অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের সুযোগ: আমাদের করণীয়

সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো–অপারেশন ও হেলভেটাস–এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ‘অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের সুযোগ: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩। আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

শামীম হায়দার পাটোয়ারী, এমপি চেয়ারপারসন, অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক সংসদীয় ককাস

অ্যাডভোকেট সালমা আলী

সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

তানিয়া হক

সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জোহরা মনসুর

উপপরিচালক, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো

শরিফুল ইসলাম

উপপরিচালক-কল্যাণ, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড

কাজী আবুল কালাম

চেয়ারপারসন, সিমস প্রজেক্ট অ্যাডভাইজরি কমিটি

আসিফ মুনীর

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ

মো. আবুল বাসার

প্রজেক্ট ডিরেক্টর, সিম্‌স প্রজেক্ট, হেলভেটাস

শাহরীন মুনির

প্রোগ্রাম অফিসার, মাইগ্রেশন পলিসি অ্যান্ড প্রসেসেস, আইওএম বাংলাদেশ

শরিফুল হাসান

প্রোগ্রাম হেড, মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভস, ব্র্যাক

আবদুল্লাহ আল মামুন

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম-ওকাপ

ইনজামুল হক

প্রজেক্ট ম্যানেজার, রামরু

তানজিম ফেরদৌস

ইনচার্জ, এনজিও অ্যান্ড ফরেন মিশনস

দ্য ডেইলি স্টার

নাফিজ ইমতিয়াজ হাসান

ডিরেক্টর-প্রোগ্রামস অ্যান্ড অপারেশনস, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায় যে শ্রমিকেরা প্রতারিত হয়েছেন। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে কোনো একটি দেশে যাওয়ার সময় পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে। আবার নির্দিষ্ট দেশে যাওয়ার পর দেখা গেল, সেখানে তাঁদের কাজ নেই। তাঁদের কোনো একটি এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যাদের দ্বারা এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, সেখানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে।

শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা ও সচেতন করা জরুরি। এ সময়ে এটা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। কিন্তু সেটা সব ক্ষেত্রে ঠিকভাবে হচ্ছে বলে মনে হয় না। আলোচনায় এসব বিষয় আসবে বলে আশা করি।

সালমা আলী

শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও যে দেশে শ্রমিক যায়, সে দেশের দূতাবাসের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। তৃণমূলের একজন শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার সময় তিনি যেন প্রশিক্ষণ পান, সব ধরনের তথ্য জেনেবুঝেযান, সেটাই আমরা আশা করি। হবিগঞ্জের একটা মেয়ের বয়স ১৪ বছর। তাকে ২৭ বছর বয়স দেখিয়ে তার পাসপোর্ট করা হয়েছে। তারপর তাকে বিএমইটির সব নিয়ম মেনে সৌদি আরব নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সে অসামাজিক কাজসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে অাইওএমের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছে। বিমানবন্দরে আমরা তাকে গ্রহণ করেছি।

বিভিন্ন সংস্থা এত কাজ করার পরও এইমেয়ে বিমানবন্দর দিয়ে কীভাবে চলে যায়। আরেকটা মেয়ে দালালের মাধ্যমে বিদেশে যায়। তাকে জোর করে যৌনকাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। ইতালি থেকে আমাকে এক নারী ফোন করে এই মেয়েকে সহযোগিতার কথা বলেন। তিনি তাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করেন। সে মামলা করেছে। বিষয়টি আমরা দেখব। কিন্তু আরও অনেক ছোট মেয়ে বিদেশে এ ধরনের নির্যাতনেরশিকার হচ্ছে।

আমার কাছে তথ্য আছে যে এক বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের একটা হাসপাতালে কজন মেয়ে মারা গেছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিএমইটি (জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো), পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা সবাই অনেক কাজ করছে। তারপরও কেন এমন পরিস্থিতি হবে।

মানব পাচার বন্ধে ২০১২ সালে ভালো আইন হয়েছে। ২০১৩ সালে নিরাপদ অভিবাসন আইন হয়েছে। জাতীয় সংসদে নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে জোরালো আলোচনা করতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা, ন্যায়বিচার ও নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে নির্বাচনী দলগুলোর ম্যানিফেস্টোতে থাকতে হবে। আগামী কয়েক মাস আমরা এটা খেয়াল রাখব।

ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন যেভাবে দর–কষাকষি করে, আমরা কেন সেভাবে পারি না।

আমাদের দূতাবাস যদি আমাদের কর্মীদের সম্মান না করে, তাহলে বিদেশে কর্মীরা কখনো সম্মান পাবে না।

আমাদের কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলে যতটুকু সহায়তা পাওয়ার কথা, সেটা তারা দূতাবাসে বা দেশে ফিরে পাচ্ছে না। এসব বিষয় প্রবাসীকল্যাণ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সমন্বয় মিটিং করা উচিত। এসব মন্ত্রণালয় বিদেশে কর্মরত কর্মীদের জন্য সে দেশের দূতাবাস কী করছে, সেটা খোঁজ নিতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে, দায়বদ্ধ করতে পারে। আমার একটি স্বাধীন দেশ। কেন আমরা ভিকটিমের পক্ষে মামলা করতে পারব না, সেই সাহস আমাদের নেই কেন? অভিবাসনের সঙ্গে দেশে-বিদেশে যাঁরা যুক্ত, তঁাদের সবার সমন্বিত উদ্যোগ ‍নিতে হবে।

নাফিজ ইমতিয়াজ হাসান

স্ট্রেনদেন্ড অ্যান্ড ইনফরমেটিভ মাইগ্রেশন সিস্টেম (সিমস) প্রকল্পের আওতায় আমরা অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারে কাজ করছি। দেশের তিনটি জেলা—নরসিংদী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে আমাদের কার্যক্রম চলছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫৯টি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এর ৯৪ শতাংশ অভিযোগ পুরুষদের কাছ থেকে, ৬ শতাংশ অভিযোগ এসেছে নারীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ প্রতারণা, ৩৫ শতাংশ চুক্তি না মানা, ২২ শতাংশ মৃত্যু, ভিসা, ইমার্জেন্সি সাপোর্ট ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য ৯ শতাংশ।

তিনভাবে আমরা শ্রমিকদের আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকি, বিএমইটিতে সালিসের জন্য রেফার, স্থানীয় পর্যায়ে আপস মীমাংসা ও কোর্টে মামলা করে। তৃণমূলের মানুষের ঢাকায় এসে অভিযোগ করা সম্ভব হয় না। এ সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে। আমরা আমাদের কর্ম এলাকায় অভিযোগ গ্রহণ করছি। আবার বিএমইটি তিন জেলায় সালিসের অনুমতি দিয়েছে ও ঢাকায় ৯ জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু এটা যথেষ্ট না। সারা দেশে অভিযোগ গ্রহণের জন্য আরও মানবসম্পদের প্রয়োজন। অভিবাসী কর্মীরা রিক্রুটিং এজেন্সি সম্পর্কে সব তথ্য জানে না। অভিযোগের জন্য যে ধরনের দালিলিক তথ্য প্রয়োজন হয়, সে রকম তাদের থাকে না।

দুর্বল দালিলিক তথ্যের জন্য অনেক ক্ষেত্রে মামলা ফলপ্রসূ হয় না। তখন আবার তাঁরা মানসিক চাপে ভোগেন। অভিবাসীরা আদালতে মামলা করতে পারেন। কিন্তু আদালতের দীর্ঘসূত্রতার জন্য অনেক সময় তাঁদের হতাশ হতে হয়। গ্রাম পর্যায়ে আমাদের প্রকল্পের কমিটি হয়েছে। যেন স্থানীয়ভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানেও তাঁরা ভালো ফল পান না।

অভিবাসীদের সাধারণ অভিযোগ হলো, যে ধরনের কাজ নিয়ে তঁারা যান, সেটা পান না। তাঁদের থাকা–খাওয়ার সমস্যার অভিযোগ রয়েছে। অনেককে জোর করে দেশে পাঠানো হয়। আবার অনেকে টিকতে না পেরে ফেরত আসেন। অনেক ক্ষেত্রে এজেন্টরা টাকা নিয়ে বিদেশে পাঠায় না, লেবার ভিসার কথা বলে অন্য ভিসা দিচ্ছে। অনেক বেতনের কথা বলে কম বেতন দিচ্ছে। ওভার টাইমের পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। বিমানবন্দরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় অভিবাসী শ্রমিকের মালিকেরা তঁাদের পাসপোর্ট আটকিয়ে রাখেন। অনেকে ঠিক সময় বেতন পান না। কোভিডের সময় যাঁরা ফেরত এসেছেন, তঁাদের অনেকে বেতন পাননি।

