প্রযুক্তিশিক্ষায় নারীর সমতা অর্জনের পথে অন্তরায় ও উত্তরণের পথ

জিআইজেড বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রযুক্তিশিক্ষায় নারীর সমতা অর্জনের পথে অন্তরায় ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২১ মার্চ। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এ ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো। এ আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউএন উইমেন ও ডেভটেল পার্টনার্স।

অংশগ্রহণকারী

চার্লস হোয়াইটলি

রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধি দলের প্রধান,ইউরোপীয় ইউনিয়ন

রাশেদা কে চৌধূরী

নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা

রুবানা হক

উপাচার্য, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন

লাফিফা জামাল

অধ্যাপক, রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তাহমিনা ইয়াসমিন

যুগ্ম সচিব, এনার্জি ডিভিশন

ড. ফ্র্যাংক ফেচার

কো–অর্ডিনেটর, এনার্জি প্রোগ্রাম, জিআইজেড বাংলাদেশ

দিলরুবা হায়দার

প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, ইউএন উইমেন

সামি আহমেদ

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্টার্টআপ বাংলাদেশ

কানিজ ফাতেমা

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিডিওএসএন এবং পরিচালক, বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি

নাহিদ শারমিন

জেন্ডার স্পেশালিস্ট, এটুআই

তনুজা ভট্টাচার্য

এনার্জি স্পেশালিস্ট, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক

ফারজানা রহমান

এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইডকল

মো. আরিফ রায়হান মাহি

চিফ ইমপ্যাক্ট অফিসার, ডেভটেল পার্টনার্স

অনন্যা রুবাইয়াত

অ্যাডভাইজার, এনার্জি প্রোগ্রাম, জিআইজেড বাংলাদেশ

 

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

 

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

সুপারিশ

  • নারীদের প্রযুক্তিশিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার জন্য অগ্রাধিকার দিতে হবে।

  • কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমান অংশগ্রহণের জন্য নিয়োগ ও অগ্রগতি পর্যালোচনায় প্রক্রিয়াকে সংস্কার করা দরকার।

  • বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

  • জ্বালানি খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে তার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই।

  • নেতৃত্বদানের দক্ষতা বিকাশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ও কর্মক্ষেত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা দরকার।

  • প্রযুক্তিশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের চিত্র গবেষণার মাধ্যমে তুলে ধরা জরুরি।

  • জেন্ডার বাজেট প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি ও বাজেট বাস্তবায়নে জোর   দিতে হবে।

  • প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ও জেন্ডার স্টেরিওটাইপ দূর করতে মিডিয়ার ভূমিকা জোরদার করতে হবে।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ‘প্রযুক্তিশিক্ষায় নারীর সমতা অর্জনের পথে অন্তরায় ও উত্তরণের পথ’। প্রযুক্তিশিক্ষায় এখনো আমাদের দেশে নারীর অংশগ্রহণ কম। পেশাক্ষেত্রেও কম। আমরা এর পরিবর্তন চাই। এটি পরিবর্তনে কী করণীয়, তা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

দিলরুবা হায়দার

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। এ বছর জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের (সিএসডব্লিউ) ৬৭তম সভার বিষয়ও ছিল প্রযুক্তি নিয়ে। ১৮১টি সদস্য দেশ ও পর্যবেক্ষক এতে অংশগ্রহণ করে। জাতিসংঘের মহাসচিবও ডিজিটাল ডিভাইডের কথা বলেছেন।

জেন্ডার সমতা খুবই জরুরি একটি বিষয়। ২০৫০ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চাকরি স্টেম এডুকেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। বিশ্বব্যপী প্রযুক্তি খাতে নারীরা এক–তৃতীয়াংশের কম কর্মরত। এখানে ২১ শতাংশের মতো জেন্ডার পে–গ্যাপ (বেতনের ব্যবধান) রয়েছে এবং ৪৮% নারী কর্মক্ষেত্রে হয়রানির স্বীকার হন। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের মালিকানায় ২৯ শতাংশ জেন্ডার গ্যাপ রয়েছে। আর মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারে জেন্ডার গ্যাপ রয়েছে ৫২ শতাংশ। নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ঠিকই, তবে তা পুরুষদের তুলনায় কম।

