ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকের অনলাইন সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ইউনিসেফ বাংলাদেশের আয়োজনে ও গ্রামীণফোনের সহযোগিতায় ‘ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকের অনলাইন সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়' শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় ১ ডিসেম্বর ২০২০। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

মোস্তাফা জব্বার

মাননীয় মন্ত্রী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়

সৈয়দ গোলাম ফারুক

মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর

লাফিফা জামাল

অধ্যাপক, রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো. মুহিবুজ্জামান

যুগ্ম সচিব (শিশু ও সমন্বয়), মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

সৈয়দ নাসিরুল্লাহ

সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম ডিভিশন,

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ

টমো হাজুমি

ইউনিসেফ প্রতিনিধি, বাংলাদেশ

ইয়াসির আজমান

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন

আবু সাঈদ ভূঁইয়া

অধ্যক্ষ, গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল

মাহবুবা সুলতানা

বাংলাদেশ সমন্বয়ক, টেইক ব্যাক দ্য টেক ও সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট

চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন

সমন্বয়ক, চাইল্ড হেল্পলাইন

সাদাত রহমান

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার-২০২০ বিজয়ী

লাবণ্য প্রজ্ঞা

শিক্ষার্থী, হলি ক্রস কলেজ

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন

শাবনাজ জাহেরীন

শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

ফিরোজ চৌধুরী

ইন্টারনেটে সুরক্ষার বিষয় নিয়েই আজকের ইউনিসেফ সংলাপ। শুরুতেই ধারণাপত্র উপস্থাপন করবেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেরীন।

শাবনাজ জাহেরীন

শাবনাজ জাহেরীন

আজকের ইউনিসেফ সংলাপের উদ্দেশ্য হলো ইন্টারনেটে সুরক্ষার বিষয়গুলো কীভাবে আমরা ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। দ্বিতীয়ত হলো, কীভাবে তা টেকসই করা যায়। বিশেষ করে পাঠ্যক্রমে এটা কীভাবে যুক্ত করা যায়। তৃতীয়ত, আইন, নীতিমালা ও রেসপন্স সিস্টেমে ইন্টারনেটভিত্তিক ঝুঁকিগুলো কতটুকু নির্দেশ করতে পারছি। তথ্যপ্রযুক্তি এখন আমাদের অগ্রযাত্রার অন্যতম একটি হাতিয়ার।

প্রাত্যহিক জীবনে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিভিন্ন সুফল আমরা পাচ্ছি। শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের বইয়ের বিষয়গুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারছে। অনেক অজানা বিষয়ের খোঁজখবর তারা রাখতে পারছে। করোনাকালের সংকটে অনেক স্কুল অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারে আমাদের সময়, শ্রম ও ব্যয়ের সাশ্রয় হচ্ছে।

ইউনিসেফ ১ হাজার ৪৮১ জন বাংলা, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর ওপর একটা জরিপ করেছিল। জরিপে অংশগ্রহণ করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছেলে ও ২৪ শতাংশ মেয়ে অহরহ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। ১৯ শতাংশ শিশু এমন কনটেন্ট পেয়েছে, যেগুলো তাদের জন্য উপযোগী নয়। কেউ কেউ ছবি আদান-প্রদান করেছে। প্রায় ৫৭ শতাংশ শিশু অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। এর মধ্যে ১৬ শতাংশ শিশু এসব অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখাও করেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। অনেক ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ শিশু তাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করেছে। এ সংখ্যা যেন আর না বাড়ে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

