকে, তাকে যেন কেউ ট্র্যাক করতে না পারে। এজন্য তারা সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও ডার্ক ওয়েব ব্যবহার করে থাকে, যেখানে ক্রোম বা সাধারণ কোনো ব্রাউজার দিয়ে ঢোকা যায় না। ওখানে ঢুকতে আপনার লাগবে টর ব্রাউজার। ডার্ক ওয়েবের কাজই হচ্ছে সবকিছু বেনামি করা, আইপি অ্যাড্রেস লুকানো, লোকেশন লুকানো, পরিচয় লুকানো। সাধারণভাবে অনেকেই হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করে থাকে। হোয়াটসঅ্যাপে আমি কী লিখছি, তা এনক্রিপ্টেড করা থাকে। ফলে তা না দেখা গেলেও আমার আইপি এবং আমি কোথা থেকে ব্যবহার করছি তা বের করা যায়। কিন্তু সিগন্যাল অ্যাপে তাও দেখা যায় না। তাদের মূলনীতি হচ্ছে জিরো ডেটা, অর্থাৎ, আপনার কোনো ডেটাই তারা রাখবে না।

এই মুহূর্তে আমরা ব্লকচেইন সম্পর্কে মোটামুটি শুনেছি। ব্লক চেইনে পুরো নেটওয়ার্ক আছে, কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে, তা ট্রেস করা যায়। পালানোর কোনো সুযোগ নেই। তাকে ট্র্যাক করা যায়। সে কোথায় যাচ্ছে, কোন রুটে যাচ্ছে, সব তথ্যই জানা থাকবে পাচারকারীর। যাঁদের পাচার করা হয়, তাঁদের সবাই তো প্রযুক্তিগতভাবে সচেতন থাকেন না, সে ক্ষেত্রে তাঁরা বুঝতেই পারবেন না বিষয়গুলো।

তাহলে পাচার প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কী? এসব বিষয় প্রতিরোধ করতেও একই রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব। প্রযুক্তি তো কেবল ক্রিমিনালরা ব্যবহার করতে পারে এমন না, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এসব ব্যবহার করতে পারে। পাচারের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথমে একটা দেশে নিয়ে রাখা হয়, পরে সেখান থেকে আরেক দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা তো অভিবাসনপ্রত্যাশীদেরও ট্র্যাক করতে পারি তিনি ঠিক জায়গায় যাচ্ছেন, নাকি তিনি পাচার হচ্ছেন। এমআইটিতে লিংকন ল্যাব নামের একটা ল্যাব আছে, যেখানে তারা বিজ্ঞাপনগুলোকে এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করে বের করার চেষ্টা করে কোন বিজ্ঞাপনের পেছনে পাচারকারীরা আছে। শেষ কথা হচ্ছে, পাচার প্রতিরোধে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো সক্ষম ও আধুনিক করে গড়ে তোলার বিকল্প নাই।

শরিফুল হাসান

সহযোগী পরিচালক,মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম, ব্র্যাক 

বাংলাদেশের শিক্ষিত ও সাধারণ উভয় ধরনের মানুষেরই দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাক–এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের মাত্র ৫ শতাংশ মাইগ্রেশন এবং ট্রাফিকিং আলাদা করে বোঝে। বাকিরা যে         পাচার হচ্ছে তারা তা বুঝতেই পারে না।  তার কাছে প্রবাসে যাওয়াটাই সব। কীভাবে গেল, সেটা মুখ্য নয়।

ইউএনএইচসিআর বলছে, সমুদ্রপথ দিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যেসব দেশের মানুষ ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশ–ভারত এবং বাংলাদেশ–মিয়ানমার আন্তসীমান্ত পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নেওয়ার কথা বলে আমাদের মেয়েদের অন্য দেশে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা আছে।

এখন পাচারের মূল কেন্দ্র হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পাচারের বিষয়টি কখনোই আমাদের মতো দেশে অগ্রাধিকার পায় না।

সাধারণ মানুষকে আগে বোঝাতে হবে, কোনটা ‘প্রবাস’ আর কোনটা ‘পাচার’। প্রবাসে যাওয়ার আগে তারা দালালের পরামর্শ অনুযায়ী সব গোপন রাখে। বিদেশ যাওয়ার আগে তাদের বোঝাতে হবে এটা করা যাবে না, আগে জানাও তুমি কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ। আমরা সেভাবে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন শাখা মানব পাচার নিয়ে কাজ করলেও সবার মধ্যে উপাত্ত বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকা উচিত। মানব পাচার কেবল এনজিওর অগ্রাধিকার তালিকায় থাকে। যতক্ষণ না এটি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে, ততক্ষণ তা ফলপ্রসূ কিছু হবে না।

রাহনুমা সালাম খান

ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার, আইএলও বাংলাদেশ   

আইএলও ২০১১ সাল থেকে সরকারকে সহায়তা করছে। এখন আইন আছে, রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির কোড অব কন্ডাক্ট আছে,  ক্লাসিফিকেশন আছে, কিন্তু এসবের ঠিকমতো বাস্তবায়ন নেই। আমরা ইন্সট্রুমেন্ট প্রস্তুত করে দিই, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

পাচার একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাকে পাচার করা হয়, তাকে গন্তব্যে নিয়ে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত করা হয়। এটা খুবই স্পষ্ট যে বাধ্যতামূলক শ্রমের কিছু সূচক রয়েছে—কাজের সূত্রে যদি কেউ যায়, যদি কাউকে জোর করে রাখা হয়ে। কারও পাসপোর্ট নিয়ে গেলে সে ভয়ে কাজ করে। এটা বাধ্যতামূলক শ্রম। এর জন্য আইএলওর একটা মৌলিক কনভেনশন আছে। আইএলওর উপাত্ত বলছে, বিশ্বব্যাপী ২৮ মিলিয়ন মানুষ বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত আছে। এদের মধ্যে ৬ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ যৌন নির্যাতনের শিকার। এর কারণ হচ্ছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাজার। এটি এত শক্তিশালী যে আমরা নিজেরাও কল্পনা করতে পারি না!

আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি। আমরা এখন উন্নত দেশের কাতারে যাচ্ছি। সুতরাং আমাদের সেই মানের সূচকের দিকে নজর দিতে হবে। আমরা সব সময় সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলি। সেখানেও যথাযথ সমন্বয়ের একটা অভাব পরিলক্ষ্যিত হয়। সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর ও এনজিওগুলোকে এ দিকে নজর দিতে হবে। আমরা আরও যেটা করতে পারি, তা হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মানুষ দেশের বাইরে যেতে চায় দেশে কাজের সুযোগের অভাব রয়েছে বলে। তাদের অভিবাসন যাতে সহজ ও নিরাপদ হয় তা’র জন্য সরকারকে সকল ব্যবস্থা নিতে হবে।

বৈঠকে আরো বক্তব্য দেন ঢাকা আহসানিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাজেদুল কাইয়ূম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, উন্নয়নকর্মী আবদুল্লাহ জাফর, দ্য ডেইলি স্টারের এনজিও অ্যান্ড ফরেন মিশনের ইন-চার্জ তানজিম ফেরদৌস, দ্য বিজনেস স্ট্যানডার্ডের স্টাফ রিপোর্টার কামরান সিদ্দিকী ও প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্পের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক শেখ নাজমুল ইসলাম।