২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যাপ্ত ৯৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০ জন শ্রমিক বিদেশে গেছেন। এখানে মধ্যপ্রাচ্যের ৯টি দেশে গেছেন ৭৬ লাখ ১৭ হাজার ২১৪ জন। এর প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক গেছেন সৌদি আরবে। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৭২৪টি মৃতদেহ বাংলাদেশে এসেছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে এসেছে ২৭ হাজার ২৩১ জন।

গত ১৪ বছরে প্রতিদিন ৯টি মৃতদেহ বাংলাদেশে এসেছে। এসব মৃতদেহের দ্বিতীয়বার কোনো তদন্ত হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে এর সঠিক তদন্ত দরকার। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার দিক থেকে এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

শরিফুল হাসান

অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণের ক্ষেত্রে একটা চক্র রয়েছে। পাসপোর্ট অফিস থেকে এটা শুরু হয়। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি। আবার তাঁদের বেতন সবচেয়ে কম। আবার বিদেশে এক রুমে অনেককে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিদেশে প্রায় ১৫০ জনের বেশি আত্মহত্যা করেছেন।

বিদেশের পুলিশ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার সাহস দেখায় না। কারণ, ওই সব দেশ প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেকোনো দেশে গেলে দেখবেন, দূতাবাসের সামনে আমাদের শ্রমিকদের লম্বা লাইন; রোদ, বৃষ্টিতে তাঁরা কষ্ট পাচ্ছেন। আমরা আমাদের নাগরিককে যতটুকু সম্মান দেব, অন্য দেশও আমাদের নাগরিককে সেই সম্মানটুকু দেবে।

প্রবাসীরা যে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, সারা পৃথিবী থেকে আমরা যে ঋণ নিই, তার কয়েক গুণ বেশি। অথচ তাঁদের সুরক্ষা নেই, ন্যায়বিচার নেই, মর্যাদা নেই। বিদেশি দূতাবাসে সাধারণ মানুষের জন্য যে বাথরুম, সেখানে দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসবে।

যত রকমের বীভৎসতা আছে, বিদেশে আমাদের নারীদের সেই সব সহ্য করতে হয়। কাউকে আগুনে শেকা দেওয়া হয়, কারও চুল কেটে দেওয়া হয় ইত্যাদি। সৌদি আরবে পাঠানো এক মেয়ে মিসরে আত্মহত্যা করেছেন। এর মানে, তাঁর মালিক তাঁকে মিসরে নিয়ে গেছেন।

একটা উদাহরণ দিই, মালয়েশিয়ার এক পুলিশ সদস্য এক ভারতীয় শ্রমিকের পাসপোর্ট ছুড়ে ফেলায় মালয়েশিয়াকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।

আমাদের বিএমইটি, বিমানবন্দর, দূতাবাস—এরা যদি অভিবাসী শ্রমিকদের সম্মান না দেয়, তাহলে বিদেশের মানুষও আমাদের অভিবাসীদের মর্যাদা দেবে না।

শাহরীন মুনির

অভিবাসন একধরনের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। যাঁরাই অভিবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরাই এখানে মুনাফা করছেন। আমাদের শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে আমাদের সুইপার, ভেনিসেও আমাদের কুলি। আমরা এমনও অভিবাসী পেয়েছি, যিনি তিনবার সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি চতুর্থবারও যেতে চেয়েছেন। আরেকজন ৮৮ লাখ টাকা খরচ করেও প্রতারিত হয়েছেন।

আমরা এটাও বুঝতে পারিনি যে যঁার ৮৮ লাখ টাকা আছে, তাঁকে কেন অভিবাসী হতে হবে! আমাদের আইন হয় কিন্তু আইনের প্রয়োগ প্রায় না। অভিবাসনের ক্ষেত্রে সুশাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আসিফ মুনীর

