খাদ্যনিরাপত্তায় জীবপ্রযুক্তির গুরুত্ব অনেক

টেকসই কৃষি ও পুষ্টিনিরাপত্তায় উদ্ভাবনী কৃষি এবং জীবপ্রযুক্তি নিয়ে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ ও প্রথম আলো।

শাহজাহান কবীর, মো. বেনজীর আলম, রাখ হরি সরকার ও মো. আরিফ হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

প্রধান খাদ্য চাল, সবজি ও ফল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। তবে আমাদের ডাল, তেল, গমসহ বেশ কিছু খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হয়। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নিজ দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর এ জন্য উদ্ভাবনী কৃষি ও জীবপ্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ওই প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে পথের বাধাগুলো দূর করতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার ‘বাংলাদেশের টেকসই কৃষি ও পুষ্টিনিরাপত্তায় উদ্ভাবনী কৃষি ও জীবপ্রযুক্তি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ ও প্রথম আলো আয়োজিত ওই বৈঠকে বক্তারা পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে ও বালাইনাশকের ব্যবহার কমাতে জীবপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে মত দেন। সভায় কৃষিতে জীবপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রাখ হরি সরকার বলেন, দেশে প্রতিবছর ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। কিন্তু এর মধ্যেই বিশ্বে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়, আলুতে সপ্তম, মৌসুমি ফলে ষষ্ঠ, পাটে দ্বিতীয় ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে। কিন্তু দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। এ জন্য দেশে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবিত ফসল ও ফলের চাষ করতে হবে।

সভায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবীর বলেন, চালের পুষ্টিগুণ বাড়াতে দেশে জিংকসমৃদ্ধ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবন করা গোল্ডেন রাইসসহ অন্যান্য ফসলের জাত দ্রুত ছাড় করলে তা দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, দেশে উৎপাদিত চাল দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় দুই কোটি টন সবজি হচ্ছে, যা দিয়ে দেশের সবজি চাহিদার বড় অংশ মেটানো হচ্ছে। তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের দিনে ২০০ গ্রাম করে সবজি খাওয়া দরকার, যা নিশ্চিত করতে হলে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে সবজির উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে।

ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মো. আরিফ হোসেন বলেন, ভারত একসময় তুলা আমদানি করত। তারা জীবপ্রযুক্তির তুলা চাষে অনুমোদন দেওয়ার কয়েক বছরের মাথায় এখন তুলা রপ্তানি করে। আমাদের দেশেও বিটি বেগুন চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে। এতে বালাইনাশকের ব্যবহার কমে আসছে। ফলে গোল্ডেন রাইসসহ অন্যান্য জীবপ্রযুক্তির ফসল দ্রুত অনুমোদন দিলে তা দেশের কৃষির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, দেশের মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য পেলেও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ ওই খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পাচ্ছে না। ফলে পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে তা দেশের দরিদ্র মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে হবে। জীবপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। এ জন্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার-বেসরকারি সংস্থার গবেষণা–সুবিধা বাড়াতে হবে। উন্নত ল্যাব ও এ খাতে অর্থায়ন বাড়াতে হবে।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহমেদ বলেন, ‘কোন ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, তা আমাদের আগে ঠিক করতে হবে। আর উৎপাদন বাড়াতে না পারলে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান টেকসই হবে না।’

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা অ্যালায়েন্স ফর সায়েন্সের পলিসি অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সহযোগী পরিচালক গ্রেগরি জাফি বলেন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জীবপ্রযুক্তি আগামী দিনে বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে তিনি বাংলাদেশকে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসিআইয়ের মলিকুলার জেনেটিকস বিভাগের মুখ্য বিজ্ঞানী এ এস এম নাহিয়ান বলেন, ‘আমাদের এমন সব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, যার মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারে ভালো দাম পায়। কারণ, দিন শেষে বাজারের মাধ্যমে ক্রেতারা তাঁদের পণ্য কেনে ও বিক্রি করেন।’

বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম ও অতিথিদের ধন্যবাদ দেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সিনজেন্টা ফাউন্ডেশন ফর সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফরহাদ জামিল, এফএওর পরামর্শক মো. আবদুল কাদের, ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আবদুল কাদের, বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বারটান) উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাসনীমা মাহজাবীন ও প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ।