তৃণমূলে বাড়ছে ডিজিটাল আর্থিক সেবা 

‘ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস: অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এর সম্ভাবনা’ শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো ও পিআরআই। 

তৃণমূল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিজিটাল আর্থিক সেবা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই তৃণমূল মানুষকে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করছে ডিজিটাল আর্থিক সেবা। তাতে সমাজের পিছিয়ে পড়া বা তলানির দিকে থাকা মানুষ এখন ডিজিটাল হচ্ছে। এখন তাদের জন্য আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। এসব মানুষের টাকার সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে আস্থাও বাড়াতে হবে। 

গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস: অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এর সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। 

প্রথম আলো ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) বাংলাদেশ পলিসি অ্যাডভোকেসি ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প যৌথভাবে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। 

অনুষ্ঠানে বক্তারা ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবার (ডিএফএস) বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনায় অংশ নেন অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ডিএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, প্রতি মাসে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। তবে গত কয়েক বছরে এমএফএস ব্যবহারে নারীর অংশীদারত্ব কমেছে। 

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলো কোনো না কোনোভাবে ডিজিটাল আর্থিক সেবার আওতায় চলে এসেছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তাঁর মতে, এখন গ্রামের আমানত গ্রামে বিনিয়োগের সুযোগ বাড়াতে হবে। অন্তত ৩৫-৪০ শতাংশ বিনিয়োগ গ্রামে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামেও এখন অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্রামের মানুষ নানা ধরনের ছোটখাটো ব্যবসায় জড়িত। শামসুল আলম আরও বলেন, ব্যাংকের এজেন্ট ব্যবসায়ীরা যাতে অন্তত ১৫-২০ বছর ব্যবসা করতে পারেন, সেই বাধ্যবাধকতা তৈরি করা উচিত। এখন দেখা যায়, কোনো এলাকায় কোনো এজেন্ট ভালো ব্যবসা করলে ব্যাংক নিজেই সেখানে শাখা খুলতে চায়। এতে বিপাকে পড়েন এজেন্টরা। 

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। কেন আমরা পিছিয়ে আছি, তা জানা দরকার। ডিজিটাল আর্থিক সেবায় নারীরা কেন পিছিয়ে, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবা গ্রামের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহর থেকে মুহূর্তেই টাকা গ্রামে চলে যাচ্ছে। প্রবাসী আয়ও পাচ্ছেন গ্রামের মানুষ। তাই গরিব মানুষের কাছে স্মার্টফোন সহজলভ্য করতে কর কমানো উচিত। স্মার্টফোনই ডিজিটাল আর্থিক সেবা সম্প্রসারণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। 

সব মানুষের একসঙ্গে সমৃদ্ধি অর্জন করতে ডিএফএস-কে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, যেকোনো নতুন প্রযুক্তি চালুর সময় গ্রাম-শহর; ধনী-গরিব এবং লিঙ্গবৈষম্য সৃষ্টি করছে কি না, তা বিবেচনায় আনতে হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল আর্থিক সেবায় আনতে এই তিন ধরনের বৈষম্য দূর করা জরুরি। এ জন্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উপযোগী আর্থিক সেবা তৈরি করতে হবে। 

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দেবদুলাল রায়। তিনি বলেন, মূলত তিনটি বিবেচনায় ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, ব্যক্তিপর্যায়ে আয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি; দ্বিতীয়ত, ব্যবসা পর্যায়ে লেনদেন সহজ করে ঝুঁকি এড়ানো এবং তৃতীয়ত, আয় ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে অর্থনীতিতে অবদান বাড়ানো। 

সরকারের এটুআই প্রকল্পের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ নাহিদ শারমীন বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে নারীদের এজেন্টশিপ দেওয়া হয় না বললেই চলে। গ্রামের নারীদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আনতে নারীদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া জরুরি। কারণ, নারীরা নারীদের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারেন। 

সেবাদানকারীরা যা বলেন

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবিদুর রহমান সিকদার বলেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবার ওপর গ্রামের মানুষের সন্তুষ্টি আছে। কোভিডের সময় ডিজিটাল লেনদেনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বেড়েছে। কোভিডের সময় প্রণোদনার টাকা ডিজিটাল আর্থিক সেবার মাধ্যমে দ্রুতগতিতে বিতরণ করা হয়েছে। 

মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, গত চার বছর আমরা ক্যাশ আউট মাশুল কমিয়েছি। এতে মানুষের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয় হয়েছে। এই টাকা এখন অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। 

বাংলাদেশে ডিজিটাল অভিযোজন গাড়িচালক, গৃহকর্মীসহ সাধারণ মানুষের হাত ধরে এসেছে—এমন মন্তব্য করেন বিকাশের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাহফুজ সাদিক। তিনি বলেন, গ্রাহকেরা যে ধরনের সেবা চান, সে ধরনের সেবা বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। গ্রাহকেরা তাঁর কষ্টের টাকা দিয়ে বলছেন, ‘আমার টাকা রাখুন, যখন প্রয়োজন হবে, তখন দেবেন।’ এই বিশ্বাসে চিড় ধরলে পুরো ব্যবস্থাটি ভেঙে যেতে পারে। 

জিডিপিতে অবদান বাড়ছে

পিআরআইয়ের পরিচালক বজলুল হক খন্দকার বলেন, আর্থিক খাতে গ্রাম-শহর; ধনী-গরিবনির্বিশেষে অন্তর্ভুক্তিকরণের ফলে নতুন
নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। জিডিপিতে অবদান বাড়ছে। তবে গরিব মানুষের উপযোগী করে সেবা দেওয়া উচিত। 

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিআইজিডি) ভিজিটিং ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলীর মতে, স্মার্টফোনের দাম যদি সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে আনা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের জীবন বদলে যাবে। এই তৃণমূলের মানুষকে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করছে ডিজিটাল আর্থিক সেবা। সমাজের পিছিয়ে থাকা তথা তলানির দিকে থাকা মানুষ এখন ডিজিটাল হচ্ছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কোষাধ্যক্ষ মঞ্জুর ই খোদা তরফদারের মতে, ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় আইন কঠোর করা উচিত। তাদের এমন সুরক্ষা দিতে হবে, যেন তারা স্বস্তি বোধ করেন। 

শৈলীর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমীনা খান বলেন, বিদেশ থেকে অনেকে পেপলে লেনদেন করতে চান, কিন্তু আইনি জটিলতায় আমরা তা পারি না। তাই লেনদেনের উপায় সহজ করা উচিত। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো সৈয়দ ইউসুফ সাদাতের মতে, ডিজিটাল লেনদেনের বাজারটি যদি আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়, সে জন্য নীতি প্রণয়ন করা দরকার।

গোলটেবিল আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।