তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিশোরী ও যুব-নারীর অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিতকরণ

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও এটুআইয়ের আয়োজনে এবং গ্রামীণফোনের সহযোগিতায় ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিশোরী ও যুব-নারীর অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিতকরণ’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় ২২ এপ্রিল। এই আয়োজনে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো ও কিশোর আলো। আলোচকদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য নিয়ে এই ক্রোড়পত্র।

অংশগ্রহণকারী

জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক, এমপি

প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ

অর্লা মারফি

কান্ট্রি ডিরেক্টর, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

সৈয়দ তানভীর হোসেন

প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন

টিনা এফ জাবীন

সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক,

স্টার্টআপ বাংলাদেশ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ

কে এ এম মোর্শেদ

সিনিয়র ডিরেক্টর, ব্র্যাক

সৈয়দ আলমাস কবির

সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)

ওয়াহিদ শরিফ

সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো)

তোছাব্বের মুনতাহা

যুব প্রতিনিধি, গার্লস উইথ ডিজঅ্যাবিলিটি, আইটুআই প্রকল্প, সিএসআইডি

মো. আসাদুজ্জামান

যুব প্রতিনিধি; ওয়াই মুভস প্রকল্প, ইয়েস বাংলাদেশ

সাফা জেরিন সুকন্যা

প্রদায়ক, কিশোর আলো। শিক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নূন কলেজ

সঞ্চালনা

লাফিফা জামাল

অধ্যাপক, রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোচনা

লাফিফা জামাল

লাফিফা জামাল

আজকের গোলটেবিল আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাই। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল প্রযুক্তি খাতে মেয়েদের যুক্ত করতে এবং এ খাতে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রতিবছরের এপ্রিল মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল গার্লস ইন আইসিটি ডে পালিত হয়।

আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। অন্যান্য খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও ইদানীং নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নে তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বায়নের এ যুগে দেশকে এগিয়ে যেতে হলে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নতি করতে হবে। এ খাতে উন্নতি না করলে নারীরা ক্ষমতায়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে। এ মহামারির সময়ে আমরা দেখেছি যে প্রযুক্তির গুরুত্ব কতটা অপরিসীম। একই সঙ্গে নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিত করা—নারী-পুরুষ সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপদ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।

২০০৬ সালে আমাদের মোট শ্রমশক্তির ১৬ শতাংশ ছিল নারী। ২০১৯ সালে এসে দেখেছি, ৩৬ শতাংশ নারী। ২০০৬ থেকে ২০১৯ এসে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০ শতাংশ বেড়েছে। এ ২০ শতাংশ বাড়ার ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাত অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী তথ্যপ্রযুক্তি খাতে পড়াশোনা করছে। তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১২ শতাংশ কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা আরও কম। এ বাস্তবতায় আমাদের আজকের আলোচনা।

প্রশ্ন:

আমরা কীভাবে স্টার্টআপে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারি? জেন্ডার–বৈষম্য কমাতে মেয়েদের কী কী বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে?

টিনা এফ জাবীন

টিনা এফ জাবীন

স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড শতভাগ সরকারি অর্থায়নে প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম। খুব সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে ‘শত বর্ষে শত আশা’ উদ্বোধন করেছি, যা ৫০ স্টার্টআপকে ১০০ কোটি টাকা করে বিনিয়োগ করা হবে। সম্প্রতি আমরা সাতটি প্রারম্ভিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছি, যেগুলোর মধ্যে দুটি হলো নারী উদ্যোক্তার ফার্ম। বাকি ৪৩টি স্টার্টআপে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করতে আমরা সতর্ক থাকব।

মেয়েদের অনেকেই তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করে বের হচ্ছে, কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা এখানে দেখতে পাচ্ছি, নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক নেতৃত্বের দক্ষতা অনেকের মধে্য কিছুটা কম। এটা এ জন্য না যে তারা কম বুদ্ধিমান। নারীরা অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হয়। ওরা ভাবে যে ব্যবসা করতে গেলে তো আমার উদ্দেশ্য সফল হবে না। সে জন্য আমরা নারী উদ্যোক্তাদের জন্য লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট স্কিলস বাড়াতে উদ্যোগ নেব।

