কোভিড-১৯: শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরা- প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়

১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ প্রথম আলো ও সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের আয়োজনে ‘কোভিড-১৯: শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরা—প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আয়োজন করা হয়। সেই গোলটেবিল বৈঠকের নির্বাচিত অংশ এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ প্রথম আলো ও সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের আয়োজনে ‘কোভিড-১৯: শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরা—প্রতিবন্ধকতা ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আয়োজন করা হয়।ছবি: প্রথম আলো

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

রাশেদা কে চৌধূরী

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

সভাপতি, কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল।

সৈয়দ গোলাম ফারুক

মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর

মো. ফসিউল্লাহ

মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর

মো. নজরুল ইসলাম

সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

ইকবাল হোসেন

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

মোহিত কামাল

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সদস্য, কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি।

মোহাম্মদ কামাল হোসেন

শিক্ষা উপদেষ্টা, সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশ।

রোমেন রায়হান

সহযোগী অধ্যাপক, জনস্বাস্থ্য বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সৈয়দ মতিউল আহসান

উপ পরিচালক, ঝুঁকি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ।

লাবণ্য প্রজ্ঞা

শিক্ষার্থী, হলি ক্রস কলেজ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

কোভিড-১৯–এর জন্য মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ আছে। খুব শিগগির হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। কিন্তু খোলার পর বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। যদি কোনোভাবে সংক্রমিত হয়ে যায়, তাহলে বড় ধরনের সর্বনাশ হবে যাবে। প্রথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটা বিস্তৃত নির্দেশিকা তৈরি করেছে। কী কী করা দরকার, সেখানে বিস্তারিত বলা আছে। এসব বিষয় আলোচার জন্য আজকের এই ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। আজকের আলোচনা থেকে মতামত ও সুপারিশ আসবে। সবার প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীদের নিরাপদে স্কুলে ফেরার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

সৈয়দ মতিউল আহসান

সৈয়দ মতিউল আহসান

সেভ দ্য চিলড্রেনের শিক্ষা শাখা থেকে একটা গ্লোবাল ডকুমেন্ট করা হয়েছে। এর সঙ্গে ইউনিসেফ, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল জড়িত ছিল। সেই গাইডলাইনের আলোকে যদি বাংলাদেশের কথা বলি, স্কুলগুলো খোলা জরুরি। শিশুরা পরিবারের বাইরে যেখানে মেধা, মননশীলতা ও বেড়ে ওঠার পরিবেশ পায়, সেটা হলো স্কুল। স্কুল শুধু শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে না, শিক্ষার্থীর নৈতিকতা, আচরণ, সামাজিক মূল্যবোধসহ বিভিন্নভাবে তাকে তৈরি করে। দুর্ভাগ্যবশত শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের শিশুরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক উন্নত দেশ চেষ্টা করেছিল স্কুল খোলার। দক্ষিণ কোরিয়া চেষ্টা করেছিল, আবার বন্ধ করে দিয়েছে। কানাডাতে কদিন আগে খুলেছে। দেখা যাক তারা কী করে। কিন্তু স্কুল খোলাও জরুরি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৪ নম্বর লক্ষ্যে গুণগত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের এটা অর্জন করতে হবে। কোভিডের ফলে এর ওপর কী প্রভাব পড়বে, আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের এখন থেকে ভাবতে হবে। গত ১০ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি করেছে। ঝরে পড়ার হার কমেছে। এমন একটা অবস্থা যেন না হয় যে শিশুরা আর স্কুলে আসছে না। তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে।