অগ্রগতি হোক বা না হোক, আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ভূমিকা রয়েছে। তারা এসব বিষয় নিয়ে কতটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে! রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুব জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের কথা যেভাবে ভাবেন, তেমন করে অন্যদেরও ভাবতে হবে। কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী প্রবাসীদের কথা বলেছেন যে তাঁরা আমাদের জন্য অনেক করছেন, এখন আমাদের তঁাদের জন্য করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অন্য সবার মধ্যে সে ইচ্ছা দেখা যায় না।

কোনো একটা সমস্যা হলে এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়ের ওপর দায় চাপায়। আবার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট কম। একইভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও বাজেট কম।

কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যেসব নারী শ্রমিক যান, তাঁদের ভীষণ মানবেতর জীবন ধারণ করতে হয়। এটা রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। একজন ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীকে ৩০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এটা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। তারপর তাঁর যে মানসিক যন্ত্রণা, সেটার তো কিছু হলো না।

প্রবাসী দেশের জবাবদিহির জায়গা নেই। প্রবাসী দেশের আইনি প্রয়োগ কার্যকর করতে হবে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নেই। আমাদের ক্ষেত্রে হয় একটা সমঝোতা স্মারক।

বিদেশে কেন একজন কর্মী মারা গেলেন, সে দেশের সরকার, বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

কাজী আবুল কালাম

বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। বিদেশে যাওয়ার জন্য খোঁজখবর নেওয়া, যাওয়ার প্রস্তুতি, বিদেশে পৌঁছানো, কোনো কারণে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর পুনঃঅন্তর্ভুক্তকরণ। বিদেশে যাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ সাধারণত যে দালাল ধরেন, সেই দালাল নিজেও কিছু জানেন না। এখান থেকেই প্রতারণার সূচনা হয়। তারপর তিনি বিএমইটিতে তিন দিনের প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু খুব অপ্রিয় হলেও এ কথা বলতে হয় যে এখানে যাঁরা প্রশিক্ষণ দেন, তাঁরা কোনো দিন বিদেশে যাননি। কর্মীর ভিসা ঠিক কি না, সেটা দূতাবাস থেকে পরীক্ষা করার বিষয় থাকে। কিন্তু বিএমইটি অনেক ক্ষেত্রে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়।

বিদেশি শ্রমিকের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শ্রমিক যাচ্ছেন সৌদি আরবে। তাহলে আমরা অন্তত এই দেশের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি, গবেষণা করি। কী কী সমস্যা হয়, সেটা তদারক করলেও অনেকটা কাজ হয়।

প্রতিবছর কতজন শ্রমিক মারা যান, কেন মারা যান, ক্ষতিপূরণ আদায়ের সর্বশেষ অবস্থা কী, কর্মীরা বিপদে পড়েছেন কি না—এসবের বিস্তারিত প্রতিবেদন লেবার উইং থেকে দেওয়ার কথা। এই কাজ হয়তো ঠিকমতো হচ্ছে না।

কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার সৌদি আরবের কিছু শহরে আইনি ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে। ২০২০ সালে রিক্রুটিং এজেন্সির মান নির্ধারণের জন্য একটা বিধি হয়েছে। এই বিধি মোতাবেক রিক্রুটিং এজেন্সির মান নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

মো. আবুল বাসার

অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের জন্য কতগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান বরং তাদের কাছ থেকে মুনাফা করার জন্য সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি যত দিন পর্যন্ত নিশ্চিত না হবে, তত দিন এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।

রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যকলাপ দেখবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়কে দেখার জন্য আছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি যদি রিক্রুটিং এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিত না করে, তাহলে এভাবেই চলতে থাকবে।

অধিকাংশ নারী দেশে কষ্টকর জীবন কাটাতে কাটাতে বিদেশে কাজ করতে যান। বিদেশে তাঁদের ওপর কতটা অমানবিক নির্যাতন করা হয় যে ওখানে তাঁদের মৃত্যু হয়। সন্তান মানুষ করা, সুখে থাকা—এমন কত ধরনের স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে যান। অথচ একটা সময় লাশ হয়ে দেশে ফিরতে হয়। আমরা যারা ঢাকায় থাকি, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, প্রতে্যকে অভিবাসী। এদের প্রত্যেককে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

ইনজামুল হক

বাংলাদেশের নাগরিক যেখানেই থাক না কেন, রাষ্ট্র তাঁকে সুরক্ষা দেবে—এটাই প্রত্যাশিত। অভিবাসী আইনেও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আইন ও নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ অভিবাসী সুরক্ষা পান না। বিদেশে গিয়ে তাঁরা প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন। এ জন্য পুলিশ, আইনজীবী, এনজিও, নাগরিক সমাজ সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অভিবাসী আইন সংশোধন হবে। সংশোধন কী হলো, অভিবাসীদের সেটাও জানাতে হবে। বিদেশে কর্মীদের নিজের অর্থ খরচ করেই আইনি সহায়তা নিতে হয়।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি দূতাবাস অভিবাসীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। অভিবাসীদের সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের বিষয়টি সরকার ভাবতে পারে।

তানজিম ফেরদৌস

বিশ্বের ১৬৯টি দেশে প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কাজ করছেন, যার মধ্যে ১০ লাখ নারী। প্রায় ৭০ হাজার নারী কাজ করছেন সৌদি আরব ও জর্ডানে। এসব দেশে নারী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে অহরহ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ফিরে আসা ব্যক্তিদের ৩৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার এবং ৪৪ শতাংশ নারী বেতন পাননি। অধিকার সচেতনতা ও বেতনে দর–কষাকষির দক্ষতা না থাকায় ওই সব দেশে ফিলিপাইনের নারীদের তুলনায় আমাদের নারী শ্রমিকদের বেতন কম এবং তাঁরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। রেমিট্যান্স আর্নার হিসেবে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে রাষ্ট্রের ভূমিকা সামান্য। আইএলও কনভেনশনের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আইনি সুরক্ষা পাওয়ার জন্য স্থানীয় ল ফার্মগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে, যেন বিদেশের মাটিতে ন্যায়বিচার পাওয়া যায়।

আবদুল্লাহ আল মামুন

ন্যায়বিচার ও সুরক্ষার গোড়ায় যে গলদ রয়েছে, সেটা বের করতে হবে। আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে বলা হয়েছে যে ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ বিদেশে যাবেন। মন্ত্রণালয় মনে করে, একে যদি ৬০ লাখ করা যায়, তাহলে এটা একটা বড় সাফল্য। গত বছর ১১ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ বিদেশে গেছেন। তাঁরা কীভাবে গেছেন, তাঁদের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, সেদিকে লক্ষ নেই।

অনেকেই তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে গেছেন। তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছে যে মালয়েশিয়া, দুবাই বা সৌদি আরবে যাওয়ার পর ওয়ার্ক পারমিট করতে পারবেন। কিন্তু সরকারের কি হিসাব আছে কতজন ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন, কতজন ফেরত এসেছেন বা কতজন জেলে আছেন? মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে এ বিষয়ে তেমন পদক্ষেপ দেখা যায় না।

তারা শুধু বিদেশে পাঠাচ্ছে। ফলে অনেকেই বিপদে পড়ছেন। ইদানীং বলা হচ্ছে যে প্রবাসী আয় কমে গেছে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া প্রবাসীদের পণ্য হিসেবে দেখা হয়। তাঁদের মানবাধিকারের কোনো বিষয় থাকে না।

অভিবাসন হচ্ছে একটা ব্যবসা। এখনো দেখা যায়, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মানুষ নৌপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে মিয়ানমারে আটক আছেন। তাঁদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাঁদের জন্য কী করছে। সব জায়গায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে প্রবাসীদের কল্যাণ কখনো হবে না।

জোহরা মনসুর

শ্রমিক সুরক্ষার আইন ও বিধিতে কর্মীর অধিকার, কল্যাণসহ সব বিষয় আছে। একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার চিন্তা থেকে শুরু করে ফিরে আসা পর্যন্ত যতগুলো ধাপ আছে, এর সব জায়গায় সুরক্ষা প্রয়োজন। ২০২২ সালে ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৮ লাখ ৮২ হাজার কর্মী বিদেশে গেছেন। অনেকে এত বেশি টাকা খরচ করে বিদেশে যান যে তাঁরা এখানেও কিছু করতে পারেন। আমরা বিএমইটি থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করি। কারণ, অর্থ ব্যয়ের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ও বিদেশে যাওয়ার পর তাঁর কী সমস্যা হতে পারে, সে সম্পর্কে সচেতন করা হয়। যেন বিদেশে যাওয়ার জন্য একজনের সবকিছু শেষ না হয়ে যায়।

