নির্বাচনী ইশতেহার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ক্রিশ্চিয়ান এইড  ও প্রথম আলোর আয়োজনে  ‘নির্বাচনী ইশতেহার ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৪ নভেম্বর ২০২৩। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

সঞ্জীব দ্রং

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম

নুজহাত জাবিন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ

কাজী মারুফুল ইসলাম

অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এস এম মাসুম বিল্লাহ

অধ্যাপক ও ডিন, আইন অনুষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সানজিদা আখতার

অধ্যাপক, উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা

সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

জয়া শিকদার

প্রেসিডেন্ট, সম্পর্কের নয়া সেতু

মো. তাজুল ইসলাম

অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ওয়াসিউর রহমান

সমন্বয়ক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেরশন

তামান্না সিং বারইক

দলিত ও চা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি

আঞ্জুম নাহীদ চৌধুরী

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন,  ক্রিশ্চিয়ান এইড

মাহেনুর আলম চৌধুরী

প্রকল্প ব্যবস্থাপক, ক্রিশ্চিয়ান এইড

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

 

সুপারিশ

  • রাজনীতির মূলধারায় প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসতে হবে।

  • বিভিন্ন আইন ও নীতিতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

  • সংখ্যালঘু কমিশন ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

  • ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের ভূমি অধিকার সমস্যার সমাধান জরুরি।

  • ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করতে হবে।

  • প্রান্তিক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, এমন কোনো উন্নয়নপ্রক্রিয়া হাতে নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সম্মতি নেওয়া দরকার।

  • শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সুবিধা প্রদান করতে হবে।

  • স্মার্ট বাংলাদেশের সুবিধা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কীভাবে নেবে, সে বিষয়টি নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা প্রয়োজন।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

দেশে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ রয়েছেন। বিশেষ করে সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও দলিতরা শিক্ষাক্ষেত্রে কিংবা সামাজিকভাবে অনেক কম সুযোগ-সুবিধা পান। তাঁদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এক অর্থে আছে, আবার স্বীকৃতি থাকলেও তা ততটা কার্যকর হয় না। আমরা চাই এসব মানুষ যেন সাধারণ মানুষের মতোই সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন।

নুজহাত জাবিন

আমরা পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছি। পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলতে আমরা বুঝিয়েছি দলিত জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রূপান্তরিত ও হিজড়া জনগোষ্ঠী, চা–শ্রমিকসহ প্রতিবন্ধকতার শিকার জনগোষ্ঠীকে। আমাদের এ প্রকল্পে মেয়াদ সাড়ে তিন বছর, যার মধ্যে দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে পিছিয়ে পড়া এসব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের মধ্যে ক্যাপাসিটি তৈরি করা, তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও পলিসি অ্যাডভোকেসি করা, যেন তাঁদের বিষয়গুলো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আসে।

দেশে এখনো অনেক আইন আছে, যেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে না। এ জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সামনে আনা যায়, এ বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করা আমাদের প্রকল্পের উদ্দেশ্য। সামনে আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা করে সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে যেন আসে, সে উদ্যোগ নিতে হবে। ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেগুলোও দেখা জরুরি।

মাহেনুর আলম চৌধুরী

গোলটেবিল আলোচনার প্রতিপাদ্য হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দাবি সংযুক্ত করা। ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ’ প্রকল্পটি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়ে তিন বছর অতিক্রম করছে। রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট বিভাগের ৮টি জেলায় ও ৭৩টি উপজেলায় এ প্রকল্প কাজ করছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনেও আমাদের সামান্য কিছু কাজ রয়েছে। এ প্রকল্পের মূল জনগোষ্ঠী হচ্ছে দলিত, রূপান্তরিত ও হিজড়া, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।

সরকারের বিভিন্ন সুবিধা যেন পিছিয়ে পড়া এসব মানুষ গ্রহণ করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই আমরা সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন রকম অ্যাডভোকেসি করে থাকি। আমরা সুশীল সমাজ ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করি। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পিছিয়ে পড়া মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও আমরা কাজ করি।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এ ছাড়া ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যেসব ক্ষেত্রে বৈষম্য হচ্ছে, তার কিছুটা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। জমি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে সুরক্ষার জন্য সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ২২টি জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক আইনে ৫০টি নৃগোষ্ঠীর কথা বলা আছে। ফলে বাকি ২৮টি নৃগোষ্ঠী প্রজাস্বত্ব আইনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তিবিষয়ক অধ্যায়ে সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা হয়নি। জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচির কথা বলা হয়নি। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোনো নির্দেশনা ছিল না।

সরকারি বিভিন্ন জরিপ ও বাজেট বরাদ্দে দলিত জনগোষ্ঠীকে একটি সমরূপ গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করার ফলে এর অধীনে বিভক্ত সব জনগোষ্ঠীর সরকারি সেবা যথাযথভাবে পৌঁছায় না। সরকারি চাকরিতে কর্মরত হিন্দু জনগোষ্ঠীর কতজন দলিত সম্প্রদায়ের সদস্য, সে–সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তাঁদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোটাসুবিধা থাকলেও সেখানে বরাদ্দ খুবই অপর্যাপ্ত। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আসন সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই।

ভোটার তালিকা আইন ও বিধিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে হিজড়াদের কথা বলা হয়েছে। দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর বিভিন্ন ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে জনসমক্ষে উপদ্রব সৃষ্টি, অশ্লীলতা প্রদর্শনের অপরাধে হিজড়া জনগোষ্ঠী শাস্তি ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রেও হিজড়া ও রূপান্তরকামীরা বঞ্চনার শিকার হন।

২০১৯ সালে সরকারি সমন্বিত বিশেষ শিক্ষানীতি ও জাতীয় প্রতিবন্ধী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকারি চাকরির অন্তর্ভুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতাকে অযোগ্যতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থাকলেও অপর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং সঠিক ব্যক্তি চিহ্নিত করা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা মনে করি, নির্বাচনী ইশতেহারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দাবিগুলো তুলে ধরতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে: সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য মর্যাদাপূর্ণ সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা, বিভিন্ন নীতি ও আইনে তাদের নাগরিক অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা। সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করে বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। দলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে হরিজনদের জন্য ৮০ শতাংশ কোটার পূর্ণ বাস্তবায়ন, তাঁদের চাকরি স্থায়ী, বেতন–ভাতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করতে হবে।

হিজড়া ও রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য দণ্ডবিধি ১৮৬০ সংশোধন ও উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি লাভের অধিকার, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ বৃদ্ধিতে বিভিন্ন নীতিতে সংশোধন আনা, বৈষম্য বিরোধ আইন পাস করা এবং সংখ্যালঘু কমিশন ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।

এস এম মাসুম বিল্লাহ

সাম্যের পথ তৈরিতে রাজনীতিবিদদেরও দায় রয়েছে, তা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। তাঁদের জনমুখী রাজনীতি করতে হবে। সমাজের প্রান্তিক মানুষ ও ব্রাত্যজন যেন আমাদের চিন্তা থেকে বাদ না পড়ে যায়, তা খেয়াল রাখতে হবে। গ্রাম ও মানুষকেন্দ্রিক চিন্তা রাজনীতিকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। লড়াকু মানসিকতার মারিয়া মান্দা, সাবিনা আক্তার বা সালমা খাতুনরাই আমাদের শক্তির জায়গা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তারা যুক্তিসংগত কোটা রাখার কথা বলেছিল। তবে সে আন্দোলনের পর কোটার প্রতি একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোটা বাতিল করে, পরে যদিও কিছু কোটা পুনর্বহাল করা হয়। কিন্তু অঙ্গীকারের জায়গায় একটা ক্ষত, বিচ্যুতি তৈরি হয়েছে।

সংবিধানে সমতার কথা বলা হয়েছে। এটি মিশে আছে আমাদের চিন্তাচেতনায়। রথীন্দ্রনাথ রায়ের গানের মতো করে বলতে হয়, ‘আমার এ দেশ সব মানুষের। ছোটদের বড়দের সকলের, গরিবের নিঃস্বের ফকিরের।’ এ দেশটা আসলে সবার। অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র বললে দেশের সব মানুষকেই বোঝায়।

সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী নিয়ে সরকারের দারুণ কিছু পদক্ষেপ আছে। বিধবা ভাতা বা বয়স্ক ভাতার মতো সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী দিয়ে আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার বুঝতে চেয়েছি।

আমাদের সংবিধান শুরু হয়েছে ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ’ দিয়ে। এ তিনটি শব্দের অর্থ অনেক ভারী, বিপ্লব ও উত্থানের। এই শক্তি আমরা টের পাইনি, আমাদের অন্তরের মধ্যেই রয়ে গেছে। এখানে কিছু মানুষ বাংলাদেশের জনগণ হতে পারেননি। তাঁদের অনেকেই প্রান্তিকতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন, তাঁদের কণ্ঠ কেউ শোনে না।

আমাদের রাজনৈতিক দলের যাঁরা ইশতেহার প্রণয়ন করেন, তাঁদের দূরদৃষ্টি প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চুনারুঘাটে যদি শিল্পাঞ্চল করা হয়, সেখানের চায়ের কথা ভুলে গেলে চলবে না। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য সরকারের প্রশংসা করতেই হবে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা এখন জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। গৃহহীন মানুষকে ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগও প্রশংসনীয়।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভূমি অধিকার সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। সেখানেও মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের বণ্টনপ্রক্রিয়ায় নজর দিতে হবে। প্রান্তিক মানুষের প্রতি দরদ না থাকলে তা আইনি কাঠামোয় আসবে না। রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে আনার বিকল্প নেই।

তামান্না সিং বড়াইক

আমি দলিত চা জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য। দলিত জনগোষ্ঠী প্রায় ২০০ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার। পেশাগত স্বীকৃতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন—সব ক্ষেত্রেই আমরা অনেক পিছিয়ে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও আমাদের অনেকে জানেন না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অনেক। অথচ আমাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। পেশার স্বীকৃতি আমরা সেভাবে পাইনি।

আমরা ২০০৮ সালে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে দলিত শব্দটি যোগ করার কথা বলেছিলাম, সেটি করা হয়েছে। হাউজিং বরাদ্দ, বিভিন্ন ভাতা কর্মসূচি ও সরকারি চাকরিতে দলিত জনগোষ্ঠীর কোটাসুবিধার দাবিও জানানো হয়েছিল। কিছু কাজ হলেও অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। আবাসনের বরাদ্দকৃত বাজেট অপ্রতুল।

বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের (বিডিইআরএম) পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ৪২টি রাজনৈতিক দলকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আমাদের দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার প্রদান প্রসঙ্গে চিঠি প্রদান করা হয়েছে। আমরা চাই, সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা হোক। জাতীয় বাজেটে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসন ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি নিয়োগে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা চালু করতে হবে। সরকারি সব নীতিমালায় দলিত সম্প্রদায়কে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

কাজী মারুফুল ইসলাম

আমরা বলছি পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা, তাঁদের দাবিগুলো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে আসুক। এতে তাঁদের সিদ্ধান্তের জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন হয়তো আসবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মূল বক্তব্যে যদি এই পিছিয়ে পড়া মানুষকে না আনা যায়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু অধিকারের প্রশ্নে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেমন, সেটাও দেখার প্রয়োজন আছে।

পিছিয়ে পড়া মানুষের দাবিদাওয়াকে চারটি ব্লকে দেখা যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, তাঁর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব সেবায় তাঁদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, এসব মানুষের কণ্ঠকে জোরালো করার জন্যই যে রাজনৈতিক পরিসর বা পাবলিক স্পেস আছে, সেখানে নিজেদের ন্যারেটিভ তৈরি করার সক্ষমতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি তাঁদের অধিকার লঙ্ঘিত হলে এর প্রতিকারে যে আইনি ব্যবস্থা, সেখানেও তাঁদের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, তাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

পিছিয়ে পড়া মানুষের দাবিদাওয়ার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এসব নিত্যদিনের প্রয়োজন। এসব ছোট দাবি তাঁদের প্রধানতম দাবি হিসেবে পরিণত হয়েছে। কারণ, পরের দিন তাঁরা কোথায় থাকবে তা নিশ্চিত নয়। সুতরাং এসব বিষয়কে কেবল দলিত মানুষের বিষয় হিসেবে আলাদা করে দেখলে হবে না; এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মূল ন্যারেটিভের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তা ও গঠনপ্রক্রিয়ার মধ্যে না প্রবেশ করতে পারলে বড় পরিবর্তন সম্ভব হবে না।

আমার প্রস্তাব হচ্ছে: ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিষয়ে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করতে হবে। সংসদের কার্যবিধি সংশোধনের মাধ্যমেই এটি করা সম্ভব। এর জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই। এই কমিটি কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর  তরুণদের জন্য উদ্যোক্তা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। চা–শ্রমিকসহ অন্য দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যা ইনস্যুরেন্সের মতো কাজ করবে। এটি ব্যবহার করে তাঁরা মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারবে।

ওয়াসিউর রহমান

আমাদের লক্ষ্য আছে ২০২৬ সাল নাগাদ এলডিসি থেকে উত্তরণের। ২০৩১ সালের মধ্যে এসডিজি পূরণের লক্ষ্যমাত্রা আমাদের আছে। এর মধ্যে আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্যবিমোচন হয়েছে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধিসহ অনেক উন্নয়ন হয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের দেশে বহুমাত্রিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে।

ক্ষমতায় থাকা দেশের বড় একটি রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের ইশতেহারের অংশ হিসেবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার কথা বলছেন। এই স্মার্ট বাংলাদেশ প্রক্রিয়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কীভাবে সহজে গ্রহণ করতে পারবে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক বড় বড় জনগোষ্ঠী আছে, যাঁরা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে মোবাইল নেটওয়ার্কও পান না। তাঁরা কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশের সুবিধা কীভাবে নেবেন, সে বিষয়টিও ইশতেহারে থাকা উচিত।

করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ততা সমস্যা প্রান্তিকতা বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বিশেষত নারী ও শিশুরা এর ভুক্তভোগী হচ্ছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা স্পষ্টভাবে ইশতেহারে থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে দলিতদের জন্য বেশ কিছু জায়গায় কোটার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ কম থাকায় ওই পর্যন্ত তাঁরা আসতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সুবিধা প্রদান করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তারা পাবে।

মো. তাজুল ইসলাম

একটি গবেষণা বলছে, সমতলে থাকা ২২টি জনগোষ্ঠীর হাতে ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী মানা হচ্ছে না। এটি নিয়ে কোনো বিধিমালাও হয়নি। ১৯৫০ সালে আইনটি প্রণীত হয়েছিল। বিভিন্ন বিষয়ে ১১টি বিধিমালা হলেও এই বিষয়ে কোনো বিধিমালা এখনো হয়নি। এই আইনের ৯৭ ধারার উপধারা ৮–এ বলা হয়েছে, এই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর যেসব ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জেলা প্রশাসকের। আমরা গবেষণা করতে গিয়ে এই বিষয়গুলো দেখার পর সরকারকে জানাই। তখন আমাদের বলা হয়, আমরা যেন আদালতে রিট করি। এই ভূমিগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষদের ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বিষয়সংক্রান্ত একটি সরকারি পদ ছিল। এই পদটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। এই পদে থাকা ব্যক্তির কাজ ছিল জেলা কমিশনারকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তথ্য জানানো।