এ ছাড়া ইন্টারনেট সুরক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কতটুকু জ্ঞান আছে, তা আমরা দেখেছি। ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বার্তা ব্লক করতে পারে। কারও কারও গোপনীয়তা সেটিংস–সংক্রান্ত জ্ঞানও আছে। এ সংখ্যা ৪৪ শতাংশ। অভিভাবকের তদারকির ক্ষেত্রে ৩২ শতাংশ ছেলে বলেছে, তাদের কোনো তদারকি নেই। কোনোরকম তদারকি ছাড়াই তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। এ নিয়ে অভিভাবকেরাও কোনো প্রশ্ন করছেন না। ২৪ শতাংশ মেয়ের ক্ষেত্রে এ একই তথ্য এসেছে। ৬৩ শতাংশ শিশু নিজেদের কক্ষে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৪৯ শতাংশ শিশু তাদের মা-বাবার ফোন ব্যবহার করছে। ৩৭ শতাংশ শিশুর নিজেদের স্মার্টফোন আছে। প্রায় ৯৪ শতাংশ শিশুর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে। ৪২ শতাংশ শিশু প্রায় প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৩৩ শতাংশ চ্যাট করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

আমাদের এখনই সময় যে কীভাবে ইন্টারনেটের সুবিধাগুলো শিশুদের কাছে পৌঁছে দেব এবং তাদের সুরক্ষিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একযোগে কাজ করতে পারব। আজকের আলোচনায় সে বিষয়ে একটা দিকনির্দেশনা ও কিছু প্রতিশ্রুতি আশা করছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

লাবণ্য প্রজ্ঞা

লাবণ্য প্রজ্ঞা

করোনার কারণে আমাদের এখন অনলাইনে ক্লাস করতে হচ্ছে। অনলাইন ক্লাস ছাড়াও অনেক কাজে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলা, বিনোদন, ভিডিও গেম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনেক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। শিশু-কিশোরদের একাংশ ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। করোনার কারণে এ আসক্তির পরিমাণ বেড়ে গেছে।

একজন শিক্ষার্থী কতটুকু সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করবে, তা নিয়ন্ত্রণে অভিভাবক সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হলো ইন্টারনেট ব্যবহারে নিরাপদ থাকা। পাসওয়ার্ড শেয়ার না করাসহ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কিছু মৌলিক নিয়ম রয়েছে। ইন্টারনেটে যাঁরা সহিংসতা ও বিভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মেয়ে। ইন্টারনেটে মেয়েরা সাইবার বুলিংসহ অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

আমাদের উচিত এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেন মেয়েরা, শিশুরা সবাই নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে। এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যেন শিক্ষার্থী, কিশোর-কিশোরী, শিক্ষক ও অভিভাবককে জানানো যায় যে নিরাপদ ইন্টারনেট কীভাবে ব্যবহার করা যায়।

আবু সাঈদ ভূঁইয়া

আবু সাঈদ ভূঁইয়া

করোনাকালে ইন্টারনেটের ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক শিক্ষকের সীমবদ্ধতা ছিল। আগে তাঁরা অনেক কিছু ব্যবহার করতেন না। তাঁদের সে বিষয়গুলো শিখতে হয়েছে। শিক্ষকেরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে পাঠদানপ্রক্রিয়া আরও উন্নত করতে পেরেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা দরকার।

এ ছাড়া পাঠ্যক্রমে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে একটি অংশ থাকলে শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে আরও বেশি শিখতে পারবে। শিক্ষকও সচেতন হবে। বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহার বর্জন করলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতেই হবে।

মাহবুবা সুলতানা

মাহবুবা সুলতানা

টেইক ব্যাক দ্য টেক ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার হয়ে যাওয়া, এ ধরনের সমস্যাগুলো আমরা বেশি পেয়ে থাকি। এটার কারণ একটাই, তা হলো অসচেতনতা। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অসচেতনতা কিংবা কখনো কখনো কোনো সম্পর্কের বিশ্বাসের ওপর ভরসা করে তারা এ তথ্যগুলো শেয়ার করছে। পরবর্তী সময়ে এ তথ্যগুলোই তাদের কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেগুলো নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ আমরা বেশি পাই। টেইক ব্যাক দ্য টেক মূলত সচেতনতা তৈরির কাজ করে। টেইক ব্যাক দ্য টেক সবার জন্যই কাজ করে। কিন্তু অনলাইনে নারী সহিংসতার প্রতি গুরুত্ব বেশি থাকে। মেয়েদের থেকে আসা অভিযোগগুলোতে বেশি জোর দেওয়া হয়। যে বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করি, তা হলো অনলাইন যেকোনো মাধ্যমের নিরাপত্তাবিষয়ক নিয়মগুলো যেন আমরা মেনে চলি। দুই স্তরের নিরাপত্তা দিয়ে যেন ই–মেইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি।

