বিশ্ব দৃষ্টি দিবস: কর্মক্ষেত্রে চোখের গুরুত্ব

ভিশনস্প্রিং ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘বিশ্ব দৃষ্টি দিবস: কর্মক্ষেত্রে চোখের গুরুত্ব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৮ অক্টোবর ২০২৩। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

অধ্যাপক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন উপাচার্য, সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়;

প্রেসিডেন্ট, ওএসবি; চেয়ার, আইএপিবি বাংলাদেশ চ্যাপ্টার

ডা. খালেদা ইসলাম

অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মিশা মাহজাবীন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভিশনস্প্রিং বাংলাদেশ

আরশাদ জামাল দীপু

পরিচালক, বিজিএমইএ

সোহেল সাদাত

চেয়ারম্যান অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর, শিনশিন গ্রুপ

সৈয়দ মাহফুজুল হক

ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, এনসিডি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

এ কে এম মাসুম-উল-আলম

প্রোগ্রাম অফিসার, অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ আইএলও বাংলাদেশ

কাজী সাবেতুল ইসলাম

এন্টারপ্রাইজ অ্যাডভাইজার, বিডব্লিউবি প্রকল্প, ওএসএইচ ফোকাল, আইএলও বাংলাদেশ

মুনির আহমেদ

কান্ট্রি ডিরেক্টর, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ও চেয়ার, আইএনজিও ফোরাম

অমৃতা রেজিনা রোজারিও

কান্ট্রি ডিরেক্টর, সাইটসেভার্স, কো–চেয়ার, আইএনজিও ফোরাম

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ক্লিয়ার ভিশন কালেক্টিভ (সিভিসি)

স্বপন পাল

দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক, সাসটেইনেবিলিটি-রেসপনসিবল সোর্সিং, লিভাই স্ট্রস অ্যান্ড কোং

সালমা আক্তার

শ্রমিক প্রতিনিধি, ডেনিটেক্স লিমিটেড

আব্দুল আজিজ

শ্রমিক প্রতিনিধি, কন্টিনেন্টাল ফ্যাশন

 

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

 

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আজকে আমাদের গোলটেবিল আলোচনার বিষয় হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে চোখের গুরুত্ব। এটি উপলব্ধি করে কর্মক্ষেত্রে আমরা কীভাবে চোখের যত্ন নিতে পারি, এ বিষয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি আলোচনায় এ–সংক্রান্ত সুপারিশও আসবে। এখন আলোচনার সূত্রপাত করবেন মিশা মাহজাবীন।

মিশা মাহজাবীন

মিশা মাহজাবীন

ভিশনস্প্রিং গত ১৭ বছর বাংলাদেশের সব জেলায় ‘রিডিং গ্লাসেস ফর ইম্প্রুভড লাইভলিহুড’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে চক্ষুসেবা দিচ্ছে। ২০১৮ সালে কর্মক্ষেত্রে চক্ষু পরীক্ষাভিত্তিক প্রোগ্রাম ‘ক্লিয়ার ভিশন ওয়ার্ক প্লেস’ (কর্মক্ষেত্রে স্বচ্ছ দৃষ্টি)–এর যাত্রা শুরু হয়। গত ৫ বছরে এই প্রোগ্রামের আওতায় ভিশনস্প্রিং ভারত, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে ৫ লাখের বেশি শ্রমিককে চক্ষুসেবা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখই বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের কর্মী। শুধু চোখ পরীক্ষাই নয়, ভিশনস্প্রিং সবার জন্য সুলভ মূল্যে চশমা দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এ প্রোগ্রাম এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ চশমাও বিতরণ করেছে। এই সাফল্যের অংশীদার বাংলাদেশের প্রগতিশীল ব্যবসায়ী মহল, উন্নয়ন সংস্থা এবং কিছু ব্র্যান্ড।

