নগর নীতিমালার অনুমোদন দিতে হবে

২০৪১ সালে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে নগর ঘিরে। প্রতিটি নগরকে এই বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

নিরাপদ ও সুষম নগর তৈরির জন্য জাতীয় নগর নীতিমালার অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন। ২০১৩ সালে খসড়া তৈরির পরও গত আট বছরে নীতিমালাটি অনুমোদন পায়নি। এদিকে পরিকল্পিত নগর তৈরিতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকে দুষলেন সিটি করপোরেশনের মেয়রেরা। তাঁদের ভাষ্য, ঝাড়ু দেওয়া আর মশা মারা শুধু মেয়রের কাজ নয়। সমন্বয়হীনতার কারণে নগরে জলাবদ্ধতা, জীর্ণ সড়ক, যানজটের মতো সমস্যা তৈরি হয়। অথচ সবকিছুর জন্য দোষারোপ করা হয় মেয়রদেরই।

গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় ‘মেয়র সংলাপ: নিরাপদ, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর’ শিরোনামে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল সংলাপে এসব মন্তব্য উঠে আসে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান এইডের (ইকো) সহযোগিতায় সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে। এতে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। এতে অংশ নেন সাতটি সিটি করপোরেশনের মেয়রেরা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, একটি নিরাপদ ও টেকসই শহর গড়তে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সব কটি প্রতিষ্ঠানের সহাবস্থানের সুযোগ আছে। সরকারি জমি, খাল অবৈধভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে ধনী ও দরিদ্র এলাকাভেদে হোল্ডিং কর এবং গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলের তফাত হতে হবে। তিনি বলেন, গ্রামকেও শহরে পরিণত করা হবে। গ্রামেও যেকোনো কিছু নির্মাণ করতে হলে সঠিক অবকাঠামোর মধ্য দিয়ে হতে হবে।

সংলাপে অংশ নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, গুলশান, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা বাড়ি তৈরির সময় সেপটিক ট্যাংক ব্যবহার না করে সরাসরি লেকের পানিতে ড্রেনেজ সংযোগ দিচ্ছেন। আবার তাঁরাই অভিযোগ করছেন, লেকের পানি দূষিত, দুর্গন্ধ। তিনি বাড়ির মালিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা এভাবে সিটি করপোরেশনের ড্রেনেজ সংযোগের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ দিতে পারবেন না।’

নগরে জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খাল ভরাট করে বাসস্থান নির্মাণের জন্য জমি বিক্রি করছে। তাদের মাস্টারপ্ল্যান ও বাস্তবতার কোনো মিল নেই। সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। তা না করে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে সাঁতার কাটতে বললে সাঁতার কাটা সম্ভব নয়।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, তাঁর ওখানে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পরিকল্পিত নগর উন্নয়নের সব কাজের দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। তাহলে মেয়রের কাজ কী? অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেওয়া না হলে নগর উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান করতে পারবে না সিটি করপোরেশন।

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, নগরের জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাট ঠিক রাখা এবং যানজট নিরসন করা বড় চ্যালেঞ্জ। সড়কে চলাচলের জন্য জেলা প্রশাসন ইচ্ছেমতো যানবাহনগুলোকে নিবন্ধন দিচ্ছে। চার-পাঁচ টন বহন সক্ষমতায় রাস্তা তৈরি করার পর তা দিয়ে চলছে ১০-১৫ টনের ট্রাক। বাইপাস সড়ক দরকার। এর জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় দরকার।

এ বছরও চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা যাবে না উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য টেকসই নগর গঠন জরুরি। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে সিটি করপোরেশনগুলোকে তাদের কাজের সাফল্য থেকে দূরে সরে যেতে হয়। প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যা কিছু দোষ, তা হয় মেয়রের।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গাজীপুরে চার হাজার শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড় দিচ্ছে। আর জনগণের অভিযোগ শুনতে হচ্ছে মেয়রকে। মেয়রের জবাবদিহি থাকে জনগণের কাছে। সরকারি বিভাগের সেই জবাবদিহি নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একসঙ্গে কাজ করা খুবই জরুরি।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক বলেন, সমন্বয় না থাকলে কাজ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। তাঁর এলাকায় সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই রাস্তা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা না দেখে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। নগরকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে হলে কর্মপরিকল্পনা ধরে কাজ করতে হবে।

সূচনা বক্তব্যে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক অনো ভ্যান মানেন বলেন, সবার জন্য নিরাপদ শহর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিশুদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। মোট জনগণের এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে শিশু।

অনুষ্ঠানে ইকোর হেড অব ইউরোপিয়ান কমিশনার্স ডিরেক্টরেট জেনারেল ড্যানিয়েলা দোসোঁ বলেন, কোভিড মহামারি আর্থসামাজিক এবং সব ধরনের স্বাভাবিক জীবনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাতে হাত রেখে সবাইকে একটি কাঠামোর মধ্যে নিরাপদ নগর গড়তে কাজ করতে হবে।

ইউএনডিপির সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আশেকুর রহমান বলেন, নগরে এখন এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বাস করে। আগামী ১৫ বছরে তা বেড়ে নগরে বসবাসকারীর সংখ্যা ৫০ শতাংশ হবে। নগর যেভাবে বেড়ে উঠছে, তাতে আয় ও সম্পদে বৈষম্য দেখা দিয়েছে। গ্রামের চেয়ে নগরের দরিদ্ররা আরও নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে বিআইপির প্রেসিডেন্ট আকতার মাহমুদ বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা, গণপরিবহনব্যবস্থা, গণপরিসর ব্যবহার, ভবন নির্মাণ কোড মানা ইত্যাদির মাধ্যমে নিরাপদ নগর গড়ে তুলতে হবে। নগর নীতিমালার অনুমোদন দেওয়া জরুরি। তাহলেই সারা দেশ সুষম নগর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হবে।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি বলেন, পরিকল্পিত নগর গড়তে সিটি করপোরেশনের দায়দায়িত্ব আছে। তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে হবে।