আমার সন্তানের ক্লাসও অনলাইনে হয়। সে ক্ষেত্রে প্যারেন্টস মনিটরিং টুল আছে। অধিকাংশ অভিভাবক এ ধরনের সেটিংস যে আছে, তা জানেনই না, যেখান থেকে নিরাপত্তার বিষয়গুলো ঠিক করে দেওয়া যায়। যেহেতু চট করে অনলাইন দুনিয়ায় আমরা চলে এসেছি, সে জন্য আমাদের আরও জানতে হবে, আরও সচেতন হতে হবে। অল্প একটু জেনেই আমরা মনে করি যে অনেক কিছু জেনে গেছি। এসব বিষয়ে আরও জানতে ও জানাতে হবে। জানানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন সেশনে আমরা ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করার চেষ্টা করি। মূলত অসচেতনতা থেকে ব্যক্তিগত তথ্যাদি শেয়ার করার মাধ্যমে সমস্যার শুরু হয়। তাই সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই।

চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন

চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন

১০৯৮ শিশুদের জন্য একটি টোল ফ্রি নম্বর। এখানে আমরা শিশুদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। শিশুর যেকোনো সমস্যায় আমরা সেবা দিয়ে থাকি। সেখানে ২২২টি সমস্যার মধ্যে একটা হলো সাইবার ইস্যু। ইদানীং এ সমস্যায় শিশুরা অনেক ফোন করছে। দুই ধরনের ফোন আসে। একটা হলো এ সমস্যা নিয়ে তারা জানতে চেয়ে ফোন করে। ইতিমধ্যে যারা সমস্যায় পড়েছে, তারাও ফোন করে জানতে চায়। এ ক্ষেত্রে তারা মনঃসামাজিক সমস্যায় পড়ে যায়। তাদের ওই সমস্যা থেকে বের করে আনাও একটা কাজ।

সমস্যায় পড়া শিশুকে আমরা মানসিক সহায়তা দিয়ে থাকি। পাশাপাশি আমরা পরিবারের সহায়তা নিতে চাই। তার সম্মতিক্রমে পরিবারকে এ বিষয়ে ইতিবাচক করি। কিছু কিছু বিষয়ে আইনি সহায়তা দরকার। সে ক্ষেত্রে আমরা আইনি সহায়তা দিয়ে থাকি। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিশুরা সমস্যায় পড়লে তাদের শোনার মতো কেউ নেই। না আছে পরিবার, না আছে এসব সমস্যায় দক্ষ কোনো সংস্থা, যারা তার কথা শুনবে। শিশুরা কী কী বিষয়ে ফোন করবে, কোন কোন বিষয়গুলো জানতে চায় এবং কীভাবে তাদের সহায়তা করা যায়, এসব বিষয়ে আমরা একটা দলকে দক্ষ করেছি। কোনো শিশু এ বিষয়ে সমস্যায় পড়লে তার প্রতিটি তথ্য গোপন রেখে সহায়তা করে থাকি। কারিগরি বিষয় কীভাবে মোকাবিলা করবে, সে বিষয়েও আমরা সহায়তা করে থাকি। আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সঙ্গে আমরা কাজ করছি। প্রতিটা থানায় এর একটা বিভাগ রয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। পাশাপাশি বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা হেল্পলাইন থেকে তদারক করি। করোনাকালে শিশুরা ডিভাইসের ওপর নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ফলে এর ঝুঁকি বাড়ছে। এটাকে কেন্দ্র করে পজিটিভ প্যারেন্টিংয়ের বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছি।