আমরা বিশ্বাস করি, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন উন্নয়ন, মানবাধিকার ও নারীর অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর। করোনা মহামারির সময় আমরা দেখেছি, ডিজিটাল ডিভাইড অনুধাবন করেছি। নারীদের তথ্যপ্রাপ্তি, প্রণোদনা প্যাকেজ, টিকাকরণ কর্মসূচিতে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিশোরীরা অনলাইন ক্লাস করতে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে ডিজিটাল মাধ্যমের বিকাশের প্রতি দায়বদ্ধ। ডিজিটাল ডিভাইড দূরীকরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক ফোরামে ২০৪১ সালের মধ্যে প্রযুক্তি স্টার্ট আপ এবং ই-কমার্স সেক্টরে জেন্ডার সমতার অঙ্গীকার করেছেন।  প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় নারী–পুরুষের সমতার কথা ভাবতে হবে। আমাদের স্টেম শিক্ষা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। এ জায়গায় জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন।

ড. ফ্র্যাংক ফেচার

‘নারীবান্ধব উন্নয়ন নীতি’ গ্রহণ করেছে জার্মান সরকার। এই নীতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্তি এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সংগত সমাজ তৈরিকে প্রাধান্য দেয়। যেহেতু জিআইজেড বাংলাদেশ জার্মান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে থাকে, তাই আমাদের লক্ষ্য থাকে উন্নয়ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্যের কাঠামো ও পদ্ধতিগত কারণগুলো মোকাবিলা করা।

২০০৪ সাল থেকে জিআইজেড বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে কাজ করছে। পেশাজীবী বা উদ্যোক্তা হিসেবে যাঁরা এই খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের বেশির ভাগেরই প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্থার মানবসম্পদের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে নারী ও পুরুষ কর্মীর সংখ্যায় ভারসাম্যহীনতা প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নেতৃত্ব পর্যায়ে এই বৈষম্য আরও বেশি। কোনো দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি আয়োজনের সময় যদি আলাদাভাবে নারী প্রশিক্ষণার্থী অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি আমরা উল্লেখ না করি, তখন ৫ শতাংশের কম অংশগ্রহণ পাওয়া যায়। এই ভারসাম্যহীনতা সরকারি-বেসরকারি বহু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, যদিও আপাতদৃষ্টে তাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া পক্ষপাতহীন।

ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রযুক্তি ও প্রকৌশলশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই বছর আগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে টেকসই জ্বালানি নিয়ে একটি উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। সেখানে বিজয়ী দলগুলোতে প্রচুর ছাত্রী ছিল, এমনকি একটি বিজয়ী দলে সব সদস্যই ছিলেন নারী। এটা প্রমাণ করে, নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহের বা মেধার কোনো    অভাব নেই।

জিআইজেড বাংলাদেশ থেকে আমরা জ্বালানি খাতে নারী পেশাদারদের জন্য এমনভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করতে চাই, যাতে তাঁরা অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশে সৃজনশীলভাবে নিজেদের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পান। শিক্ষা থেকে ক্যারিয়ার জীবনের রূপান্তরের সময়টায় ঠিক কী ধরনের সহযোগিতা পেলে প্রযুক্তিগত পেশা বেছে নিতে নারীরা আরও আত্মবিশ্বাসী হবেন, তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি এ ধরনের কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কী ধরনের কাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন, তা–ও আমাদের ভাবতে হবে।

লাফিফা জামাল

আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পড়ি, তখন ২০ জনের মধ্যে মাত্র ৩ জন নারী শিক্ষার্থী ছিলাম। একইভাবে ২০১৬ সালে আমি রোবোটিকস বিভাগের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিই, আমাদের প্রথম ব্যাচের ১৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩ জন ছিলেন নারী। এখন আমরা ২৫ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়তো ৫ জন নারী শিক্ষার্থী পাই। তবে প্রকৌশল বিষয় ছাড়া স্টেমভুক্ত অন্য বিষয়, যেমন উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি। পরিসংখ্যান বলছে, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নারী স্টেম বিষয়ে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তা দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশে। এ জায়গাও বড় একটি ফারাক তৈরি হচ্ছে। সুতরাং আমি মনে করি, ছোটবেলা থেকেই নারী শিক্ষার্থীদের স্টেম এডুকেশনের আগ্রহ তৈরি করা উচিত। অভিজ্ঞতামূলক শিক্ষা আমাদের শিক্ষাক্রমে যুক্ত হয়েছে। এটি স্টেম এডুকেশনে ভীতি কমাতে সাহায্য করে। এ জন্য স্কুল পর্যায় থেকেই এর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের বিদ্যমান সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটি শিশুর বেড়ে ওঠার সময় তাকে যে খেলনা দেওয়া হয়, তার মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। মেয়েশিশুকে কিনে দেওয়া হচ্ছে পুতুল বা হাঁড়িপাতিল, যেখানে ছেলেশিশুকে দেওয়া হচ্ছে ফুটবল বা গাড়ি। ছেলেশিশু হলে আমরা বলি সে প্রকৌশলী হবে। কিন্তু মেয়েশিশুর বেলায় এটি তুলনামূলকভাবে কম বলি।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পর এসএসসিতে একজন শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগের যেকোনো একটিতে ভর্তি হতে হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বড় ভূমিকা রয়েছে। আমরা গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, গ্রামাঞ্চলের নারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে গেলে খরচ বেশি হয়। মা–বাবা ছেলেসন্তানের পড়াশোনায় আর মেয়েদের বিয়ের জন্য বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। এই জায়গায় দেখা যায়, মা–বাবা খরচের কথা ভেবে তাঁর মেয়েকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে চান না। এর ব্যতিক্রমও অবশ্যই আছে। তবে পুরো দেশের মোটামুটি চিত্র এমনই। এ জায়গাগুলো আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

তনুজা ভট্টাচার্য

আমি একজন প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থী। আমি বলব সমতা অর্জনের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে সদিচ্ছার অভাব। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জেন্ডার সমতার সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য আছে কি না, আমি জানি না। এ কারণেই হয়তো এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎও জ্বালানি খাত এসডিজি-৭ সাপেক্ষে তাদের অর্জনগুলো ব্যাখ্যা করলেও এসডিজি-৫ অর্থাৎ জেন্ডার সমতার সাপেক্ষে তাদের অবস্থান বা অর্জন লিপিবদ্ধ করেন না। একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে জেন্ডার সমতা আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও প্রযুক্তিশিক্ষায় জেন্ডার সমতা অর্জনের বিষয়টা এখনো বিবেচনার বাইরে। প্রযুক্তিশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম বা প্রকৌশলবিদ্যায় কায়িক শ্রমের প্রয়োজনই বেশি—এ রকম অনেক ভ্রান্ত ধারণা চর্বিতচর্বণ করে বিষয়টির গুরুত্ব ও করণীয় বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। এ খাতে আগামী দিনে মাইলফলক হবে বিদ্যুৎ সরবরাহের গুণগত মান, কারিগরি দক্ষতা ও উৎকর্ষ নিশ্চিত করার ওপর। বিদ্যুৎখাতের আধুনিকীকরণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে নতুন ধরনের কর্মকৌশল ও কাজের সুযোগসৃষ্টি হবে। টেকসই ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ অবকাঠামোর জন্য চাই নতুন ধরনের প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির রোডম্যাপ।

বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ক্লিন এনার্জি ট্রান্সিশনের ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি কর্মসংস্থানতৈরি হবে। নেট মিটারিংয়ের মতো নীতিমালা ভোক্তার জন্য বিনিয়োগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগও তৈরি করছে। এই সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে আমরা এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ কীভাবে দেখতে চাই, সেটাই বড় প্রশ্ন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মহাপরিকল্পনা যদি নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়ে উদাসীন থাকে, তাহলে এ খাতের উন্নয়ন ও অর্জনই বিলম্বিত হবে।

