গোলটেবিল বৈঠক
নগরমুখী জলবায়ু উদ্বাস্তু: সামাজিক নিরাপত্তা ও অন্তর্ভুক্তি
কারিতাস বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘নগরমুখী জলবায়ু উদ্বাস্তু: সামাজিক নিরাপত্তা ও অন্তর্ভুক্তি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৯ জুন ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।
আলোচনা
সেখ ফরিদ আহমেদ
যুগ্মসচিব, ত্রাণ কর্মসূচি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের সমস্যা নিয়ে সরকার চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। রাষ্ট্র চায়, প্রতিটি নাগরিক যেন তার ন্যায্য অধিকার পায়। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও ভূখণ্ডের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসন এখন একটি কঠিন বাস্তবতা। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষেরা সাধারণত কাজের কিছু সুযোগ পেলেও বসবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশনসহ মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন। আবার যারা গ্রামে রয়ে গেছেন, তাদের অবস্থাও প্রায়শই আরও শোচনীয়।
এই বাস্তবতায় শুধু শহর উন্নয়নের কথা ভাবলেই হবে না, বরং পুরো দেশকে সামনে রেখে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। বাস্তুচ্যুত মানুষদের একেবারে বাইরে রাখা চলবে না। তাদের অন্ততপক্ষে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবাসনের মৌলিক সেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে পুনর্বাসন প্রকল্পের অবস্থান, গৃহীত মানুষদের সামাজিক-পারিবারিক বাস্তবতা—সবই বিবেচ্য। অনেকেই পুনর্বাসন প্রকল্প ছেড়ে চলে যান, ঘর ভাড়া বা বিক্রি করে দেন—এতে তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার ঝুঁকি থেকে যায়।
তাই চেনা পরিবেশের কাছাকাছি পুনর্বাসনই বেশি কার্যকর। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্তির জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার তৈরি জরুরি। অন্তত দুই থেকে পাঁচ বছর ধরে শহরে বাস করা ব্যক্তিদের ‘স্থায়ী’ ধরে পরিকল্পনা করা যেতে পারে।
আর কারা পিছিয়ে আছেন, কারা সাপোর্ট ছাড়া চলতে পারছেন—তা বুঝে স্থানীয় সরকার, সমাজসেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থ বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও মানবিক রাষ্ট্রচিন্তাই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ দেখাতে পারে।
দাউদ জীবন দাশ
নির্বাহী পরিচালক, কারিতাস বাংলাদেশ
কারিতাস বাংলাদেশ ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী মানবিক সংকটে ২ দশমিক ৫ লাখ গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে পুনর্বাসনে পথপ্রদর্শক হয়। এরপর থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি অবকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক পুনর্গঠনে সরকারের অন্যতম সহযোগী সংস্থা হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে দেশের দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোয় ৩২৯টি ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রসহ ৯ লক্ষাধিক অবকাঠামো উন্নয়নে কারিতাস উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিদিন ঢাকা শহরেই নতুন করে ২ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু যুক্ত হচ্ছে, বছরে এই সংখ্যা সাত লক্ষাধিক। শুধু ২০২৪ সালেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ২৪ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের একটা বিরাট অংশ দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আসে। জাতীয় পরিচয়পত্রে স্থায়ী ঠিকানা নিবন্ধিত থাকায় তারা সাধারণত সেটি পরিবর্তন করতে চায় না। অন্যদিকে অস্থায়ী বস্তিবাসী হিসেবে ঠিকানা পরিবর্তন করাও একটি চ্যালেঞ্জ হওয়ায় তারা অধিকাংশ সময়েই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতার বাইরে থেকে যায়। বর্তমানে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে প্রায় মিলিয়নের বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে ঢাকা শহরের ভঙ্গুর অবকাঠামো আবাসন স্বাস্থ্যসেবা শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করছে।
সরকারি ও বেসরকারি সবার সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু বা বাস্তুচ্যুতদের বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের জীবন এবং মানবাধিকার সুরক্ষা করা এবং একই সঙ্গে সাসটেইনেবল সিটিজ এবং কমিউনিটিস গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।
কবিতা বোস
কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
৩১ বছর ধরে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা, কিশোরী কন্যা শিশু, জেন্ডার সমতা ও তরুণদের নেতৃত্ব বিকাশে কাজ করছে। যদিও আমরা সরাসরি জলবায়ুবিশেষজ্ঞ নই, তবে নারী, শিশু ও তরুণদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করি। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় নারীরা ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়—বাসস্থান হারানো, সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং সহিংসতার ঝুঁকি এসবের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে স্থানান্তরের ফলে শিশুরা স্কুলছুট হয় আর মেয়েশিশুরা পড়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে। বাস্তবে এমনও দেখা গেছে, ১০–১২ বছরের শিশুদের বিয়ে হচ্ছে, যা একদিকে স্বাস্থ্যগত সংকট, অন্যদিকে একটি প্রজন্মের সম্ভাবনাকে গ্রাস করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্যেও প্রভাব পড়ছে। অনেক মেয়েশিশু লবণাক্ততার কারণে মাসিক চক্র বিলম্বিত করতে ওষুধ সেবন করছে, কারণ স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা কেবল শরীর নয়, একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করছে। ১২-১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে যদি আজ এই যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়, তাহলে তাকে দীর্ঘকাল এই কষ্ট বইতে হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কেবল একটি মন্ত্রণালয় বা সংস্থার পক্ষে সমাধান সম্ভব নয়। পরিবেশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজসেবা, অর্থ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মাইগ্রেশন সব সময় খারাপ নয়, কিন্তু বাধ্যতামূলক হলে তা সংকট। তাই গ্রামেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নারী ও শিশুদের রক্ষা এবং তাদের সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে হলে রাষ্ট্রকে হতে হবে সহানুভূতিশীল, বাস্তববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।
আনোয়ারুল হক
সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি, ইউএনডিপি বাংলাদেশ
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৯টি শহরের বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৫২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে শহরে এসেছে। এর মধ্যে বন্যা, নদীভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড় প্রধান কারণ। এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্যম দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৫০ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের শিকার। এদের মাত্র ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে জলবায়ু উদ্বাস্তুরা শহরে এসে আর্থিক ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই ব্যাপক সংগ্রাম করছেন। এ পরিস্থিতিতে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে পুনর্গঠন করা আবশ্যক, যাতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে এর আওতায় আনা যায়।
শহরের দরিদ্র মানুষের জন্য লো-কস্ট হাউজিং, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন এবং প্রশিক্ষণব্যবস্থা বাড়াতে হবে। শহর মানে শুধু ঢাকা নয়—স্থানীয় সম্পদের ভিত্তিতে অন্যান্য শহরেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি জরুরি আইনগত নথিভুক্তিকরণ ও টেনিউর সিকিউরিটির নিশ্চয়তা। বস্তি উচ্ছেদ হলে এই মানুষদের কী হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর থাকতে হবে।
মনস্তাত্ত্বিক ও লিঙ্গসংবেদনশীল সহায়তার অভাবেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরে এসে সামাজিক সহায়তা কাঠামো হারানোয় মানসিক চাপ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সহায়তা কৌশল গড়ে তোলা দরকার। প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বিগ ডেটা, মোবাইল ফোন তথ্য বা স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে বাস্তুচ্যুতির তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। এসব উদ্যোগের মাধ্যমেই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাধান সম্ভব। ভিত্তিতে পদোন্নতি এবং পদায়ন নীতিমালা সংস্কার করা প্রয়োজন।
আবু ইউসুফ
অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মার্টিন রেভিলিয়েন তাঁর ‘অন দ্য আরবানাইজেশন অব পোভার্টি’ নিবন্ধে দেখিয়েছেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি মজুরিবৈষম্যের কারণেও মানুষ নগরমুখী হচ্ছে। উপাত্তের ক্ষেত্রে বিবিএসের সঙ্গে কোলাবোরেশন করা যেতে পারে। বিবিএস এখন অনেক কাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিবিএস সংস্কারে উদ্যোগ নিয়ে চমৎকার একটি কাজ করেছে, বিশেষ করে উপাত্তের বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা পৃথিবীর অন্যতম কম। আমাদের ফিসক্যাল স্পেইস বাড়াতে হবে। এটি না করতে পারলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু অভিযোজন ও সামাজিক সুরক্ষায় খরচ করতে পারব না।