আমাদের বিনিয়োগে (ফান্ডিং) সমতা নিশ্চিত করতে আমরা জেন্ডার লেন্স ব্যবহার করছি। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে নারীদের অপর পক্ষের দিকে তাকালে হবে না। দক্ষতা উন্নয়নে মেয়েদের এখন নিজেকেই নির্ভরযোগ্য পরামর্শকের অবস্থানে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেডের একটা বড় ভূমিকা আছে। নারীরা যেন অগ্রাধিকার পায়, সে জন্য আমরা অন্য নারী উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিই; যা আমাদের প্রতিদিনের কাজের অংশ।

স্টার্টআপ বাংলাদেশ টিমে নারী-পুরুষের প্রায় সমান-সমান প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সামাজিক দিক থেকে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি। সরকারি ও বেসরকারি নীতিমালা নিতে পারি। কিন্তু দিন শেষে মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু আইসিটি খাতের নারী নয়, যে মেয়েটা পাঠাওয়ে কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছে, সেও যেন নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারে। সে জন্য সামাজিক দিক থেকেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রশ্ন:

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়তে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কী কী ধরনের সহায়তা প্রত্যাশা করেন? বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারীদের ক্ষেত্রে?

তোছাব্বের মুনতাহা

তোছাব্বের মুনতাহা

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের এগিয়ে নিয়ে আসতে সরকারের নানা পদক্ষেপ আমরা দেখে থাকি। প্রতিবন্ধী মানুষের চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে সুযোগ বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থা জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। জাতীয় মহিলা সংস্থার আরেকটি প্রকল্প হলো ‘তথ্য আপা’। এর মাধ্যমে একটি ডিজিটাল তথ্যভান্ডার সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি আইটুআই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়েছে। এ প্রকল্প প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

আইসিটি ক্ষেত্রে আমরা—প্রতিবন্ধী নারীরা, অন্যদের থেকে এমনকি পুরুষ প্রতিবন্ধীদের থেকে কম বেতন পেয়ে থাকি। অনেক নারী প্রতিবন্ধীর কাছে স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ পর্যন্ত নেই। তাদের জন্য সরকারি–বেসরকারিভাবে ডিভাইস কেনার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সমাজের বোঝা হয়ে থাকত না। যদিও মাননীয় আইসিটি প্রতিমন্ত্রী গত বছর থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ফ্রি ল্যাপটপ দিয়ে আসছেন। খুব শিগগির আরও প্রায় এক হাজার ল্যাপটপ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করবেন। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য মন্ত্রণালয় এগিয়ে এলে ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পিছিয়ে থাকবে না।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ইম্পোরিয়া নামের একটি সফটওয়্যার উদ্বোধন করেছে। যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বিভিন্ন চাকরি মেলায় অংশ নিতে পারেন। এটি এখন দ্রুত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে অধিক প্রচারণার প্রয়োজন। সরকারি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের পর কাজ করতে পারছে কি না, কাজ করতে না পারলে তার পেছনের কারণ কী ইত্যাদি কোনো তদারকি হয় না। ফলে অনেকেই প্রশিক্ষণের পর ঝরে যাচ্ছে। বর্তমানে কোটা ব্যবস্থা বন্ধ। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধী কোটা আবশ্যক। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে তদারকি থাকতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হলো, বেসরকারি চাকরিতে বিচার–বিশ্লেষণ করে প্রতিবন্ধী, বিশেষ করে নারী প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

প্রশ্ন:

সফটওয়্যার খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কোন বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে?

সৈয়দ আলমাস কবির

সৈয়দ আলমাস কবির

জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণে পরিসংখ্যানটা এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। আমরা বেসিস থেকে বিভিন্ন সময় নানা জরিপ করেছি। সেখান থেকে মোটামুটি ধারণা পেয়েছি যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। উদ্যোক্তা নারীর সংখ্যা হিসাব করলে তা ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে যায়। এটা হতাশাজনক।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ নানা প্রকল্প নিয়েছে। প্রযুক্তি খাতের নারীদের জন্য আমাদের একটি আলাদা স্ট্যান্ডিং কমিটি আছে। আমরা একটি উইমেনস ফোরামও করেছি। যেখানে আইসিটির সঙ্গে যারা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত, তারা সদস্য হতে পারে। নারীদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতের প্রতি একটা অদ্ভুত ভীতি কাজ করে। বিশেষ করে গণিতে নারীদের ভয় আছে। এ ভয়টা তাদের সত্যিকারের ভয় না। এ ভয় ছোটবেলা থেকে তাদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য এ ক্ষেত্রে একটা সামাজিক বিপ্লব আমাদের করতে হবে। বেসিস সদস্য ফার্ম ও কোম্পানিগুলোতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নারী কর্মী হলে বেসিসের বিভিন্ন সেবায় তারা ডিসকাউন্ট পাবে। কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নারী কর্মী রাখতে এ কোম্পানিগুলোকে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি। আমাদের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি হলো বেসিস সফট এক্সপো, যেটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সফটওয়্যার ও আইটি খাতে সবচেয়ে বড় একটি প্রদর্শনী। সেখানে গতবারও আমরা ২০টির মতো স্টল নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিনা মূল্যে বরাদ্দ রেখেছিলাম।

আমাদের ইন্টারনেট কাঠামো ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে, যা ব্যবহার করে ফেসবুকের মাধ্যমে একেবারে মফস্বলের নারীরাও উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ফেসবুককেন্দ্রিক ব্যবসা (এফ কমার্স) যেন আরেকটু প্রসার লাভ করে। এফ কমার্সে লাখো উদ্যোক্তা আছে। তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ হচ্ছে নারী উদ্যোক্তা। এফ কমার্সের ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। হঠাৎ করে যেন তাদের এ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা না হয়। তবে ফ্রিল্যান্সারদের মতো নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিসিকের অনেক জায়গা খালি পড়ে আছে। নারী উদ্যোক্তাদের কাছে এগুলো নামমাত্র মূল্যে ভাড়া দেওয়া গেলে তারা অফিসের কাজ সেখানে করতে পারবে।

এনবিআরে জমা দেওয়া বাজেট প্রস্তাবে বলা আছে ৩০০ কোটি টাকার একটি বরাদ্দ তৈরি রাখার জন্য; যেখান থেকে শুধু নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ২ শতাংশ সুদে একটা সফট লোন দেওয়া হবে। উদ্যোক্তা নারী হলে আগামী দশ বছরের জন্য তাদের করপোরেট ট্যাক্স মওকুফ করা হোক।

প্রশ্ন:

বিপিও খাতে নেতৃত্বের ভূমিকায় নারীদের অংশগ্রহণ কী রকম দেখছেন?

ওয়াহিদ শরিফ

ওয়াহিদ শরিফ

নারী কর্মসংস্থানের জন্য বিপিও একটা ইতিবাচক জায়গা। শুধু বিপিও নয়, সব ধরনের ইন্ডাস্ট্রিতে মিড লেভেলে নারীর অংশগ্রহণ ওভাবে দেখা যায় না। এর কিছু কারণ আছে। মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টে ক্ষেত্রে শুধু নারী নয়, অন্য লোকেরও স্বল্পতা আছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে অনেকগুলো প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এগুলো চলমান রাখা দরকার। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটু নজর দিতে হবে।

বিপিও খাতে আমরা এখনো একটা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দেখছি। এ খাতে ২৪/৭ কাজ হয়। মেয়েরা রাতে কাজ করলে সেটা এখনো সমাজ ও পরিবার থেকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। আমাদের এ খাতে ইতিবাচক দিক হলো, এখানে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি।

আমাদের মোট শ্রমশক্তির ৩০-৪০ শতাংশ নারী। বিপিও খাতে নারী কর্মীদের কর্মদক্ষতা পুরুষ কর্মীদের থেকে বেশি। এ ক্ষেত্রে এখনো কিছু সামাজিক চ্যালেঞ্জ আছে। এই অঞ্চলে পার্শ্ববর্তী যেসব দেশ বিপিও খাতে ভালো করছে, সেই দেশগুলোর কর্মপরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ ও সামাজিক বোঝাপড়ার চেয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অনেক নারীকে রাতে বাড়ি ফেরার সময় নানান হয়রানির শিকার হতে হয়। এ জায়গাগুলোতে নজর দেওয়া দরকার।