এ ছাড়া ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতি অনুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের জন্য নিজেদের ভাষায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একজন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষকের কথা বলা হয়েছে। এদিকে ২০১৯ সালে প্রণীত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালাসংক্রান্ত আইনে এই সুযোগ নেই। কারণ, এখানে ৬০ শতাংশ নারী, ২০ শতাংশ পোষ্য এবং বাকি ২০ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মেধার ভিত্তিতে যে ২০ শতাংশ আছে, সেটি ছাড়া অন্য কারো কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

জয়া শিকদার

সরকারি ভাষ্যে নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গ—এর মানে দাঁড়ায় আমি তৃতীয় একজন কেউ। এই তৃতীয়জনের জায়গায় যেতে চাই না। আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের ইতিহাস ভারতবর্ষে নতুন নয়। মোগল আমল থেকেই তাঁরা ছিলেন। ব্রিটিশরা এসে নানান আইনকানুন দিয়ে ট্রান্স মানুষদের প্রান্তিক করেছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। কিন্তু দেখা গেছে, জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে শিক্ষাগত সনদসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিজড়া জনগোষ্ঠী নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়।

রাষ্ট্র যেহেতু আমাকে নাগরিকত্ব প্রদান করেছে, সেহেতু লিঙ্গ অনুযায়ী আমাকে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সুযোগ দেওয়াও প্রয়োজন। রাষ্ট্র বলছে, ১২ হাজার হিজড়া রয়েছে। কিন্তু কেন তারা এখনো পথে পথে ঘুরছে? কেনই–বা ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছে? আমরা এখনো সরকারি চাকরি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

সানজিদা আখতার

আগামী কয়েক বছর পর ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জনের শেষ সময় চলে আসবে। এসডিজির মূল কথা হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। ইতিমধ্যে আমাদের সরকার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমকে গুরুত্বসহকারে দেখার চেষ্টা করছে। সরকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমস্ত উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, আইনিভাবে আমরা যা গ্রহণ করছি, তা সামাজিকভাবে গ্রহণ করতে অনেক সময় লেগে যায়। আইনে থাকলে প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বড় অসুবিধা দেখা যায়। এ ছাড়া কাঠামোগত, রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক অসুবিধা তো থাকেই। বিশেষত, প্রতিবন্ধী নারীরা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। প্রতিবন্ধী ভাতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কোনো প্রতিবন্ধী নারী তার ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। ভাইয়ের হয়তো মোটামুটি ইটের তৈরি বাড়ি আছে। ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়, তোমার তো বাড়ি আছে, তোমার ভাতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ঘরের মধ্যে যে সে প্রান্তিকতার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে, এগুলো আর দেখা হয় না।

বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান এখন সক্ষমতা অনুযায়ী হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এমন কর্মসংস্থান প্রয়োজন, যেখানে তাঁরা উৎসাহের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। একটি মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় তাঁদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ধাপে ধাপে পরিকল্পনা করতে হবে। কর্মসংস্থান যদি তাদের প্রান্তিক অবস্থানেই রেখে দেয়, তাহলে তো আর হবে না।

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা

দলিতদের একজনকে বলতে শুনেছি, তারা পিছিয়ে থাকে না; বরং তাদের পিছিয়ে রাখা হয়। যখন বলা হয় ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’, তখন মূলত আমরা এক ধরনের পদ্ধতিগত বৈষম্য করি। এই জনগোষ্ঠীকে ‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ বলা হবে, নাকি ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ বলা হবে, সে ব্যাপারে আমাদের আবারও ভেবে দেখা উচিত।

আমাদের দেশে অনেক মেগা প্রকল্প হচ্ছে। এসব প্রকল্প হয়তো আমাকে-আপনাকে সুবিধা দিচ্ছে, আবার অন্য একটি জনগোষ্ঠীর জীবনমান তলানিতে চলে যাচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় ভাসমান ডাব বিক্রেতা, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের মতো অনেকেই ছিলেন। সে মানুষগুলো এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে, সেদিকে আমরা মনোযোগ দিই না।