এ বছর বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘কর্মক্ষেত্রে চোখের যত্ন’। মূলত সবার মধ্যে কর্মক্ষেত্রে চোখের যত্নবিষয়ক সচেতনতা তৈরি এবং প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষকে তাদের কর্মীদের চোখের সেবা দিতে উৎসাহিত করাই এবারের প্রতিপাদ্যের মূল লক্ষ্য।

যেকোনো কাজের জায়গায় কর্মীদের স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা অনেক। কিন্তু পরিমিত সম্পদ নিয়ে সমস্যা সমাধান করতে গেলে বেছে নিতে হবে সবচেয়ে টেকসই কৌশলকে। এর মধ্যে চোখের সমস্যাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমাধান করা হলে কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসে বাড়তি উৎপাদনশীলতা।

২০১৮ সালে বিশ্বসেরা স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ল্যানসেট এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা করেছিল। এ গবেষণায় দেখা যায় আসামের চা-বাগানে ভিশনস্প্রিং পরিচালিত চক্ষুসেবা কার্যক্রম চা-বাগানের কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব চা–বাগানের শ্রমিকেরা চশমা পেয়েছেন, তাঁদের গড় উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ২২ শতাংশ এবং যাঁদের বয়স ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে, তাঁদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ৩২ শতাংশ।

পরবর্তী সময়ে কিছু পোশাকশিল্প কারখানার গবেষণায়ও দেখা গেছে, যেসব কর্মীর চশমা নিতে হয়েছে, তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে ভুল কমে যাওয়ার হার প্রায় ৮১ শতাংশ। ৮৮ শতাংশের সুইয়ে সুতা প্রবেশ করাতে সুবিধা হচ্ছে এমনটি বলেছেন।

প্রতিবছর চোখসংক্রান্ত সমস্যার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২০ থেকে ৫১৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ চোখের সমস্যা সমাধানে খরচ করা প্রতি এক ডলারের বিপরীতে উঠে আসতে পারে ১০ থেকে ৫০ ডলার সমমূল্যের অর্থনৈতিক সুবিধা। চোখের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আমরা জাতিসংঘের এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) ৫টি স্তম্ভকে স্পর্শ করতে পারি। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের যেসব কর্মী ভিশনস্প্রিংয়ের চোখ পরীক্ষার আওতায় এসেছেন, তাঁদের মধ্যে ৩০ শতাংশকেই চশমা নিতে হয়েছে। এই হার দিনে দিনে বাড়ছে।

এ ক্ষেত্রে চক্ষুসেবা নিশ্চিত করা হলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। সরকারি, বেসরকারি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আইএলওর মতে, আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সেবা সংস্থার এক হয়ে কাজ করার মাধ্যমেই এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। এ জন্য চশমা ও এর কাঁচামালের ওপর আরোপিত করের হার ৭৮ শতাংশ থেকে কমানো হলে আরও বেশি মানুষের কাছে এই সেবা সুলভ মূল্যে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। সবার জন্য চক্ষুসেবা হোক আমাদের স্বাস্থ্যসেবার অঙ্গীকারের অংশ।

আরশাদ জামাল দীপু

আরশাদ জামাল দীপু

ভিশনস্প্রিংয়ের উদ্যোগকে তুসুকা গ্রুপ শুরুতেই স্বাগত জানিয়েছে। আমাদের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান নিজেরাই এটি বাস্তবায়ন করেছে। আমরা সবাই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করি। যা করলে আমাদের লাভ হবে, আমরা কেন তাতে বিনিয়োগ করব না। এ কর্মসূচির সফলতা সবার মধ্যে প্রচার করতে হবে। পাশাপাশি এই সেক্টরে আরও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ করতে হবে।

পোশাকশ্রমিকদের কাছে আস্থার বিষয়টি নিশ্চিত করাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চোখের গুরুত্ব তাঁদের বোঝাতে হবে। ভিশনস্প্রিং যেভাবে পরীক্ষা করছে, তা অনেক বড় হাসপাতালের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তারা বেশ যত্নের সঙ্গে এবং মানসম্পন্ন পরীক্ষা করেছে। ভিশনস্প্রিংয়ের পাশাপাশি সরকার ও বিভিন্ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। পোশাকশিল্প–সংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়, যদি ক্রেতারা তা চান।