নগরমুখী জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ট্র্যাক করে বিস্তৃত একটি কৌশলের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। রুরাল ওয়ার্ক ফেয়ারের মতো শহরেও কিছু করা যায় কি না, তা ভাবতে হবে। কারণ, কর্মসংস্থান একটা বড় জায়গা। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে বাজেটে তাদের জন্য খাদ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এবারের বাজেট সংকুচিত হলেও এ জায়গাটি গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষদের যেন গ্রাম থেকে না আসতে হয়। কিন্তু একবার যখন তারা এসে পড়ে, তাদের পরিকল্পনার বাইরে রাখা যাবে না। তারা আমাদের আবশ্যকীয় অংশ, আমাদের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ৮৫ শতাংশ কর্মের জোগান দিচ্ছে।
জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে ইন্টিগ্রেশন নিয়ে ভাবতে হবে। সরকারের কৌশলগত গাইডলাইনে আমাদের সুপারিশগুলো অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। শহর ও গ্রামে উভয় জায়গায় সমানভাবে কাজ করতে হবে।
শেহনাজ ওজদামার
কান্ট্রি ডিরেক্টর, নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি)
বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে বাস্তুচ্যুতি এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতা। শুধু গত বছরই ২৪ লাখ মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে স্থানচ্যুত হতে হয়েছে, বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এটি বিশাল সংখ্যা। এমন পটভূমিতে জরুরি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনায় যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে আসে, তা নিয়ে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) একটি অভ্যন্তরীণ জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায়, ব্যক্তিগত পরিচয়পত্রের অভাবে বহু মানুষ সহায়তা পায়নি। আবার নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। সবার জন্য এক রকম সমাধান কার্যকর নয়, প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী দেখতে হবে।
সহায়তা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হলে কেবল চাহিদা নির্ধারণ নয়; বরং সহায়তা পৌঁছানোর প্রতিটি ধাপে তথ্যভিত্তিক ও মানুষকেন্দ্রিক পদক্ষেপ জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় কাঠামো, সামাজিক মূলধন ও বিদ্যমান সিস্টেমের ওপর নির্ভর করাই সবচেয়ে কার্যকর পথ। প্রতিরোধ, বর্তমান প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া—এই তিনটি দিকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্যসহায়তা একটি অবহেলিত ক্ষেত্র। তুরস্কের ভূমিকম্প-পরবর্তী অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, মানসিক সহায়তা যত দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যায়, এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ততটাই কমানো সম্ভব। আমাদের শিখতে হবে, প্রতিক্রিয়াব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে। সমাধানের পথ আছে, দরকার শুধু আন্তরিকতা, প্রস্তুতি এবং সম্মানের সঙ্গে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
চন্দন গোমেজ
সিনিয়র ডিরেক্টর (অপারেশনস), ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ফলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অভিবাসন একটি আলোচিত কিন্তু জটিল বিষয়, যা বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশেও বিষয়টি তীব্র আলোড়ন তুলেছে। এই ইস্যুর সঙ্গে বহু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জড়িত, ফলে সংজ্ঞা নির্ধারণের চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারণ করা। যদিও আলোচনা ও গবেষণা হচ্ছে প্রচুর, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা দুর্বল। জলবায়ু অভিবাসীরা এখন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে, তাই তাদের বিষয় গুরুত্বসহকারে দেখা জরুরি।
মানুষ স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ে না, বাধ্য হয়ে ছাড়ে। নতুন জায়গায় তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসন রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কোন মন্ত্রণালয় নেতৃত্বে থাকবে এবং কে কীভাবে সহায়তা করবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। কারা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে, সে বিষয়ে ট্র্যাকিংয়ের জন্য একটি কাঠামো থাকতে হবে। শুমারি করে জানা প্রয়োজন তাদের সংখ্যা, চাহিদা, বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধীদের অবস্থা।
স্থানীয়ভাবে সনদ ইস্যু ও ডিজিটাল উপাত্ত ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে। বাজেটে যদি জলবায়ু অভিবাসন বিষয়ে কিছু না থাকে, তবে বাস্তবায়ন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই খরচ বিশ্লেষণও জরুরি—বাংলাদেশ কী হারাচ্ছে, কী পাচ্ছে, তা বোঝার জন্য।
শামছুন নাহার
অতিরিক্ত পরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে লাখ লাখ মানুষ আজ বাস্তুচ্যুত হয়ে শহরে এসে চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর দেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাস্তুচ্যুত মানুষেরা পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, ঠিকানা ইত্যাদি হারানোর কারণে সরকারি সেবার আওতায় আসতে পারছে না। তা ছাড়া শহরের জটিল সেবাব্যবস্থায় কোথায় গেলে কীভাবে সহায়তা পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কেও তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই।
সমাজসেবা অধিদপ্তর এই সংকটে বিদ্যমান কাঠামো ব্যবহার করে সহায়তার চেষ্টা করছে। আমাদের সক্ষমতা ও কাঠামো দুটোই আছে। এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো এই সেবাব্যবস্থাকে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সহজলভ্য ও প্রবেশগম্য করে তোলা। নগরীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আমাদের বিশেষায়িত কার্যক্রমকে আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অন্তর্ভুক্তির প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার কীভাবে করা যায়, সেটার সুযোগ খুঁজছি। যেমন ২০২৪–২৫ অর্থবছরে নগরের ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে বিশেষ পরিচিতি নম্বর, জাতীয় তথ্যভান্ডার তৈরি, স্থানান্তরযোগ্য ভাতা এবং একটি সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ রয়েছে। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন হলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হবে, যা কেবল মানবিক দায়িত্ব নয়, রাষ্ট্রের ন্যায্যতার পরীক্ষাও বটে।
মনিরুজ্জামান খান
পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেই আমরা ‘পলিসি গ্যাপ’-এর কথা বলি। কিন্তু প্রকৃত সমস্যা পলিসির ঘাটতি নয়, বরং বাস্তবায়নের অভাব। আমরা জানি কী সমস্যা—এটিই সমাধানের অর্ধেক পথ। বাকিটা নির্ভর করে কার্যকর পদক্ষেপে। আমরা অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের কথা বলি, অথচ উপকূলের মানুষ—যাদের জীবনে এসব নীতির বাস্তব প্রভাব পড়ে—তাদের কণ্ঠস্বর অনুপস্থিত। গবেষণায় তথ্য এলেও ভুক্তভোগীদের সরাসরি অন্তর্ভুক্তি নেই।
জলবায়ুগত সংকটকে প্রাকৃতিক বলা হলেও, এর অনেক কারণ মানবসৃষ্ট। মানুষ হঠাৎ ঘর ছাড়ে না, বরং বছরের পর বছর লড়াই করেই একসময় স্থানান্তরে বাধ্য হয়। আমার নিজের গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই পুরো প্রক্রিয়াটি মানবসৃষ্ট। মাইগ্রেশন কি তাদের পছন্দের বিষয়? আমরা জানি ঘটনা ঘটবে অথচ তাদের সেই জায়গায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারের খুরুশকুলে অবস্থিত জলবায়ু শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রের কথা বলা যায়। সমিতিপাড়া এবং কুতুবদিয়াপাড়া থেকে স্থানান্তরিত মানুষদের জন্য তৈরি এই ছয়তলা বা পাঁচতলা ভবনে পানির সরবরাহ পর্যন্ত নেই। এটি কি সত্যিই তাদের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান? এ ধরনের পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া জরুরি।
মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)
‘ক্লাইমেট মাইগ্রেশন’ এখন আর ভবিষ্যতের কোনো আশঙ্কা নয়, এটা বর্তমানেরই বাস্তবতা। বাংলাদেশে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে তারা রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য শহরে চলে আসছে। শহরে এসেও তাদের সংকট শেষ হয় না, বরং শুরু হয় নতুন এক সংগ্রাম। তারা স্থানীয় পরিচয়হীন, ঠিকানাবিহীন। এতে করে তাদের ওপর বাড়ে নিরাপত্তাহীনতা, মানসিক চাপ ও সামাজিক বৈষম্য। এই বাস্তবতায় উপকূলে কর্মসংস্থান তৈরি ও গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন জরুরি, যাতে মানুষ নিজ এলাকায় থাকতে পারে। স্থানচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেন্ট কার্ড’ নামে একটি সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে তাদের চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা ও নিরাপদ আবাসনের সুযোগ থাকবে। এই সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া সবচেয়ে জরুরি।
নারী ও শিশুদের বিশেষ সুরক্ষা দিতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও তহবিল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং সমস্যা সমাধানে স্থানীয়করণ ও বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাল্টিস্টেকহোল্ডার অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে একটি ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেশন প্ল্যাটফর্ম’ গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে তথ্য আদান–প্রদান, প্রশিক্ষণ, নীতিমালা ও বাস্তবায়ন এক ছাতার নিচে হবে।
রাশেদ আলম ভূইয়া
সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, রামরু
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসনের প্রেক্ষাপটে ‘অন্তর্ভুক্তি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। আমরা প্রায়ই ‘জলবায়ু অভিবাসী’, ‘বাস্তুচ্যুত’ ও ‘অভিবাসন’ শব্দগুলো একে অপরের পরিবর্তে ব্যবহার করি, যদিও এগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তাদের সুনির্দিষ্ট চাহিদা ও দুর্বলতা নিরূপণ জরুরি।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জলবায়ু অভিবাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরায়ণ নিয়ে কাজ করছে। তাদের সহায়তায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে ‘জাতীয় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি কৌশল’ গ্রহণ করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জেও (ইউএনএফসিসি) স্বীকৃত।
অন্তর্ভুক্তির মানে শুধু অভিবাসীদের চিন্তা করা নয়—নারী, শিশু, জাতিগোষ্ঠীসহ ভিন্ন চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। শিশুযত্ন কেন্দ্র, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও আবাসনের মতো ব্যবস্থা নিতে হবে শহরবাসীর জন্যও। গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রেই উদ্যোগ প্রয়োজন।
মোস্তফা কামাল
ডিরেক্টর, হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাকশন অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার বস্তিগুলোতে গেলে দেখা যাবে সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, ফরিদপুর বা শরীয়তপুর থেকে নয়; বরং সারা বাংলাদেশ থেকে মানুষ আসেন। খুলনা শহরের কথা বললে দেখা যাবে, সেখানকার প্রতিটি উপজেলার মানুষই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কিছু মানুষ গ্রাম থেকে উপজেলায় এসেছেন, কিছু মানুষ শহরে ও জেলায় এসেছেন, আবার কেউ বিভাগীয় শহরে এসেছেন।
আরেকটি বড় বিষয় হচ্ছে আমরা জলবায়ুর উদ্বাস্তুদের গণনা করার সময় কেবল বস্তিবাসীর তথ্যই অন্তর্ভুক্ত করি। কারণ, তাঁরা গরিব মানুষ। কিন্তু ক্যাটাগরি করলে দেখা যাবে, সব শ্রেণির মানুষই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এখন আমাদের সুরক্ষাবেষ্টনীও আছে, নীতিও আছে। আমাদের কাজ হচ্ছে, আমরা কাকে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শিকার বলব, তার সংজ্ঞা ঠিক করা। একজন ধনী লোকও তো বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তাঁকে গণনা করব কি না।
সুরক্ষাবেষ্টনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকরণে আমাদের একটা পদ্ধতি রয়েছে। ২০টি মন্ত্রণালয় এখানে কাজ করে। আমাদের শতাধিক সুরক্ষাবেষ্টনী কর্মসূচি রয়েছে। এখন জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কোনটি দেওয়া হবে, সেটি এমনভাবে ঠিক করতে হবে যেন ফলপ্রসূ হয়।
সৈয়দ শাহরিয়ার শাবাব
জাতীয় প্রকল্প কর্মকর্তা, আইওএম (জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা)
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যে যদি একজন গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তরিত হন, তাহলে তিনি কি আগের মতো সামাজিক নিরাপত্তাসুবিধা পাবেন? জাপানসহ অনেক উন্নত দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পোর্টেবিলিটির ব্যবস্থা রয়েছে, যা বাংলাদেশের পটভূমিতে আলোচনার দাবি রাখে।
নীতিগত দিক থেকে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী যারা অর্থনৈতিক অভিবাসী ও জলবায়ু অভিবাসী—উভয় ক্ষেত্রেই জীবিকা ও আশ্রয় প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের উচিত তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করা। সুবিধাভোগীদের আকাঙ্ক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং বাজারের চাহিদা বিশ্লেষণ করে সহায়তা প্রদান করা উচিত।
দুর্যোগের পর সহায়তার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সহায়তা সরকারিভাবে আসে, বাকিটা স্থানীয় সত্তা বা বেসরকারি খাত থেকে আসে। উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকা মূলত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে সীমাবদ্ধ। সুতরাং সরকার কীভাবে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীকে আরও স্থানান্তরযোগ্য করতে পারে এবং পরিষেবাগুলোতে (পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি) প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারে, তা নিয়ে কাজ করা জরুরি।
আলেক্সান্ডার ত্রিপুরা
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রধান, কারিতাস বাংলাদেশ
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন সারা বিশ্বের জন্যই একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এশিয়ার অতিদ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণজনিত সবচেয়ে সমস্যাপূর্ণ দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ লোকের বাস শহরাঞ্চলে। অথচ ১৫ বছর আগেও এ হার ছিল ২৫-২৮ শতাংশের নিচে। শহরের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ মানুষ আবার বস্তিবাসী। তাঁদের প্রতি চারজনের তিনজন জলবায়ু উদ্বাস্তু। শহরের অন্যান্য এলাকার তুলনায় বস্তি এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব ৭ গুণ বেশি। মৌলিক নাগরিক সেবার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনার তিনটি ধাপের দ্বিতীয় ধাপে জরুরি সাড়াদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গত ৫৪ বছরে কারিতাস ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে সরাসরি জরুরি সাড়াদান কার্যক্রমের আওতায় আনতে পেরেছে। তবে কারিতাসের মোট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তহবিলের ১০ শতাংশের নিচে দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগঝুঁকি মোকাবিলা কর্মসূচির জন্য ব্যয় হয়, যেখানে বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনার অন্য দুটি ধাপও অন্তর্ভুক্ত। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মর্যাদাপূর্ণ নগরজীবন নিশ্চিতকরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি তহবিলের পাশাপাশি আন্তমন্ত্রণালয় ও এনজিও মিলে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি, যেখানে সবার ভূমিকা সুনির্দিষ্ট থাকবে।
জামিল আহমেদ
টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার (অ্যাডভোকেসি), কারিতাস বাংলাদেশ
জলবায়ু অভিবাসন-সংক্রান্ত সমস্যাগুলো মোটামুটি চিহ্নিত, তাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো করণীয় নির্ধারণ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের উদ্যোগগুলোর সঙ্গে আমাদের ভাবনাগুলো কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা দেখা জরুরি। এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। আজকের আলোচনা থেকে যে সুপারিশগুলো উঠে এসেছে, তা যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর নজরে আনা যায়, তাহলে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। খুলনা ও ঢাকায় এমন কয়েকটি কর্মসূচিতে প্রস্তাব এসেছে—জলবায়ু উদ্বাস্তু নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা দরকার।
এ বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা ইতিমধ্যে নানা গবেষণা করেছে। নতুন করে গবেষণা না করে সেই সুপারিশগুলো কাজে লাগালে কার্যকারিতা বাড়বে। সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর যে কর্মপরিকল্পনা আছে, তার সঙ্গে আমরা একত্র হয়ে সমন্বিত কোনো কাজ করতে পারি কি না, তা–ও ভাবা যেতে পারে।
জাতীয় বাজেটে এই প্রস্তাবগুলো প্রতিফলিত হচ্ছে কি না, তা দেখা জরুরি। জলবায়ু উদ্বাস্তু–সংক্রান্ত বিষয়গুলো বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে প্রস্তাব দিতে হবে।
সুপারিশ
জলবায়ু ও দুর্যোগজনিত বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন ইস্যুতে সমন্বিত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার জন্য আন্তমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক বাস্তুচ্যুতদের অস্থায়ী পরিচয়পত্র প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বাস্তুচ্যুতদের ‘উদ্বাস্তু’ নয়, দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে তাঁদের মর্যাদা নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতদের আবাসনসহ টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তুচ্যুতদের ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ও গমনাগমন অনলাইনভিত্তিক মাধ্যমে রেকর্ড করা।
মাল্টিস্টেকহোল্ডার পদ্ধতিতে ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেশন প্ল্যাটফর্ম’ গঠন।
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতিবিষয়ক নীতিগুলোর গ্যাপ চিহ্নিত করে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ।
এ ছাড়া আরও অংশগ্রহণ করেন কারিতাস বাংলাদেশের কর্মসূচি কর্মকর্তা (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা) ইন্মানুয়েল চয়ন বিশ্বাস, কর্মসূচি কর্মকর্তা (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা) ডায়না পোদ্দার, কর্মসূচি কর্মকর্তা (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা) উজ্জ্বল এক্কা, প্রকল্প সমন্বয়কারী পবিত্র কুমার মন্ডল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কে এম আবুহুরাইরা সিয়াম, সানজানা লাবিবা, রওনক জাহান রাকামনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গিয়াস উদ্দিন, সিফাত আরেফিন, শাবাব সবুজ, তৌহিদুল ইসলাম, মাহদী আল হোসাইন, সাদিয়া রহমান, রওনক জাহান রেশমা প্রমুখ।
সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো