স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব

এম্বাসি অব সুইজারল্যান্ড ইন বাংলাদেশের সহায়তায়, ইউএনডিপি বাংলাদেশের স্ট্রেনদেনিং ইনস্টিটিউশনস পলিসিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস প্রকল্প ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ২৪ নভেম্বর ২০২৪। এ আয়োজনে গবেষণা সহায়তা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন বাজেট অ্যান্ড পলিসি (সিবিপি)।

এম্বাসি অব সুইজারল্যান্ড ইন বাংলাদেশের সহায়তায়, ইউএনডিপি বাংলাদেশের স্ট্রেনদেনিং ইনস্টিটিউশনস পলিসিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস প্রকল্প ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ক সংস্কার প্রস্তাব’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: তানভীর আহমেদ

অংশগ্রহণকারী:

ড. তোফায়েল আহমেদ,

প্রধান, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

এ কে এম তারিকুল আলম,

অতিরিক্ত সচিব, প্রশাসন অনুবিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। 

ড. মাহফুজ কবীর,

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান,

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

ইলিরা দেওয়ান,

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

মাশহুদা খাতুন শেফালী,

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন।

মহসিন আলী,

নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন।

শাহীন আনাম,

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

তোফাজ্জল হোসেন,

উপপরিচালক, স্থানীয় সরকার, সিরাজগঞ্জ।

মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া,

সহ–মুখপাত্র, জাতীয় নাগরিক কমিটি।

নাজিফা জান্নাত,

সমন্বয়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪।

গোলাম মাওলা রতন,

চেয়ারম্যান, ধানকাটি ইউনিয়ন পরিষদ, ডামুড্যা উপজেলা, শরীয়তপুর। 

হামিদা বেগম,

নারী সদস্য, ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদ, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম।

সুবোধ হাজং,

সদস্য, খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদ, কলমাকান্দা, নেত্রকোনা।

আনোয়ারুল হক,

সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি, ইউএনডিপি বাংলাদেশ।

মাহমুদুল হাসান,

প্রকল্প ব্যবস্থাপক, এসআইপিএস, ইউএনডিপি।

ড. কাজী মারুফুল ইসলাম,

অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আয়েশা কবির,

ইংরেজি বিভাগের প্রধান, প্রথম আলো।

সঞ্চালনায়:

ফিরোজ চৌধুরী,

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

ড. তোফায়েল আহমেদ

প্রধান, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

জুলাই অভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব আমাদের সামনে সংস্কারের বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টি বেশ পুরোনো। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হয় না। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাও এ ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না।

বর্তমান সময়টি সংস্কারের প্রশ্নে খুব অনুকূলে আছে। এ নিয়ে অন্তত একটি কমিশন গঠিত হয়েছে। এ সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো কমিশনের আওতায় খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। প্রাথমিকভাবে সমস্যাগুলো কোথায় রয়েছে, তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এরপর সেগুলোকে এক করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে সমাধানের পথে এগোতে হবে।

আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারের আওতায় অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে কাজ করার কোনো কার্যকর পদ্ধতি তৈরি করা যায়নি। আইয়ুব খানের আমলে ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল। স্বাধীনতার পর সেটি ইউনিয়ন পরিষদ হয়েছে। এর কিছুদিন পর উপজেলা পরিষদ হলো। এরপর এল জেলা পরিষদ। সিটি করপোরেশন তুলনামূলকভাবে নতুন প্রতিষ্ঠান। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো আইনও হয়েছে। কিন্তু কোনো কেন্দ্রীয় পদ্ধতি তৈরি হয়নি।

এ জন্য আমাদের একটি পদ্ধতি উন্নয়ন করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে একেকটি আইনে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ পরিচালিত হয়। এতে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। আমাদের অনেকগুলো আইন আছে। আবার এগুলো বিভিন্ন সময়ে কাটছাঁট হয়েছে। যে কারণে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করা কঠিন।

গত সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। এত টাকা খরচ করে আমরা আসলে কার্যকর কিছুই পাইনি। নির্বাচনের সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার। অসংখ্য নির্বাচন আয়োজন ছাড়াও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়৷ আমরা সে মডেল অনুসরণ করব। এ নিয়ে বিপ্লব–পরবর্তী এই সময়টিতে কাজ করে যেতে হবে। দুটি কাজ করা যেতে পারে। প্রথমত, একটি উপযুক্ত আইন তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে নির্বাচনের আয়োজন করা।

স্থানীয় সরকারকে মানুষ বিভিন্নভাবে দেখে। অনেকেই এটাকে কেবল উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন হিসেবে জানে। অথচ এটি একটি বড় কাঠামো৷ তাই এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সেভাবেই ভাবতে হবে।

এ কে এম তারিকুল আলম

অতিরিক্ত সচিব, প্রশাসন অনুবিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশে একটি পরিসংখ্যান দরকার। এ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাজের পরিধি ছোট হতে হবে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বের বাইরে অতিরিক্ত কোনো কাজ দেওয়া যাবে না। একটি ইউনিয়ন পরিষদের আওতায় থাকা প্রতিটি ওয়ার্ড কার্যালয়ে একজন করে পরিসংখ্যান সহকারী থাকা উচিত। প্রতিটি প্রয়োজনীয় বিষয়ের তথ্য নথিভুক্ত করাই হবে এসব পরিসংখ্যান সহকারীর কাজ। দেশকে এগিয়ে নিতে এ কাজই যথেষ্ট। এ কাজ সঠিকভাবে করা গেলে আর কোথাও যেতে হবে না।

স্থানীয় সরকারের সংস্কার কিংবা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া কয়েকটি ধাপে সম্পাদন করতে হবে। প্রথমত, কাউন্সিল কিংবা পরিষদের সংস্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অবকাঠামোগত সংস্কার এবং তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়বিষয়ক সংস্কার প্রয়োজন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের আয় করার নিজস্ব একটি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রকল্পসমূহ প্রয়োজনের নিরিখে হতে হবে, রাজনৈতিকভাবে সন্তুষ্টির জন্য না।

কিছু বিশেষ কাজ জেলা প্রশাসন পর্যায়েই রাখা উচিত। ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্য বহিষ্কারের বিষয়টি অযথা মন্ত্রণালয়ের অধীন রাখার প্রয়োজন নেই। উপযুক্ত প্রক্রিয়ায় বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।

স্থানীয় সরকার পর্যায়ের দায়িত্বের কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে। একজন কাউন্সিলর কতজনকে সেবা দিতে সক্ষম হবেন, সে অনুযায়ী ওয়ার্ডগুলোকে ভাগ করতে হবে। অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

এ ছাড়া সেবাদাতাদের যোগ্যতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা উপযুক্ত সেবা দিতে না পারলে সংস্কার সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্ম কমিশনের আওতায় প্যানেলের মাধ্যমে সেবাদানকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পরে।

এ কমিশনের আওতায় যথাযথ সংস্কার হোক, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।

ড. মাহফুজ কবীর

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

স্থানীয় সরকারব্যবস্থার সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার কাঠামো নিয়ে দায়িত্বশীলদের পাশাপাশি সেবাগ্রহীতা সাধারণ নাগরিকেরাও অস্বস্তিতে থাকেন। মোটাদাগে দুই ধরনের স্থানীয় সরকারব্যবস্থা রয়েছে। একটি শহরের, অন্যটি গ্রামের। এর বাইরে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় একটি ব্যবস্থা রয়েছে।

স্থানীয় সরকারের জন্য বাজেটে ভালো অঙ্কের বরাদ্দ রাখা হয়। এ ছাড়া নিজস্ব আয়ের উৎস আছে। এ ক্ষেত্রে হোল্ডিং ট্যাক্স একটি ভালো আয়ের উৎস। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির বিষয়ে ভয়ে থাকেন। হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ালে ভোট কমে যাবে বলে তাঁরা মনে করেন। অনেক এলাকায় হোল্ডিং ট্যাক্স সম্পূর্ণ মওকুফ করার ঘটনা ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

পৌরসভার ক্ষেত্রে ক, খ ও গ আকারে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এই শ্রেণিকরণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্যের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। কিছু কিছু পৌরসভার সক্ষমতা সিটি করপোরেশনের চেয়ে বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা জরুরি।

বাজেটের ক্ষেত্রে জন–অংশগ্রহণ বলে একটা বিষয় আছে। এটি কাগজে–কলমেই আছে। বাস্তবে নেই। কেন নেই, তা মূল্যায়ন করা জরুরি। জনগণের জন্যই যে কাজ, সেই কাজ হয় না কেন, তা খুঁজে দেখতে হবে।

ড. ফেরদৌস আরফিনা ওসমান

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

প্রান্তিক মানুষের সেবা পাওয়া নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে মাঠ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার পাশাপাশি কাজ করছে; কিন্তু আমাদের মাঠ প্রশাসনের মতো স্থানীয় সরকারব্যবস্থাও কাজ করছে না। মাঠপর্যায়ে সেবা দেওয়ার জন্য মাঠ প্রশাসনের অনেক বিভাগ আছে। এদের সমস্যা হচ্ছে, তাদের জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হয় না। তাদের জবাবদিহি করতে হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে। জবাবদিহির শৃঙ্খল যত লম্বা, জবাবদিহিও তত দুর্বল হয়ে যায়। সে কারণে স্থানীয় পর্যায়ের প্রান্তিক মানুষ সেবা খুবই কম পান।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসন নেই। ইউনিয়ন পরিষদের কিছু কার্যক্রম ও উপজেলা পরিষদের অনেক কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একই কাজের দায়িত্ব দুজনকেই দেওয়া হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এ কাজগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিতে চাই।

উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তারা সমন্বিতভাবে কাজ করলে আমাদের সম্পদের অপচয় কম হয়। পাশাপাশি অনেক বিষয়ের ধোঁয়াশাও কেটে যায়। বিগত বছরগুলোতে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এর সুবিধা নিয়েছে।

বিকেন্দ্রীকরণ সত্যিকার অর্থে অর্থবহ করতে হলে দায়িত্বগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাজগুলো সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।

স্থানীয় সরকারকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তারা কে কী কাজ করছে, তা কিন্তু আমরা জানি না। আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটি অনেক দুর্বল। স্থানীয় পর্যায়ে সেবাকে শক্তিশালী ও অর্থবহ করতে হলে বা মানুষের কাছে সেবা দিতে চাইলে তদারকির ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। স্ট্যান্ডিং কমিটি স্থানীয় পর্যায়ে সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।

এ নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করার কথা ভাবছি। যেন এ–সংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কোনো অনিশ্চয়তার সৃষ্টি না হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেন আমাদের ধারণাগুলো গ্রহণ করে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে তা যুক্ত করে, সে বিষয়েও আামদের প্রচেষ্টা থাকবে।

ইলিরা দেওয়ান

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

সারা দেশে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ আছে। কিন্তু পার্বত্য এলাকায় একই সঙ্গে আঞ্চলিক পরিষদ ও প্রথাগত ব্যবস্থা রয়েছে। এসব জায়গা সমন্বয় করে কীভাবে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কার করা যায়, তা ভাবতে হবে। প্রথাগত ব্যবস্থাকে বজায় রেখে স্থানীয় সরকারব্যাবস্থা সংস্কার করার বিষয়ে ভাবতে হবে।

সাড়ে তিন দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচন হচ্ছে না। এই ৩৫ বছর কেবল সিলেকশনের মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এসব জায়গা দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত থাকেন। এবার একটা স্বচ্ছ পরিষদ পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করেছিলাম; কিন্তু এবারও আমরা তা পাইনি। এখানে নিয়োগকৃত ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। দেখে পড়তে পারেন না, এমন ব্যক্তিকেও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ জায়গায় আমাদের নতুন করে ভাবার সুযোগ রয়েছে।

জেলা পরিষদগুলোতে নির্বাচন না হওয়ার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে ভোটার তালিকায় জটিলতা। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশন এ জটিলতা নিরসনে কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করছি। কারণ, শুধু এ দোহাই দিয়েই বিগত ৩৫ বছর সেখানে নির্বাচন হয়নি।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠী বা জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা দেখতে হবে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হলে তৃণমূল থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত সব পর্যায়ে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

মাশহুদা খাতুন শেফালী

সদস্য, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার মুখোমুখি অবস্থানে আছে, এটা আমাদের মূল সমস্যা। স্থানীয় সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পর্কের জায়গাগুলোর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারকে তার প্রজা হিসেবে রাখে।

স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়েছে। তার আগের নির্বাচনগুলোয় প্রতীক সরবরাহ করা না হলেও একই কায়দায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকা দলের সদস্যরাই বেশি পাস করেছেন।

কেন্দ্রীয় সরকারে সংসদ সদস্যদের মধ্যে অর্থ উপার্জনের অসুস্থ একটি প্রতিযোগিতা দেখা যায়। স্থানীয় সরকারে একই জিনিস ভর করেছে। এ জায়গাগুলোতে নজর দিতে হবে।