মেয়েদের জন্য বিপিও খাত দারুণ জায়গা। কারণ, এখানে অনেক নমনীয়তা আছে। এ পেশায় বাড়ি থেকে কাজ করা এবং খণ্ডকালীন কাজ করার সুযোগ আছে। তাই এ খাতে জোর দেওয়া দরকার। এখানে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। বেসরকারি কোম্পানিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি নারী কর্মীর অংশগ্রহণ থাকলে সে কোম্পানিকে কিছু প্রণোদনা দেওয়া উচিত। যেন তারা আরও উৎসাহিত হয়।

প্রশ্ন:

অনেক ক্ষেত্রে কিশোরী ও নারীরা সাইবার হয়রানির শিকার হয়। এ সম্পর্কে কিশোরী ও নারীদের সচেতন করতে গণমাধ্যম কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

সাফা জেরিন সুকন্যা

সাফা জেরিন সুকন্যা

করোনাকালে ঘরে বসে কাজ করার জন্য আমরা অনলাইনে বেশি ঝুঁকেছি। সে ক্ষেত্রে শুধু নারীরা সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছে, তা নয়। সব ধরনের মানুষই এ হয়রানির শিকার হচ্ছে। যে সংখ্যক মেয়ে সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছে, তার খুব কমসংখ্যক পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে রিপোর্ট করছে। এর অনেকগুলো কারণ আছে। তারা জানে না কোথা থেকে সাহায্য নিতে হবে। রিপোর্ট কীভাবে করতে হয়, তারা সেটাই জানে না। অনেকে আবার রিপোর্ট করাটা ঝামেলার মনে করে।

পুলিশ বিভাগ থেকে নারীদের জন্য সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের একটা হেল্পলাইন আছে। এ ছাড়া ঈগল নামে একটি অ্যাপ আছে। যেখান থেকে আমরা চাইলে সাইবার হয়রানি হলে সহায়তা নিতে পারি। সমস্যা হলো, এ বিষয়গুলো আমরা সবাই জানি না। এমনকি আমি নিজেও জানতাম না। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে সাইবার হয়রানির জন্য একটা হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। এটা সবাই ঠিকমতো জানেই না। গণমাধ্যমে সহযোগিতায় এ তথ্যগুলো আরও ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। এ জন্য বিভিন্ন কর্মশালা নিলে ভালো হয়।

প্রশ্ন:

আমদের সব খাতেই জেন্ডার গ্যাপ আছে। প্রযুক্তি খাতে সেটা তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণে আমাদের অর্থনীতিতে কী কী প্রভাব পড়ছে?

কে এ এম মোর্শেদ

কে এ এম মোর্শেদ

সরকার থেকে প্রণোদনা দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়টি এসেছে। আমরা আসলে নিশ্চিত নয়। গবেষণায় দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য থাকলে কোম্পানি হিসেবে আপনি লাভবান হবেন। এ লাভটা বুঝলে আমরা সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনার জন্য বসে থাকতাম না। নিজ উদ্যোগে এ বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতাম।

আমরা দেখছি, আইটি খাতে নারী ও উদ্যোক্তা হিসেবে নারীর সংখ্যা কম। আইটি খাতের বাইরে কি অনেক উদ্যোক্তা আছেন? তা তো নেই। করোনাকালে নারী উদ্যোক্তারা কী অবস্থায় আছে, তা জানার জন্য গত আগস্ট মাসে একটা জরিপ করা হয়েছে। গবেষণায় এসেছে, নারী উদ্যোক্তা মানেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ। বড় নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা হাতে গোনা। বাল্যবিবাহ এখনো বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের সমস্যা। মেয়েদের এখনো বোঝা মনে করা হয়। তারা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়, হয়তো সেখানকার শিক্ষকেরাও মনে করেন যে কলেজ পার হয়েছে, তাই এখন মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়াই উচিত। কর্মক্ষেত্রে আমাদের নারীরা নিরাপদ কি না? করোনার সময়ে মেয়েদের বিকাশে টাকা পাঠাতে হতো। প্রথমেই দেখলাম যে ওদের বিকাশ নেই। অনেকে বললেন, নারীরা বিষয়টি বুঝবেন না। পরে আমরা একটা পরীক্ষামূলক প্রকল্প নিই। একটু শ্রম দিলেই তাদেরকে বিষয়গুলো বোঝানো সম্ভব।

প্রশ্ন:

আপনাদের কোম্পানিতে নারীর অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?