বিজিএমইএ উদ্যোক্তাদের সংগঠন। যেকোনো কিছু হলেই আমরা বিজিএমইএর দিকে তাকিয়ে থাকি এবং বলি যে বিজিএমইএ কেন কিছু করল না। অথচ আমরা বোঝার চেষ্টা করি না যে বিজিএমইএ সরকার বা নিয়ন্ত্রক নয়। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। অথচ এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নেই। আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের ক্রেতারা।

 রানা প্লাজা ধস–পরবর্তী সময়ে ক্রেতাদের জোট—অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, বিশেষ করে স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে, যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ। আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২২ হাজার শ্রমিকের চক্ষু পরীক্ষা করা হয়েছে। যাঁদের চশমা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ২০ শতাংশ নিয়মিত চশমা পরে কারখানায় আসেন। আমাদের কিছু সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অনেকে ভাবেন চশমা পরবেন ম্যানেজার, সুপারভাইজার কিংবা বড় কর্মকর্তারা। এ ছাড়া তরুণ জনগোষ্ঠীর চশমা পরায় অনাগ্রহ রয়েছে। বিজিএমইএ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগের সঙ্গে আছে।সোহেল সাদাত

সোহেল সাদাত

সোহেল সাদাত

আমরা বাংলাদেশ বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের ফাউন্ডার মেম্বর। উদ্যোক্তা হিসেবে সব সময়ই আমাদের ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা থাকে। ভিশনস্প্রিংয়ের উদ্যোগটি অসাধারণ। অনেক শ্রমিকই চোখ নিয়ে সচেতন নন। তাঁরা চোখের অস্বস্তি বা তা থেকে মাথাব্যথার কারণ বুঝতে পারতেন না। চোখের স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এখানে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে কাজ করার পর আমরা দেখেছি, শ্রমিকদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তাঁদের অস্বস্তি দূর হওয়ায় উৎপাদন যেমন বেড়েছে, গুণগত মানও তেমনি বেড়েছে। চিকিৎসার পর শ্রমিকেরা খুশি আছেন, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। এ সেবাগুলো সহজলভ্য করতে হবে।

আমরা ডিজঅ্যাবল শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ দিয়েছি। আমাদের কারখানায় এখন ডিজঅ্যাবল ১১০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। আমরা একটি এনজিওর সঙ্গে কাজ করেছি। তাঁরা আমাদের প্রশিক্ষণ ও গাইডলাইন দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে, এসব শ্রমিক স্বাভাবিক অন্যান্য শ্রমিকের তুলনায় বেশি কাজ করেন। পোশাক খাতসহ যেকোনো খাতেই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে সবার সর্বাত্মক সহায়তা প্রয়োজন।

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

ক্লিয়ার ভিশন কালেকটিভ সবার যৌথ প্রচেষ্টার একটি উদ্যোগ। ২০১৮ সাল থেকে শেরপুর জেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। এতে সরকারের পাশাপাশি অরবিস, ব্র্যাক, ইসলামিয়া, এসেলর একসঙ্গে কাজ করছে। সেখানে বহুমাত্রিক কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভিশন সেন্টার, ফার্মেসি, আই মিত্র, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, আউটরিচ প্রোগ্রাম, স্কুল স্ক্রিনিং প্রোগ্রামের মতো কর্মসূচি।

এর লক্ষ্য হচ্ছে শেরপুরকে দৃষ্টি ত্রুটিমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করা। দৃষ্টির সমস্যা চশমা ব্যবহার করেই সমাধান করা যায়। বেজলাইন সার্ভেতে দেখা যায়, সেখানে ২০ শতাংশ দৃষ্টির ত্রুটি সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। মধ্যবর্তী জরিপে এটি দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। আগামী বছরের শেষে চূড়ান্ত জরিপের পর বোঝা যাবে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কতটুকু আমরা সফল হয়েছি। পৃথিবীতে ১০০ কোটি মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় চক্ষুসেবা গ্রহণ করতে পারছে না। বিষয়টি দুঃখজনক। এই বাধা দূর করার জন্য সবচেয়ে সহজ ও কম খরচের পদ্ধতি হচ্ছে চশমা ব্যবহার।

বাংলাদেশে চক্ষুরোগ–বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে। এ সীমাবদ্ধতা দূর করতে ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই চিকিৎসাসুবিধা রয়েছে। সেখানে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানরা আছেন। এখানে অপ্টোমেট্রিস্ট বা অন্তত এমএলওপি নিয়োগ করলে আরও বেশিসংখ্যক কর্মী সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।

কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো মানুষের দোরগোড়ায় চক্ষুস্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যেতে হবে। ন্যাশনাল আই কেয়ার বর্তমানে ২০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কমিউনিটি আই সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। এনজিও ও অন্য বেসরকারি খাত মিলে ২৩৫টি ভিশন সেন্টার করেছে। আমাদের এমন ১ হাজার ৬০০ সেন্টারের প্রয়োজন।

আব্দুল আজিজ

আব্দুল আজিজ

আমি ১০ বছরের বেশি কন্টিনেন্টালে কাজ করছি। গত কিছুদিন যাবত চোখে সমস্যা হওয়ায় সঠিকভাবে পরিমাপের কাজ করতে পারছিলাম না, মাথা ব্যথাও হত। এ সময় আমার প্রতিষ্ঠান থেকে ভিশনস্প্রিং এর মাধ্যমে চক্ষু পরীক্ষা করা হয় ও চশমা দেওয়া হয়। আমি কোম্পানির কাছে কৃতজ্ঞ।

সালমা আক্তার

সালমা আক্তার

আমি দুই বছর ধরে ডেনিটেক্স কোম্পানিতে কাজ করছি। কাজ করতে গিয়ে আমি ঠিকমতো দেখতে পেতাম না। অর্থাভাবে আমি এর চিকিৎসা করাতে পারিনি। পরে একদিন শুনি কারখানায় চোখের ডাক্তার আসছেন। আমি সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নিই এবং আমাকে চশমা দেওয়া হয়। এখন আমি ঠিকমতো দেখতে পাই। ফলে আমি আগের তুলনায় বেশি উৎপাদন করি, ভুলও কম হয়।

মুনির আহমেদ

মুনির আহমেদ

অরবিস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে ১৯৮৫ সাল থেকে কাজ করছে। পোশাকশিল্পসহ প্রায় প্রতিটি কর্মস্থলেই চক্ষুস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের কমবেশি বিচরণ রয়েছে। আমরা চা–বাগানেও কাজ করছি। কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকেরা জানেন না যে তাঁর চোখে সমস্যা হয়েছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু। তারা পরবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কর্মে যোগ দেবে। এরাই দেশের ভবিষ্যৎ।

এখন দেশে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে শূন্য দশমিক ৬ জন অন্ধ। যারা এখনো অন্ধ হয়নি, এমন মানুষের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। একসময় ভিটামিন ‘এ’–এর অভাব ছিল। এখন কাজ করতে গিয়ে আমরা নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছি। এর একটি হচ্ছে অপরিণত নবজাতকের জন্ম বাড়ছে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির কারণে শিশুরা অপরিণত বয়সে জন্মালেও বেঁচে যাচ্ছে। তাদের সমস্যা স্ক্রিনিং করে নির্ণয় করতে হবে।

বাংলাদেশে ছয় লাখ নবজাতক অপরিণত বয়সে জন্মগ্রহণ করছে। তাদের ২০ শতাংশ শিশুই এ ধরনের ঝুঁকিতে আছে। এর ১০ শতাংশের রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিউরিটি (আরওপি) হতেও পারে, আবার না–ও পারে। কিন্তু তাদের তো পরীক্ষা করতে হবে। তাই অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়া সব শিশুকেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। সুতরাং এই বিষয়টি আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র বলে মনে হয়েছে।