এডুকেশন গাইডলাইন থেকে স্কুলটাকে দুভাবে দেখা হচ্ছে। একটা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট যারা তারা, অরেকটা হলো শিক্ষক, অভিভাবক, এলাকাবাসী। সবাইকে নিয়েই একটা পরিকল্পনা করতে হবে। বড় পরিকল্পনা হলো ভীতি দূর করা। কিছুদিন আগে সরকার সবকিছু খুলে দিয়েছে। ভালো হয়েছে। আমরা অফিসে আসতে পারছি। আমাদের বড়দের মধ্যে সংশয়–আতঙ্ক কাজ করছে। এই জায়গাটা দূর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিশু ও যুবকদের কাছ থেকে শোনা দরকার যে বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা কেমন অনুভব করছে। তারা স্কুলে গিয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে কি না। শিশুদের কাছ থেকে যেমন শোনা দরকার, তেমনি অভিভাবকদের কাছ থেকেও শোনা দরকার। আমার স্ত্রী আমাকে বলছিল, করোনার প্রকোপ চলতে থাকলে সন্তানদের আগামী দুই বছরও স্কুলে পাঠাতে চায় না। এর মানে, আমাদের মতো পরিবারে আতঙ্ক কাজ করছে। এই আতঙ্ক দূর করা খুব জরুরি। বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা হচ্ছে। কিন্তু স্কুলে ফেরা নিয়ে আলাদা ধরনের প্রচারণা হতে পারে।

একটি সমন্বিত উদোগ নিতে হবে। সেটা হলো স্কুল খোলার আগে কী কী করতে হবে। আবার স্কুল খোলার পর কী কী করতে হবে। আগে দেখতে হবে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে কি না। আমাদের স্কুলে সাধারণত এক ক্লাসে ৭০–৮০ জন করে বসানো হয়। স্কুল খুললে শিফট নির্ধারণ করে তিন দিন করে শিশুরা স্কুলে আসতে পরে। তাদের যাওয়া-আসা তদারক করা প্রয়োজন। যাওয়া-আসার পরিবেশ ঠিক রাখতে অভিভাবকসহ অন্যদের দায়িত্ব নিতে হবে। শিশুরা যেন তাদের স্কুলে ওয়াশরুম পরিষ্কার রাখে, সেটা তাদের বোঝাতে হবে। সে যেন নিজের দায়িত্বে হাত ধোয় ও অন্যদের বলে। এ ধরনের একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধিকে একটা কালচারের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সবাইকে ভূমিকা নিতে হবে।

লাবণ্য প্রজ্ঞা

লাবণ্য প্রজ্ঞা

করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস হচ্ছে। কিন্তু সীমান্তবর্তী ও দুর্গম অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ নিতে পারে না। স্কুল খোলার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের দিকটা সবার আগে বিবেচনা করা উচিত। কালকেই যদি স্কুলে যায়, তাহলে আমার মনে হতে পারে, স্কুল থেকে আমি করোনা বহন করে বাসায় নিয়ে আসছি কি না। স্কুলে বন্ধুবান্ধব, শিক্ষকসহ সবার সঙ্গে একটা সামাজিকীকরণের বিষয় থাকে। স্কুল খোলা হবে কি হবে না, এটা নিয়ে আমরা শিক্ষার্থীরা অনেক চাপের মধ্যে আছি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটা বড় সমস্যা। গণপরিবহনে যাত্রী বেশি থাকে। স্কুল খোলার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুলে একটা ক্লাসে ৭০–৮০, এমনকি ১০০ জনও বসে। কিছু স্কুল হয়তো তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে বসাতে পারবে। কিন্তু সব স্কুল এটা পারবে না। স্কুলে স্যানিটাইজার ব্যবহার, হাত ধোয়া, তাপমাত্রা মাপা জরুরি। প্রতিটা স্কুল কি এই খরচ বহন করতে পারবে? প্রতিটা স্কুল যদি এ কাজ করেও তাহলে কে এর তদারক করবে?

শিক্ষার্থীরা ভাবছে করোনা ঠিক হলে স্কুলে যাবে। পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেছে। পিইসি, জেএসসি হবে না, নিজ নিজ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হতে পারে, না–ও পারে। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের চিন্তা অনেক বেশি। আমরা এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা প্রায় ছয় মাস পিছিয়ে গেছি। লাখ লাখ শিক্ষার্থী এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করে বলব, পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলে এইচএসসি পরীক্ষাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়ার জন্য।

রোমেন রায়হান

রোমেন রায়হান

আমরা অভিভাবকেরা সত্যিই দুশ্চিন্তায় আছি। শিশুরা স্কুলে শুধু পড়াশোনার জন্যই যায় না, সেখানে তাদের মানসিক বিকাশ ও শরীরচর্চার বিষয় থাকে। আমাদের স্কুল অবশ্যই খুলতে হবে, কিন্তু তার আগে কয়েকটা বিষয় বিবেচনা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, ভিড়ের মধ্যে না যাওয়া, খুব বেশি কারও কাছাকাছি না যাওয়া ইত্যাদি। আবার স্কুল খোলার সময় একট বড় ব্যাপার। আটটায়, সাড়ে আটটায়, নয়টায়—কখন স্কুল শুরু হবে। স্কুল শুরু ও ছুটির সময় গেটে খুব ভিড় হয়। সে ক্ষেত্রে বিরতি দিয়ে স্কুলে প্রবেশ ও ছুটির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। বাসায় ও স্কুলে তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা রাখা দরকার। স্কুলে তিন ফুট দূরত্বে বসা জরুরি। ছোট ছোট দলে ভাগ করা যেতে পারে। এক দল আরেক দলের সঙ্গে মিশবে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ যেন মাস্ক ও হ্যান্ড সানিটাইজার নিশ্চিত করে। আমার দিক থেকে এটুকু বলতে চাই।

মো. ফসিউল্লাহ

মো. ফসিউল্লাহ

আমরা প্রথম থেকে খুব সতর্ক ছিলাম। আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন নিরাপদে থাকে। তারা যেন সুস্থ থাকে, আনন্দে থাকে। তারা যেন লেখাপড়ার মধ্যে থাকে। ডিজিটাল ক্লাস দেওয়ার পর আমরা একটা জরিপ করেছি। সেখানে আমরা দেখেছি ৪৫ শতাংশ মানুষের টেলিভিশন আছে। টেলিভিশন নেই কিন্তু পাশের বাড়িতে গিয়ে দেখে, এমন আছে ১৫ শতাংশ মানুষ। প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষের এই সুযোগ ছিল। রেডিওতে ক্লাস শুরুর পর এখন প্রায় ৯৮ শতাংশ শিশু তাতে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা–উপজেলায় শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ, কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসন অনলাইন শিক্ষা চালু করেছে। সারা দেশে এটা চালু হয়েছে। কিন্তু তাদের অনলাইন অ্যাকসেস সীমিত। আমাদের দেশে ইন্টারনেট সংযোগ ওই পর্যায়ে যায়নি। তারপরও এটা আমরা শুরু করেছি।

আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি, যখনই স্কুল খোলা হোক, তখন আমাদের কী কী কাজ করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মত রাখতে হবে, শিক্ষকদের কীভাবে তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীরা কীভাবে সচেতন হবে। অভিভাবকদের কী জানতে হবে। কমিউনিটিকে কীভাবে যুক্ত করা হবে। এসব নিয়েই আমরা একটা নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। নির্দেশনা তৈরির অর্থ এই নয় যে স্কুল আজ বা আগামীকাল খুলে যাচ্ছে।

স্কুল কখন খোলা হবে, এটা পরিবেশই বলে দেবে। আমরা কখনোই স্কুলটা এমন সময় খুলব না, যেখানে কোনো ঝুঁকি থাকে। সব বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে স্কুল খোলা হবে। শুধু এটা নয়, আন্তর্জাতিক অবস্থাও আমরা দেখছি। এটুকু বলতে চাই, এখনো স্কুল খোলার কোনো দিন–তারিখ ঠিক করতে পারিনি। স্কুল যখন খোলার সময় হবে, তখন আমরা খুলব। স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত অবস্থা বজায় রাখা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হবে। মাস্ক অবশ্য অভিভাবকেরা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। দূরত্ব বজায় রেখে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে। ইউনিসেফ, ইউনেসকো, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন–সহযোগীদের কাছ থেকে আমরা তহবিল পাচ্ছি। এটা আলাদা বিষয়। আমাদের যে তহবিল আছে, সেটা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারব। প্রতিবছর একটা স্কুলকে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই টাকা এখানে খরচ করতে বলব।

সৈয়দ গোলাম ফারুক

সৈয়দ গোলাম ফারুক

শিক্ষাটা শুধু তথ্য জানার মধ্যে হয় না। নানা প্রকার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে হয়। এ মিথস্ক্রিয়াটা কেবল স্কুলেই সম্ভব। ফলে স্কুল খোলাটা খুব জরুরি। স্কুল না খোলার কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে। সবাই ভাবছে, আমরা ভাবছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে স্কুলটা দ্রুত খোলা যায়। উন্নত ধনী দেশে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা আছে, তারপরও তারা স্কুল খুলে আবার বন্ধ করেছে। চালাতে পারেনি। এটাই হলো বাস্তবতা।

গুণগত শিক্ষা আমাদের লক্ষ্য। পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক—সবাইকে পরিস্থিতিরি সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই হবে। কিছু ইতিবাচক দিক বলি। করোনার মধ্যে আমরা অনলাইন ক্লাসে গিয়েছি। আমার টেলিভিশন ক্লাসে গিয়েছি। এতে আমাদের একধরনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা যেটা দেখেছি, অনেক দেশের চেয়ে আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা দ্রুত এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। আমি জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে দেখেছি, শিক্ষকেরা এখন অনেক বেশি ফলপ্রসূভাবে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছেন।

স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে নিরাপদে আমাদের শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা যাবে, এ ব্যাপারে পরিকল্পনা আমরা নিচ্ছি। কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে এই পরিস্থিতিটাকে মেনে নিয়ে কীভাবে এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি। অনলাইন ক্লাস একটা বড় সুযোগ। এর মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন হচ্ছে। অনলাইন ছাড়া আমাদের মতো দেশে এটা দেওয়া সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে করোনার কারণে সৃষ্ট সুযোগে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি।

আর এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়টি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। অবশ্যই এটা আমাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে আছে। আমরা ১৫ দিনের নোটিশেই এ পরীক্ষা নিয়ে নিতে পারব। কেবল পরিস্থিতি অনুকূলে আসার অপেক্ষা। কজেই আমরা খুবই অগ্রাধিকার দিচ্ছি এই বিষয়ের প্রতি। সবার আগে এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করব।

রাশেদা কে চৌধূরী

রাশেদা কে চৌধূরী

বিষয়টা হলো, শিক্ষার্থীদের নিরাপদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরা। প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী, বিশাল একটি জনগোষ্ঠী। যেদিন আমরা শিক্ষার্থীদের নিরাপদে স্কুলে নিতে পারব, আমি মনে করি, সেদিন আমাদের উৎসব করা উচিত। শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি, তাঁরা যেন মনে করেন, এখন সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সময় হয়েছে। আমরা যেন ভুলে না যাই, সরকার যখন স্কুল বন্ধ করতে একটু সময় নিচ্ছিল, তখন অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

শিক্ষার্থীদের নিরাপদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরানোর বিষয়ে খুব সহজ ভাষায় অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে বার্তা যেতে হবে। এখানে গণমাধ্যমের একটা বিশাল ভূমিকা আছে। এ বিষয়ে অনেক খরচ আছে। সরকার প্রচার–প্রচারণা করবে। কিন্তু আমি মনে করি, এখানে বেসরকারি খাতের এগিয়ে আসা উচিত। এনজিও বা উন্নয়ন সংস্থারও দায়িত্ব রয়েছে বার্তাগুলো সঠিক সময়ে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া। স্কুল বন্ধ করে ছুটি দিলাম, করোনার সময়ে সবাই সমুদ্রসৈকতে চলে গেল, এভাবে বার্তা দিলে হবে না। বার্তাটা সঠিকভাবে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞাদের সঙ্গে আলাপ করে সহজভাবে দিতে হবে।

আমি, আপনি কিছু মানুষ বাড়িতে তাপমাত্রা চেক করতে পারলেও বেশির ভাগ অভিভাবক পারবেন না। প্রজ্ঞার মা-বাবা পারবেন। কিন্তু বেশির ভাগ পারবেন না। এখানে আমাদের চিন্তা করতে হবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় যে মূলধারায় শিক্ষার্থী কারা আছে? এটা আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মহাপরিচালক মহোদয়েরা জানেন। মূলধারায় বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সন্তান। উচ্চবিত্ত তো ইংলিশ মিডিয়ামে যায়। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

সরকারকে ধন্যবাদ দেব, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয় মিলে একটি ভালো গাইডলাইন করেছে স্কুল খোলার প্রস্তুতি হিসেবে। বাস্তবায়নের জায়গায় আমাদের আরও জোর দিতে হবে। সরকার কিন্তু ৩ অক্টোবরের আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেয়নি। করিগরি পরামর্শক কমিটি বলেছে, এখন এই মুহূর্তে স্কুল খোলা বা পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। কারিগরি পরামর্শক কমিটি কাজ করছে আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সর্বক্ষণ নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের সেটার ওপর আস্থা রাখা উচিত। সবার বাড়িতে বই আছে। শিক্ষার্থীরা যেন এটা পড়তে থাকে। বাংলদেশে চার কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মা-বাবা লেখাপড়া জানেন না। তাঁদের কাছেও বার্তাগুলো সঠিকভাবে যাওয়া উচিত।

সব ক্ষেত্রে প্রণোদনা আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রণোদনা কোথায়? সরকার যদি সব শিক্ষার্থীকে বই দিতে পারে, তাহলে মাস্ক দিতে কেন পারবে না। স্কুল খোলার জন্য যা যা দরকার, সেটা ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। পরিস্থিতি ভালো হলে স্কুল একসময় খুলবে। আমরা সে উৎসবের অপেক্ষায় আছি।

মো. সহিদুল্লা

মো. সহিদুল্লা

আজকের আলোচনার বিষয় হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে কি না। কবে খোলা হবে? কী কী বিধি মেনে নিরাপদভাবে খুলতে পারি। এ বিষয়ে জাতীয় পরামর্শক কমিটি, বিশেষ করে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে দিন দশেক আগে একটা আলোচনা করেছি। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে শুনেছি তাঁদের কী চিন্তাভাবনা। আমরা বলেছি, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক দিক থেকে যা করা উচিত, আমরা সে দিকটি দেখব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি সবার সঙ্গে একমত।

কিন্তু সবার আগে জীবন। আমাদের সংক্রমণের ধারাটা স্থিতিশীল হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলতে পারেন, একটু কমছে। এই অবস্থায় কথাটা এল, স্কুল–কলেজ খোলা যাবে কি না। কিন্তু এখনো সংক্রমণের হার প্রায় ১৫ শতাংশ। এটা একটা উচ্চ সংক্রমণের হার। এ অবস্থায় আমাদের তরফ থেকে বলেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা ঠিক হবে না।

পরীক্ষার বিষয়ে বলেছিলাম নভেম্বরের আগে যেন চিন্তা না করা হয়। অক্টোবরের পরিস্থিতি দেখে বলতে পারব নভেম্বরে কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। স্কুলে শিশুদের বাবা-মায়েরা বাইরে বসে থাকেন। তাঁরা কতক্ষণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে বসে থাকবেন? গেট হলো একটা। যেখান দিয়ে প্রবেশ ও বের হতে হয়। তা–ও ছোট গেট।

