আমরা কি পারি বাল্যবিবাহ রোধ করতে?

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের আয়োজনে ‘আমরা কি পারি বাল্যবিবাহ রোধ করতে?’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৮ জুন ২০২১। গোলটেবিল বৈঠকে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

ভার্চু্যয়াল গোলটেবিল

রাশেদ খান মেনন

সাংসদ। চেয়ারম্যান, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

আরমা দত্ত

সাংসদ। ভাইস চেয়ারপারসন, শিশু অধিকারবিষয়ক সংসদীয় ককাস

নমিতা হালদার, এনডিসি

সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন

সমন্বয়ক, চাইল্ড হেল্প লাইন ১০৯৮, সমাজসেবা অধিদপ্তর

শাহীন আনাম

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

চন্দন জেড গোমেজ

সিনিয়র অপারেশনস ডিরেক্টর, ওয়ার্ল্ড ভিশন

মনিরা হাসান

শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিশু সুরক্ষা বিভাগ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

কাশফিয়া ফিরোজ

পরিচালক, গার্লস রাইটস, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

টনি মাইকেল গোমেজ

পরিচালক, যোগাযোগ ও অ্যাডভোকেসি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

অর্পিতা দাস

কর্মসূচি সমন্বয়ক, নারী ও কন্যাশিশুদের নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মসূচি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

স্ট্রেলা রুপা মল্লিক

সিনিয়র ম্যানেজার, টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম, শিশু সুরক্ষা ও অংশগ্রহণ, ওয়ার্ল্ড ভিশন

সীমা আক্তার

কিশোরী প্রতিনিধি

আসফিয়া কানিজ ফাতেমা

কিশোরী প্রতিনিধি

আরজু আক্তার

কিশোরী প্রতিনিধি

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালক

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আমরা কি বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারি? অবশ্যই পারি। এ ক্ষেত্রে বড় তিনটা সমস্যা আছে। সেটা সমাধানেরও উপায় রয়েছে। প্রথম সমস্যা দারিদ্র্য। দ্বিতীয় সমস্যা বখাটেদের উৎপাত। আরেকটা হচ্ছে অনেক অভিভাবক বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নন। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভাতার ব্যবস্থা এবং বখাটেদের উৎপাত বন্ধের জন্য স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে মা ও সন্তান স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অপুষ্টিতে ভুগতে পারে। তাই অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।

চন্দন জেড গোমেজ

চন্দন জেড গোমেজ

ধরে নিলাম, জুলাই মাসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। সেখানে দেখা গেল, ২০২০ সালের মার্চে কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০টি মেয়ে ছিল। স্কুল খোলার পর দেখা গেল সেখানে ১৩ জন মেয়ে কম উপস্থিত। এখন প্রশ্ন হলো, এরা কোথায়? ইউনিসেফের এক গবেষণা বলছে, ২০২০ সালের মহামারির পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে কিশোরীদের বিয়ের হার বেড়েছে ১৩ শতাংশ। এটা আমাদের সবার জন্য বেদনার। দেশের নীতিনির্ধারক ও বিশ্ব নেতাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন, আমরা কি পারব বাল্যবিবাহ রোধ করতে? টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) সুস্পষ্টভাবে বাল্যবিবাহ রোধ, শিশুর প্রতি সহিংসতা নিরসন ও শিশু অধিকারের উল্লেখ রয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ২০২০ সালে একটা মূল্যায়ন করেছিল। তখন আমরা দেখেছিলাম, বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ পরিবারে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। এ জন্য দেশের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছে। দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে কিশোরীদের জীবনে। বাল্যবিবাহ আমাদের সমাজের জন্য একটা ভয়াবহ সমস্যা। সরকার যেমন অর্থনীতিকে চাঙা রাখার জন্য ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে ভীষণ আন্তরিক, তেমনিভাবে দারিদ্র্য, স্কুল বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে মেয়েদের যে বাল্যবিবাহ হচ্ছে, সেটা রোধ করতে না পারলে দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ২৮টি জেলায় কাজ করে। বাল্যবিবাহ রোধে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ১৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ঝুঁকিপূর্ণ শিশুর কাছে সেবার বার্তা নিয়ে যেতে হবে। এটা ওয়ার্ল্ড ভিশনের একার কাজ নয়। সবার প্রচেষ্টায় সম্ভব হবে বলে আশা করি। দেশের অনেক শিশু জন্মনিবন্ধনের বাইরে। এর ফলে কোনো না কোনোভাবে তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, দুর্যোগসহ এসব বিষয় যেন শিশুদের জীবনে প্রভাব ফেলতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আমরা যদি ২০৪১ সালে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চাই, তাহলে চাইল্ড ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট রিভিউ করে যুগোপযোগী করতে হবে।

রাশেদ খান মেনন

রাশেদ খান মেনন

বিভিন্ন প্রচারণা, সরকারের আইনসহ নানা কারণে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত কোভিডের জন্য সেই অগ্রগতিটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমরা নানাভাবে জানতে পারছি যে দেশে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দারিদ্র্য, সামাজিক রীতিনীতি, নিরাপত্তা—এসব কারণে সাধারণত মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয়। এর ফলে মা ও শিশুর মৃতু্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। মেয়েদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, মৃত্যুঝুঁকি রোধসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেওয়ার জন্য আইন আছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে ১৮ বছরের পরিবর্তে ১৬ বছরেও বিয়ে দেওয়া যাবে বলে আমাদের দেশের আইনে আছে। এর সুযোগ নিয়ে অনেকে তাঁদের মেয়েকে বিয়ে দেন বলে মনে হয়।

এখন মাধ্যমিক পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। সরকার উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়ার বিষয় চিন্তা করছে। ফলে মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে কোনো সমস্যা হবে না। পোশাকশিল্প ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশুশ্রম রয়েছে। অনেক শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। এরা স্কুলে যায় না। এ জন্য উপবৃত্তি পায় না। আমাদের সবাইকে চেষ্টা করতে হবে, শিশুরা যেন স্কুলে যায়। উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানসহ ঋণদান ও ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। তাদের সব কাজের মধ্যে বাল্যবিবাহ না হওয়ার বিষয়টি যুক্ত করতে পারে।

আজকের আলোচনার শিরোনাম, ‘আমরা কি বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারি?’ আমি বলব, অবশ্যই আমরা পারি। আমাদের পারা উচিত। আমি আমাদের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে বাল্যবিবাহ রোধে একটি বিশেষ কর্মসূচির প্রস্তাব করব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে সুপারিশ করব। সাবই মিলে কাজ করলে নিশ্চয়ই সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ রোধ হবে।

স্ট্রেলা রুপা মল্লিক

স্ট্রেলা রুপা মল্লিক

১৯৭২ থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে কাজ করছে। বর্তমানে আমরা দেশের ২৮ জেলার ৫৫টি উপজেলায় কাজ করছি। আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে শিশু সুরক্ষা। শিশুরা যেন তাদের অধিকার পায়, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জীবন দক্ষতার উন্নয়ন হয়, এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করি।

গার্লস নট ব্রাইডের এক গবেষণায় এসেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়। প্রতি মিনিটে ২২ জন মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। ইউনিসেফের এক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে, যাঁদের বয়স এখন ২০ থেকে ২৪ বছর। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখের বেশি কিশোরীর বাল্যবিবাহ হয়ে যেতে পারে।