কোন বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা চিহ্নিত করে বন্ধ করা জরুরি। স্থানীয় সরকারে স্বায়ত্তশাসনের প্রথম শর্ত হলো তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে হবে।

স্থানীয় সরকারের সব বিষয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের ধাঁচে চলে। ফলে সেখানে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন হয়েছে ১৯৭৩ সালে, স্থানীয় সরকারে সেটি হয়েছে ১৯৮৩ সালে, এই যা পার্থক্য। নতুন কোনো পরিকল্পনা না করে একই বিষয় স্থানীয় সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নারীরা নিজেরা স্বাধীন হতে সরাসরি নির্বাচনে এসেছেন; কিন্তু দিন শেষে তাঁদের পরিবর্তে তাঁদের স্বামীরাই দায়িত্ব সামলান। চেয়ারম্যানেরা নির্বাচিত নারীর পরিবর্তে তাঁর স্বামীকে সভায় ডাকেন। কারণ, তাঁরা সভাগুলো সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানে করেন।

মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন

উপপরিচালক, স্থানীয় সরকার, সিরাজগঞ্জ

স্থানীয় সরকার বিভাগের সেবাগুলো কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে মানুষের কাছে উপযুক্ত উপায়ে পৌঁছে দেওয়া যায়, এ ক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জ জেলা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। বিশেষত জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমরা সফলতা অর্জন করেছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়ে অনেক সংকটের কথা শুনতে পাওয়া যায়। সিরাজগঞ্জ জেলায় এ ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দেখা যায়।

যেখানে টাকা, সেখানেই কলহ। তাই ইউনিয়ন পরিষদের সেবা ক্যাশলেস পদ্ধতিতে দেওয়া যায় কি না, তা ভাবা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে এসব জায়গায় দালাল-বাটপারদের সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। ক্যাশলেস পদ্ধতিতে কাজ করা গেলে তাদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ইউনিয়ন পরিষদে ১০ জন করে গ্রাম পুলিশ থাকেন। তাঁদের মধ্যে একজন থাকেন দফাদার। তাঁদের দিয়ে চা-পানি আনানোর মতো কাজ করানো হয়। প্রত্যেক মানুষই সম্মান নিয়ে বসবাস করতে চান। তাঁদের দিয়ে এ ধরনের কাজ করানো শোভনীয় নয়। এ ছাড়া তাঁদের ওয়াশরুম পরিষ্কারের মতো কাজও করতে হয়। তাঁরা মুখ ফুটে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন না। সে জন্য এসব জায়গায় আলাদা পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

স্থানীয় সরকারের সদস্য ও অন্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার রীতি আছে। তবু আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম একটি সীমা রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। যোগ্য ব্যক্তিরাই যেন চেয়ারে বসতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

মহসিন আলী

নির্বাহী পরিচালক, ওয়েভ ফাউন্ডেশন

আলোচনায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কিছু সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাব এসেছে। এর মধ্যে কিছু সংস্কার এখনই করা সম্ভব। উপজেলা পরিষদে সংসদ সদস্যের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকা আইন থেকে এখনই বাতিল করে দেওয়া সম্ভব। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী নির্বাহী অফিসারের সাচিবিক দায়িত্ব পালনের ভূমিকা কার্যকর করা দরকার। উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব ও ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করা যেতে পারে। নারী প্রতিনিধিদের ভূমিকাও সুনির্দিষ্ট করা নেই। এগুলো স্পষ্ট করতে হবে।

স্থানীয় পর্যায়ে দীর্ঘদিন মডেল ট্যাক্স শিডিউল হালনাগাদ করা হয়নি। দ্রত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক গবেষণায় এসেছে, উপজেলা পরিষদের জন্য বাজেট বরাদ্দের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ফর্মুলা নেই। বরাদ্দের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বা পিছিয়ে পড়া অঞ্চল—কোনোকিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয় না, রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে এ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এ জন্য উপজেলা পরিষদের জন্য বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট ফর্মুলাভিত্তিক করা জরুরি।

সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে অনেক দূরত্ব রেখে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। তাই সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দুটিই কাছাকাছি সময়ে হতে হবে। আমলাদের ওপর স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের তদারকির বিষয়টি ফিরিয়ে আনতে হবে।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমলা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার মধ্যে একটা ভারসাম্য আনা দরকার। এটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ডিসিকে জেলা প্রশাসক বলার পরিবর্তে জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে রেভিনিউ সংগ্রহের দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া উচিত।

শাহীন আনাম

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

স্থানীয় সরকার বিকেন্দ্রীকরণে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চায় না। প্রথমেই এটা সংস্কারের মাধ্যমে সমাধানের বিষয়টি ভাবতে হবে।

বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি না থাকলে যেকোনো সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। আমাদের দেশে অনেক আইন আছে; কিন্তু সেসব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। যেকোনো ক্ষেত্রে আইনের বাস্তবায়ন, তদারকি ও জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ।

সংসদ সদস্য ও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বের বিষয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। কার কী দায়িত্ব, এ বিষয়গুলো তাঁরা অনেকেই জানেন না। আইনপ্রণেতারা সংসদে আইন প্রস্তাব, আলাপ ও বিতর্কের পরিবর্তে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর ক্ষমতা খাটাতে চান। পরিপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন বাস্তবায়ন কমিটিতে সাংসদদের উপদেষ্টা করা হলো। এসব কমিটি পুরো দলীয়করণ হয়ে যায়। সাংসদের ইচ্ছানুযায়ী এসব কমিটিতে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ফলে আমরা এখানে বিশেষ করে সামজিক সুরক্ষা খাতে অনেক দুর্নীতি হতে দেখেছি। আমরা দেখেছি, সামাজিক সুরক্ষা খাতের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ উপকারভোগী দলীয়ভাবে নির্ধারণ করা হয়।

আমাদের সামনে এসব নিয়ে কাজ করার একটা বড় সুযোগ এসেছে। কেন্দ্র ও স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে। সে জন্য আমরা যেসব আইন করব, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিছুটা স্বাধীন ছিল। পরবর্তী সময়ে দলীয় মনোনয়নের বিধান করে তা দলীয়করণ হয়ে যায়। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

আনোয়ারুল হক

সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি, ইউএনডিপি বাংলাদেশ

সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্থানে সমস্যার ধরন ভিন্ন। কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর আর কুমিল্লার সমস্যা এক নয়। ফলে সমাধানও ভিন্ন হতে হবে। স্থানীয় সরকারকে গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমেই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ শক্তির কেন্দ্রে থাকে। আর জনগণের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হচ্ছে স্থানীয় সরকার। এসডিজি অর্জনেও স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রে রাখতে হবে। যেকোনো সংস্কার বাস্তবায়নের রাজনৈতিক অঙ্গীকার গুরুত্বপূর্ণ। অতীতেও অনেক ধরনের কমিশন হয়েছে, সেগুলো প্রতিবেদনও দিয়েছে। কিন্তু কার্যকর কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ জন্য সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে নিজস্ব অর্থায়ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বাধিকার ও স্বাবলম্বিতার জায়গায় গুরুত্ব দিতে হবে। স্থানীয় সরকারের যথার্থ বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় সরকারেরও

একটা অঙ্গীকার থাকতে হবে। চাহিদাসহ অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করেই বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের গঠন ও পরিচালনাপ্রক্রিয়াকে আরও গণতান্ত্রিক করার চেষ্টা করতে হবে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে অন্য সদস্যদের ক্ষমতার ভারসাম্য জরুরি। শহরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা সেভাবে গুরুত্ব পায় না। এটা অনেক বেশি রাজনৈতিক। একে অংশগ্রহণমূলক, নারীবান্ধব ও দরিদ্রবান্ধব করতে অনেক কাজ করার আছে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ৯৫ শতাংশ সেবা নিতে জনগণের অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তথ্যপ্রযুক্তির সাম্প্রতিক বিপ্লবের ফলে নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কের ধরনগুলোর পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও ভালোভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে। এর মাধ্যমে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সেবা নিশ্চিত করা যায়।

এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করতে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সক্ষম করে তুলতে হবে। এখানে একটা সামাজিক নিবন্ধন জরুরি। জনপ্রতিনিধিদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

মোহাম্মদ মিরাজ মিয়া

সহ-মুখপাত্র, জাতীয় নাগরিক কমিটি

প্রায় দুই হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের সামনে সংস্কারের সুযোগ এসেছে। এ সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাই না। প্রথমত, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। সারা বছর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এসব নির্বাচন একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট মাসে সারা দেশে যেন একযোগে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়, সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

বিদ্যমান স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবী, স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বেসরকারি সমাজকর্মীরাও নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। ব্রিটেনের মতো দেশে এ চিত্র দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে আইন বা নিয়ম শিথিল করা প্রয়োজন। এতে তুলনামূলক শিক্ষিত ও দক্ষ জনপ্রতিনিধি পাওয়া যাবে।

নাজিফা জান্নাত

সমন্বয়ক, বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪

স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। এখানে আমলাতান্ত্রিক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব বেশি থাকে। এ কারণে কোনো কাজ বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা বেড়ে যায়। সুতরাং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে এ ধরনের প্রভাব মুক্ত করতে হবে।

শহর এলাকার সরকারব্যবস্থায় অল্পবিস্তর হলেও জবাবদিহির ব্যাপার থাকে। কারণ, শহরের মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়। কিন্তু গ্রামের ক্ষেত্রে এ দৃশ্য দেখা যায় না। গ্রামীণ মানুষ জানেন না এসব ব্যক্তিকে প্রশ্ন বা জবাবদিহি করা যায়। সরকারিভাবে নীতিমালা তৈরি করে এ জায়গাটির সংস্কার প্রয়োজন আছে। গ্রাম থেকে শুরু করে শহর এলাকার মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে হবে।

গোলাম মাওলা রতন

চেয়ারম্যান, ধানকাটি ইউনিয়ন পরিষদ, ডামুড্যা উপজেলা, শরীয়তপুর

আমরা ২৪ ঘণ্টা জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকি। সারা দিন জন্ম–মৃত্যুর নিবন্ধন, নাগরিকত্ব সনদ, প্রত্যায়নপত্রসহ নানা রকমের কাজ করতে হয়। এমনকি জরুরি পরিস্থিতিতে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠেও কাজ করতে হয়। তা সত্ত্বেও আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে যথাযথ সুযোগ–সুবিধা পাই না।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেন কোনো রকম প্রভাব না খাটানো হয়, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। জনগণের রায় বাস্তবায়নের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সঙ্গেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা গেলে প্রভাব খাটানো অনেকটাই কমে আসবে।

হামিদা বেগম

নারী সদস্য, ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদ, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম

ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ ধাপ। সর্বশেষ ধাপ হলেও ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা। আমরা সরকারের সব সেবা সাধারণ জনগণের কাছে গিয়ে পৌঁছে দিচ্ছি। স্থানীয় সরকারের সংস্কার করতে হলে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী করতে হবে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব সনদ আমরা তাদের কাছে পৌঁছে দিই। সংরক্ষিত নারী সদস্যরা কাজ করেন না বলে বলা হয়। এটি সঠিক নয়। বরং তাঁদের কাজ করতে উৎসাহিত করা হয় না।

প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে নারী সদস্য দেওয়া হলে কাজের আগ্রহ আরও বাড়বে।

সুবোধ হাজং

সদস্য, খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদ, কলমাকান্দা, নেত্রকোনা

স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা নানা রকম সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হই। অনেক সময় নিজেদের যাতায়াত ব্যয়ে জনগণকে ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য সেবা পৌঁছে দিতে হয়। আমরা যারা সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি, তারা কাজ করতে পারছি না। এ জন্য সাধারণ মানুষের কাছে আমরা লজ্জিত। সর্বশেষ বন্যায় আমরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যদিও বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে কিন্তু সরকারিভাবে আমরা সে রকম কিছুই করতে পারিনি। সরকার ১০ কেজি করে চাল দিয়েছে, তা–ও আমরা সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে পারিনি। এ জায়গাগুলোয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা জনগণের জন্য সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে চাই। এ জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দরকার।

সুপারিশ

  • স্থানীয় সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করার স্বাধীনতা থাকা জরুরি।

  • স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা।

  • ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদের নির্বাচন একটি একক আইনের আওতায় করা।

  • নগর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে আরও গুরুত্ব দিয়ে একে অংশগ্রহণমূলক, দরিদ্রবান্ধব ও জেন্ডার সংবেদনশীল করে তোলা।

  • স্থানীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এনআইএলজিকে পুনর্গঠন ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন করা।

  • স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রভাব খাটানো বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

  • জনগণের সেবাপ্রাপ্তি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে স্থানীয় সরকারের সেবা ডিজিটালাইজ করা।

  • ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা এবং নারীদের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।