লাফিফা জামাল

লাফিফা জামাল

এ মহামারির সময়ে শিশু থেকে শুরু করে আমরা সবাই ইন্টারনেটের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। দেখা গেছে, এ বছরের মার্চ মাস থেকে আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার ছিল শহরাঞ্চলনির্ভর। শহরের শিশুরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহার করত। এখন যেহেতু আমাদের পড়াশোনার কাজেও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাই এটা এখন দেশজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে। ইন্টারনেট ইতিবাচক কাজের জন্য এসেছে। আমাদের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তা ইতিবাচক, নাকি নেতিবাচক হবে। অনেক সময় আমরা ইন্টারনেট নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি। কিন্তু নিরাপদ থেকেও যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি, এ সচেতনতা আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা হয়রানির শিকার হলে বা সমস্যায় পড়লে অভিভাবককে জানাতে ভয় পায়। কেন ভয় পায়? কারণ, অভিভাবকের কাছ থেকে সে বন্ধুসুলভ আচরণ পাচ্ছে না। যখন অভিভাবক দেখেন তাঁর সন্তান ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে, তখন সমাধান না করে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে নিষেধ করছেন। এদিকে আমাদের সচেতন হতে হবে। অভিভাবকেরা কীভাবে তাঁর শিশুকে ইন্টারনেটে নিরাপদ রাখতে পারেন, সে জন্য তাঁদের জন্য বেশ কিছু সেশন রাখা খুব দরকার। ইন্টারনেটের দুনিয়াটা আমাদের জন্য নতুন একটা জায়গা। কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করলে নিরাপদ থাকব, তা নিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বেশি হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কমিকস আকারে কিছু বই প্রকাশ করা যায়, যেখানে কীভাবে ইন্টারনেটে নিরাপদ থাকা যায়, সেসব বিষয় থাকবে। সে ক্ষেত্রে শিশুরা কমিক বইয়ের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারবে।

সৈয়দ নাসিরুল্লাহ

সৈয়দ নাসিরুল্লাহ

আমরা এখানে শিশুদের নিয়ে আলোচনা করছি। শিশু ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা পার্থক্য থেকে যায়। আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী আমরা শিশুদের একটা কাতারে ফেলব। আর কিছু শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা শিশুদের সেই বয়সটা পেরিয়ে এসেছেন। যেমন আমাদের আইনে শিশুদের যে বয়স আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তা পেরিয়ে যান। এ দুই জায়গা দুই রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ অপরাধ ও সমস্যাগুলো যখন শিশু আইনের ভেতরে পড়ে যায়, তখন একভাবে সমাধান করতে হয়। আবার যখন শিশু বাইরে থাকে, তখন আরেকভাবে সমাধান করতে হয়। বিষয়টা একটু মাথায় রাখতে হবে।

আমাদের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে গত এক বছরে অনলাইন সমস্যার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। শিশুদের ক্ষেত্রে অনলাইনে সচেতনতা দরকার। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যে দায়িত্বগুলো রয়েছে, সেগুলো যেন সঠিকভাবে পালন করা হয়। শিশুরা যখন কোনোভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তখন স্বাভাবিক আইনে তাদের আমরা নিতে পারি না। তাদের জন্য আলাদা আইন রয়েছে। তাদের সংশোধনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সে ক্ষেত্রে অভিভাবকদের এ বিষয়গুলো জানাতে হবে। শিশুদের বয়স পেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা থাকছে। তাঁরা পুরোপুরি মূল আইনের অধীনে চলে যাচ্ছেন। আমি ‘অনলাইন হাইজিন’ শব্দটা প্রবর্তন করতে চাই। শব্দটা প্রচার করা এখন জরুরি হয়ে গেছে। অনলাইন হাইজিনের মধ্যে থাকবে শিশু, শিক্ষার্থী ও অন্যরা কীভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে। সবকিছুর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় আমরা লক্ষ করছি যে অনলাইনে সহিংস উগ্রবাদে অনেক কিশোর ও উঠতি বয়সী ছেলের জড়িয়ে পড়া। এ জায়গায়ও আমাদের পরিবার থেকে সচেতন হতে হবে।