অপরিণত নবজাতকের মস্তিষ্কে, চোখে, দাঁতে, শ্রবণে বা আচরণগত সমস্যা হয়। এসব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। সুতরাং ৩৫ সপ্তাহের আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া বা দুই কেজির চেয়ে কম ওজনের নবজাতকদের অন্ধত্বের বড় ঝুঁকি রয়েছে। আমরা সবাই মিলে কাজ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুস্থ থাকবে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখবেকারণ, বাল্যবিবাহে অল্প বয়সে গর্ভধারণের কারণে অপরিণত নবজাতকের জন্ম হতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধত্বের হাত থেকে মুক্তি দিতে গণমাধ্যমেরও বড় ভূমিকা রয়েছে।

অমৃতা রেজিনা রোজারিও

অমৃতা রেজিনা রোজারিও

আমি প্রতিবন্ধকতা অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব পারসন্স উইথ ডিজঅ্যাবিলিটির (ইউএনসিআরপিডি) সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ পাস করেছে। সেখানে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হয়েছে। ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ-২০২১’ শীর্ষক এ জরিপের তথ্যমতে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। জরিপে বলা হচ্ছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। যদিও এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। এরপরও এখানে একটা বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ‘কাউকে পিছিয়ে ফেলে নয়’—এই মূলমন্ত্র নিয়ে সাইটসেভার্সের বিষয়ভিত্তিক কৌশলে আমরা তিনটি খাতে অবদান রাখছি। সেখানে আমরা প্রতিবন্ধকতা অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কাজ করেছি।

প্রথমত, আমরা চক্ষুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে স্ক্রিনিং ও ছানি দূর করি। কিন্তু যাঁরা অন্য ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার, তাঁদের নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। তাঁরা কীভাবে এ সেবার আওতায় আসবেন? এই জনগোষ্ঠীকে যেন সেবার আওতায় আনা যায়, সে জন্য সাইটসেভার্স হাসপাতালগুলোকে প্রবেশযোগ্য করেছে। পাশাপাশি কীভাবে তাঁদের দোরগোড়ায় সেবা নিশ্চিত করা যায়, সে বন্দোবস্ত করেছে।

বাংলাদেশে ৮ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই চক্ষু স্ক্রিনিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা পাঁচ শতাধিক প্রতিবন্ধীকে কর্মক্ষেত্র এনেছি, যাঁদের চক্ষু স্ক্রিনিংও হয়েছে।

এ কে এম মাসুম-উল-আলম

এ কে এম মাসুম-উল-আলম

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা এবং অন্ধত্বের কারণে মানুষের উৎপাদনশীলতা হারানোর ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে। বাংলাদেশে এমন কোনো উপাত্ত নেই। আলোচনায় সবার মধ্যে সমন্বয় ও মানুষের মধ্যে সচেতনতার বিষয়টি এসেছে, যার সঙ্গে আমরা একমত। বিশ্ব শ্রম সংস্থার কিছু বৈশ্বিক অঙ্গীকার রয়েছে। ১১০তম আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে মৌলিক কনভেনশন ৮টি থেকে ১০টি করা হয়েছে। এর মধ্যে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং এ–সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক অনুসরণ করে আমরা সবাই কাজ করি। এ দুটি বিষয়ে বাংলাদেশের কী অবস্থা বা কীভাবে একে টেকসই করা যায়, তা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।

জাতীয় পর্যায়ে আমাদের একটি কর্মপরিকল্পনা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে ভালো খবর। কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতিমালা এবং পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই তিনটি ফ্রেমওয়ার্কের কোথাও চক্ষুবিষয়ক কোনো কথা নেই। এ জায়গায় চক্ষুকে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভাবতে হবে। চক্ষুরোগকে পেশাগত রোগ হিসেবে দেখতে হবে৷

