ভবিষ্যতের পানি সুরক্ষা: বরেন্দ্র অঞ্চলের সহনশীলতা বৃদ্ধি

ব্র্যাক ও ওয়াটারএইড বাংলাদেশের আয়োজনে এবং প্রথম আলোর সহযোগিতায় ‘ভবিষ্যতের পানি সুরক্ষা: বরেন্দ্র অঞ্চলের সহনশীলতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। রাজধানীর গুলশানের ক্রাউন প্লাজায় ১৮ মার্চ ২০২৪ এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়ছবি: খালেদ সরকার

অংশগ্রহণকারী

মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী

মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)

ড. আনোয়ার জাহিদ

পরিচালক, ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড

অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন

সহ-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)

ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ড. মো. লিয়াকত আলী

পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন, নগর উন্নয়ন ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি, ব্র্যাক

হাসিন জাহান

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ

মালিক ফিদা এ খান

নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস

ড. নেহরীন মাজেদ

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, পুরকৌশল বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক (ইউএপি)

জাহাঙ্গীর আলম খান

পরিচালক, ডাসকো ফাউন্ডেশন, রাজশাহী

হোসেন ইশরাত আদিব

ডিরেক্টর, আইডিপি ও ওয়াশ, ব্র্যাক

সঞ্চালনায়

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

হাসিন জাহান

হাসিন জাহান

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ

আমরা দেশের জলবায়ু ভঙ্গুরতার কথা বলতে গেলেই উপকূলীয় এলাকার কথা সর্বাগ্রে বলে থাকি। কিন্তু বরেন্দ্র এলাকা অনেক কম গুরুত্ব পায়।

বরেন্দ্র অঞ্চলে ৩০ বছর আগে ‘তারা’ টিউবওয়েল দিয়ে কাজ শুরু হয়। এরপর যখন তারা টিউবওয়েল কাজ করছিল না, তখন এল ‘তারা দেব’। নতুন প্রযুক্তি এল, আমরা খুশি। এখন তারা দেব কাজ করে না। আমরা কাজ চালাই সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে। পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরাও নতুন প্রযুক্তি পেয়ে খুশি হয়ে যাচ্ছি, ফলে ফিরে তাকাচ্ছি না। এটি একটি বড় সমস্যা।

বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ যেমন সেচের জন্য পানি উত্তোলন করছে, পাশাপাশি বেসরকারি কিছু উদ্যোক্তাও একই কাজ করছেন। একসময় বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ সেচের পাশাপাশি তার গ্রাহকদের খাওয়ার পানিও সরবরাহ করেছে। এ পানি তারাই পেত, যারা সেচের পানি কিনেছে। ফলে অর্থাভাবে যারা সেচের পানি কিনতে পারেনি, তারা খাওয়ার পানিও পায়নি।

অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষ, যাদের মধ্যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষজন আছেন, তাঁরা পানি পাচ্ছেন না। নিজের নাগালের মধ্যে পানি না পাওয়ার অর্থ হচ্ছে আমরা এসডিজি ৬ অর্জন করতে পারব না। পানির সংকটের কারণে ছেলেরা যেখানে সেচের পানি তোলা হয়, সেখানে গোসল করে। কিন্তু মেয়েরা বাধ্য হয়ে তলানিতে পৌঁছে যাওয়া নোংরা পুকুরের মধ্যেই গোসল করতে বাধ্য হয়।

এসব অঞ্চলে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে খাওয়ার পানি জনপ্রিয়তা পায়নি। কিন্তু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি দেখা যায়। এ বিষয়টি আমাদের আরও অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখা উচিত।

বরেন্দ্র প্রকল্পের সেচদক্ষতা ৫০ শতাংশ। বাকি অর্ধেক পানি কিন্তু কীটনাশক নিয়ে গড়িয়ে পড়ে অন্যান্য পানির উৎসকে দূষিত করছে।

একটা সময় ধীরে ধীরে ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করছে। সুতরাং বরেন্দ্র এলাকার এই প্রকল্প কেবল পানি উত্তোলন করেই আমাদের বিপদে ফেলছে তা নয়, তারা পানির উৎসকেও দূষিত করছে।

মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী

মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী

মহাপরিচালক, পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো )

বরেন্দ্র অঞ্চলে ৮৭ শতাংশ উঁচু জমি। আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মিলিমিটার। অথচ পূর্বাঞ্চলে পাঁচ হাজার মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টি হলে তা স্রোত হিসেবে গড়িয়ে চলে যায়, সংরক্ষণ করার কোনো সরকারি বা বেসরকারি সুবিধা নেই৷ আমাদের চিন্তা করতে হবে দ্রুততম সময়ে কীভাবে এর সমাধান করা যায়।

আমরা যখন প্রকল্প করেছি তখন পানি বিধিমালার নামকরণ করেছি অপারেশনালাইজেশন আইডব্লিউএম। আমরা ২০২০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এ প্রকল্প করি। গত বছরের ২৫ জুন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীসহ পানি খাতের অনেক বিশেষজ্ঞ কিছু সুপারিশ করেছিলেন। সুপারিশ প্রণয়নের আগে আমরা প্রকল্পের মাধ্যমে দেখেছি, বরেন্দ্রভূমিতে ২১৫টি ইউনিয়ন রয়েছে, যার ৮৭টি ইউনিয়ন উচ্চ মাত্রার স্ট্রেস অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। এর ৪১ শতাংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি খুবই জটিল আকার ধারণ করবে।

আমাদের দেশে দুটি অঞ্চল সমস্যাগ্রস্ত। এর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লবণাক্ততা ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পানির স্বল্পতা। সমাধানের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত কর্মশালায় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবনা আমাদের দেন। এ এলাকায় ৮ হাজার ২০০ পুকুর রয়েছে৷ এ সংখ্যা কম নয় কিন্তু। এসব পুকুরের অধিকাংশই সরকারের বেদখলে রয়েছে। ৮টি উপজেলার ৪১ শতাংশ মানুষ এখন খাওয়ার পানি পাচ্ছে না। এ সংকট নিরসনকল্পে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, যেন এসব এলাকায় সুনির্দিষ্ট পুকুর শনাক্ত করা হয়। এসব পুকুরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিতে হবে, যেন এগুলো খাওয়ার পানির জন্য ও গৃহস্থালির ব্যবহারের জন্য। এ পানি যেন ভূগর্ভে না গিয়ে কিছুটা সময় এখানে থাকে, সে জন্য আমাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রতিটি উপজেলায় খাওয়ার পানির জন্য ও গৃহস্থালির ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করে একটি করে খাল সংরক্ষণ করতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এটি বাস্তবায়ন করবে। ম্যানেজড অ্যাকুইফার রিচার্জ (মার) কৌশলের কথা আলোচনায় এসেছে। এটি খুবই কঠিন, কিন্তু একে আমরা আমাদের প্রকল্পে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। এটি তিনটি জেলায় ছিল। বরেন্দ্রভূমির আরও ১৩টি জেলা কিন্তু বাকি রয়ে গেছে। এখানে আমরা আরেকটা প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এতে আমরা ভূগর্ভস্থ পানি পরিমাপ করব না, স্ট্রেস অঞ্চল নির্ধারণ করব না, প্রাপ্যতা দেখব না। আমরা এগুলো ছাড়া কীভাবে কার্যকর সমাধান বের করা যায়, তার চেষ্টা করব।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বরেন্দ্র অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তার চেয়ে পানি নিরাপত্তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক কেজি ধান উৎপাদন করতে ৩ হাজার ২০০ লিটার পানি ব্যবহার করতে হয়। শ্যাডো দাম হিসাব করলে এক কেজি ধানের দাম পড়বে কয়েক হাজার টাকা।

পানি খাতে শাসনের সীমাবদ্ধতা আমরা স্বীকার করি। এটি পূরণ করার জন্য সারা দেশেই আমরা প্রকল্প নিচ্ছি। আমরা ডিস্টেন্স সাপোর্ট সিস্টেম চালু করব। এর মাধ্যমে আমরা প্রযুক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারি। পানি খাতে কোনো স্টার্টআপ নেই। এ খাতে কিছু স্টার্টআপ থাকলে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির ব্যবস্থা করা যেত।

পানি বিধিমালায় পানি সরবরাহ র‍্যাঙ্কিংয়ের কথা বলা আছে। আমাদের আগে খাওয়ার পানি দিতে হয়, তারপর বাসাবাড়িতে। এরপর আসে কলকারখানা ও অন্যান্য খাতে। এ রকম ১২টি ক্রম রয়েছে।

আমাদের দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়াটার পলিসি নেই। আমরা এটি করার চেষ্টা করছি, খসড়া করাও হয়ে গেছে। ইন্ডাস্ট্রি খাতে অনুমতি ছাড়া অনেক পানি ব্যবহৃত হয়। এখন থেকে এ খাতে পানি ব্যবহারের আগে আমাদের অনুমতি নিতে হবে। আমাদের উপাত্ত কম, তাই কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এ জন্য আমরা সারা দেশে স্টাডি করব।

ড. মো. লিয়াকত আলী

ড. মো. লিয়াকত আলী

পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন, নগর উন্নয়ন ও দুর্যোগ ঝুঁকি

ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি, ব্র্যাক

আমরা সবাই জানি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সবার প্রথমে ঝুঁকিতে পড়বে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা। এরপরেই আসবে পানি নিরাপত্তার বিষয়টি।

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নামার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ যেমন দায়ী, তেমনি আমাদের অব্যবস্থাপনাও দায়ী। কারণ, আমরা যতগুলো করার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি টিউবওয়েল স্থাপন করেছি। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি কম, এটা সত্যি। কিন্তু সেখানে যারা পানি বণ্টন করে, তাতেও একটা অরাজকতা দেখা

যায়। টাকা নিয়েও পানি না দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

মাঠপর্যায়ে আমরা সেই সব মানুষ নিয়েই কাজ করি, যারা অবহেলিত, নিগৃহীত। আমরা কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন চাই না। বরেন্দ্র অঞ্চলে কাজ করতে গেলে আইডব্লিউআরএম ধারণা ছাড়া কোনো কাজ তেমন সুফল বয়ে আনতে পারবে না।

ওয়াটার ডাইভারসিফিকেশন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। কারণ, ছোট পর্যায়ে কাজ হচ্ছে, কিন্তু কিছু বড় প্লেয়ারের ভূমিকা শক্তিশালী না করা হলে এ বড় সমস্যা সমাধান করা কষ্টসাধ্য। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

গত বছর সাপাহারে আমরা গভীর করে একটি পুকুর খনন করেছি। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে চেয়েছি বৃষ্টিপাতের পানি কতটা ধরে রাখা যায়। বৃষ্টিতে পুকুর ভরেছে এবং তা দিয়ে ধান ছাড়া অন্য কিছু ফসলে সেচ দেওয়া হয়। আমার পরিকল্পনা ছিল পুকুর করার পর নিচে পলিথিন দেব, যাতে বাষ্পায়ন ছাড়া আর কোনো পানি না হারায়। এখনো পুকুরটিতে সাড়ে তিন ফুটের মতো গভীরে পানি আছে। কিছুদিন পর হয়তো এ পানিটুকুও থাকবে না। এটি সফল হলে অন্যত্রও এ পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।

২০ থেকে ২৫ বছরে জলবায়ুগতভাবে পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা বিবেচনায় রেখে আমাদের পরিকল্পনা করতে হবে। ধান চাষের বিকল্প আমাদের ভাবতে হবে।

অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন

অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন

সহ-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)

আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকাগুলো যতটা গুরুত্ব পায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় খরাপ্রবণ এলাকা সেভাবে গুরুত্ব পায় না।

ওয়ারপোর ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পানির স্তর এক দিনে নামেনি, ধীরে ধীরে নেমেছে। ৭১ শতাংশ এলাকার পানি নেমে গেছে। রাজশাহীর তানোরে ১১৩ ফুট পর্যন্ত পানি নেমে গেছে। ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় সে পানি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু প্রকল্পে আমরা দেখেছি বাড়ির আশপাশে ছোট গর্তগুলোতে পানি ধরে রেখে তা সবজি চাষে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে এনজিও এটি বাস্তবায়ন করছে, তারা বলছে কম সেচের আবাদ আমাদের বাড়াতে হবে। কম সেচে আবাদ বলতে আমরা কী বুঝি, সে ধরনের ধান উৎপাদনের তথ্যটা সেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়নি।

আফ্রিকার কয়েকটি দেশে বড় আকারের খরা সমাধানে ওয়াটার শেড ব্যবহার করেছে। তারা নানাভাবে পানি পুনর্ব্যবহার করে। পানি দিয়ে তাঁরা সবজি বা মাছ ধুয়েছেন, সে পানি তারা আবার গাছে দিচ্ছেন। এ গৃহস্থালি জ্ঞানগুলো আবার নারীদের বেশি আছে। গৃহভিত্তিক এ রকম সমাধানের মতো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কিছু জ্ঞান-অভিজ্ঞতা আছে। আমরা দেখেছি, তারা বাড়ির পুকুর থেকেই সবকিছু করছেন, পানি বিশুদ্ধ করে খাচ্ছেন। তাঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় আবশ্যক উপাদানের মতো করে পুকুরটি আঁকড়ে ধরে রাখেন। এ রকম ছোট কিছু প্রকল্প আছে। তাঁরা মুষ্টি চাল জমা রাখেন কমিউনিটি লিডারের কাছে। যখনই খরার সময় আসে, ফসল থাকে না, তখন সবাই তা বণ্টন করে নেন। আবার ১০ টাকা করে জমা রাখেন, যা খরার সময় পানি আনার কাজে ব্যবহৃত হয়। তাঁরা আমাদের মতো বড় পরিসরে না দেখে ছোট ছোট পরিসরে ওয়াটার মাইনিং করছেন। কাজগুলোকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। লোকায়ত ও বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের মাধ্যমে বড় সমাধান আসবে। আরও বেশি সাফল্য আসবে।

ড. আনোয়ার জাহিদ

ড. আনোয়ার জাহিদ

পরিচালক, ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তর, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশের হাইড্রোলজিক্যাল বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছে৷ বরেন্দ্র অঞ্চল পানিসম্পদের প্রাপ্যতা ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে নাজুক অবস্থায় আছে৷ বাংলাদেশের মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা বলে থাকি, আগের বছর যে পরিমাণ পানি বৃষ্টি বা নদীনালা থেকে জমা হবে, তার বেশি পানি তোলা যাবে না।

আমরা সম্প্রতি প্রায় ৩৮ বছরের উপাত্ত নিয়ে একটা গবেষণা করেছি। সেখানে দেখা গেছে, প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্থায়ীভাবে নেমে যাচ্ছে। কোথাও মিলিমিটার স্কেলে নামছে, আর ঢাকায় তা আড়াই থেকে তিন মিটার করে বছরে নামছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে তা প্রায় মিটার স্কেলে নামছে। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে সুপেয় পানি। বরেন্দ্র অঞ্চলে এটি বহু আগে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের প্রথমে সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে হবে। পানের জন্য ৩ থেকে ৪ শতাংশ পানি লাগে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ পাইপের যে টিউবওয়েল বাড়িতে বাড়িতে বসানো হয়, তা কাজ করছে না।

এ সমস্যার সমাধানে একটি বিষয় আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি৷ বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০০ থেকে ২৫০ ফুট নিচে থেকেই কাদার স্তর শুরু হয়েছে। আমরা ৭০০ থেকে ৮০০ ফুট পর্যন্তও বোরিং করে সে কাদার স্তর ভেদ করতে পারিনি৷ এখানে আমরা যদি ডিপ অ্যাকুইফার শনাক্ত করতে পারি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ম্যাপিং করতে পারি। সৌভাগ্যক্রমে আমরা যদি তা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ফুটের মধ্যে, তাহলে সে স্তরকে কেবল পানযোগ্য পানির জন্য সংরক্ষিত রাখি তাহলে আমরা সুপেয় পানির সমস্যা সমাধান করতে পারব।

আলোচনায় যেসব স্ট্রেস এরিয়ার কথা এসেছে তার আশপাশের বিল, লেক আছে, যাতে মোটামুটি অনেক সময় ধরে পানি থাকে। আমরা ভূপৃষ্ঠের এ পানি ব্যবহার করতে পারি৷ এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। এটি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও এখন ব্যবহার শুরু করেছে। এ অঞ্চলে যেহেতু পানির সংকট রয়েছে, তাই যেসব জাতের ফসল চাষে পানি কম প্রয়োজন হয়, আমাদের সেদিকে যেতে হবে। আর বৃষ্টির পানিকে ভূপৃষ্ঠে ধরে রাখতে হবে। সারা দেশের জন্য আমাদের ওয়াটার বাজেট করতে হবে। এ জন্য প্রথমে ইউনিয়ন পর্যায়ে যেতে হবে এবং কোন কাজের জন্য কতটুকু পানি ব্যবহার করা হবে, তা বরাদ্দ করে দিতে হবে। এ জন্য সবার চাহিদা জানা প্রয়োজন, যার তথ্য বিভিন্ন সংস্থার কাছে আছে৷ সে ইউনিয়নে বণ্টন করার মতো কী কী পানিসম্পদ আছে, তা–ও দেখতে হবে। তার তুলনায় চাহিদা বেশি হলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে বা ফসলের জাত পরিবর্তন করে একে সমন্বয় করতে হবে।

ড. নেহরীন মাজেদ

ড. নেহরীন মাজেদ

অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, পুরকৌশল বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

বিশ্ব ইকোনমিক ফোরামের ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বের এক–তৃতীয়াংশ মানুষ কমপক্ষে এক মাসের জন্য হলেও পানির সংকটে থাকে। সংখ্যার হিসাবে এটি প্রায় ২০০ কোটি। অন্যদিকে ৫০ কোটি মানুষ সারা বছরই পানির সংকটে থাকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার আমাদের বরেন্দ্রভূমি। বিষয়টি দিন দিন আমাদের অসহায়ত্বর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

মানুষের অভিযোজন এবং সমন্বয় সাধনের যে সুযোগ, তার জ্ঞান তো পুরোপুরি নেই। আমাদের সমস্যাও বহুবিধ। এখানে ১৫ হাজারের বেশি ডিপ টিউবওয়েল খনন করা হয়েছে। সে কারণে প্রতিবছর ১০ ফুটের বেশি ভূগর্ভের পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। এ চিত্র খুবই উদ্বেগজনক। এ অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্য দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছে। এর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে নারী, শিশু এবং বয়স্করা। পরিবারের সদস্য সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে ৫ থেকে ২০ কলসি পানিও সংগ্রহ করতে হয়। আবার এ জন্য হেঁটে যেতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। একটা জনগোষ্ঠীকে জীবিকা নির্বাহের এই মৌলিক প্রয়োজনের জন্য কেন এত কষ্ট করতে হবে?

এখানের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ নির্ভর করে পশুপালন, কৃষিকাজ ও মৎস্য চাষের ওপর। এর সব কটিই পানির কারণে ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের শক্তির জায়গা হচ্ছে মানুষ এত প্রতিবন্ধকতার পরও এখানে টিকে আছে। আমরা কি তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি?

সে জন্য অবশ্যই প্রণোদনা থাকতে হবে। নওগাঁতে নাকি ১৫০ ফুটের বেশি নিচে পানির স্তর নেমে গেছে৷ এখানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে চিন্তা করে এবং অনেক ধৈর্য ধরে। কমিউনিটির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।

হোসেন ইশরাত আদিব

হোসেন ইশরাত আদিব

ডিরেক্টর, আইডিপি ও ওয়াশ, ব্র্যাক

গত বছর চৈত্র মাসে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে মুকুল সরেন নামের এক সাঁওতাল কৃষক জমিতে সেচ দিতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এরও ঠিক এক বছর আগে আরও দুজন কৃষক একই কারণে আত্মহত্যা করেন। আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলছি। পানির সংকটই জলবায়ু সংকট। বরেন্দ্র অঞ্চলের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও প্রকট। এ বছর বিশ্ব পানি দিবসের প্রতিপাদ্য, শান্তির জন্য পানি। একে দুইভাবে দেখা যায়—পানির প্রাপ্যতা ও অভিগম্যতা অর্থাৎ যতটুকু পানি আছে, তা কারা কীভাবে পাচ্ছে তা নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের কৃষিকাজের ক্রপিং ইনটেনসিটি বা ফসলের তীব্রতা ১৯০ শতাংশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য তা ২২৫ শতাংশ। এখানে কৃষিকাজ মূলত ধাননির্ভর, যার ৭৫ শতাংশ পানি আসে ভূগর্ভ থেকে। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা শঙ্কা তো থেকেই যাচ্ছে, যেখানে বর্তমান নিয়েই আছে। এ জন্য আমরা যারা মাঠে কাজ করি, তারা একটি কার্যকর সমাধানের কথা বলছি। সেখানে প্রযুক্তি এবং পলিসির বাস্তবায়ন মাঠপর্যায়ে এমনভাবে হবে, যাতে মুকুল সরেনদের এই চৈত্র মাসে পানির অভাবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে না হয়।

বরেন্দ্র অঞ্চলের সংকটের তিনটি দিক রয়েছে, হাইড্রো-জিওলজিক্যাল কনটেক্সট, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের কার্যক্রম। শান্তির জন্য পানি বলতেই আমরা একে আন্তর্জাতিক ইস্যু মনে করি। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, পানি যদি দূষিত বা অপ্রতুল হয়; বণ্টন যদি সুষম না হয়, তাহলে কমিউনিটি ও দেশের মধ্যেই অশান্তির সৃষ্টি হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলে বাঙালিরা ছাড়াও ১৭ ধরনের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে। সেখানে পানির স্বল্পতা নয়, এর সুষম বণ্টন বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এ কারণে আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ যে কারণে আমরা সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বা আইডব্লিউআরএমের কথা বলে থাকি।

মালিক ফিদা এ খান

মালিক ফিদা এ খান

নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস

আমাদের পরিকল্পনায় ভুল ছিল। এ কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের এ অবস্থা। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মিলিমিটার। সুতরাং এটি খরাপ্রবণ এলাকা। তাই যখন এখানে ভূগর্ভস্থ পানিকে সেচের জন্য উত্তোলন করেছি, তখন কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব হলো। এ পদ্ধতিতে মানুষকে চাষাবাদ করতে যখন উৎসাহিত করেছি, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা কষ্টসাধ্য বিষয় হচ্ছে। প্রতিবছর এখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৮৬ সেন্টিমিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে।

পানি দুভাবে তোলা যায়— হার্ভেস্টিং ও মাইনিং। হার্ভেস্টিং হচ্ছে পানি জমিয়ে সে পানি তোলা, আর মাইনিং হচ্ছে জমা না করে কেবল পানি তোলা। আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পানির মাইনিং হচ্ছে। এর কারণেই এ অঞ্চলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে এ জায়গাগুলোকে দেখতে হবে।

ডেলটা পরিকল্পনার একটি হটস্পট কিন্তু এই বরেন্দ্র অঞ্চল। ডেলটা পরিকল্পনা ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় ঝুঁকি চিহ্নিত করে কিছু কৌশলের সুপারিশ করা হয়েছে। আমাদের প্রচলিত সেচব্যবস্থায় চাষাবাদের পরিবর্তে অন্য কোনো ধরনের চাষাবাদ পদ্ধতিতে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প এখন নেই।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত ব্রি ৫৬, ব্রি ৬৬, ব্রি ৭১, ব্রি ১০৩—এ ধানগুলো আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য উপযোগী। খরাসহিষ্ণু এ ধরনের ধানের চাষাবাদকে উৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি বরেন্দ্র এলাকায় চাষাবাদ দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের চাষাবাদ দক্ষতা ৫০ শতাংশের মতো, ফলে অনেক পানি অপচয় হচ্ছে। এগুলো না করা গেলে বরেন্দ্র অঞ্চলের অবস্থা আরও খারাপ হবে। আমাদের প্রচলিত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংলাপের মাধ্যমে আমাদের আন্তসীমান্ত নদীগুলো বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে যৌথ নদীগুলোর হিস্যা দেখাতে হবে।

জাহাঙ্গীর আলম খান

জাহাঙ্গীর আলম খান

পরিচালক, ডাসকো ফাউন্ডেশন, রাজশাহী

বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থা হচ্ছে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর। পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা সম্প্রতি একটি অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর ২৫টি উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলার অবস্থা খুবই খারাপ। এর মধ্যে প্রায় ৩০ থেকে ৪০টি ইউনিয়নে এখনই ওয়াটার স্ট্রেস ঘোষণা করার মতো অবস্থা আছে। পানি আইন ২০১৩–এ বলা আছে, অ্যাসেসমেন্টের ভিত্তিতে আইডেন্টিফাই করা হবে। এটি হয়ে গেছে এবং এখন হয়তো গেজেট নোটিফিকেশনের অপেক্ষায় আছে। এই হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের চিত্র।

এখন দেখতে হবে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অঞ্চলে সাধারণত পানি আনতে হয় মেয়েদের। পুরুষেরা পানি আনে কম। এখানে সংখ্যালঘু এক লাখ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাস। তাঁরা নারী ও পুরুষ উভয়েই কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আদিবাসী মেয়েরা সরাসরি মাঠের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা পানি আনতে গেলে মাঠে কাজ করতে যেতে পারে না। আদিবাসীদের ৯৭ থেকে ৯৮ শতাংশ ভূমিহীন। ফলে তারা ক্রমান্বয়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। আবার যথেষ্ট পানির অভাবে মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে পারে না। অন্য অঞ্চলের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলের শিশুদের চর্মরোগ বেশি হয়। সুতরাং দেখা যায়, এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী হচ্ছেন নারীরা।

এমনও দেখা যায় যে পানি আনতে গিয়ে অনেক মেয়ে হয়রানির শিকার হয়। কারণ, খরার সময় কোনো টিউবওয়েলে পানি থাকে না। তখন মাঠের মাঝখানে বিএমডিএর যে ডিপ টিউবওয়েল আছে, সেখানে একেবারে জনমানবহীন এলাকায় একটা মেয়েকে পানি আনতে যেতে হয়। এমনকি তাকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।

ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ

ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ

অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর ১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো আমি বরেন্দ্র এলাকায় যাই। তখন আমি অবাক হয়েছিলাম পানির স্বল্পতা ও এর কারণে শুষ্ক লাল মাটি দেখে, গাছপালাও খুব কম ছিল। পরে আমি আমার পিএইচডির বিষয়বস্তু হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলকে বেছে নিই।

বরেন্দ্র এলাকা হাইড্রো-জিওলজিক্যালি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে কিছুটা ভিন্ন। জলবায়ুগতভাবেও কিছুটা ভিন্নতা আছে। ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অন্য অঞ্চলের উপরিতলে পলিমাটির স্তর দেখা গেলেও বরেন্দ্র অঞ্চলের উপরিতলে কাদামাটির স্তর রয়েছে। এর ফলে অন্যান্য এলাকায় বৃষ্টির পানি যত সহজে ভূগর্ভে পৌঁছায়, এখানে তা সম্ভব হয় না। আর বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টি হলে পানি এক জায়গায় অবস্থান না করে দ্রুত গড়িয়ে চলে যায়, এতে করে পানি ভূগর্ভে যাওয়ার সুযোগ পায় না। আবার সেখানে গাছপালাও কম। ফলে সবকিছু মিলিয়ে এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ বাড়তে পারে না।

বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিআইএডিপি) ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। সে সময় অনেকে বলেছিলেন কিছুদিন পর এখানে টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাবে না। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত আমি এটি নিয়ে গবেষণা করি। তখনকার টিউবওয়েলের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে আমি বলেছিলাম, এখানে যথেচ্ছ পানি উত্তোলন করা যাবে না। এ জন্য আমি পানি উত্তোলন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিলাম।

পানির স্তর নেমে যাওয়ার প্রথম কারণ হচ্ছে ভূতাত্ত্বিক, অর্থাৎ পানির প্রাকৃতিক জোগান কম। দ্বিতীয়ত, ভূগর্ভে পানি জমা হওয়ার তুলনায় বেশি পরিমাণে উত্তোলন করা। বরেন্দ্র এলাকায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তুলনায় বেসরকারি টিউবওয়েলের সংখ্যা ২০ গুণ বেশি। তারা অনেক পানি তুলছে। অন্য একটি কারণ হচ্ছে বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন। বিআইএডিপির শুরুর ১০ বছরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়লেও এরপর এটি ক্রমাগত কমেছে। পাশাপাশি বৃষ্টির সময়কালও কমে আসছে৷ পুনর্ভবা নদী শুকিয়ে গেছে, বড় বড় বিল শুকিয়ে গেছে। এসব অবস্থার সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।

সুপারিশ

  • বরেন্দ্র অঞ্চলে সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সবার যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে।

  • ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার বাড়িয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হবে।

  • ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির জলাধার শনাক্ত করতে হবে।

  • পানযোগ্য পানির জন্য ভূপৃষ্ঠের ও ভূগর্ভস্থ জলাধার নির্দিষ্ট করে সংরক্ষিত রাখতে হবে।

  • বৃষ্টির পানি সংরক্ষণকে গুরুত্ব দিতে হবে।

  • সারা দেশের পানিসম্পদ সমন্বয়ের জন্য একটি ডিজিটাল ড্যাশবোর্ড প্রণয়ন করতে হবে।