গোলটেবিল বৈঠক
বন্যা–পরবর্তী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নজর জরুরি
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পুষ্টি নিশ্চিত করে—এমন খাবার সরবরাহের ওপর জোর দেন।
এবার পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ডায়রিয়া, কলেরা, চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে এ সময় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পান করার জন্য এবং নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পানি বিশুদ্ধ করার উপায়গুলো শিখে নেওয়া দরকার। অপুষ্টি প্রতিরোধে কম খরচে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যায়—এমন খাবার সরবরাহ করা জরুরি। কী ধরনের ওষুধের প্রয়োজন বেশি হবে, সেটা নির্ণয় করে ওষুধ সংগ্রহ ও সরবরাহ করা উচিত। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল করে মাইকিংয়ের মাধ্যমে লোকজনকে জানানো উচিত, কোথায় এসে তাঁরা সেবা নিতে পারবেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করণীয়’ শিরোনামে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব মতামত তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে যৌথভাবে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ও জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী হিসেবে ছিল প্রথম আলো। বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পুষ্টি নিশ্চিত করে—এমন সব খাবার সরবরাহ করার ওপর নজর দিতে বলেছেন। শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, অন্তঃসত্ত্বা, শিশুকে বুকের দুধ পান করানো মা এবং ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ অসংক্রামক অসুস্থতায় ভোগা ব্যক্তিদের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৭৫ হাজারের মতো অন্তঃসত্ত্বা রয়েছেন বলে ধারণা দেওয়া হয় বৈঠকে।
গোলটেবিল বৈঠকে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ বলেন, বন্যার পর পাতলা পায়খানা, ডায়রিয়া, রক্ত আমাশয়, কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এবারও দেখা দিচ্ছে। শিশুদের পানিশূন্যতা ঠেকাতে এ সময়ের সবচেয়ে ভালো দাওয়াই হচ্ছে খাওয়ার স্যালাইন ও জিংক। আইসিডিডিআরবি কম খরচে খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেট তৈরির কাজ করছে। পানি বিশুদ্ধ করার উপায়গুলো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের শেখানো দরকার। যেকোনো স্থানের পানি ৪ থেকে ৮ ভাঁজ পাতলা কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিয়ে এর মধ্যে ফিটকিরি ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। ময়লাগুলো তলানিতে জমা হলে ওপরের পানি অন্য পাত্রে ঢেলে নিতে হবে। এরপর সেই পানিতে ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। এই পানি পান করার জন্য নিরাপদ। এক লিটার পানির জন্য এক চিমটি পরিমাণ ফিটকিরি, ব্লিচিং পাউডার লাগে। বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া নলকূপ থেকে বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার জন্য নলকূপের মুখ সোপি ওয়াটার দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এবং কিছু পানি চেপে ফেলে দিতে হবে।
তাহমিদ আহমেদ আরও জানান, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা যেন অপুষ্টির শিকার না হয়, সে জন্য খাবারে চাল, ডাল ও একটি ডিম নিশ্চিত করা দরকার। ভাতের ওপরে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাউডার ছিটিয়ে খাওয়ালেও অপুষ্টির ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশের সংক্রামক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দিকেও নজর দিতে হবে। অনেকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ পাচ্ছেন না। বন্যার পানিতে হাঁটাও এখন ঝুঁকিপূর্ণ। টয়লেট, হাসপাতালের বর্জ্য এই পানিতে মিশে রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলে সম্মিলিত ও সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) নাঈম গোলদার বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ওষুধের ঘাটতি যেন না হয়, সে লক্ষ্যে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে অধিদপ্তর। ২৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিনা মূল্যে ওষুধ দিচ্ছে। বন্যার পর সাপের উপদ্রবও বাড়ে। এ জন্য অ্যান্টিভেনম মজুত রাখা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ফার্মেসিগুলোকে কাজের উপযোগী করা এবং ফার্মেসিগুলো যেন বন্যার পানিতে ভিজে যাওয়া ওষুধ বিক্রি না করে সেদিকে নজর রাখার কথা জানান তিনি।
নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক মো. জোনাইদ শফিক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে ফেনী ও কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় তাঁদের প্রতিষ্ঠান চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে দেখেছে, পানি ও খাবারের পাশাপাশি ওষুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপারের চাহিদা অনেক বেশি। সব এলাকা সমানভাবে নজরও পাচ্ছে না। বিশুদ্ধ পানি পান এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে, যদি সবাই তাঁদের পাশে দাঁড়ায়। খাওয়ার পানির পাশাপাশি তাঁরা যেন গোসল করে নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করতে হবে। তিনি জানান, পুকুরের পানিতে চুন মিশিয়ে তা গোসলের উপযোগী করা যায়। শিশুদের অপুষ্টি প্রতিরোধে স্কুল খুলে মিড–ডে মিলের (দুপুরের খাবার) ব্যবস্থা করতে হবে।
এই দুর্যোগ মোকাবিলায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সরদার এ নাঈম। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা যেসব মতামত দিয়েছেন, তা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। লোকজনকে জানাতে হবে, কোথায় গেলে তাঁরা চিকিৎসাসেবা পাবেন। সরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনে একটি ফিল্ড হাসপাতাল করা যেতে পারে, যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একেকটি কর্নার স্থাপন করে সেবা কার্যক্রম চালাবে। এ কাজে স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, মসজিদের ইমামদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ মোহাম্মদ খান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব হবে জানিয়ে বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের অন্তত এক-দুই মাস যেন চিকিৎসা, ওষুধ, মলম দিয়ে সহায়তা করা যায়, সে উদ্যোগ নিতে হবে।
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নাজলিমা নারগিস অন্তঃসত্ত্বাদের ওপর নজর দিতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যেসব অন্তঃসত্ত্বার প্রসবের সময় হয়েছে, তাঁদের কাছাকাছি কোন হাসপাতালে নেওয়া যায়, পরিবারগুলোকে সেই পরিকল্পনা করতে হবে।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের শিশু ও নবজাতক বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক আল মুকতাফী সাদী; একই হাসপাতালের কিডনি ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ গোলাম ফাহাদ ভূঞা এবং ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের ডায়াবেটিস ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. আব্দুল মাহিদ খান।
গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।