অনন্যা রুবাইয়াত

প্রযুক্তি শিক্ষা শুনলে আমরা প্রথমেই ভাবি প্রকৌশল বা তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার কথা। তবে বাংলাদেশে কারিগরি ও কর্মমুখী প্রযুক্তি শিক্ষাতেও নারীদের অংশগ্রহণ অনেক কম। ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা পলিটেকনিকগুলোর তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, মেয়েদের ভর্তির হার কম এবং এ সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রগুলোতে তাঁদের উপস্থিতি আরও কম।

বাংলাদেশে শিল্পায়নে প্রাধান্য বাড়ছে এবং শিল্পায়নে প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে, যার জন্য বিপুলসংখ্যক দক্ষ কারিগরিজ্ঞানসম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এর ফলে দেশের সব প্রান্তে বিভিন্ন রকম নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হবে। এই উদীয়মান খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে।

নারীদের জন্য পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়াতে হবে ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামকে হালনাগাদ করে দেশ–বিদেশের চাহিদা অনুসারে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধে৵ যোগাযোগ স্থাপন করে নারী শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ তৈরি করতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাইলে যাতে তা পারেন, তেমন প্ল্যাটফর্মও তৈরি করা প্রয়োজন। সব স্তরে এমন পরিবর্তন আনতে না পারলে আমাদের টেকসই উন্নয়ন এবং এনার্জি ট্রান্সিশান অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে উঠবে না। 

কানিজ ফাতেমা

মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখছি, তথ্য প্রাপ্তি, স্মার্ট ডিভাইস ও ইন্টারনেট এক্সেসের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিভাইড রয়েছে। নারীদের ইন্টারনেটে এক্সেস নিশ্চিতে প্রতিটি শিক্ষাস্তরে একটি পলিসি করা প্রয়োজন। স্টেম এডুকেশনে বা প্রযুক্তি খাতে মেয়েরা ভালো করবেন না, এ রকম একটি ধারণা সমাজে বিদ্যমান। আমরা চিকিৎসক বললেই ধরে নিই নারী আর প্রকৌশলী হলে পুরুষ। এসব বিষয়ে আমাদের সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময়ে প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেসব দক্ষতা চাওয়া হয়, তাতে প্রথাগত একাডেমিক নিয়মের মধ্য দিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। কেউ যদি নিজের মতো করে তাঁর দক্ষতা উন্নয়ন করতে পারেন, তাহলে তিনি সফল হবেন।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেখানে পর্যাপ্তসংখ্যক ডে–কেয়ার সেন্টার নেই। শিশুকে রেখে বা পরিবারের কাজ দেখাশোনা করে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া নারীদের জন্য একটি বড় বাধা। করোনা মহামারির পর এখন ঘরে বসে অফিস করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুতরাং কোনো নারী যদি প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন, তাহলে তিনি ঘরে বসেই ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিংয়ের মতো কাজ করতে পারেন। এ–সংক্রান্ত ইতিবাচক দিকগুলোকে গণমাধ্যম তুলে ধরতে পারে।

ফারজানা রহমান

ইডকল সরকারি মালিকানাধীন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করে থাকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নেও এই প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান যাদের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযুক্তি দল রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই দলে নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য নয়।

প্রযুক্তিনির্ভর প্রকল্পে নারীদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করেও নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারি না। ফলে নারীদের জন্য প্রণয়ন করা অনেক প্রকল্পই আলোর মুখ দেখে না। বিভিন্ন বিনিয়োগে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে নারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি হলেও অনেক সময় যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। ভবিষ্যতে জ্বালানির রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং তা বেশির ভাগই প্রযুক্তিনির্ভর হবে। তাই স্নাতক পর্যায়ে আরও নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারলে নতুন কর্মসংস্থান শুধু বৈষম্যই বৃদ্ধি করবে। এই বিষয়ে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।