সৈয়দ তানভীর হোসেন

সৈয়দ তানভীর হোসেন

বৈশ্বিকভাবেই স্টেমে (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিত) মেয়েদের সংখ্যা কম। বিশ্বে ৩০ শতাংশ মেয়ে স্টেম শিক্ষায় আছে। বাকিরা ছেলে। একটা গবেষণায় বলা হচ্ছে, আজকে যেসব শিশু স্কুলে যাচ্ছে বা ভর্তি হচ্ছে, তাদের ৬৫ শতাংশ যেসব পেশায় ঢুকবে, সেসব পেশা এ সময়ে নেই। ভবিষ্যতে বেশির ভাগ চাকরিই প্রযুক্তি ও নতুনত্ব দ্বারা পরিচালিত হবে। তাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্টেম ব্যাকগ্রাউন্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতিতে জোর দিয়ে থাকি। তা না হলে কর্মীরা থাকতে চায় না। নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে বিশেষ করে স্টেম এরিয়ায় যুক্ত হতে কী বাধা থাকে? এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, নারীর জন্য কর্মপরিবেশ ও নারীবান্ধব নীতিমালা নিয়ে আসি। কোভিডের আগে যখন আমরা অফিস করতাম, তখন কর্মীদের বাসা থেকে আনা-নেওয়া করতাম। ফলে অন্য নারীরা যেসব হয়রানির শিকার হতে পারে, সেসব থেকে তারা মুক্তি পাচ্ছে।

আমাদের অনেক নারী সহকর্মী আছে, যারা টেক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেনি। কিন্তু এ খাতে প্রযুক্তিগত প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় জানতে হয়। সে জন্য যেসব নারী সহকর্মী সাধারণ, ব্যবসা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে, আমরা তাদের কাঠামোগত শিক্ষার মধ্য দিয়ে নিই—স্ট্রাকচারড লার্নিং। যেন তারা কিছু প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করে। গত দুই বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ কর্মী ফোকাস এক্সপার্ট অথবা স্টেম ট্রেনিং নিয়েছে।

গত দুই বছরে আমরা ৬১ জন নারী কর্মী নিয়োগ দিয়েছি, তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ জন স্টেম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। আমাদের নারী কর্মীর অনুপাত নিয়ে আমরা খুব বেশি গর্বিত নই। সে জন্য আমাদের সব নিয়োগে (এক্সটারনাল রিক্রুটমেন্ট) ৮০ শতাংশ নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়ার ম্যান্ডেট রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের যোগ্য হতে হবে। গ্রামীণফোনে যত নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তারা নারী বলে নয়; যোগ্য বলেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করি। ‘শি’ এ রকম একটি প্ল্যাটফর্ম। যেখানে ৮০ শতাংশই স্টেম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছে। এ ছাড়া আমাদের জিপি এক্সপ্লোরার আছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৩৫৭ জন শিক্ষার্থী এখানে এসেছে, যাদের ৫০ শতাংশ নারী। তাদের মধ্যে ৪৪ জন স্টেম ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছে। আমরা ৯০ হাজার কিশোরীকে অনলাইন সেফটি ট্রেনিংয়ে দিয়েছি।

প্রশ্ন:

ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রযুক্তি কতটা সহায়ক হতে পারে?

মো. আসাদুজ্জামান

মো. আসাদুজ্জামান

একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জনে আমরা কোর্স এরা, উদেমিসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করি। কোর্সগুলোর ফি পরিশোধ করতে ডুয়েল কারেন্সি কার্ড প্রয়োজন হয়, যা খুব একটা সহজলভ্য নয়। সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের একটি অনলাইন কোর্স প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার, যা থেকে তারা চাকরি, ফ্রিল্যান্সিং বা ব্যবসার দক্ষতা অর্জন করবে। যেখানে তাদের সনদ দেওয়া হবে, যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে। হাইটেক পার্ক নির্মাণ, ফ্রিল্যান্সারদের সুযোগ বৃদ্ধি ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

করোনার সময়ে এক বছর ধরে অনলাইন ক্লাস চলছে। এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেকে গ্রামে বা এমন জায়গায় থাকে, যেখানে নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এর পাশাপাশি অনেকের কাছে ল্যাপটপ বা অন্য ডিভাইস নেই। ফলে অনেকে পিছিয়ে ও ঝরে পড়ছে। এ জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে বিশেষ ডেটা প্যাকেজ ও ডিভাইস দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ঝরে পড়ার হার কমে আসত।

বিভিন্ন ক্যারিয়ার ফেয়ারে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচল কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা দরকার। পাশাপাশি অনলাইনে ইন্টার্নশিপ, শিক্ষানবিশি চালু করা গেলে ঘরে বসে দক্ষতা অর্জন করা যাবে।

সরকারের অন্যতম উদ্যোগ লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রকল্প। যেখানে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩২০ জন নারী বেসিক আইসিটি প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যাচ করা, প্রশিক্ষণ–পরবর্তী তদারকি ও ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করলে তারা এগিয়ে যাবে। আমি ইন্টারন্যাশনাল গার্লস ইন আইসিটি দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

প্রশ্ন:

বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা ও নারীর অবস্থানের উন্নয়নে কীভাবে প্রযুক্তিগত সুযোগ কাজে লাগাতে পারি?

অর্লা মারফি

অর্লা মারফি

আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির প্রভাব রয়েছে। আর এ প্রভাব শুধু বাড়তেই থাকবে। আমরা দেখছি, খুব কমসংখ্যক নারী স্টেম শিক্ষায় প্রবেশ করছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা এগিয়ে যেতে চাইলে জেন্ডার সমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মেয়ের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তার পুরোটাই যেন সে কাজে লাগাতে পারে, তা নিশ্চিত করতে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গার্লস গেট ইকুয়্যাল ‘মেয়ে আমি সমানে সমান’ নামে আমাদের একটি বৈশ্বিক প্রচারণা কর্মসূচি রয়েছে।

বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির মধ্যেই ৩৬ শতাংশ মেয়েশিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, যেখানে ছেলেশিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে এ হার ৫ শতাংশ। অর্থাৎ অসমতা অনেক অল্প বয়স থেকেই দেখা যায়। এটুআই ও গ্রামীণফোনকে সঙ্গে নিয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ একটি গবেষণা করছে। যেখানে এ–সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হবে। আমরা কীভাবে অংশীদারত্বের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারি, সে ক্ষেত্রে এ তথ্যগুলো আমাদের সহায়তা করবে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থায়ও নজর দিতে হবে। প্রযুক্তি খাতে জেন্ডার–বৈষম্য কমিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে করণীয় ঠিক করতে হবে।

প্রশ্ন:

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) জেন্ডার–সমতার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের পদক্ষেপ কী?

জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক

জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ঘোষণা করলেন, তখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের সম্পৃক্ততা খুবই অল্প ছিল। কলেজ ও উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার আমরা চোখেই দেখিনি। এখন তো ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যেখানে ছেলে, মেয়ে, বিশেষ চাহিদার মানুষসহ সবারই প্রবেশাধিকার আছে।

এক যুগ আগে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ, তা এখন সাড়ে ১১ কোটি। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে সারা দেশে এখন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ আইটি ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দ্রুত এবং বড় এ পরিবর্তন হওয়ায় মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যুক্ত হওয়া ও প্রবেশাধিকার বেড়েছে। নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে ৫০ হাজারের বেশি আইটি ফ্রিল্যান্সার তৈরি করা হয়েছে। আমরা পরীক্ষামূলক প্রকল্প শি পাওয়ার প্রজেক্ট ২১টি জেলায় শুরু করেছিলাম। যেখানে আমাদের লক্ষ্য ছিল নারী আইটি মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার,ই-কমার্স উদ্যোক্তা, কল সেন্টার এজেন্ট ও ফ্রিল্যান্সার তৈরি করা। সেখানে মাত্র কয়েক বছরে ১০ হাজার ৫০০ জন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। ইউনাইটেড ন্যাশনের সঙ্গে আমরা উইমেন আইসিটি ফ্রন্টিয়ার ইনিশিয়েটিভ (ওয়াইফাই) নামে একটি প্রকল্প শুরু করছি। যেখানে ব্র্যাক, গ্রামীণফোন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল আমাদের অংশীদার হতে পারে।