সাদাত রহমান

সাদাত রহমান

আমরা চারটি বিষয়ে বিশ্বাস করি। সেগুলো হলো সচেতনতা, সহমর্মিতা, কাউন্সেলিং ও কর্মপরিকল্পনা। আমরা চারটা বিষয়কে লক্ষ্য করে কাজ করছি। প্রধানত সচেতনতা বৃদ্ধি করছি। আমরা ‘সাইবার টিনস’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম করেছি। যেটার পেজ, ওয়েবসাইট ও অ্যাপ্লিকেশন আছে। নড়াইলের কোনো কিশোর-কিশোরী অনলাইনে নিপীড়নের শিকার হলে তারা তাদের সমস্যা আমাদের অ্যাপে জানায়। আমরা সেগুলো বাছাই করি। সাইবারসংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে তা আমরা সাইবার বিশেষজ্ঞকে পাঠিয়ে দিই। যেমন তার আইডি হ্যাক হলে বিশেষজ্ঞ দল তা পুনরুদ্ধার করে দেয়। যদি দেখি যে বড় ধরনের কোনো হয়রানি হচ্ছে, তখন নড়াইল জেলা পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়ে দিই। তিনি কোনো মামলা বা সাধারণ ডায়েরি ছাড়াই অপরাধীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করেন।

আমরা গত বছর এটার কার্যক্রম শুরু করেছি। ২৫০ জনের বেশি কিশোর-কিশোরীকে সহায়তা করতে পেরেছি। আটজন সাইবার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যারা নড়াইলের বিভিন্ন কিশোর-কিশোরীকে উত্ত্যক্ত করত। আমাদের একটা হটলাইন নম্বরও আছে। প্রতিটা স্কুল-কলেজে আমরা সাইবার ক্লাব গঠন করছি। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করছি।

এ ছাড়া কিশোর-কিশোরীদের মানসিক সহায়তা দেওয়ারও চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারগুলা আমরা একদম গোপনে করার চেষ্টা করছি। এসব নিয়ে সাইবার টিনস কাজ করছে। আমাদের এখনো অনেক ধরনের কাজ করতে হবে। আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার বুলিং বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আনতে হবে। এ–সংক্রান্ত আইন সহজ করতে হবে। ২০২১ সালের মধ্যে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মো. মুহিবুজ্জামান

মো. মুহিবুজ্জামান

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আমাদের অনেকগুলো কর্মসূচি আছে। আমরা শিশু বিকাশ কেন্দ্র নামে একটা কর্মসূচি করে থাকি। আমাদের শৈশব–পূর্ববর্তী সময়ে বিকাশের (আর্লি চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট) জন্য একটা কর্মসূচি আছে, যার মাধ্যমে শুধু শিশুর বিকাশ নয়, শিশুর লাইফ সাইকেল (যেটা মায়ের গর্ভে শিশুর ভ্রূণ থেকে শুরু হয়) অনুযায়ী শিশুকে কীভাবে পরিচর্যা করা যায়, তা খেয়াল করা হয়।

আজ আলোচনা হচ্ছে অনলাইনে শিশু, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিরাপত্তা বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অনেক আছে। এসব কিছুর পরও যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, সে ক্ষেত্রে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে টোল ফ্রি হটলাইন ১০৯ আছে, যেটা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। এর সঙ্গে জাতীয় তথ্যসেবার নম্বর ৩৩৩ ও পুলিশের জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯–এর আন্তসংযোগ আছে। যে কেউ যদি অনলাইনে কোনো হয়রানির শিকার হন, কোনো রকম দুর্ভোগের শিকার হন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার কোনো খবর পেলে যেন এ টোল ফ্রি নম্বর ১০৯–এ যোগাযোগ করেন। আমাদের সহায়তা গ্রহণ করেন। সার্বক্ষণিক সহায়তাকেন্দ্র খোলা থাকে।