মো. আরিফ রায়হান মাহি

প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার আগে আমাদের জানতে হবে স্নাতক পর্যায়ে কত শতাংশ নারী ভর্তি হন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক থেকে কেন একটি বড় অংশ স্নাতক পর্যায়ে অন্য বিষয় বেছে নেয়, তা জানতে হবে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিয়মিত তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে।

প্রযুক্তিগত শিক্ষায় আগ্রহের বিষয়টি অনেকাংশেই নির্ভর করে ইন্ডাস্ট্রির ওপর। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠান নারী প্রকৌশলীদের কর্মী হিসেবে নিতে আগ্রহ দেখায় না। এর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে প্রযুক্তিশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ওপর। তা ছাড়া চাকরিতে অগ্রগতিও একটি বড় নিয়ামক। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা পর্ষদে ১ শতাংশেরও কম নারী প্রতিনিধি সুযোগ পান। কর্মক্ষেত্রে নারীদের পেশা মূল্যায়নে একটি সংস্কার প্রয়োজন।

আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের নেতৃত্বদানের গুণাবলি বিকাশের সুযোগ পুরুষের তুলনায় কম। সামাজিকভাবে একজন পুরুষ যেসব নেটওয়ার্ক, কাজ ও সামাজিক সম্পর্ক তৈরির সুযোগ পান, একজন নারী তা তুলনামূলকভাবে কম পান। তাই শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন ধাপে এমনকি চাকরিজীবনের শুরুতে নারীদের নেতৃত্বদানের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। সম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে দক্ষ নারী নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা ‘শক্তিকন্যা’ শীর্ষক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে দেখেছি, এ খাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সুফল পেতে শুরু করেছে। তাই এ ধরনের আয়োজন চলমান রাখা জরুরি। 

নাহিদ শারমীন

সারাদেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে আমাদের ডিজিটাল সেন্টার আছে। সেগুলোতে একজন নারী ও একজন পুরুষ উদ্যোক্তা কাজ করেন। অনেক জায়গায় নারী উদ্যোক্তারা সক্রিয় নন। আমাদের মূল কাজ তাঁদের সক্রিয় করা। ডিজিটাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আমাদের সেন্টারগুলোতে নারী উদ্যোক্তারা সরকারি ও বেসরকারি ডিজিটাল সেবা প্রদান করে থাকেন। বর্তমানে প্রযুক্তিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য। তা না হলে স্মার্ট বাংলাদেশে আপনি এগোতেই পারবেন না।

সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৭৫ শতাংশ চাকরি ডিজিটাল ও ব্যবহারিক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করবে। ‘ফিউচার অব এডুকেশন’ নামে এটুআইয়ের একটি প্রকল্প আছে, যা মূলত ডিজিটাল শিক্ষা নিয়ে কাজ করে। এর মধ্যে তিনটি উদ্যোগ আছে। এই প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রমে শিশু ও শিক্ষকেরা অংশ নিতে পারেন, এবং বিভিন্ন কোর্স করার সুযোগ ও রয়েছে।

এটুআই-এর একটি ডিজিটাল অর্থনৈতিক সেবা প্রকল্প আছে। এখানে নারীদের কীভাবে যুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে কাজ করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সঙ্গে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তিনটি বিষয় জরুরি। সেগুলো হলো, প্রবেশযোগ্যতা, ক্রয়ক্ষমতা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা। এ তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে পারলে প্রযুক্তি শিক্ষায় সমতা অর্জন করা সম্ভব।

সামি আহমেদ

‘স্টেম এডুকেশন’ বা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-প্রকৌশল ও গণিতসংক্রান্ত শিক্ষা মূল শিক্ষার বাইরের কিছু নয়। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রযুক্তিশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করে এগুলোকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। আমরা ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষকে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৩০ শতাংশ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া। কিন্তু নারীদের অংশগ্রহণ ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি ছিল না। পরে মেয়েদের স্কুল-কলেজগুলোতে গিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়েছিল।

আশা করি,  বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও নারীর অংশগ্রহণ ধীর ধীরে বাড়বে। সোলার, নবায়নযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক যান প্রভৃতি নিয়ে কাজ করা বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। তাদের বিনিয়োগের ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি। এসব বিষয় নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন সামাজিক বাধার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তা হয়ত বিকশিত হতে পারেন না। সরকার উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনাও রয়েছে। এই প্রণোদনা কার্যক্রমগুলোর আরও প্রচার প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের গ্রুমিং নিয়ে যারা কাজ করেন, তারাও তাদের প্রক্রিয়ায় জেন্ডার বিষয়টি নিয়ে আরও সচেতন হতে পারেন।

চার্লস হোয়াইটলি

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশিত She Figures–২০২১ অনুসারে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা কম। যেমন: ভৌতবিজ্ঞান (৩৮.৪%), গণিত ও পরিসংখ্যান (৩২.৫%), তথ্যপ্রযুক্তি (২০.৮%), প্রকৌশল ও প্রকৌশল ব্যবসায় (২৭%), ম্যানুফ্যাকচারিং ও প্রক্রিয়াকরণ (৪০.৯%) এবং স্থাপত্য ও নির্মাণে (৩৭.২%)। এসব ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে নারীদের ওপর শিশু পালনের দায়িত্ব, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীদের আর্থিক সক্ষমতার অভাব। ইউরোপীয় কমিশন জেন্ডারভিত্তিক সমতা নীতি ২০২০-২০২৫ গ্রহণ করেছে এবং জেন্ডার অ্যাকশান প্ল্যান (GAP III) ২০২১–২০২৫  গ্রহণ করেছে।

প্রযুক্তি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ জোরদার করা, নবায়নযোগ্য ও ডিজিটাল রূপান্তরের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য অপরিহার্য। জ্বালানি খাত বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে পুরুষপ্রধান খাতগুলোর মধ্যে একটি। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি কাজের তুলনায় নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি, যা প্রায় ৩২%।

ইইউ এমন একটি জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় যা জ্বালানির কার্যকারিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে দেশের শক্তির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি ইইউ জ্বালানি খাতে জেন্ডার সমতা অর্জন করতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।  ইইউ-জিআইজেড যৌথ অংশীদারিত্বের প্রকল্পের মাধ্যমে এ লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হবে। কর্মসুচিগুলো ফলপ্রসু করতে জেন্ডার-বিভাজিত তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দিতে হবে। প্রকৌশল শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা, নারী উদ্যোক্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের কর্মী এবং গৃহে জ্বালানি ব্যবহারকারী পর্যন্ত সকল নারীই জ্বালানি খাতে পরিবর্তনের মূল চালক হতে পারেন।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেয়েন বলেছেন যে, শীর্ষ পদে নেতৃত্বের জন্য প্রচুর যোগ্য নারী রয়েছেন, তাঁদের সেই সুযোগ পাওয়া উচিত।

তাহমিনা ইয়াসমিন

একটি জরিপে দেখা গেছে, সচিব ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা প্রায় ১১ থেকে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে জ্বালানি বিভাগে প্রায় ৩১ শতাংশ নারীর উপস্থিতি রয়েছে। এখানে কিন্তু খুব বেশি হতাশার চিত্র নেই। জ্বালানি বিভাগে খুব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এবং নারীরা এখানে প্রতিযোগিতা করেই আসতে পারছেন।

তাছাড়া সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে গুরুত্ব দিয়েছে। বেশ কয়েকটি টেকসই লক্ষ্যমাত্রায় নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এই জেন্ডার বাজেট প্রযুক্তিখাতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