ই-কমার্স ও এফ-কমার্সে লাখো নারী উদ্যোক্তার গল্প সব জায়গায় প্রশংসিত হচ্ছে। আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্প থেকে বেশ কিছু মাস্টারক্লাস করাচ্ছি। যেখানে গ্রামীণ প্রান্তিক নারীরা কীভাবে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে সফল হতে পারে এবং কীভাবে উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত পুরো ব্যবসা মডেল তৈরি করতে পারে, সে বিষয়ে আমরা ক্লাস চলমান রেখেছি।

কয়েক বছর ধরে আমরা ন্যাশনাল হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা করছি। সেখানে মেয়েদের ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় তাদের জন্য আলাদা প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু করেছি। পাশাপাশি সারা দেশে ৮ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছি। শৈশব ও কৈশোর থেকে মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিতের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হলে আমাদের শিক্ষক, অভিভাবককেও সচেতন করতে হবে। তাহলে আমরা মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে আরও বেশি সফল করতে পারব।

আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৫ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করব, যেটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তিতে উৎসাহিত করবে। সেখানে মেয়েদের প্রবেশাধিকার যেন থাকে, সে জন্য আমরা কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড ও ওয়েবসাইট করছি। যার মাধ্যমে এটা তদারক করতে পারব। এ বছর আমরা ‘শত বর্ষে শত আশা’ প্রকল্পে ৫০টি স্টার্টআপকে ১০০ কোটি টাকা করে দেব। যেখানে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা থাকবে।

লাফিফা জামাল

কোভিডকালে আমরা দেখেছি, কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক কমে গেছে। যাঁরা বিভিন্ন কাজে ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তঁারা চাকরি হারাচ্ছেন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তঁারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন। আইসিটি কত বড় শক্তি, এ সময়টা তা আমাদের শিখিয়েছে। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন করে আমাদের মেয়েরা এগিয়ে যেতে পারছে। আগে দেখা যেত, আইসিটিতে যে মেয়েরা অংশগ্রহণ করত, তারা ছিল শহরকেন্দ্রিক। এখন আর সেটা নেই। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিটি হাতিয়ার হিসেবে পৌঁছে গেছে। গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরা আইসিটি নিয়ে কাজ করছেন। ২০১৫ সালের দিকে প্রথম ন্যাশনাল গার্লস প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তখন যে সংখ্যক মেয়ে প্রোগ্রামিংয়ে অংশগ্রহণ করেছিল, এখন সে সংখ্যাটা ১০ গুণ বেড়েছে। নারীকে এগিয়ে নিতে চাইলে তার আত্মবিশ্বাস, দক্ষতা বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত অনুশীলন—এ তিনটির কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সামাজিক ও লিঙ্গসংক্রান্ত বাধাগুলো পেরিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে। দেশের অর্থনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

সুপারিশ

  • ইন্টারন্যাশনাল গার্লস ইন আইসিটি ডে (আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরী দিবস)-কে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

  • নারীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষায় আগ্রহী করতে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার।

  • তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও তদারকির ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

  • কোনো প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশের বেশি নারী কর্মী নিয়োগ দিলে তাদের সরকারি প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

  • নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানত ছাড়া স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা দরকার।

  • সাইবার হেল্পলাইনের প্রচার বাড়াতে গণমাধ্যমের আরও বেশি করে ভূমিকা নিতে হবে।

  • নারীর কর্মসংস্থান বাড়াতে বিপিও (বিজনেস প্রোসেস আউটসোর্সিং) খাতে জোর দেওয়া প্রয়োজন।

  • ভিন্নভাবে সক্ষম নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনা খরচে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করা জরুরি।

  • তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

  • তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে এনজিও, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।