কাজী সাবেতুল ইসলাম

কাজী সাবেতুল ইসলাম

চোখের জন্য খরচ করলে তা বিনিয়োগের শামিল। অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে গোলটেবিল বৈঠক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই চক্ষু নিয়ে কাজ করলেও আমাদের সবার ক্ষেত্র এক নয়। এ বিষয়ে আমাদের সাধারণ একটি জায়গায় আসতে হবে। চোখের সমস্যা আছে জানামাত্রই কেউ হয়তো মুষড়ে পড়তে পারেন। বাংলাদেশ শ্রম আইনে পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য চেকলিস্টের কথা বলা হয়েছে, যা নিরাপত্তা কমিটির কাজ।

যখন সূক্ষ্ম কাজ করা হয়, তখন আলোর তীব্রতা কতটা থাকতে হবে, তা ঠিক করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করাতে হবে।

আইএলওর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের জনসংখ্যার ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন প্রতিরোধযোগ্য। বলা হয় যে ৭০ শতাংশ চোখের রোগ চশমা ব্যবহার করে সমাধান করা যায়।

স্বপন পাল

স্বপন পাল

ব্যবসার ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে শ্রমিকদের কল্যাণ ও ব্যবসার জন্য কী ভালো হবে, তা বুঝতে পারা। শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য কাজ করা লিভাই স্ট্রসের কাছে ব্যবসার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন ভিশনস্প্রিং সম্পর্কে জানতে পারি, বিশেষ করে অন্যান্য খাতে এর প্রভাব সম্পর্কে জানার পর ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। দৃষ্টি নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মানও বৃদ্ধি পায়।

২০১৮ সালে ভিশনস্প্রিংয়ের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে আমাদের একটি কারখানায় এ কর্মসূচি শুরু করি। শুরুর বিষয়টি অবশ্যই একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ, কারখানা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, শুরুতে তাঁদের বোঝাতে হয় এটি আসলে কী বা এর দ্বারা তাঁরা কীভাবে লাভবান হতে পারেন। পরীক্ষামূলক প্রথম কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফল কোম্পানির মালিকদের জানানোর পর আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাঁরা নিজেরাই আগ্রহী হয়ে এটি বাস্তবায়ন করেছেন। এমনও হয়েছে, আমাদের পণ্য সরবরাহকারী একটি কারখানায় প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক আছেন। তাঁরা সব শ্রমিককে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনার জন্য ভিশনস্প্রিংয়ের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করেছেন।

এ পাঁচ বছরে আমাদের ৫০ শতাংশের বেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত আমাদের সরবরাহ প্রক্রিয়ার ৫০ হাজার শ্রমিক স্ক্রিনিংয়ের আওতায় এসেছেন। এ বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে শ্রমিক, উৎপাদনকারী ও ব্র্যান্ড—সবাই লাভবান হয়।

সৈয়দ মাহফুজুল হক

সৈয়দ মাহফুজুল হক

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি দর্শন। এর তিনটি মাত্রা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে যাঁদের স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন, তাঁদের সবার কাছে যাওয়া, সেবাগ্রহীতার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা করা এবং এটি করতে গিয়ে তাঁরা যেন আর্থিক কষ্টে না পড়েন, তা নিশ্চিত করা। এটি চক্ষুস্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্যের সব শাখার জন্যই প্রযোজ্য। এ উপলব্ধি থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার সদস্যদেশগুলোকে প্রামাণিক তথ্যের আলোকে নীতিমালা তৈরিতে সাহায্য করে। নীতিমালা তৈরির পাশাপাশি এটি বাস্তবায়নে সহায়তা করে এবং পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে চক্ষুকেও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী কমিটির সভায় ‘ইন্টিগ্রেটেড পিপলস সেন্টার্ড আই কেয়ার (আইপেক)’ বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে ৭৪তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনের রেজল্যুশনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ৪০ শতাংশ দৃষ্টিত্রুটি সমস্যার কার্যকর সমাধান করা। অন্যটি হচ্ছে চোখের ছানি অপারেশন ৩০ শতাংশ করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য হিসেবে বাংলাদেশও এর সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।

খালেদা ইসলাম

খালেদা ইসলাম

 ‘নিবারণযোগ্য অন্ধত্ব’ রোধে সরকার ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচি চালু করে। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ইন্টিগ্রেটেড পেশেন্ট সেন্টার্ড আই কেয়ার অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে অন্ধত্ব কমানো। চারটি পদ্ধতিতে ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচি কাজ করে। এর একটি পদ্ধতি হচ্ছে প্রতিরোধমূলক ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম। এর মাধ্যমে নিবারণযোগ্য অন্ধত্ব নির্মূল, অনিবারণযোগ্য অন্ধত্বের হার কমানো এবং কমিউনিটিকে সচেতন করা হচ্ছে।

নিরাময়মূলক কার্যক্রম আরেকটি পদ্ধতি। ন্যাশনাল আই কেয়ার স্বাস্থ্যসেবা–সুবিধা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে এ কাজটি করছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ৬টি মৌলিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে।

চক্ষুস্বাস্থ্যসেবায় জনবলসংকটের বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রাথমিক চক্ষুস্বাস্থ্য পরিচর্যা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর চেষ্টাও সরকার বা ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচি করছে। গবেষণা, উদ্ভাবন ও সমন্বয়ের মাধ্যমে চক্ষুস্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করা হচ্ছে।

আলোচনায় এসেছে, অধিকাংশ পোশাকশ্রমিকের বয়স ৩০ বছরের কম। তাঁদের হয়তো এই মুহূর্তে চশমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাদের অবশ্যই তাঁদের প্রতিরোধমূলক ও প্রচারণামূলক কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। ভিটামিন এ ক্যাপসুল দিয়ে আমরা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করেছি। চক্ষুস্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও এমন কিছু করতে হবে। আলোচনায় এসেছে, চশমা পরার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এটি দূর করতে জনগণকে সচেতন করতে হবে।

সরকার সংকট দূরীকরণে কাজ করছে। কিন্তু আমরা তো বসে থাকতে পারি না। আমাদের সবাই সমন্বিতভাবে কাজ না করতে পারলে দৃষ্টি সমস্যা সমাধান ও অন্ধত্ব প্রতিরোধ করতে পারব না। সুতরাং এখানে কার, কোথায় এবং কতখানি ভূমিকা রয়েছে, তা নির্ধারণ করা জরুরি।

সরকার সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছে। ন্যাশনাল আই কেয়ার কর্মসূচি নেতৃত্ব দেবে, অন্যরা তার সহায়তায় এগিয়ে আসবে। কখন, কীভাবে স্ক্রিনিং করা দরকার, কী কী করণীয় ও কত দিন পরপর করা দরকার—এসব প্রটোকল তৈরি করবে আই কেয়ার। তারা মনিটরিং ও সুপারভিশনের জন্য ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে দেবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের বাইরে কর্মক্ষেত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজের বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, শ্রম সংস্থা, আইএনজিও, পোশাকশিল্পের মালিক, শ্রমিক সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।

এ এইচ এম এনায়েত হোসেন

এ এইচ এম এনায়েত হোসেন

হেলেন কেলার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলো দেখা যায় না, স্পর্শও করা যায় না। সেগুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়।’ চোখের সমস্যাকেও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। গত ২০ বছরে সবার সহযোগিতায় বয়স্ক ব্যক্তিদের অন্ধত্বের হার ৩৫ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে শিশুদের অন্ধত্ব প্রতি ১০ হাজারে ৮ জন থেকে ৬ জনে এসেছে। ২০২৩ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য গৃহীত কর্মসূচিতে চোখের বিষয়টি রয়েছে।

এবারের প্রতিপাদ্যে বলা হচ্ছে, ‘কর্মক্ষেত্রে চোখ ভালোবাসুন’। একে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে চোখের যত্ন নেওয়া, অন্যটি হচ্ছে এটি করলে কর্মক্ষেত্রের কী লাভ হবে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগ। আমরা সবাই কম্পিউটার ব্যবহার করি। এ ক্ষেত্রে ২০ মিনিট কাজ করার পর ২০ ফুট দূরত্বে তাকিয়ে ২০ সেকেন্ড চোখকে বিশ্রাম দেওয়ার নিয়ম। এগুলো আমরা চর্চা করি না। যাঁরা ঝালাইয়ের কাজ করেন, করাতকলে কাজ করেন, এমন অনেক জায়গাতেই চোখের সুরক্ষায় বিশেষ ধরনের চশমা ব্যবহার করা প্রয়োজন; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না।

কর্মক্ষেত্রে আলোর সঠিক মান থাকা প্রয়োজন। এটি করা গেলে কর্মক্ষেত্রে চোখের নিরাপত্তা অনেকটা বেড়ে যায়। ছোট এ বিষয়গুলোয় আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। পোশাক কারখানায় যাঁরা সূক্ষ্ম কাজ করেন, তাঁদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষার প্রয়োজন। প্রয়োজনে তাঁদের জন্য চশমার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁদের চোখ ভালো থাকলে উৎপাদন বাড়বে। পোশাক খাতে যেকোনো সহায়তায় আমরা প্রস্তুত আছি। বলা হচ্ছে, ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের শ্রমিকেরা পোশাকশিল্পে কাজ কম করছেন। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।

আমরা যদি একটি মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান করতে পারি, তাহলে চক্ষু স্বাস্থ্যসেবায় অনেক অগ্রগতি হবে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা গাইডলাইনে লেবার অফিসারদের পর্যবেক্ষণপদ্ধতি সেকেলে রয়ে গেছে। সেখানে পুরস্কার ও তিরস্কারের মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। অরবিসের সঙ্গে আমরা সিলেটের চা–বাগানে কাজ করেছি। আমরা ১৮০ জন চা–শ্রমিকের ছানি অপারেশন করেছি, যাঁরা বলেছেন, পরবর্তী সময়ে তাঁদের কর্মক্ষমতা বেড়েছে।

চক্ষুস্বাস্থ্যে সরকারের শক্তিশালী অঙ্গীকার রয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবাই যেন স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পারে সেটা নিশ্চিত করাও জরুরি। সর্বোপরি চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, নানা পর্যায়ের অংশীজনসহ সবার অংশগ্রহণে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আশা করি, নীতিনির্ধারকেরা আজকের আলোচনার সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

সুপারিশ

  • কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত চোখের পরীক্ষা প্রয়োজন।

  • চোখের সমস্যাকে পেশাগত রোগ হিসেবে দেখতে হবে।

  • উৎপাদনশীলতায় চক্ষুসেবার কর্মসূচির সাফল্য প্রচার করতে হবে।

  • চশমা পরার ক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।

  • চোখের স্বাস্থ্যসেবায় জনবলসংকট দূর করা প্রয়োজন।

  • চোখ পরীক্ষার একটি সর্বাঙ্গীন গাইডলাইন তৈরি করতে হবে।

  • শ্রমিকদের চোখ স্ক্রিনিংয়ে কোম্পানি, ক্রেতা ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

  • স্বাস্থ্য খাতের সামাজিক নির্ধারকগুলো ঠিক করা প্রয়োজন।

  • কর্মক্ষেত্রে আলোর সঠিক মান থাকা বাঞ্ছনীয়।

  • ননকমিউনিকেবল ডিজিস কন্ট্রোল প্রোগ্রামের গাইডলাইনে অকুপেশনাল হ্যাজার্ডে চোখের পরীক্ষা যোগ করতে হবে।