টিকায় চাই প্রতিবন্ধীর অগ্রাধিকার

করোনাকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের উদ্যোগগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদ।

এখন করোনাকাল। শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থানসহ সবখানে একধরনের সংকট। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোগান্তি ও চ্যালেঞ্জটা অন্যদের চেয়ে আরও বেশি। তাই তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বরাদ্দ রাখার তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রণোদনার আওতায় আনতে হবে। করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

গতকাল সোমবার আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় এসব অগ্রাধিকারের কথা বলেছেন। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও জরুরি সহায়তা: কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক বৈঠকটির যৌথ আয়োজনে ছিল চারটি বেসরকারি সংগঠন ও প্রথম আলো। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ওই চারটি সংগঠন হচ্ছে লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, সিডিএম ইন্টারন্যাশনাল ও ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি)। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করে ইউকে এইডের সহায়তায় গঠিত আন্তর্জাতিক মোর্চা ইনক্লুসিভ ফিউচার।

বৈঠকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশ নেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, করোনা একটি জরুরি পরিস্থিতি। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আলাদা উদ্যোগ, বরাদ্দ ও প্রণোদনা থাকতে হবে। প্রতিবন্ধকতার ধরন অনুযায়ী কতজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কোন ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করতে হবে। সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, করোনাকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। দেশে করোনার টিকা যখন আসবে, তখন তা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের তালিকায় বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও রাখতে হবে। গুরুতর প্রতিবন্ধকতার শিকার ব্যক্তিরা ফিজিওথেরাপিসহ বিভিন্ন সেবা যাতে বাড়িতে বসেই পেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও নিতে হবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন এ পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন, সেই তথ্য নেই বলে উল্লেখ করেন সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান। তিনি বলেন, সারা দেশে যে সংগঠনগুলো কাজ করছে, তাদের কাছ থেকে সংক্রমিত ব্যক্তিদের তথ্য নিয়ে একটি পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব। এমন একটা পরিসংখ্যান থাকাটা জরুরি। ১০ মাস ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুনর্বাসনসহ সব ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। অন্য সময়ের তুলনায় ঝুঁকিটাও বেড়েছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ালেখা প্রায় বন্ধ। এদের বড় অংশই ঝরে যাবে। তাদের আর স্কুলে ফেরানো যাবে না। করোনাকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এডিডি ইন্টারন্যাশনালের দেশীয় পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কেউ করোনায় সংক্রমিত হলে তাঁকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার জন্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আলাদা বুথ বা বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বাস্তবায়ন নিয়ে যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আছে, করোনা পরিস্থিতিতে তা আবার বিশ্লেষণ করে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে বিশেষ বরাদ্দ রাখার তাগিদ দেন তিনি।

করোনাকালে নতুন কিছু সুযোগও তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন অ্যাডভাইজার মুরালি পদ্মানাভান। তিনি বলেন, অনলাইনে শিক্ষা, ডিজিটাল জ্ঞান—এসবের মাধ্যমে কীভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা দেওয়া যায় বা কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

আলোচনায় সিবিএম ইন্টারন্যাশনালের দেশীয় পরিচালক মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা বলেন, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা, প্রয়োজন ও অধিকার—এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে অগ্রসর হতে হবে। পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধীদের মধ্যে নারী, শিশু বা হিজড়াসহ আরও প্রান্তিক পর্যায়ে যারা আছে, তারা যাতে কোনোভাবেই পরিকল্পনা থেকে বাদ না পড়ে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর কাজের মধ্যেও সমন্বয় বাড়াতে হবে। জবাবদিহিও বাড়াতে হবে।

ভার্চ্যুয়াল এই গোলটেবিল বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, বিভিন্ন আইন ও নীতিতে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা আছে। এসব আইন ও নীতির বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিবিএম ইন্টারন্যাশনালের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশনস ম্যানেজার অসীম ডিও এবং লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ডের ন্যাশনাল ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন অফিসার নুসরাত আইরিন। মূল প্রবন্ধে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য নির্দিষ্টভাবে হালনাগাদ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ত্রাণ কার্যক্রমের পাশাপাশি করোনা–পরবর্তী পুনর্বাসন কার্যক্রমেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও সংগঠনকে সম্পৃক্ত করা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কমিটিকে সক্রিয় করার সুপারিশ করা হয়েছে।

গোলটেবিল বৈঠকে রাজশাহীতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের (ডিপিও) নেতা আসাদুজ্জামান চৌধুরী এবং ফরিদপুরের ডিপিও নেতা ইতি আক্তার দুজনই স্থানীয়ভাবে ত্রাণ পেতে প্রবেশগম্যতার সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। ত্রাণ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সুপারিশ করেন তাঁরা। টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ইতি আক্তার।

ইশারা ভাষায় দোভাষীর দায়িত্বে ছিলেন আরাফাত সুলতানা (লতা)। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।