আমরা কর্মীদের নিবন্ধন করি, বায়োমেট্রিক করি। তাঁদের সুরক্ষার জন্য বিমার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে কী করতে হবে—দিনের পর দিন এসব বিষয়ে বলে যাচ্ছি। সরকার যে কিছু করছে না, তা কিন্তু নয়।

যখন কেউ অভিযোগ করে, অভিযোগের ভিত্তিতে যে কাগজ দরকার, এর কিছুই থাকে না। বিদেশে যাওয়ার সময় তাঁর সব ধরনের কাগজ বুঝে নিতে হবে। ভিজিট ভিসাকে ওয়ার্ক ভিসা করে দেবে, দুবাই সরকারের এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে কিছু ভ্রমণ ভিসা দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু সমস্যা হওয়ায় আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। অনেকে দালালের প্রলোভনে সবকিছু হারায়। দূতাবাসের জনবল বাড়িয়ে একে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। যাঁরা ফিরে আসেন, ডেটাবেজ করে তাঁদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করা বা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

একজন নির্যাতিত নারী (অনলাইনে যুক্ত)

আমাকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি গ্রামে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রায় আড়াই মাস আটকে রাখা হয়েছিল। অনেক কষ্ট করে বের হয়েছি। তারা আমাকে নির্যাতন করেছে। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। আমি চাই, অবশ্যই তারা যেন শাস্তি পায়। আমি মামলা করেছি। তারা এখন জেলে আছে।

শরিফুল ইসলাম

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সুরক্ষায় অনেক সেবা দেয়। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার আছে। সেখানে প্রবাসী কর্মীদের জন্য নিরাপদে মাত্র ২০০ টাকায় আবাসনের সুবিধা রয়েছে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ৯৩ জন প্রবাসী কর্মী এ সেবা গ্রহণ করেছেন।

বিদেশফেরত অসুস্থ কর্মীদের সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়। প্রবাসী কর্মীর মেধাবী সন্তানদের এসএসসি ও এইচএসসি ক্যাটাগরিতে বার্ষিক যথাক্রমে ২৭ হাজার ৫০০ ও ৩৪ হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রবাসী কর্মীর প্রতিবন্ধী সন্তানদের মাসে ১ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে মৃতদেহ দেশে আনা, লাশ পরিবহন ও দাফন বাবদ ৩৫ হাজার টাকা প্রদান এবং মৃতের পরিবারকে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদানসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়।

কর্মীদের মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, বকেয়া বেতন ও ইনস্যুরেন্সের অর্থ আদায়ের জন্য দূতাবাসের সহায়তায় মামলা পরিচালনা করা হয়। ক্ষতিপূরণ মামলার কাগজপত্র তৈরিতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে একটি লিগ্যাল সেল রয়েছে। লিগ্যাল সেলের মাধ্যমে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরিতে কর্মীদের পরিবারকে সহায়তা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বিদেশগামী সব কর্মীকে বিমার আওতায় আনা হয়েছে।

চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিমাকৃত কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৭৯ হাজরের বেশি। শ্রমকল্যাণ উইংয়ের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা প্রদান করা ও শ্রম কল্যাণ উইংয়ে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সরকারের একার পক্ষে সবকিছু নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

তানিয়া হক

অভিবাসনের মাধ্যমে একজন মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। কিন্তু দেশের একজন সাধারণ মানুষ ভাগ্যবদলের জন্য বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন। বাংলাদেশ জনসংখ্যা ব্যুরোর ২০১৭ সালের এক তথ্যে দেখা যায়, ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন পুরুষ ও ১ লাখ ১২ হাজার নারী।

আমাদের দেশের নারীরা প্রায় কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি ছাড়া বিদেশে যাচ্ছেন। এ জন্য তাঁরা গৃহকর্মীর কাজ ছাড়া আর তেমন কিছু করতে পারেন না। বিদেশে নানা কারণে তাঁরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে বেতন পাচ্ছেন না। আমাদের জেন্ডার সংবেদনশীল নীতিমালা করতে হবে। দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা শুধু প্রেরণ ও গ্রহণকারী দেশের মধ্যে থাকছে না। এখানে বহু পক্ষ কাজ করে। এখানে প্রত্যেকের দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি।