সুবিধাপ্রাপ্তদের আরও সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে সুবিধাবঞ্চিতদের আমরা ভুলে যাচ্ছি কি না, সে বিষয়টি ভাবতে হবে। হিজড়া ও যৌনপল্লির কর্মীরা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন—এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের আইন বা বিধি সম্পর্কে আমরা কি আলোচনা করেছি? যৌনকর্মীও একজন শ্রমিক। সে–ও ধর্ষণের শিকার হতে পারে। আমরা কি তাদের কোথাও শ্রমিকের মর্যাদা দিয়েছি? তার জন্য কি কোনো নিরাপত্তা আছে? তারও তো একটি মৌলিক নাগরিক অধিকার আছে। তারাও সমাজের অংশ।

সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের মধ্যে কি সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা হচ্ছে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবক্ষেত্রে দায়িত্ব গ্রহণ করে কি? এসব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

সঞ্জীব দ্রং

স্বাধীনতার পর ৫২ বছর কেটে গেলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিম্নগামী হিসেবে দেখার প্রবণতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমাদের যে ব্যবস্থা, সে কারণেও অনেকে বাদ পড়ে গেছে। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক অবিচার হয়েছে। রাষ্ট্রের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক বঞ্চনা বা অবিচার এখনো শেষ হয়নি।

জাতিগত, ধর্মীয় ও পরিচয়গত কারণে যারা সংখ্যালঘু, তাদের জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একটি দেশ কতখানি গণতান্ত্রিক কিংবা মানবিক, সেটির বিচার করা উচিত ওই দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যদি বলে, আমরা এই দেশে ভালো আছি, আমাদের ভালো রাখছে– তবেই বুঝতে হবে এই দেশ মানবিক, গণতান্ত্রিক, সভ্য ও উন্নত।

প্রান্তিক মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, এমন কোনো উন্নয়নপ্রক্রিয়া হাতে নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সম্মতি নেওয়ার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কোনো জাতীয় উদ্যান তৈরি কিংবা পর্যটনসংক্রান্ত কোনো বিষয়—সবকিছুর ক্ষেত্রেই এটি করা প্রয়োজন। জাতিসংঘও একই কথা বলে। কোনো জনগোষ্ঠী যদি সেটি না চায়, তাহলে এ ধরনের কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া যাবে না।

১৯৯২ সালে ভারতে মাইনরিটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। আমাদের দেশেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে একটি বিশেষ জাতীয় নীতি গ্রহণ করা উচিত। আদিবাসীদের জন্য জাতীয় আদিবাসী নীতি গ্রহণ করা উচিত। ওই নীতির মধ্যেই লেখা থাকবে, কাদের উন্নয়ন কীভাবে হবে। এই নীতির বাক্যগুলো হতে হবে খুবই ইতিবাচক ও বিশুদ্ধ।

বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যকার জনসংখ্যা কত—সে–সংক্রান্ত সরকারি তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই ঠিক থাকে না। তাদের জনসংখ্যা কেন কমে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সে জন্য সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা জরুরি। আমাদের দেশে মানুষের যে বৈচিত্র্য, সেটিকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং উদ্‌যাপন করতে হবে।

আঞ্জুম নাহীদ চৌধুরী

আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারীদের অধিকার আদায়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তার  মর্যাদা দান করার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা, দলিত জনগোষ্ঠীর বিভাজিত তথ্য সরকারিভাবে সংগ্রহ করা এবং তাদের উন্নয়ন করার কথা এখানে আলোচিত হয়েছে। প্রতিবন্ধী ও হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়েও বেশ কিছু প্রস্তাব এখানে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা আশা করব, আজকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে উঠে আসবে। আজকের আলোচনা থেকে প্রাপ্ত বিষয়গুলো আসন্ন নির্বাচনে আমাদের প্রকল্পের কর্মস্থলের সব রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্য প্রার্থী ও দলের কাছে লিখিত আকারে পৌঁছে দেব।

ফিরোজ চৌধুরী

সম্মানিত আলোচকদের প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নীতনির্ধারকেরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন এবং নির্বাচনী ইশতেহারে তা অন্তর্ভুক্ত করবেন।