শ্রেণিতে অনেক বেশি শিক্ষার্থী। শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার কোনো সুযোগ নেই। এসব যত দিন বন্ধ করতে না পারব, আমাদের পরামর্শ ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ থাকে। ভার্চ্যুয়াল শিক্ষাটা যেন চলতে থাকে। এই প্রতিটি বিষয় যদি সবাই চিন্তা করি, তাহলে মনে হয় সামনে এগোতে পারি। জাতীয় পরামর্শক কমিটি থেকে এই মুহূর্তে বলেছি, স্কুল–কলেজ খোলা যাবে না। আপাতত পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। অক্টোবরের পরিস্থিতি দেখে ধাপে ধাপে যেন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। এটাই আমাদের পক্ষ থেকে পরামর্শ ছিল সরকারের কাছে, শিক্ষামন্ত্রীর কাছে।

ইকবাল হোসেন

ইকবাল হোসেন

যে বিষয়টিতে জোর দিতে চাই সেটা হলো, অবশ্যই আমাদের শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পরই এটাকে এক নম্বর অগ্রাধিকারে রেখেই পরিকল্পনা করা হবে। গ্লোবাল প্রক্রিয়ার মধ্যেও এটা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এটা ইউনিসেফের কাছেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। একই সঙ্গে কখন কী পরিস্থিতে স্কুল খোলা হবে, সে বিষয়টা ঠিক করা থাকেলে সেদিকে এগোনোর ব্যবস্থা করতে পারি। স্কুল যত দিন পরই খুলুক না কেন, শিক্ষাটা যেহেতু চলছে; সুতরাং ভীতিকর পরিস্থিতি পরিবার থেকে, শিশুদের থেকে, শিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবার কাছ থেকে এটাকে সরাতে হবে।

এর জন্য একটা পরিকল্পনা নিয়ে স্কুলে ফেরার ক্যাম্পেইন করা দরকার। সব ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পরিবারকে সংযুক্ত করার প্রয়োজন আছে। কোনটা হলে কোনটা হবে, এভাবে বসে থাকলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাটা যেন কেন্দ্রীভূত না থাকে। এটা যেন বিকেন্দ্রীকরণ হয়। গাইডলাইন পরিষ্কার হওয়া উচিত। সবাই যেন বুঝতে পারি। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আমাদের সচেতনতা লাগবে। সম্পদ লাগবে। স্কুলে ফেরার বড় ধরনের প্রচারাভিযান এখনই করা দরকার। আর এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সবাই যুক্ত থাকবে। সম্পদ কোথা থেকে আসবে, কীভাবে আসবে, কতটা কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করবে, কতটা সরকারের দিক থেকে হবে—এ ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে এখন থেকে স্কুল খোলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

মো. নজরুল ইসলাম

মো. নজরুল ইসলাম

আমরা চার কোটি শিক্ষার্থীর কথা আলোচনা করছি। এই চার কোটি শিক্ষার্থী হলো আমাদের জনসংখ্যার সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। সুতরাং বলি, টাকাপয়সার ব্যাপারে যেন কোনো রকম কৃপণতা না হয়। একটু আগে শুনেছি, স্কুল থেকে মাস্ক দেওয়া সম্ভব নয়। অত টাকা নেই। এ কথাটা মানি না। স্কুলে বিনা পয়সায় বই দিলে মাস্ক দিতে পারব না কেন? ৩০ মে পর্যন্ত সংক্রমণের হার ছিল ২০–এর নিচে। ৩০ মে সংক্রমণের হার ছিল ১৭ দশমিক ৬৬ । ৩১ মে হলো ২১ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০–এর ওপরে সংক্রমণের হার জুন-জুলাই দুই মাস চলতে থাকল। আগস্ট মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত চলল।

২১ আগস্ট ১৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ হলো। দুই দিন ধরে ১২ দশমিক ৬৪ ও ১২ দশমিক ৩৮ শতাংশ হচ্ছে। আমরা দেখছি একটু কমছে। কেন কমছে, এটা একটু চিন্তা করতে হবে। করোনার ব্যাপারে একটা হলো প্রতিরোধব্যবস্থা, আরেকটা হলো রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা। দুই জায়গায় আমাদের ঘাটতি ছিল। দুই জায়গায় অনেক উন্নয়ন করেছি। পরীক্ষা কম হতো। এখন পরীক্ষা বেশি হয়। ইদানীং আবার একটু কমে গেছে। আমাদের রোগীদের চিকিৎসার জন্য মোটামুটি এখন ভালো ব্যবস্থা আছে। আমরা এখন ১২ শতাংশে আছি। এখানে একটা কথা বলি, মানুষের সমাজ আছে। ভাইরাসেরও সমাজ আছে। বাংলাদেশে সংক্রমণ ৯ থেকে ৬ শতাংশের নিচে নামবে না। মাঝেমধ্যে বলা হয়, সরকার আর কতটুকু পারবে। সরকারকে সব পারতে হবে। শুধু সরকার নয়, আমরা সবাই মিলে এটাকে কার্যকর করব। শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারে, সেটা আমরা সম্ভব করে তুলব।

মোহিত কামাল

মোহিত কামাল

এক এক নম্বর কথা হলো, আমরা ১৭ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রেখেছি। এটাকে স্বাগত জানাই। এই বন্ধ রাখাটা দরকার ছিল। এ জন্য আমাদের দেশে সংক্রমণের হার বাড়তে পারেনি। সরকারের এই সিদ্ধান্তটা মনঃস্তাত্ত্বিকভাবে অভিনন্দনযোগ্য। কিছুদিন আগে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আমাদের একটা আলোচনায় যুক্ত হয়েছিলেন। আমাদের কমিটির প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ১৪ থেকে ১৯ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সংক্রমণ প্রায় ১২ শতাংশ। ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের এটা ছিল ৫ শতাংশ। ১০ বছরের নিচে যাদের বয়স, তাদের মধ্যে সংক্রমণ ছিল ৪ শতাংশ। আমরা আরও দেখিয়েছি, ৮৬ শতাংশ শিশু উপসর্গবিহীন থাকে। ১৪ শতাংশের উপসর্গ পেয়েছি। এই ৮৬ শতাংশ বাড়িতে আসত। বাড়ির বড়দের সংক্রমিত করত। স্কুলে গিয়ে অন্যদের সংক্রমিত করত।

এই অবস্থা থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি। সুতরাং আমরা স্কুল খুলব কি খুলব না, পরীক্ষা দেব কি দেব না, এটুওয়ান প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পরীক্ষা দেব কি দেব না, সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্পষ্টভাবে বলছি, অবশ্যই জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির মতামত নিয়েই খুলতে হবে।

তাহলে এই বিষয়গুলো যৌক্তিক হবে। হ্যাঁ, আমরা বলব, ভয় পেয়ো না, আতঙ্কিত হোয়ো না, সতর্ক হও—এসব কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর অবশ্যই একটু ভয় পেতে হবে। ভয় না পেলে স্বাস্থ্যবিধি মানার মোটিভেশনাল ফোর্স আসবে না। আতঙ্কিত হবে না, সেটা ঠিক আছে। সতর্ক হব, সেটা ঠিক আছে। টেলিভিশনসহ সব গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা যেন ভয় না পায়। একটু তো ভয় পেতেই হবে।

তা না হলে তারা কেন মাস্ক পরবে, কেন হাত ধোবে, কেন স্বাস্থ্যবিধি মানবে, কেন শরীরিক দূরত্ব মানবে? যৌক্তিক ভয় থাকতে হবে। যেখানে রেড জোন, সেখানে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা গ্রিন বা ইয়েলো জোনে না আনছি, সেখানে খোলা যাবে না। তাহলে গ্রিন জোন কি আছে? থাকলে সেখানে আমরা পাইলটিং করব। একটা–দুটো স্কুল খুলব। সেখানে দেখব যে কী সমস্যা হতে পারে। সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য অর্থের দিকে তাকাব না। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেব। কারণ, আমরা জীবনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।

আতঙ্ক দূর করতে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের বেশি চাপ দিয়ে ফেলেন। একজন বলেছেন যে দুই বছরের মধ্যেও তাঁর সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন না। বাবা-মায়েদের আতঙ্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। এ বিষয়ে বাবা-মায়েদের সতর্ক হতে হবে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়ার আগে বাড়িতে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে। সেটা হলো প্রত্যেক শিক্ষার্থী স্কুলের পোশাক পরে তার পড়ার টেবিলে স্কুলে যত সময় থাকে, তত সময় বসে থাকবে। প্রতিটা বিষয় একটু একটু করে পড়বে। তাহলে তার খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বাড়বে। স্কুলের পরিবেশকে মানিয়ে নিতে পারবে। এখন থেকেই এই অভ্যাস শুরু করে দিতে হবে।

মোহাম্মদ কামাল হোসেন

মোহাম্মদ কামাল হোসেন

সরকার স্কুল না খোলার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এতে আমরা সবাই একমত। আমরাও মনে করি, স্কুল খোলার পর্যাপ্ত পরিবেশ এখনো হয়নি। বাংলাদেশের সব স্কুলের অবস্থা এক নয়। আমরা একটা গাইডলাইন তৈরি করে যখন সেটা সব জায়গায় প্রয়োগ করতে চাই, তখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো সব জায়গায় এটা খাপ খাওয়ানো যায় না। কারণ, স্থানীয় সমস্যার ওপর নির্ভর করে সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য সবাই সাধারণ নির্দেশিকা অনুসরণ করতে পারে না। এ জন্য ঝরে পড়ার হার বেশি হয়। দিকনির্দেশিকায় স্থানীয় পরিকল্পনার একটা বিষয় থাকতে হবে। স্থানীয় স্কুলগুলো যেন তাদের নিজেদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে। আমাদের এখন থেকেই আলোচনার মধ্যে আনা উচিত স্কুল খুলতে কী ধরনের প্রস্তুতির দরকার, কী করতে হবে, কী করা উচিত নয়, কী ধরনের সচেতনতা দরকার। এটা যদি এখন শুরু করি সেটা কিন্তু একটা বড় কাজ করবে।

সব শেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন তাদের সবার সাথে বসা উচিত। সবাই মিলে আলোচনা করা দরকার। এভাবে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারি। স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনায় সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। যাতে করে আমাদের পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে করা যায় এবং এটাকে অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিতে পারি। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে আছি। দ্রুত স্কুল খোলার কাজটিও আমরা সফলভাবে করতে পারব। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে নতুন স্বাভাবিক সময়ে স্কুল খোলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো উঠে এসেছে, সেই সঙ্গে এসেছে যৌক্তিক কিছু সুপারিশ। আজকের ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিলে অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

আলোচনায় সুপারিশ

  • কখন কোন পরিস্থিতিতে স্কুল খোলা যাবে, তা নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা তৈরি করা জরুরি। তাহলে কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।

  • স্কুল খোলার উপযুক্ত পরিবেশ এখনো হয়নি। স্কুল তখনই খোলা উচিত, যখন ঝুঁকি থাকবে না। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে স্কুল খুলতে হবে।

  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর সবার আগে এইচএসসি পরীক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

  • শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরার প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের প্রচারাভিযান এখনই শুরু করা দরকার।

  • স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা এবং দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা যেন অনলাইন ক্লাসের সুবিধা পায়, সে জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে প্রণোদনা জরুরি।

  • শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নিরাপদ গণপরিবহন নিশ্চিত করতে হবে।

  • শিক্ষার্থীদের নিরাপদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।