আবার যিনি কাজে যাচ্ছেন, তাঁরও ওই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, কাজের ধরনসহ সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সম্প্রতি মানবাধিকার কমিশন কাতারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে। কোনো দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি না থাকলে তাঁদের দায়বদ্ধ করা যায় না। এসব বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। বিদেশে নারীদের বেশি করে হেল্পডেস্ক থাকতে হবে। শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সচেতন করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকের মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য শ্রমিককে যোগ্য ও দক্ষ হতে হবে।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী

রিক্রুটিং এজেন্ট, বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা যদি তুলনা করা হয়, তাহলে এটি একটি অসম অবস্থান। রিক্রুটিং এজেন্ট বছরে সাত থেকে আট লাখ মানুষ বিদেশে পাঠায়। একজনের কাছ থেকে যদি দুই থেকে তিন লাখ টাকা মুনাফা করে, তাহলে বছরে এখানে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য।

আজ যে আলোচনা হলো, চার বছর ধরে সেই একই কথা শুনছি। এ অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। প্রবাসীকল্যাণ ও আইন মন্ত্রণালয় এখানে কাজ করবে। কিন্তু তাদের বাজেট সবচেয়ে কম। এক কোটি মানুষ বিদেশে থাকলে তাঁদের সঙ্গে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ জড়িত। তাঁদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সহজ নয়। তবে ন্যায়বিচারের উদাহরণ তৈরি করতে হবে। একটি রিক্রুটিং এজেন্টকে শাস্তি দিলে অন্যরা সতর্ক হবে।

বিদেশেও নারীরা ধর্ষণসহ বিভিন্ন অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। সেখানে দু-একজনের শাস্তি নিশ্চিত করলে অন্যরা সতর্ক হবে। রিক্রুটিং এজেন্ট দুই লাখ টাকা নিলে তাঁর হয়তো রিসিট থাকছে, কিন্তু দালাল যে টাকা নিচ্ছে, তার কোনো ডকুমেন্ট নেই। এ জন্য আমরা ঠিক করেছিলাম, সবাই মিলে একটি প্রেসক্রাইবড ফরম করব। কার কোথায় কতটুকু দায়, ক্ষতিপূরণ কী হবে, এসব লেখা থাকবে।

আমাদের ১৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কয়েক শ পলিটেকনিক আছে। বিদেশ থেকে যাঁরা ফেরত আসছেন, তাঁরাসহ সবাই মিলে পরিকল্পনা করলে ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়া কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সরকার ইট–পাথরের বাইরে কোনো চিন্তা করছে না। রাষ্ট্র দক্ষতা বৃদ্ধি ও সুশাসন দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া বা অন্যান্য দেশ থেকে ফেরত আসার সময় কর্মীর বেতন ও ওভার টাইম দিয়েছে কি না, কী অনিয়ম তাঁর সঙ্গে করা হয়েছে, এর ভিত্তিতে সরকার ওই দেশের কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

কোনো সরকারই চায় না তার কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হোক। যেকোনো দেশের ধর্ষককে রক্ষা করার ইচ্ছা তো কোনো দেশের থাকার কথা নয়। পোশাকশিল্পে যে ডলার আসে, তার প্রায় ৮০ শতাংশ খরচ হয় কাঁচামাল আমদানিতে। কিন্তু বিদেশি শ্রমিকেরা যে ডলার আয় করেন, এর সবটা দেশে থাকে। এখন সময় এসেছে, সবাই মিলে তাঁদের জন্য কাজ করার।

ফিরোজ চৌধুরী

অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিয়ে সম্মানিত আলোচকেরা গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • জাতীয় সংসদে নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে জোরালো আলোচনা করতে হবে।

  • সরকারের পক্ষ থেকে অভিবাসী শ্রমিকের প্রবাসে মৃত্যুর কারণ তদন্ত অত্যন্ত জরুরি।

  • অভিবাসনের ক্ষেত্রে সুশাসন, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

  • মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

  • শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সচেতন করতে হবে।

  • অভিবাসী শ্রমিককে উপযোগী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

  • নিরাপদ অভিবাসনের জন্য ফলপ্রসূ তদারক জরুরি।

  • অভিবাসীদের সুবিচার নিশ্চিত করতে সরকারের আলাদা ট্রাইব্যুনাল করা উচিত।

  • অভিবাসনসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

  • শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।