চাকরির পরীক্ষাগুলোতে কোটা তুলে দেওয়া হয়েছে। তারপরেও নারীরা প্রতিযোগিতামূলক চাকুরির পরীক্ষায় ভাল করছে। তাই সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে নারীদের অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া নারীদের সামনে সফল উদ্যোক্তা এবং পেশাজীবীদের রোল মডেল হিসাবে নিয়ে আসতে হবে যাতে তারা অনুপ্রাণিত হতে পারেন। এর পাশাপাশি নারীদের বিভিন্ন নেটওয়ার্কে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি এতে করে বিভিন্ন সম্ভাবনা এবং সুযোগ সৃষ্টি হয়। স্নাতক পর্যায় থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত ইন্টার্নশীপ আয়োজন করা উচিত। এতে একাডেমিয়ার সাথে ইন্ডাস্ট্রির সম্পর্ক জোরালো হবে এবং উভয় পক্ষই লাভবান হবে।

রুবানা হক

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ) মূলত মানবিক বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা দুটি মেজর করার সুযোগ দিই। একটি মেজর মানবিক হলে অন্যটি অবশ্যই বিজ্ঞানসংক্রান্ত বিষয় হতে হবে। বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। পঞ্চম শ্রেণি থেকে প্রোগ্রামিং শিক্ষা শুরু করতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএস-৫০ নামে একটি কোর্স আছে। এটি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ ঘণ্টা এই কোর্সের পেছনে ব্যয় করেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এ কাজ করছেন। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এ কাজগুলো করা যেতে পারে।

গুগলে সার্টিফিকেট প্রদান করে এমন কিছু কোর্স আছে। বিনা মূল্যে অনেকগুলো কোর্সও আছে। এগুলো মূলত ছয় মাসের কোর্স হয়। শিক্ষার্থীরা কোর্সগুলো সম্পন্ন করার পর চাকরিযোগ্য হন। চাকরি প্রাপ্তির যোগ্যতার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার একীভূত হওয়া প্রয়োজন।

প্রাথমিক পর্যায় থেকে প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট এমন কিছু কোর্স আমরা তৈরি করতে পারি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-প্রকৌশল ও গণিতসংক্রান্ত বিদ্যা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমরা চাইলে এখনই শুরু করতে পারি।

নারীরা বহুদিন বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছে, আমরা এখন সমতা নয়, অগ্রাধিকার চাই।

রাশেদা কে চৌধূরী

প্রাথমিক পর্যায় থেকে অবশ্যই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত শিক্ষা দেওয়া শুরু করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত শিক্ষার বিষয়ে আমাদের কোনো বৈজ্ঞানিক উপাত্ত নেই। তা হলে কীভাবে পরিকল্পনা করা সম্ভব? জাতিগত সংখ্যালঘু কিংবা বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত শিক্ষায় অনুপস্থিত?

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত শিক্ষার আধেয়গুলোর প্রকৃতি কেমন, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলো কি লিঙ্গ নিরপেক্ষ? নারীদের অংশগ্রহণ প্রচুর। কিন্তু অংশীদারত্ব কি আছে? রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি—সব জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু এদের কজন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে? তাই এ জায়গায় পার্থক্য গড়তে হবে। এই জায়গায় গণমাধ্যমের কাজ করতে হবে।

নারীরা ঘরে বসে কাজ করছে। কিন্তু অনেক নারীর জন্য এটি অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, একই সঙ্গে তাদের ঘরের কাজও সামলাতে হয়। ১৯৭৪ সালের দিকে আমরা ‘সবার জন্য শিক্ষা’ প্রচারণা চালাচ্ছিলাম। অন্যদিকে এনজিওগুলো সাক্ষরতা অভিযান চালাচ্ছিল। সে সময় বছরে তিন ফসলসংক্রান্ত কর্মসূচি চলছিল। এর কারণে নারীদের অতিরিক্ত কাজ করতে হতো। এত কিছুর মধ্যে অবসর সময়ে নারীদের এসব জায়গায় আসতে বলাটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয় ছিল। সে জন্য আমরা ভারসাম্য রক্ষার কৌশল গ্রহণ করেছিলাম। আজকের দিনেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচনায় উত্থাপিত সুপারিশগুলো নীতিনির্ধারকেরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবেন বলে আশা করা যায়। গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।