গোলটেবিল বৈঠক
ভোজ্যতেলের মান নিয়ন্ত্রণ জরুরি
‘খোলা ভোজ্যতেল, সুস্বাস্থ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলো।
দেশে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ ভোজ্যতেল খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। এই খোলা তেল পরিবহন ও সংরক্ষণে রাসায়নিকের ড্রাম ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাই প্যাকেটজাত ভোজ্যতেলের ব্যবহার বাড়ানো এবং মান নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি বলে মনে করছেন চিকিৎসক, গবেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘খোলা ভোজ্যতেল, সুস্বাস্থ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ কথা বলেন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। খোলা তেল ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং করণীয় বিষয়ে বক্তারা মতামত দেন।
বৈঠকে খোলা ভোজ্যতেল সংরক্ষণে নিজের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান। তিনি বলেন, হবিগঞ্জ, কক্সবাজার, সিলেট, কুমিল্লাসহ অনেক জায়গায় তিনি দেখেছেন, যেসব কনটেইনারে তেল রাখা হয়েছে, সেগুলো কোনোভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সেই সঙ্গে যারা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত, তারাও কেউ সচেতন নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে সবাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, ভোজ্যতেলের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য সব ক্ষেত্রে তদারক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পাবলিক সার্ভেন্ট আমরা যদি সঠিক হই, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চেঞ্জ আনা সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, দেশে আমদানি বেশি হয় পাম অয়েল। কিন্তু খুচরা বাজারে গেলে দেখা যায় সয়াবিন তেল বেশি। এখানেই শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। ভোজ্যতেলের মান নিয়ন্ত্রণে সরবরাহশৃঙ্খল শনাক্তকরণের (ট্রেসিবিলিটি) ওপর জোর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, হয় খোলা তেল সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে, নয়তো এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ট্রেসিবিলিটি নিশ্চিত হয়।
ভোজ্যতেল নিরাপদ করতে সচেতনতার পাশাপাশি সঠিক ব্যবস্থাপনাও জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শোয়েব। বৈঠকে তিনি বলেন, শিল্পকারখানার কর্মকর্তা ও কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে হ্যাজার্ড অ্যানালাইসিস ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্ট (খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা) অনুসরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতি
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রীনা রানী পাল। প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে প্যাকেটজাত তেল ব্যবহারের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। শিল্পকারখানায়, বাণিজ্যিকভাবে খোলা ভোজ্যতেল ব্যবহৃত হচ্ছে। দামে কম এবং বাজারে ছোট প্যাকেজিং না থাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষও খোলা তেল ব্যবহার করছেন। এসব তেল সংরক্ষণ করা হয় রাসায়নিক পরিবহনে ব্যবহৃত পুরোনো ড্রাম। ফলে রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ ভোজ্যতেলের সঙ্গে মিশে দীর্ঘ মেয়াদে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। প্রবন্ধে আরও বলা হয়, খোলা তেলে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ না থাকায় এখনো দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশের মধ্যেই ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতি থেকে গেছে।
রাসায়নিকের ড্রামে ভোজ্যতেল সংরক্ষণ বন্ধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার বলে বৈঠকে মন্তব্য করেন বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক এস এম আবু সাঈদ। তিনি বলেন, সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে যেভাবে লবণে আয়োডিন যুক্ত করে আয়োডিনের ঘাটতি দূর করা গেছে, তেমনিভাবে ড্রামে ভোজ্যতেল পরিবহন ও সংরক্ষণও বন্ধ করতে হবে।
ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতির কারণ হিসেবে বৈঠকে বক্তারা বলেন, স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম হওয়ার কারণে তাঁরা বাধ্য হয়ে খোলা ভোজ্যতেল কিনে থাকেন। তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভোজ্যতেলের ছোট প্যাকেট বাজারজাত করার দাবি জানান তাঁরা। প্রয়োজনে সরকারকে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবীর ভূঁইয়া বলেন, শ্যাম্পুর পাতা যদি দুই টাকায় বিক্রি করা যায়, তাহলে তেল ছোট প্যাকেটে বাজারজাত করা যাবে না কেন।
সলিডারিডাড নেটওয়ার্কের কান্ট্রি ম্যানেজার সেলিম রেজা হাসান বলেন, পাম তেল ক্ষতিকর নয়। প্রয়োজনে ব্যবসায়ীরা এই তেল ছোট প্যাকেটজাত করতে পারে।
তেলের ট্রেসিবিলিটি নিশ্চিত করতে কোম্পানিগুলোর কনটেইনার নির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। তিনি বলেন, একেক কোম্পানির কনটেইনারের রং একেক রকম করার নির্দেশনা দিলেই তেলের উৎস সম্পর্কে ক্রেতা জানতে পারবেন।
খোলা তেলের ব্যবহার কমেছে
বৈঠকে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত খোলা তেল ও প্যাকেটজাত তেল ব্যবহারের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের (জেপিজিএসপিএইচ) ডেপুটি ডিন অধ্যাপক মলয় কান্তি মৃধা। তাঁদের এক জরিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, জাতীয় পর্যায়ে খোলা তেল ব্যবহারের পরিমাণ কমে এসেছে। ২০১৮-১৯ সালে গৃহস্থালি পর্যায়ে ৬৭ শতাংশ মানুষ খোলা তেল ব্যবহার করতেন। যেটি ২০২৩ সালে ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালে দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ সয়াবিন তেল ব্যবহার করতেন, যেটি ২০২৩ সালে ৮৮ শতাংশ হয়েছে।
মলয় কান্তি মৃধা বলেন, গৃহস্থালি পর্যায়ে পাম অয়েলের ব্যবহার ২ শতাংশ বেড়েছে। তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি খোলা তেল ব্যবহৃত হয় ময়মনসিংহে এবং সবচেয়ে কম ব্যবহার করা হয় সিলেটে। তবে সিলেটে পাম অয়েল ব্যবহারের পরিমাণ বেশি।
বৈঠকের শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক খন্দকার আব্দুল আউয়াল রিজভী। তিনি বলেন, খোলা ভোজ্যতেল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ বেশি। তা ছাড়া যে ড্রামে এই তেল সংরক্ষণ করা হয়, তা বিষাক্ত। একই সঙ্গে খোলা তেলে ভেজাল মেশানো খুব সহজ। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। ফুডগ্রেড কনটেইনারে তেল সংরক্ষণ করতে হবে। পণ্যের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ মুদ্রিত থাকতে এবং ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ব্র্যাক জেপিজিএসপিএইচের সহযোগী বিজ্ঞানী আবু আহমেদ শামীম, বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহিনুর ইসলাম, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের (জিএআইএন) প্রকল্প ব্যবস্থাপক নন্দিনী চৌধুরী, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের (বিইওএল) ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মোহাম্মদ ফকরুজ্জামান, মেঘনা গ্রুপের পরামর্শক মো. শফিউর রহমান, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরামর্শক মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।