ড্যাপের লক্ষ্য হোক বাসযোগ্য ঢাকা

ঢাকার বাস্তবতায় যেকোনো পরিকল্পনা করাই কঠিন। পেশাজীবীদের মতামত নিয়ে এমনভাবে ড্যাপ প্রণয়ন করতে হবে, যাতে সেটি জনবান্ধব হয়।

আইনুন নিশাত, মো. আশরাফুল ইসলাম, মোবাশ্বের হোসেন ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের কৌশলই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পেশাজীবীদের মতামত নিয়ে একে আরও পরিশীলিত করে তারপর চূড়ান্ত করতে হবে। ড্যাপের লক্ষ্য হওয়া উচিত ঢাকা যাতে বাসযোগ্য হয়।

গতকাল শনিবার ‘আগামীর ঢাকা ও বিশদ নগর-পরিকল্পনা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ও প্রথম আলো যৌথভাবে এই গোলটেবিলের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সম্প্রচার সহযোগী ছিল চ্যানেল আই।

আলোচনায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ঢাকা বাড়বে, বাড়তে বাধ্য। ১০০ বা ২০০ ইপিজেড করে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হলেও চিকিৎসা-শিক্ষাসহ নানা কারণে মানুষ ঢাকায় আসবে, এই আসা বন্ধ করা যাবে না। ড্যাপের বিষয়ে তিনি বলেন, পরিকল্পনা দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়, কিন্তু মোটা দাগে যেসব বিষয় নিয়ে বিশিষ্টজনেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। ড্যাপ প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সাহসীভাবে এগোতে হবে, সরকারকে খুশি করার জন্য নয়। ঢাকা শহরের ওপর মানুষের চাপ কমাতে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি জোর দেন।

আলোচনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার যে ‘ডায়নামিক ফর্ম’, তার কারণে যেকোনো পরিকল্পনা করাই কষ্টকর ব্যাপার। তবে তাঁরা বাস্তবধর্মী ড্যাপ প্রণয়ন করতে চান। তিনি বলেন, ঢাকার জন্য জলাভূমি ও কৃষিজমি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। কিন্তু জমির মালিকেরা চান না তাঁদের জমি কৃষি বা জলাধার হিসেবে চিহ্নিত হোক। সবার মতামত থেকে গঠনমূলক বিষয়গুলো গ্রহণ করে ড্যাপকে পরিশীলিত আকারে প্রকাশের সুযোগ আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ড্যাপকে আইনানুগ, সাম্যভিত্তিক হতে হবে বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ঢাকা শহর বাসযোগ্যতার তালিকায় নিচের দিকে থাকে, এই ব্যর্থতার দায় নিতে সংশোধনের রাস্তায় হাঁটতে হবে, যাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকা সত্যিকার অর্থে বাসযোগ্য হয়। আইনি বাধ্যবাধকতার অংশ হিসেবে ড্যাপ পাসের আগে ‘স্ট্রাকচার প্ল্যান’ (কাঠামো পরিকল্পনা) অনুমোদনের আহ্বান জানান তিনি।

আলোচনায় প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের কনসালট্যান্ট খ. নিয়াজ রহমান বলেন, ড্যাপে ভূমি ব্যবহারের ১৩টি শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে জলাশয়ের বিষয়টি উল্লেখ আছে। কোন এলাকায় কতটুকু জলাশয় থাকবে, সেটি চিহ্নিত করে দেওয়া আছে। সাধারণ প্লাবন ভূমি হিসেবে একটি বিষয় আলোচনায় এলেও ড্যাপে সাধারণ প্লাবন ভূমি বলে কিছু নেই; আছে বন্যামুক্ত ও বন্যা অববাহিকা এলাকা।

ঢাকায় মানুষ বাড়ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন যাতায়াতের জন্য উন্নত রেল যোগাযোগের প্রতি গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ঘণ্টায় ১০০-১৫০ কিলোমিটার গতির ট্রেন চালু করতে পারলে ঢাকার আশপাশ থেকে মানুষ আসবে, কাজ শেষ করে আবার চলে যাবে। এ ছাড়া উঁচু ভবন নির্মাণের পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, পাশাপাশি দ্বিতল ২০টি ভবনের পরিবর্তে একটি সুউচ্চ ভবন তৈরি করে বাকি ১৯টি ভবনের জায়গা ফাঁকা রাখলে শিশুরা খেলাধুলার সুযোগ পাবে।

আলোচনায় বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রক্রিয়াধীন ড্যাপে ওয়ার্ডভিত্তিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও নাগরিকসেবা নিশ্চিত করা, ভূমি পুনঃ উন্নয়নসহ বেশ কয়েকটি ইতিবাচক কৌশলের বিষয়টি তুলে ধরেন। পাশাপাশি মিশ্র ভূমি ব্যবহার নিয়ে ড্যাপে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটি আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার দাবি জানান।

ভূমি ব্যবহারের ওপর যানবাহনের সংখ্যা নির্ভর করে বলে জানান বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, পরিবহন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সমন্বিত হওয়া উচিত।

বুয়েটের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, ড্যাপের প্রস্তাব অনুযায়ী সাধারণ জলস্রোত এলাকার ২০ থেকে ৪০ শতাংশ জায়গা জলাধার হিসেবে রেখে বাকিটা ভরাট করা যাবে। এটি করা হলে ব্লু নেটওয়ার্ক ধ্বংস হয়ে যাবে।

বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠান বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়জুর রহমান খান বলেন, প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রস্তাব কার্যকর হলে তা ভবন করার জায়গা ৩০ শতাংশে নেমে আসবে। এতে ফ্ল্যাটের দাম শতভাগ বাড়তে পারে। এ ছাড়া ৮ তলার বেশি ভবন নির্মাণ করলে নির্মাণ খরচ বেশি হয়—ড্যাপের এমন তথ্যের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ১৫ তলার ওপর গেলে নির্মাণ খরচ বাড়ে।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আওয়ালও ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চতা (তলা) নির্ধারণ না করে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। সমগ্র দেশ নিয়ে বিশদ পরিকল্পনার দাবি জানান তিনি। অন্যদিকে রিহ্যাবের সহসভাপতি সোহেল রানা ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় যে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিও’ উল্লেখ আছে, সেটিকে পরিমার্জন করার আহ্বান জানান।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পুরান ঢাকাকে বাদ দিয়ে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য হবে না। জনঘনত্বের ক্ষেত্রে ডুয়েলিং ইউনিটকে (পরিবারের সংখ্যা) গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি খাল উদ্ধারের প্রক্রিয়া ড্যাপে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।

ড্যাপের প্রস্তাব অনুযায়ী রাস্তা প্রশস্ত না করলে সেটি আত্মঘাতী হবে বলে আলোচনায় উল্লেখ করেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি কাজী গোলাম নাসির।

কৃষিজমিতে ইকো ট্যুরিজম-সংক্রান্ত ড্যাপের প্রস্তাবের বিষয়ে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সুশাসনের ঘাটতির কারণে এটি বুমেরাং হতে পারে।

অনুষ্ঠানে আইএবির ভাইস প্রেসিডেন্ট এহসান খান বলেন, একটি নগর-পরিকল্পনা তখনই সার্থক হবে, যখন তার সামাজিক-রাজনৈতিক ভিশন সম্পর্কে জনগণের পরিষ্কার ধারণা থাকবে। সে কারণে পরিকল্পনা প্রণয়নে পেশাজীবী ও জনসাধারণকে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।