শিশু ও নারীর জন্য আমাদের আইনগত সহায়তা ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার আছে। সারা দেশে আমাদের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার ও মনোজাগতিক কাউন্সেলিং সেন্টার আছে। অনলাইন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমাদের কিছুটা সতর্ক হওয়া উচিত। অবশ্যই অপরিচিত কারও সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার এবং অপরিচিত অথবা লোভনীয় কোনো অফার গ্রহণ করার আগে চিন্তা করে নেবেন।

ইয়াসির আজমান

ইয়াসির আজমান

আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে অনলাইন সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছি। এ নিয়ে কথা বলার জন্য আমিও ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন স্কুলে গেছি। গ্রামীণফোন-ইউনিসেফ যৌথভাবে ১০ লাখ শিশুকে অনলাইন সুরক্ষা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আমরা হয়তো শুধু আমাদের শিক্ষার্থীদের সচেতন করা নিয়ে চিন্তা করছি। কিন্তু আমরা এমন একটা যুগে এসেছি, যেটা অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য একেবারে নতুন একটা পরিবেশ। এ পরিবেশের জন্য কীভাবে অনলাইন ব্যবহার করব, তা আমাদের সবাইকে নতুন করে জানতে হচ্ছে। সেই বাস্তবতা বিবেচনা করে গ্রামীণফোন ও ইউনিসেফ বাংলা ভাষার লার্নিং রিসোর্স প্ল্যাটফর্ম ‘ডিজিওয়ার্ল্ড বাংলা’ চালু করেছে।

কোভিড পরিস্থিতি আমাদের একটা বড় ধাক্কা দিয়ে অগ্রগামী একটা জায়গায় নিয়ে গেছে। শিশুরা এখন অনলাইনে শিক্ষা নিচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি কীভাবে শিক্ষকেরা একজন প্রথম শ্রেণির শিশুকে অনলাইন শিক্ষা মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণির একটি শিশু ল্যাপটপের সামনে বসে থাকতে অভ্যস্ত নয়। তাই সঙ্গে তার অভিভাবকও বসে আছেন। এ তিনজন মিলে একটা নতুন জগৎ আবিষ্কার করছেন। আমি যখন শিশু ছিলাম, সারা দিনের কাজ শেষে বাবা যখন বাসায় ফিরতেন, তিনি জানতেন আমার গণ্ডিটা কতটুকু ছিল। স্কুলের চারদেয়ালের ভেতর দৌড়াদৌড়ি করে আঘাত পেলে সেটা কতটুকু যেতে পারে, তা তিনি জানতেন। কিন্তু এখন সারা দিন ঘরে থেকেও জানতে পারি না যে আমার সন্তানেরা আসলে কোথায় আছে। ওরা কোন জগতে আছে, কোথায় আছে, কার সঙ্গে কথা বলছে, কী করছে—এই জিনিসগুলো জানা খুব দুরূহ ব্যাপার। এখানে অনেক বড় একটা তফাত দেখতে পাচ্ছি। কীভাবে অনলাইনজগতে আচরণ করব, তা না জানায় আমরা নিজেরা পরিবারে ভুক্তভোগী হয়েছি। তারা যখন শিক্ষার মাধ্যমে গেছে, তখন অভিভাবক হিসেবে আমরা ও স্কুলের শিক্ষকেরা একসঙ্গে বসে সমস্যাগুলোর ব্যবস্থাপনা করার চেষ্টা করেছি।

আমাদের প্রত্যেক শিশু অনলাইন শিক্ষার অধিকার রাখে। তাদের অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। প্রত্যেক শিশুর অনলাইনে নিরাপদ থাকার অধিকার আছে। আমরা এখন সাবিনা ও মীনা ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দুই কোটি শিশুর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির একটা লক্ষ্য নিয়েছি। সবার জন্য এ অনলাইন সুবিধা থাকতে হবে।

টমো হাজুমি

টমো হাজুমি

ডিজিটাল সেবা শিশুসহ আমদের বড় ধরনের সুযোগ দিতে পারে। বর্ধিত আইটি সংযোগে প্রান্তিক শিশুদের প্রবেশাধিকার পটপরিবর্তক হতে পারে। এটি একই সঙ্গে তাদের শিক্ষা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিতে সহায়তা করতে পারে। পাশাপাশি তা আমাদের নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি উপস্থাপন করে। ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশে একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া ১০ থেকে ১৭ বছরের শিশুদের ২৫ শতাংশ ডিজিটাল দুনিয়ায় সচল ছিল ১১ বছরের কম বয়স থেকে। অনলাইনে সাক্ষাৎ হওয়া লোকের সঠিক পরিচয় জানা সত্যিই মুশকিল। শিশুরা অনলাইন সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানার আগপর্যন্ত এসব ঝুঁকি থেকে তাদের সুরক্ষা দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের অনলাইন সুরক্ষা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে শেখানো ক্রমবর্ধমান সংযুক্ত পৃথিবীতে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করে।

ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় শিশুর ভুলক্রমে ক্ষতিকর সফটওয়্যার ডাউনলোড করার ঝুঁকি থাকে। শিশুরা প্রায়শই সাইবার বুলিং, হেনস্তা ও যৌন হয়রানির মতো নিকৃষ্ট ঘটনার শিকার হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে। সে জন্য শিশুদের অনলাইনে নিরাপদ রাখতে বাস্তব কর্মপরিকল্পনা নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ছাড়া তাদের এ বিষয়ে সচেতন ও ডিজিটালি স্মার্ট করতে হবে, যেন তারা ইন্টারনেটকে ভালো কাজে ব্যবহার করতে পারে।

একই সঙ্গে শিশুদের ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারে পর্যাপ্ত সহায়তা ও তাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে কার্যকরভাবে সুরক্ষিত করতে শিক্ষক ও অভিভাবককে উৎসাহিত করা জরুরি। ইন্টারনেটে শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে সমন্বিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ থাকা দরকার। প্রতিরোধ সব সময়ই প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তার বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

সৈয়দ গোলাম ফারুক

সৈয়দ গোলাম ফারুক

শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে অনলাইন সুরক্ষার বিষয়টি অবশ্যই পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা দরকার। করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার পরিধি বাড়াতে হয়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইন শিক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তারা অনেক বেশি এখন মুঠোফোন ও ল্যাপটপ ব্যবহার করছে। যেসব অভিভাবক আগে আমাদের শিক্ষার্থীদের এ ডিভাইসগুলো ব্যবহার করতে দিতেন না, এখন তাঁরা বাধ্য হয়েই দিচ্ছেন। নিজেরা চাচ্ছেন না কিন্তু দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই সঙ্গে অনলাইন ব্যবহারে নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বিষয়টা চলে আসে। শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে এখন আমরা চিন্তিত। পাঠ্যপুস্তকে অনেক সময় সব বিষয় আনা সম্ভব হয় না। ফলে এটা পাঠ্যবইয়ে আসুক বা না আসুক, পাঠ্যবই অথবা অতিরিক্ত পাঠ্যক্রমে নিয়ে আসব।

নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আজ যে আলোচনা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা একটা প্রকল্প করেছিলাম। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের এ প্রকল্পে অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সেগুলো মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ নম্বর বার্ষিক পরীক্ষায় যোগ হওয়ার কথা ছিল। কোভিডের পর এটা এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। আইসিটির বিষয়টি আমাদের প্রাত্যহিক লেখাপড়ার অংশ হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়টি আমরা এখন অনেক বেশি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।

মোস্তাফা জব্বার

মোস্তাফা জব্বার

আলোচনায় মোটামুটি সমস্যাগুলো এসেছে। আমরা কিছুটা দিকনির্দেশনাও পেয়ে গেছি। শিশুদের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরে, বিশেষ করে প্রাথমিক স্তর নিয়ে আমি কাজ করেছি। একই সঙ্গে শিশুদের নিরাপদ রাখার বিষয়টি নিয়েও কাজ করছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পেছনে একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল নিরাপদ ইন্টারনেট।