২০০৯ সালে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমাদের দেশে ৫১ শতাংশ শিশুর বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এই কোভিডের সময় এটা আরও বেড়েছে। গত এক বছরে ওয়ার্ল্ড ভিশন যে ৫৫টি উপজেলায় কাজ করছে, সেখানে আমাদের তথ্য অনুযায়ী ৪৮৬টি শিশুর বাল্যবিবাহ হয়েছে। এক বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ১৫৯। সে হিসাবে কোভিডের সময় বাল্যবিবাহ প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের বিরল উপজেলা, মুক্তগাছা, দিনাজপুর, গোদাগাড়ী—এসব এলাকায় বেশি বাল্যবিবাহ হচ্ছে। দারিদ্র্য, যৌন হয়রানি, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে বলে অভিভাবকেরা জানিয়েছেন। তবে আমরা মনে করি, এসবই একমাত্র কারণ নয়। বাল্যবিবাহ আমাদের একটা সংস্কৃতিতেও পরিণত হয়েছে বলে মনে করি।

আমাদের সঙ্গে ১ লাখ ৩০ হাজার শিশু-কিশোর কাজ করছে। এরা যখনই কোনো বাল্যবিবাহের খবর পায়, তখনই বন্ধ করার চেষ্টা করে। এর পাশাপাশি আমাদের ১ হাজার ৭০০ শিশু সুরক্ষা কমিটি আছে। এসব কমিটি বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে। এখানে চ্যালেঞ্জ হলো, বিয়েগুলো হয় সাধারণত মধ্যরাতে, অনেক সময় অন্য এলাকায়, সব সময় স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন পাওয়া যায় না। অনেক সময় হেল্পলাইন এত ব্যস্ত থাকে যে ফোন করে পাওয়া যায় না।

আমরা ওয়ার্ল্ড ভিশনের পক্ষ থেকে সবাইকে বলতে চাই, মেয়ের যেন ১৮ বছরের আগে বিয়ে না হয়। আমরা যদি স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারি, কিশোরীদের ক্ষমতায়ন করতে পারি, ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা নিশ্চিত করা যায়, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ান যায়, স্থানীয় সরকারকে আরও বেশি কার্যকর করতে পারি, তাহলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।

অর্পিতা দাস

অর্পিতা দাস

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। এখন আমরা বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে কাজ করছি। কমিউনিটি পর্যায়ে আমাদের গ্রুপ গঠন করা আছে। এর সঙ্গে যুক্ত আমাদের ৫০ হাজার কিশোর-কিশোরী। গত ১২ বছরে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন প্রায় ৪০ হাজার বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। কোভিডের সময় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বাল্যবিবাহ বেড়েছে।

ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় আমরা র‍্যাপিড অ্যানালাইসিস অব চাইল্ড ম্যারেজ ইন সিচুয়েশন কোভিড–১৯ বাংলাদেশ নামে একটি জরিপ করেছি। এটি করা হয়েছে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। আমরা অভিভাবক, ১০ থেকে ১৮ বছরের বিবাহিত-অবিবাহিত মেয়ে এবং স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছি। কোভিডের জন্য পারিবারিক আয় কমেছে, অনেকে ব্যবসা–বাণিজ্য হারিয়েছেন।

সামাজিক বিশ্বাসের জায়গা দুর্বল হয়েছে। এ জন্য অনেকে মনে করছেন, মেয়েরা একটি বোঝা। তাদের বিয়ে দিলে বোঝা কমবে। আবার স্কুল বন্ধ থাকার জন্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। লকডাউনের সময় স্থানীয় প্রশাসনসহ সবার তদারকি কম ছিল, এ কারণেও বাল্যবিবাহ বেশি হয়েছে।

আমাদের জরিপ থেকে এসেছে, ২১ জেলায় ২১ হাজার ২৪৮ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ সময় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বিয়ে হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ৪৮ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে, আর ২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

৭৮ শতাংশ মা-বাবা তাঁদের কন্যাশিশুর বাল্যবিবাহের আয়োজন করেছেন। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ বিয়ের নিবন্ধন হয়েছে। এ থেকে
বোঝা যায়, বয়স লুকিয়ে বিয়েগুলো হচ্ছে। আমাদের সুপারিশ হলো, দরিদ্র পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ, বাল্যবিবাহ যেন না হয়, সে জন্য জাতীয়ভাবে প্রচারণা চালানো।

শাহীন আনাম

শাহীন আনাম

আমাদের যদি দৃঢ় অঙ্গীকার থাকে, দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি দায়িত্ব পালন করেন, সর্বোপরি পরিবার যদি কন্যাশিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবে, তাহলে বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর সব ধরনের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছেন তারপরও বাংলাদেশ বাল্যবিবাহে সর্বোচ্চ দেশগুলোর মধ্যে একটি, যা সত্যিই খুব লজ্জা ও বেদনার।

বাল্যবিবাহ হলো একটা শিশুর সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন। বাল্যবিবাহের জন্য একজন শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না, নিজের মতো সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে না। দারিদ্র্য ও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আমরা একজন শিশুর সারা জীবনের ক্ষতি করতে পারি না। যদি কোনো কন্যাশিশুকে তার মা–বাবা জোর করে বিয়ে দিতে চান, তাহলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, তবে অভিভাবকদের জানতে হবে বাল্যবিবাহ আইনত একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। অভিভাবকদের আরও বুঝতে হবে, বাল্যবিবাহ কন্যাশিশুকে নিরাপত্তা দেয় না, বরং তাকে ঠেলে দেয় জোরপূর্বক একটি শারীরিক ও মানসিক সম্পর্কের দিকে।

কন্যাশিশুর যখন বাল্যবিবাহ হয়, এক বছর পর সে একটা শিশু নিয়ে বাড়ি ফেরে, তখন তার নিরাপত্তা কোথায় যায়? সম্প্রতি ১৪ বছরের একটি মেয়ে বিয়ের পর মারা গেল, তার নিরাপত্তার কথা আমরা ভাবিনি। এমন কত মেয়ে রয়েছে, যাদের আমরা জানি না।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে যদি আমরা জিরো টলারেন্স না নিই, তাহলে এটা রোধ করতে পারব না। কোভিডের সময় বাল্যবিবাহ ও নারীর প্রতি সহিংসতা কত বেড়েছে, সেটা আপনারা উপস্থাপনায় দেখেছেন। আর কোভিড ঠিক হয়ে গেলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না। বাল্যবিবাহ রোধের আইন যাঁদের প্রয়োগ করার কথা, তঁারা কি সঠিকভাবে কাজ করছেন? যারা ঝরে পড়বে এবং যাদের বিয়ে হবে, তাদের কি আমরা ভুলে যাব? এদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা ঠিক করতে হবে।

চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন

চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন

অবশ্যই আমরা বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারব। বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য বাল্যবিবাহ হয়ে থাকে। তবে আগের থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। শিশু সুরক্ষায় আমরা প্রায় ২২২টি সেবা দিয়ে থাকি। এগুলোর মধ্যে একটি হলো ১০৯৮ নম্বরে ফোন করার মাধ্যমে বাল্যবিবাহ রোধ। যে কেউ ১০৯৮ নম্বরে ফোন দিলে তখনই আমরা ওই এলাকার সমাজসেবা কর্মকর্তার মাধ্যমে তা বন্ধ করে থাকি। শুধু বন্ধ করেই আমরা থেমে থাকি না, কেন একটি পরিবার তাদের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল, সে সমস্যার সমাধান করি।

আমি সবাইকে অনুরোধ করব, যে কারণে আপনি আপনার অপরিণত মেয়েকে বিয়ে দিতে চান, সেটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলুন। আমরা সব ধরনের সহযোগিতা দিতে চেষ্টা করব। আমাদের এখানে সামাজিক কাউন্সিলর থাকে। প্রয়োজনে এসব পরামর্শক আপনাদের সঙ্গে কথা বলবেন। আমরা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ফলোআপ করতে থাকব।

সবাইকে অনুরোধ করব, কোথায় কোনো বাল্যবিবাহ হলে আমাদের জানান। আমাদের এই নম্বর টোল ফ্রি। এটা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে।

সীমা আক্তার

সীমা আক্তার

আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আমি ভাইয়ের বাসায় থাকি। আমার বোনেরও বাল্যবিবাহ হয়েছে। তার একটা সন্তান হওয়ার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি বাল্যবিবাহ করতে চাই না।

কিন্তু আমার ভাই বেড়ানোর কথা বলে আমাকে তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যায়। ওখানে গিয়ে দেখি, সেখানে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমাকে বিয়ে দেবে। আমি সেখান থেকে পালিয়ে বোনের বাসায় আসি। পরে কিশোর-কিশোরী দলের সদস্যরা আমার ভাইকে অনেক বোঝায়। শেষে বলে, আপনি যদি আপনার বোনকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভাই এখন আর বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেয় না। আমার ইচ্ছা আছে, লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরি করব। মা-বাবা যেন তাঁদের মেয়েদের বাল্যবিবাহ না দেন, সে জন্য সবাইকে বোঝাব।

আসফিয়া কানিজ ফাতেমা

আসফিয়া কানিজ ফাতেমা

বাল্যবিবাহের জন্য আমরা সমাজ ও পরিবারকে দোষারোপ করে থাকি। কিন্তু সেই সমাজ ও পরিবার তো আমরাই। কেবল আমরা সচেতন হলেই বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে। আমার এলাকায় ছোট মেয়েদের বিবাহের শিকার হতে হয়। তারপর তাদের একাধিক সন্তান হয়। তাদের ওপর বড় একটা সংসারের চাপ পড়ে। তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।

আমার জীবনদক্ষতা, বাল্যবিবাহ, পিরিয়ডের সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার সুযোগ হয়। প্রথমে আমি তিনজন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। তাদের বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকে নিয়ে বলি। তারপরও দুজন মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়। আমি দুঃখ পাই।

তারপর আরও ৩০ জন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। তাদের বাল্যবিবাহের সমস্যা নিয়ে বোঝাই। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, দুটি কারণে বাল্যবিবাহ হয়—দারিদ্র্য ও উত্ত্যক্তকরণ। চাঁদা তুলে ও বিভিন্নভাবে পরিবারকে সংশ্লিষ্ট করে দরিদ্র মেয়েদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করি। এভাবে যদি সবাই আমরা দায়িত্ব পালন করি, তাহলে বাল্যবিবাহ অনেকটা বন্ধ হবে।

কাশফিয়া ফিরোজ

কাশফিয়া ফিরোজ

আসফিয়ার কথা শুনে কুড়িগ্রামের ইতি খাতুনের কথা মনে পড়ল। সে ফুটবল খেলতে ভালোবাসত। করোনার জন্য তার খেলা, স্কুলে যাওয়া, মায়ের রোজগার—সবই বন্ধ হলো। তার মা তাকে বিয়ে দিতে চেষ্টা করলে আসফিয়ারা সেটা বন্ধ করেছিল। কিন্তু কত দিন বন্ধ থাকবে? প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য বিনিয়োগ করে আসছে। কুড়িগ্রামে আমাদের বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস নামে একটি প্রকল্প আছে। কোভিডে লকডাউনের জন্য এই অঞ্চলে আমাদের ও অন্যদের কমিটিগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। ঠিক এ সময় অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। অনেক অভিভাবক এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক মেয়ের বাল্যবিবাহ দিয়েছেন।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনা, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম—সবাই আমরা বাল্যবিবাহ কমাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বাজেট বরাদ্দ। কয়েক দিন আগেই আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার সময় শিশুবিবাহ রোধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু এটা বাস্তবায়নের জন্য কতটুকু বরাদ্দ আছে, এর কোনো দিকনির্দেশনা আমরা পাই না। যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে বা ইতিমধ্যে বিয়ে হয়েছে, তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এসব ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। ঘরে বন্দী থেকে প্রায় অধিকাংশ মেয়ে মানসিকভাবে ভালো নেই। তাদের মেন্টাল হেলথ সেবা দিতে হবে। ডিজিটালি পড়ালেখার পাশাপাশি যেন তাদের ডিজিটালি সুস্থ বিনোদনের সুযোগ থাকে, সেটাও ভাবতে হবে।

মনিরা হাসান

মনিরা হাসান

প্রায় শত বছর আগে, ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন তৈরি করা হয়েছিল, আবার ২০১৭ সালে পাস হয়েছে চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট। অর্থাৎ এক শ বছর আগেও সমস্যা ছিল, সেটা এখনো আছে। এখনো ৫১ দশমিক ৪০ শতাংশ চাইল্ড ম্যারেজ বাংলাদেশে হচ্ছে। ২০১৩ সালে এটা ছিল ৫২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এত বছরে আমরা মাত্র ১ শতাংশ কমাতে পেরেছি। তবে ১৯৭১ সালে ৯০ শতাংশ শিশুবিবাহ ছিল।

সারা বিশ্বে বাল্যবিবাহে আমরা চতুর্থ। অনেক ক্ষেত্রে আমরা এগিয়েছি। কিন্তু বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে এগোতে পারিনি। আমরা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি কিন্তু আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, তা না হলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাব না।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনা, ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রায় ৫৪টি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ হচ্ছে, এ বছর শেষে আমরা বলতে পারব, মন্ত্রণালয়গুলোর ব্যয়ের পরিকল্পনা কী এবং তদারকের ব্যবস্থা কী। যে জায়গায় যাঁর দায়িত্ব, সে সেটা পালন করছেন কি না, এটা নিয়ে কাজ করছি।

আমাদের সব কাজ হচ্ছে এসডিজি-৫–এর আলোকে। এ বছর শেষে বাল্যবিবাহ নিয়ে আমরা বড় গবেষণাপত্র জমা দিতে পারব। জাতীয় কৌশলপত্র এ বছর শেষে তৈরি করে আগামী বছর একটা প্ল্যান অব অ্যাকশন দিতে পারব। তখন জানতে পারব, কোন মন্ত্রণালয়ের কী দায়িত্ব এবং তাদের কস্টেড অ্যাকশন প্ল্যান কী।

শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, যারা ৯ বছরের নিচে, ইউনিসেফ আগামী পাঁচ বছর তাদেরও নিয়ে কাজ করবে, যেন বাল্যবিবাহের সমস্যা সম্পর্কে তারা বুঝতে পারে।

যদি বিয়ে হয়েই যায়, গর্ভধারণে বিলম্বের জন্য আমরা কাজ করছি। অতিদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বাল্যবিবাহ রোধে শর্তহীনভাবে নগদ সহায়তা দিতে হবে। সরকার ও ইউনিসেফের প্রায় ৮ হাজার কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে। ১০ থেকে ১৯ বছরের কিশোর-কিশোরীদের জীবনে যত ইস্যু আছে, এর সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করে আমরা বই করেছি। এটা জাতীয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তাদের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারবে।

আরজু আক্তার

আরজু আক্তার

আমরা গরিব। আবার বাবা দিনমজুর। অন্যের জমিতে কাজ করেন। আমি মা–বাবার একমাত্র সন্তান। ক্লাস সেভেনে পড়ি। করোনার সময় আমার বাবার কাজ ছিল না। সরকারি- বেসরকারি কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাননি।

আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চাইলেন। বিয়ে না দেওয়ার জন্য অনেক বোঝালাম কিন্তু কাজ হলো না। তারপর আমাকে জোর করেই বিয়ে দিলেন। পড়াশোনা করার ইচ্ছা ছিল। এখনো করতে চাই। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমি শিক্ষক হতে চাই। স্কুল খুললে স্কুলে যাব।

নমিতা হালদার

নমিতা হালদার

গত এক শ বছরে আমরা ৫০ শতাংশ বাল্যবিবাহ কমাতে পেরেছি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এম্পাওয়ারমেন্টাল প্রটেকশন অব চিলড্রেন প্রকল্পের ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক ছিলাম। এ সময়ই কিশোর-কিশোরী ক্লাব তৈরি হয়। কোথাও বাল্যবিবাহ হলে তারা এটা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করত। প্রয়োজনে প্রশাসনকে খবর দিত। আরও বেশি কিশোর-কিশোরী ক্লাব তৈরি হলে এদের কাজে লাগাতে পারলে অনেক বেশি ফল পাওয়া যাবে।

একমাত্র সমাজসেবা অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যন্ত কর্মকর্তা আছে। ইউনিয়নে যে কেউ ১০৯৮ নম্বরে ফোন দিলে যেন তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাহলে এটা খুব বড় কাজ হবে বলে মনে করি। এনজিওসহ অন্যান্য সংগঠনও ইউনিয়ন পর্যায়ে কিশোর-কিশোরী ক্লাব করতে পারে।

বাল্যবিবাহের বিভিন্ন কারণের কথা শুনলাম। এসব কারণই বড় কথা নয়। এটা হলো মানসিকতার বিষয়। আমরা আরজুর কথা শুনলাম। আরজু একমাত্র মেয়ে না হয়ে যদি একমাত্র ছেলে হতো, তাহলে তার বাবা কী করতেন?

আরজু তার স্বামীর বাড়িতে কি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে? যদি না পারে, তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে? কোনো কাজি যদি ১৮ বছরের আগে বিয়ে পড়ান, তাঁর বিরুদ্ধে ৯৯৯, ৩৩৩ ও ১০৯৮ নম্বরে অভিযোগ করা যায়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রায় প্রতিটি বিষয়ে নজর রাখে। তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানায়। আমরা ইউএনও থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে চিঠি লিখি। সবাই অমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অবশ্যই বাল্যবিবাহ রোধ হতে পারে।

আমরা ইউনিয়নে চেয়ারম্যানকে সভাপতি ও সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের কর্মীকে সদস্যসচিব করে কমিটি করার প্রস্তাব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠাব।

আরমা দত্ত

আরমা দত্ত

বাল্যবিবাহের জন্য কোনো বিশেষ একটি কারণকে দায়ী করা যাবে না। এর অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের আইন আছে, সরকার কাজ করছে, উন্নয়ন সহযোগীরা কাজ করছে। এত কিছুর পর ফলাফল হয়তো তেমন ভালো না। তবে বাল্যবিবাহ কিছুটা তো কমিয়েছি।

এর বহুবিধ কারণের জন্য আমরা হয়তো জিরোতে আনতে পারব না। ছেলেসন্তানের মতো মেয়েও যে মা–বাবাকে সহযোগিতা করতে পারে, এ ধারণার জন্য এখন প্রায় শতভাগ মা–বাবা মেয়েদের শিক্ষিত করছেন। বাল্যবিবাহ রোধের এটা একটা উপকরণ।

মেয়েদের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি যদি অমরা টেকনিক্যাল শিক্ষা দিতে পারি, তাহলে তারা নিজের ও পরিবারের জন্য কিছু আয় করতে পারবে। তাহলে মা-বাবা তাকে বিয়ে দেবেন না। ইউসেপ স্কুল শিশুদের টেকনিক্যাল শিক্ষা দেয়। তাই জেলা, উপজেলা ও প্রয়োজনে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ইউসেপের মতো কারিগরি স্কুলের ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান আছে, আইন আছে, সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তারপরও বাল্যবিবাহ থামছে না। অনেকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে বাল্যবিবাহ দেন। আমি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটিতে বারবার বলেছি, এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, এনজিও সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। করণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে এদের যোগাযোগ আছে।

একজন মেয়ে পরিবারে এমন ভূমিকা রাখবে, যেন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য বোঝা না যায়। বাল্যবিবাহ রোধে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। মা-বাবা যেন ভাবতে পারেন ছেলে যেমন বৃদ্ধ বয়সে সাহায্য করতে পারে, তেমনি মেয়েও পারে। মেয়েদের জন্য ব্যয়কে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। আমরা সবাই মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করে বাল্যবিবাহ রোধ করব।

টনি মাইকেল গোমেজ

টনি মাইকেল গোমেজ

আজকের অধিকাংশ আলোচনা হয়েছে আইন, নীতি, পরিকল্পনা প্রভৃতি নিয়ে। বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসহ অন্যান্য কারণের থেকে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানসিকতার পরিবর্তন। যত দিন পর্যন্ত আমাদের মনস্তাত্ত্বিক জগতের পরিবর্তন না হবে, তত দিন বাল্যবিবাহ রোধ হবে না। ২০১৭ সালের আইনে অনেক শক্তিশালী জায়গা রয়েছে। খুন, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এতে কি খুন–ধর্ষণ কমেছে? তাহলে আইন, নীতির ওপর আমরা কতটা নির্ভর করব। বাংলাদেশের মতো এত আইন, নীতি পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। কিন্তু এসব আইনের সঠিক প্রয়োগ ও জবাবদিহি বা দায়বদ্ধতা নেই।

শুধু এনজিওরা কুসংস্কার ঠিক করবে, এটা কখনো হবে না। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। ১৮ বছরের নিচের জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ মেয়ে। আমরা দেখলাম, যেসব মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে, তারা তাদের বিয়ে বন্ধের দায়িত্ব নিচ্ছে। কিন্তু হতে হবে এর উল্টো। যে ছেলেরা বাল্যবিবাহ করবে, তারা কেন করছে? মা–বাবা কেন বিয়ে দিচ্ছেন? কাজি কেন বিয়ে পড়াচ্ছেন? এই প্রশ্নগুলো কেন আমরা আরও জোরে সামনে আনছি না? একজন মেয়ে যদি তার মা-বাবার কাছে নিরাপদ না থাকে, অন্যের বাড়িতে কীভাবে নিরাপদ থাকবে। সে তাকে সবকিছু দিয়ে সুখে রাখবে, এই যে মানসিকতা, এর পরিবর্তন দরকার। আমাদের সব এক্সাইটমেন্ট ঘটনা ঘটছে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছি। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট দিচ্ছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই চান বাল্যবিবাহ রোধ হোক। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সরকারের সরাসরি অংশীদারত্ব দরকার। সরকার যত দিন আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিজে কাজটি না করবে, তত দিন আসলে পরিবর্তন আসবে না।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের আলোচনায় সচেতনতা, আইন ও নীতির বাস্তবায়ন, আচরণের পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয় এসেছে। এসব ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিলে বাল্যবিবাহ কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

সুপারিশ

■ আমরা যদি ২০৪১ সালে আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে চাই, তাহলে চাইল্ড ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট যুগোপযোগী করতে হবে।

■ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, দুর্যোগসহ এসব বিষয় যেন শিশুদের জীবনে প্রভাব ফেলতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

■ পোশাকশিল্প ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশুশ্রম রয়েছে। অনেক শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। স্কুলে না যাওয়ায় উপবৃত্তি পায় না। সবাইকে চেষ্টা করতে হবে, শিশুরা যেন স্কুলে যায়।

■ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম— সবাই আমরা বাল্যবিবাহ কমাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য বাজেট থাকতে হবে।

■ বাল্যবিবাহ রোধে দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা এবং বাল্যবিবাহ যেন না হয়, সে জন্য জাতীয়ভাবে প্রচারণা চালানো দরকার।

■ যারা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে বা ইতিমধ্যে বিয়ে হয়েছে, তাদের মূল ধারায় আনার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।