পোশাক কারখানার পরিবেশ হোক নিরাপদ

বক্তারা বলেন, কারখানায় নেতৃত্বের স্থানে নারীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার যথাযথভাবে দিতে হবে।

পোশাক কারখানায় নারী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য নিরাপদ ও বৈষম্যহীন পরিবেশ প্রয়োজন। কারখানায় যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ নেওয়ার বিষয়গুলোকে সক্রিয় করা দরকার।

পাশাপাশি নারী কর্মীদের যাতায়াত নিরাপদ করতে পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটির সময় শ্রম আইন অনুসারে মজুরি পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহযোগিতায় গতকাল মঙ্গলবার সজাগ কোয়ালিশন ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই অভিমত দেন।

সজাগ কোয়ালিশন হচ্ছে বেসরকারি সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও নারীপক্ষের একটি যৌথ উদ্যোগ।

‘পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও নারীর জন্য বড় প্রাতিষ্ঠানিক কাজের ক্ষেত্র বিবেচনায় পোশাক কারখানায় ছোটখাটো কোনো বিষয়েও অবহেলা করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন বক্তারা। তাঁরা বলেন, পোশাকশিল্প কারখানায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের (অটোমেশন) কারণে নারী কর্মীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উৎপাদনদক্ষতা বাড়িয়ে নারী কর্মীর সংখ্যা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারখানায় নেতৃত্বের স্থানে নারীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার যথাযথভাবে দিতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক বলেন, মালিক, শ্রমিক ও শ্রমিকনেতারা একসঙ্গে সচেতন হলে পোশাক কারখানার সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। বিদেশি ক্রেতারা কারখানায় সুবিধা বাড়ানোর ওপর জোর দিলেও পোশাকের দাম বাড়াতে চান না। তাই সবাই মিলে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শ্রম আইনে বিচার হচ্ছে কি না, বিচার মানা হচ্ছে কি না, সেসব দেখতে হবে। নারী শ্রমিকের সংখ্যা যেন না কমে, সে জন্য কারখানায় উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বলেন, নারী কর্মীদের সুরক্ষায় কারখানায় যৌন হয়রানি রোধে কর্তৃপক্ষ অনেক সজাগ থাকে। তিনি বলেন, অটোমেশনের কারণে নারী কর্মীর সংখ্যা কমে যাওয়া রোধে নারীদের এখন অন্তত কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে কারখানায় প্রবেশ করা দরকার।

বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের মতে, বিভিন্ন খাতের মধ্যে পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকেরা সবচেয়ে সুরক্ষিত অবস্থানে আছেন। এখানে শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার বঞ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই।

গোলটেবিল বৈঠকে দুটি পৃথক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।

ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের জেন্ডার সমতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ বিভাগের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আঞ্জুম নাহীদ চৌধুরী পোশাক কারখানায় নারী কর্মীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এবং এলাকা ও জনপরিসরে চলাচলে সুরক্ষা বিষয়ে সজাগ কোয়ালিশনের দুই বছরের প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, ৩০টি কারখানায় ৫০ হাজার কর্মীকে নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য, ২০২৪ সালের মধ্যে ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৩৩ পোশাককর্মীর কাছে সরাসরি পৌঁছানো।

সজাগ কোয়ালিশনের টিম লিডার ও নারীপক্ষের সদস্য মাহীন সুলতান নারী পোশাককর্মী ও নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা সম্পর্কে ছোট্ট পরিসরে করা জরিপের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ মনে করেন, পেশার চেয়ে পরিবার ও সন্তানের দেখভাল করা নারীর জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ ধরনের গতানুগতিক ভাবনার বাইরে ইতিবাচক মনোভাবও রয়েছে।

৯৬ শতাংশ মনে করেন, বাড়ির কাজ পুরুষ-নারীর দুজনের যৌথভাবে করা উচিত। প্রায় ৭৪ শতাংশ মনে করেন, পোশাক কারখানার নারীরা নানাভাবে যৌন হয়রানির মুখোমুখি হন। সে ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করা, পুলিশ, কারখানা কর্তৃপক্ষ বা হেল্পলাইনে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি মানুষ।

বৈঠকে নারী কর্মীর সংখ্যা পুনরুদ্ধারে উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা। তিনি বলেন, মধ্য বয়সের নারী কর্মীদের দক্ষতাকে কাজে লাগাতে তাঁদের মাধ্যমে নতুন নারী কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, কারখানাগুলোতে যৌন নির্যাতনবিরোধী কমিটিগুলোর বেশির ভাগই কাজ করে না। অভিযোগ জানানোর সাহস পান না নারী কর্মীরা। একদিকে কারখানায় নারী কর্মীর সংখ্যা কমছে, অপরদিকে উচ্চ পদেও নারীদের দেখা যায় না।

ইন্টারস্টফ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (কমপ্লায়েন্স) আবু বকর সিদ্দিক বলেন, কারখানার নেতৃত্ব অবস্থানে নারীদের আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারখানায় নারী কর্মী বেশি হওয়ায় নারী নেতৃত্ব থাকাই নিরাপদ।

নারী কর্মীর জন্য নিরাপদ ও বৈষম্যহীন পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে ব্লাস্টের পরিচালক (লিগ্যাল) মো. বরকত আলী বলেন, কারখানার ব্যবস্থাপনায় কর্মীদের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে। কারখানার ভেতর নারীরা যেন পুরুষ সহকর্মীর প্রতি আস্থা নিয়ে কাজ করতে পারেন, এমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।

সজাগ কোয়ালিশনের প্রকল্প সমন্বয়কারী রওশন আরা বলেন, অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে কাজ করে নারী কর্মীদের সুরক্ষার উপায় বের করতে হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচির প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আফসানা চৌধুরী বলেন, পোশাক কারখানায় নেতৃত্বের পদে আছেন মাত্র ১০ শতাংশ নারী। আইএলও কারখানায় যৌন হয়রানি ও বৈষম্যের জায়গাগুলো শনাক্ত হওয়ার ওপর জোর দিচ্ছে।

সভায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবীন বলেন, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে পোশাক কারখানায় নারী কর্মীদের নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণায় যুক্ত হতে পারবেন তাঁরা।

স্বাগত বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, নারী কর্মীদের প্রতি নজর না দিলে পোশাক কারখানা থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ হারাতে হবে দেশকে।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।