আমরা ২০১১ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটারশিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছি। কিন্তু বাধ্যতামূলক কম্পিউটারশিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যে উদ্যোগ দরকার ছিল, সে উদ্যোগটা দেখিনি। বহু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, বাধ্যতামূলক তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, কম্পিউটারশিক্ষাগুলো রয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় এগুলোর কোনোটিই ব্যবহৃত হয় না। শিক্ষকের অভাব থাকে অথবা পরীক্ষা নেওয়া হয় না। এই জায়গায় আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অভিভাবকেরা ইচ্ছা করলে যেকোনো ডিভাইসে প্যারেন্টাল গাইডেন্স ব্যবহার করতে পারেন।

সুরক্ষিত ইন্টারনেট ব্যবস্থার বিষয়টি তো পাঠ্যপুস্তকে থাকতেই হবে। কিন্তু যিনি এ বিষয় পড়ান, তিনি যদি ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার কী, কেমন করে শিশুরা নিরাপদ থাকতে পারে, তা না জানেন, তবে সেটি কাজে আসবে না। আমাদের আইন নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। কারণ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে ব্যবস্থাগুলো আছে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব। সমস্যা হলো আইন পর্যন্ত যায় কত শতাংশ? আইন পর্যন্ত পৌঁছানোর সুযোগ অথবা ইচ্ছা কতজনের আছে? এ ক্ষেত্রে সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের সন্তানেরা সোনার টুকরো। আমরা তাদের অকারণে দায়ী করি ও বকা দিই। বুঝিয়ে বলার পর খারাপ কাজ করলে তখন তাকে বকা দেওয়ার অধিকার আছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ভালো–মন্দ বোঝাতে পারি, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে দোষারোপ করা উচিত হবে না। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে পুলিশ বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে। তারা এ বিষয়গুলো বোঝে। কিন্তু সমস্যা হলো, ঢাকা শহরের একটা ইউনিট বা বিশেষ সংস্থার কয়েকজন লোকের পক্ষে পুরো দেশের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি থানায় এ ব্যবস্থা থাকা উচিত। এখন প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক বেশি সক্ষম। তাদের কাছে অভিযোগ পৌঁছানো গেলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধীকে আটক করা সম্ভব।

বাংলাদেশে শুধু ফেসবুকে ব্যবহারকারী আছে কয়েক কোটি। তাই ম্যানুয়ালি এসব তদারকি করা সম্ভব নয়। এ কারণে যেন প্রযুক্তির সাহায্যে তদারকি করা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। নতুন প্রজন্ম নিরাপদ না থাকলে দেশ নিরাপদ হবে না, ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে না। যেকোনো মূল্যে তাদের নিরাপদ রাখতে হবে। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যত ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের ইউনিসেফ সংলাপে অংশ নেওয়ার জন্য আলোচকদের প্রথম আলো, গ্রামীণফোন ও ইউনিসেফের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

সুপারিশ

  • নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জানাতে হবে

  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার

  • কোনোভাবেই অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা যাবে না

  • সমস্যায় পড়া প্রত্যেক শিশুর কথা শুনতে হবে এবং তাদের মনঃসামাজিক সহায়তা দিতে হবে

  • সাইবার বুলিং বিষয়টি সংজ্ঞাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আনা প্রয়োজন

  • শিশুরা যেন অনলাইনে সহিংস উগ্রবাদে জড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে

  • শিশুদের ইন্টারনেট প্রবেশাধিকারে পর্যাপ্ত সহায়তা ও তাদের সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে শিক্ষক ও অভিভাবককে উৎসাহিত করা জরুরি

  • শিশুদের অনলাইনে নিরাপদ রাখতে বাস্তব কর্মপরিকল্পনা নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন