নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকার ও আন্তসংস্থার সমন্বয়

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান এইডের (ইকো) সহযোগিতায় সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকার ও আন্তসংস্থার সমন্বয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৮ এপ্রিল ২০২১। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

মো. এনামুর রহমান, এমপি

প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

মো. আতিকুল ইসলাম

মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

সেলিনা হায়াৎ আইভী

মেয়র, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন

মো. সাজ্জাদ হোসেন

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স

মো. আশরাফুল ইসলাম

প্রকল্প পরিচালক, ড্যাপ, রাজউক

মুকিত বিল্লাহ

প্রোগ্রাম সহকারী, ইকো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন

আশেকুর রহমান

সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি, ইউএনডিপি

মো. মোস্তাক হোসেন

পরিচালক, হিউম্যানিটেরিয়ান, সেভ দ্য চিলড্রেন

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

বর্তমানে আমরা একধরনের দুর্যোগের মধ্যে আছি। করোনা মহামারি চলছে। এটাও নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশ্বে প্রশংসনীয়। আজকের আলোচনায় অনেক সুপারিশ আসবে। নীতিনির্ধারকেরা এসব বিবেচনায় নিলে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারব। নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার ও আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে নগরের যেকোনো দুর্যোগ আমরা সহজে রোধ করতে পারব।

মো. মোস্তাক হোসেন

মো. মোস্তাক হোসেন

ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটেরিয়ান এইডের (ইকো) সহযোগিতায় সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে শহরকেন্দ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। কোভিড-১৯ বাস্তবতায় নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। গত ২০১৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি আইনগত স্বীকৃতি পায়। এ কমিটিকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এর সঙ্গে যদি অন্যান্য সংস্থার যোগসূত্র স্থাপন করা যায়, তাহলে আমরা নগরের ওয়ার্ড পর্যায়ে ভালোভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করতে পারব।

মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জানেন যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরবান কমিউনিটি ভলান্টিয়ার গাইডলাইন আছে। এই গাইডলাইন অনুমোদিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এই কমিউনিটি ভলান্টিয়ারদের নগরের ওয়ার্ড পর্যায়ে কাজে লাগাতে পারলে তাঁরা নগরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। ভলান্টিয়ারদের তথ্য ব্যবস্থাপনায় আনা জরুরি। তাহলে তাঁরা কে কোথায় আছেন, কী ধরনের দক্ষতা অর্জন করেছেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা সব জানতে পারব। সে ক্ষেত্রে নগরের দুর্যোগের সময় তাঁদের দ্রুত কাজে লাগাতে পারব। আপনারা জানেন যে ২০২০ সালের মার্চে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কোভিড-১৯ রোগী ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করে।

দু-তিন বছর আগে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) ও আর্মড ফোর্সের ডিভিশনের সহায়তায় আমরা মৃতদেহ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। এর সঙ্গে করোনাভাইরাসে মৃতদেহ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সংযোজন করা দরকার।

শহরে জলাবদ্ধতা, ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ডসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে সব সংস্থা যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তাহলে শহরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক স্থাপিত হবে। বাংলাদেশ সাইক্লোন, বন্যা—এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় রোল মডেল। নগরের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা রোল মডেল হতে হলে সবাইকে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে আরও কাজ করতে হবে।

মুকিত বিল্লাহ

মুকিত বিল্লাহ

উন্নয়ন সহযোগীদের একটা ভূমিকা থাকে। সেভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গে আমাদের যে সহযোগিতা আছে, সেটা অর্থের দিক থেকে খুব বড় কিছু নয়। উন্নয়ন সহযোগীরা আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কীভাবে কাজ করা যায়, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বব্যাপী এখন চিন্তা করা হচ্ছে, দুর্যোগের পূর্বে কীভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যেন ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। নগরের দুর্যোগের বিষয়টি অনেক জটিল। এখানে শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরু করে ভূমিকম্প পর্যন্ত সবই দুর্যোগ। এখন করোনা মহামারি একটা বড় দুর্যোগ। উন্নয়ন সহযোগীদের এ ধরনের দুর্যোগের বিষয় এখন থেকে ভাবতে হবে।

ভূমিকম্পের ওপর আন্তমন্ত্রণালয়ের একটা সভায় ছিলাম, সেখানে দেখলাম যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না, এমন ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন। তাই একা দুর্যোগ মন্ত্রণালয়কে কাজ করলে হবে না, সবাইকে অবশ্যই সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার ও আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।

সেলিনা হায়াৎ আইভী

সেলিনা হায়াৎ আইভী

সেভ দ্য চিলড্রেন আমাদের সঙ্গে ২০১৫ সাল থেকে কাজ করছে। তাদের সহায়তায় আমরা অনেকগুলো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। আমরা আলোচনায় শুনলাম সেভ দ্য চিলড্রেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির মাধ্যমে আমরা অনেককে সচেতন করতে পেরেছি। অনেক বেশি স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে পেরেছি। সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতায় ৩৫০ জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যে তাঁদের মহড়া দেওয়া হয়। যেন তাঁরা দুর্যোগের সময় দ্রুত এগিয়ে আসতে পারেন। তবে তাঁদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।

আজ আলোচনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আছেন। আমি তাঁকে অনুরোধ করব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য যেসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে যেন সিটি করপোরেশনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অমার মনে হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য যে লোকবল আছে, এত লোকবল অন্য কোথাও নেই। আবার সিটি করপোরেশনগুলো যেভাবে সামনে আসার কথা, সেভাবে আসে না। তারা রাস্তা ঝাড়ু থেকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত অনেক কাজ করে থাকে। কিন্তু তাদের বাজেট ঘাটতি থাকে।

তবে সেভ দ্য চিলড্রেনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই তাদের উদ্যোগের জন্য। আমরা অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি। এখন যেকোনো দুর্যোগে আমাদের লোকবল দ্রুত সেবা দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে আমার একটি অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের সুইপার কলোনি আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানে আমাদের ভলান্টিয়াররা কাজ করেছেন। আমরা তাদের নতুন ঘর করে দিয়েছি। দুর্যোগের সময় আমাদের কী করতে হবে, কী করণীয়, সেটা আমরা সবাই জানি। আমাদের শহরে গ্যাস থেকে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। মাননীয় মন্ত্রীকে বলব এ ব্যাপারে যেন কার্যকর উদ্যোগ নেন।

এখন করোনা মহামারি চলছে। এ ব্যাপারে আমরা অনেক কাজ করেছি। সেভ দ্য চিলড্রেনও সহযোগিতা করেছে। তারা ৪ হাজার ৫০০ টাকা করে প্রায় ১৫০টা পরিবারকে সহযোগিতা করেছে। মৃতদেহ দাফন-কাফন/সৎকারের জন্যও সেভ দ্য চিলড্রেন আমাদের লোকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য তারা ৫০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাঁরা আমার এলাকার মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার ব্যাপারে কাজ করবেন।

আমি একটা বিষয় বলতে চাই সেটা হলো, আমাদের তেমন কোনো বড় খোলা জায়গা নেই, যেখানে দুর্যোগের সময় মানুষ আশ্রয় নেবে। কোনো একটি শহরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা থাকার কথা। আমার মনে হয় না দেশের কোনো একটি শহরে এ ধরনের খোলা জায়গা আছে। আমি সব সময় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খোলা জায়গার কথা বলে থাকি। আমি মাননীয় মন্ত্রীকে অনুরোধ করব দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যেন এক নম্বর শর্ত দেওয়া হয় খোলা জায়গা রাখার জন্য। এখন থেকে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে শহরে খালি জায়গা পাওয়া যাবে না।

আমাদের রাস্তা প্রশস্ত হওয়ার পরিবর্তে মানুষের দখলে যাচ্ছে। যেকোনোভাবে প্রতিটা শহরে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা রাখার ব্যবস্থা করতেই হবে।

মো. সাজ্জাদ হোসেন

মো. সাজ্জাদ হোসেন

দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বয় খুব জরুরি এবং সমন্বয়ের মাধ্যমেই দুর্যোগ মোকাবিলা করা হয়। নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ভূমিকম্প ছাড়া অন্যান্য দুর্যোগ হলো আগুন ও আগুনসংক্রান্ত। বিশেষ করে আগুনসংক্রান্ত দুর্যোগ প্রায় প্রতিদিনই মোকাবিলা করতে হয়। অনেক সময় ভবন ধসে পড়ার সমস্যা রয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে মানুষের বিভিন্ন ভুলের জন্য দুর্যোগের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, নৌকা, লঞ্চডুবি ইত্যাদি।

তাই দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তসংস্থার সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। সমন্বয় ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলা আসলে সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে রয়েছে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রধানত স্বেচ্ছাসেবক দল।

শহর এলাকায় ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা আছে। আমরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে এ পর্যন্ত ৪৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেছি। ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক থাকার লক্ষ্য রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের একটি কর্মসূচি আছে। এটা পাস হলে দ্রুত প্রতি ওয়ার্ডে ২০০ জন স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করতে পারব।

বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজর ৪০০ জন মানুষ বাস করে। একটা শহরে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জায়গা খোলা থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকা শহরে ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি নেই। এ জন্য আন্তসংস্থার মধ্যে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।

ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ অ্যাডভাইজারি গ্রুপের আমরা সদস্য। আরবান সার্জেন রেসকিউ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমাদের কাজ করার কথা। এ গ্রুপের সদস্য হওয়ার জন্য তিন ধরনের দল থাকতে হয়। ভারী, মধ্যম ও হালকা। আমরা এ লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি।

এ গ্রুপের সদস্য হওয়ার জন্য যে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা, সেটা আমরা নিচ্ছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম পাচ্ছি। আরও আসছে। খুব দ্রুত হয়তো আমরা আরবান সার্জেন রেসকিউ গ্রুপের সদস্য হতে পারব।

এখন প্রশ্ন হলো, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী হবে। বিভিন্ন উদ্ধার দলের সঙ্গে কথা বলেছি। ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কী হবে, এটা বলা খুব মুশকিল। বহু বছর ধরে ঢাকা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠেছে। এখন সেটা আর হচ্ছে না।

এ শহরের মাটির নিচে কী কী সেবা আছে, আমরা অনেকে জানি না। বিশেষ করে গ্যাসলাইনের কোনো হিসাব নেই। কেউ সঠিকভাবে বলতে পারবে না কোথায় গ্যাসলাইন আছে, কোথায় নেই। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিমের মধ্যমে এসব বিষয়ে একটা জরিপ করা যেতে পারে।

এখনো যদি এই শহরকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফেরানো না যায়, তাহলে হয়তো পুরোনো স্থাপনার অধিকাংশই ধসে পড়বে। রাস্তা ফেটে গ্যাসলাইন থেকে আগুন ধরে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটতে পারে। আসলে কী হবে আমরা জানি না। এসবই ধারণা করছি।

২০১৫ সালে নেপালে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল। এই ভূমিকম্পের ৪৮ ঘণ্টা পর আমার নেপালে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। নেপাল আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশ নয়। এত উঁচু ভবনও সেখানে নেই। তারপরও নেপালে যে ভয়াবহতা দেখেছি, সেটা কল্পনা করা যায় না।

আমাদের এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে মাটির নিচের সেবাগুলো একটা আমব্রেলার আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে গ্যাসলাইনগুলো সেক্টর ভিত্তিতে জোনিং করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি বিশেষভাবে মাননীয় মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।

আশেকুর রহমান

আশেকুর রহমান

জাতীয় নগর নীতিমালা এখনো বাংলাদেশে হয়নি। আমাদের দেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। আমাদের নগরায়ণের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রায় সর্বোচ্চ। আমাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মনুষ শহর ও নগরে বাস করছে। গত এক দশকে নগর নীতিমালার খসড়া প্রণীত হয়েছে। এ নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে আমরা যুক্ত ছিলাম। আমরা জানি যে এটা এখনো অনুমোদিত হয়নি। নগর নীতিমালা অনুমোদিত না হওয়ার পেছনে আন্তমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার পেছনে যে রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক কারণ, সেটা হয়তো অন্য আলোচনা। আমাদের নগর উন্নয়নের ধারা ও প্রকৃতি দুটোই অপরিকল্পিত ও অসম।

ঢাকা মেগা সিটি। ঢাকার সঙ্গে অন্য শহরগুলোর অনেক পার্থক্য। এসব কারণে বলা যায়, আমাদের নগরগুলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমানে নগর দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থাপনা অনেকটা নাজুক, ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ। নগর দুর্যোগের যে পরিকল্পনা, সেটা তৈরি হয়েছে গ্রামের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধারণা থেকে। নগর দুর্যোগ যতটা না প্রাকৃতিক, তার থেকে অনেক বেশি মানবসৃষ্ট। নগর দুর্যোগ বহুমাত্রিক ও জটিল। এর সমন্বয়ের বিষয়টাও অনেক জটিল।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টারে (এসওডি) সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার যে বিধান রয়েছে, সেখানে জলাবদ্ধতা, পাহাড়ধস, বস্তির পরিকল্পিত ও স্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি খুব বেশি জোরালোভাবে নেই। আলোচনায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যার কথা এসেছে। এখান থেকে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু নগর ঝুঁকি মোকাবিলায় এসব তেমনভাবে নেই।

আমাদের নগরের নতুন বাস্তবতায় এর পরিধি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আরও বাড়তে থাকবে। তাই নগর দুর্যোগের প্রচলিত ধারণা দিয়ে বর্তমানের নগর দুর্যোগ মোকাবিলা করা যাবে না।

কেন আমরা স্থানীয় সরকার ও আন্তসংস্থার সমন্বয় চাই? পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনকে কিন্তু অনেক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এসব দায়িত্ব পালনের যে ক্ষমতা, সেটা তাদের আছে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এর জন্য জনবল ও অর্থের প্রয়োজন। কার্যকর নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আসলে কার্যকর নগর সরকার বা শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের নীতিমালা ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।

নগর দুর্যোগ মোকাবিলার কার্যকর মডেল এখনো তৈরি করতে পারিনি। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের যে স্থায়ী আদেশাবলি, বিশ্বে এটা প্রশংসিত। এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে যতটা সফল, নগরের ক্ষেত্রে ততটা সফল নয়।

বর্তমানের কোভিডও একধরনের নগর দুর্যোগ। এ দুর্যোগ কিন্তু সফলভাবে মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। নগর দুর্যোগ মডেল তৈরির দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এটা করতে হবে।

মো. আশরাফুল ইসলাম

মো. আশরাফুল ইসলাম

দুর্যোগ মোকাবিলায় নগর-পরিকল্পনা জরুরি। আমরা দুর্যোগ বন্ধ করতে পারব না। কারণ, আমরা জানি না কখন ভূমিকম্প, বন্যা, ঝড়-বৃষ্টি হবে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা থাকল ঝুঁকি কমাতে পারব। তাহলে প্রাণহানি কম হবে। অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।

ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, আরও সাতটি পৌরসভাসহ অনেকগুলো উপজেলা ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের আওতাভুক্ত। ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে বন্যার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া আছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জাতীয় ভবন নির্মাণ বিধি মেনে চলার নির্দেশনা আছে। ঢাকা মহানগরের এলাকাভিত্তিক মাটির ধরনের তথ্য আমাদের নেই। রাজউক ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্প নিয়েছে। প্রতি ১০০ মিটার পর মাটির তথ্য সংগ্রহ করেছি। এটা এখন বিশ্লেষণ পর্যায়ে আছে। চূড়ান্ত তথ্য পেলে জানাতে পারব কোন এলাকায় কী ধরনের, কত তলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। এটা আমরা আমাদের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে যুক্ত করব। এর মধ্যমে নগরবাসী সুবিধা পাবে।

নগরে খোলা জায়গার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করলাম। কিন্তু ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসে রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো পার্কও খোলা জায়গা সেভাবে তৈরি করতে পারেনি। বিষয়টিতে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে। রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে রমনা ও সোহরাওয়ার্দীর মতো ১০টি পার্ক বা খোলা জায়গার ব্যবস্থা রেখেছি। সরকার অথবা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে খোলা জায়গা তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে।

ঢাকা মহানগরের জনঘনত্ব অনেক। একে বহুতল ভবন দিয়ে ঢেকে ফেললে দুর্যোগ মোকাবিলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এলাকার জনঘনত্ব বিবেচনা করে আমরা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান করেছি। এসব বাস্তবায়িত হলে নগরের মানুষ ব্যাপক উপকৃত হবে।

মো. আতিকুল ইসলাম

মো. আতিকুল ইসলাম

শুরুতে এক হাজার শয্যার কোভিড হাসপাতালের বিষয়টি বলতে চাই। তারপর মূল আলোচনায় আসছি। আপনারা অনেকে জানেন কারওয়ান বাজার স্থানান্তরিত হবে। এটা গাবতলীর আমিনবাজার, যাত্রাবাড়ী ও মহাখালী যাবে। মহাখালীতে কারওয়ান বাজার থেকে ৩৬০টা দোকান স্থানান্তরিত হবে। আমরা ২৫৮টা দোকান ইতিমধে্য বরাদ্দ দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে মহাখালীর বাজারের জায়গায় হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিই। যাঁদের দোকান বরাদ্দ দিয়েছিলাম, তাঁদের প্রায় সাবইকে বুঝিয়ে টাকা ফেরত দিয়েছি। এটা এখন এক হাজার শয্যার কোভিড হাসপাতাল। এই মুহূর্তে ১৫০টা অক্সিজেন বেড আছে। ২০টা আইসিইউ বেড আছে। মে মাসে গিয়ে ২০০টা আইসিইউ বেড হবে। আর ৮০০টা হবে অক্সিজেন বেড।

খাল আমাদের নিয়ন্ত্রণে কখনো ছিল না। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমরা এটা পেয়েছি। আমরা প্রায় নিয়মিত খাল পরিদর্শন করছি। কে কোন সংস্থায় আছি, কার অধীনে আছি, সেটা বড় কথা নয়। আমার কথা হলো, আমরা কাজ করব নগরবাসী, দেশ ও মানুষের জন্য।

নগরের ঝুলন্ত তার যদি আমরা কাটি, তাহলে সমস্যা হতে পারে। আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসেছি। তাঁদের বলেছি, আপনারা নিজেরা আপনাদের তার কাটবেন। উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে খাল আছে। একজন প্রভাবশালী মানুষ খালের একটা অংশ দখল করেছেন। আমি সবাইকে নিয়ে খালটা উদ্ধার করি। আমরা অবশ্যই খালগুলো দখলমুক্ত করব। যাঁরা খাল দখল করেন, তাঁদের এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করতে হবে।

আমি যত দিন আছি, একজন নগরসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাই। ‘সবার ঢাকা’ নামে আমরা অ্যাপ তৈরি করেছি। আপনাদের যাঁর যে সমস্যা আছে, আপনারা ‘আমার ঢাকা’ অ্যাপে জানান। আমরা যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করে দেব। ম্যানহোলের ঢাকনা থাকবে না, রাস্তায় লাইট থাকবে না, ময়লা জমে থাকবে—মানুষ যেন এসব অভিযোগ জানাতে পারে, সে জন্যই অ্যাপ।

কিছুদিন আগে আমাদের অ্যাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছেলে ময়লা জমে থাকার কথা লিখল। কিছুক্ষণ পরই তার কাছে ময়লা সরিয়ে ফেলার জন্য ফোন গেল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না আমাদের দেশে এমন হতে পারে।

সিটি করপোরেশনকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে চাই। অনলাইনের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স পরিশোধের উদ্যোগ নিচ্ছি। সবার সহযোগিতায় আমরা একটি পরিকল্পিত নগরী করতে চাই।

নগর দুর্যোগে সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য কমিটি আছে। আমি সে কমিটির সভাপতি। এফঅার টাওয়ারে আগুন লাগলে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করেছি। পরিকল্পিত নগরের জন্য সমন্বিতভাবে সবাই একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

মো. এনামুর রহমান

মো. এনামুর রহমান

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশে একটি জাতীয় কমিটি বা ন্যাশনাল ডিজাস্টার কাউন্সিল আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এর সভাপতি। বছরে একবার কমিটির সভা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১০ সালের দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থায়ী কার্যাদেশের নতুন সংস্করণ ২০১৯ সালে বের হয়েছে। এখনে ওয়ার্ড কমিটির বিষয়টি যুক্ত হয়েছে।

উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ার্ড কমিটি আছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড কমিটি নেই। এ জন্য নগরের দুর্যোগ মোকাবিলা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ঢাকা মহানগরসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড কমিটি গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেব। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সভা থেকে যে দিকনির্দেশনা আসে, সেগুলো নীতিমালায় সংযোজন করি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি আছে। পদাধিকারবলে আমি এ কমিটির সভাপতি। আমার সঙ্গে স্থানীয় সরকার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সড়ক ও সেতু, পূর্ত, সমাজকল্যাণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও অন্যান্য মন্ত্রণালয় আছে। তিন মাস পরপর আমরা সভা করি। দুর্যোগের পর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সভা করি। এসব সভার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্যোগ নিই।

নগর দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস, জলাবদ্ধতা, গ্যাসলাইন ও কেমিক্যাল দুর্ঘটনা ইত্যাদি। আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও একধরনের দুর্যোগ। বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় উদ্ধার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা জরুরি। এসব যন্ত্রপাতি কেনার আগে সার্স অ্যান্ড রেসকিউ অপারেশন নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের নিয়ে আলোচনা করেছি। এর মধ্যে ছিল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, সেনা, পুলিশ, বিমান ও নৌবাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, আনসার ভিডিপি, কোস্ট গার্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে বসেছি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আগে কোনো একাডেমিক স্বীকৃতি ছিল না। এখন এটা পাঠ্যপুস্তকে এসেছে। ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটিস বিষয়ে অনার্স–মাস্টার্স কোর্স করা হয়েছে। দুর্যোগে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রাখা ও সেবাদানের জন্য গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে খোলা জায়গা রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ দরকার। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে এটা আছে। আমাদের ছিল না। ২০১৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তেজগাঁও এলাকায় ১০০ কাঠার জায়গা পেয়েছি। এখানে চীনের সহযোগিতায় একটি বিশ্বমানের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণকক্ষ গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে দেশের যেকোনো এলাকার দুর্যোগ সম্পর্কে জানতে পারব ও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারব।

দুর্গম এলাকায় আমাদের উদ্ধার ও ত্রাণ পরিচালনা করতে অসুবিধা হতো। তাই নৌবাহিনী পরিচালিত একটি সংস্থা থেকে ৬০টি বোর্ড নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। এ বছর ২০টি পাব। আগামী দুই বছরে অরও ৪০টি পাব।

আমাদের নগরগুলো ভূমিকম্প সহনীয় করার জন্য জাপানের জাইকার সঙ্গে ৫০ বছরের চুক্তি করেছি। জাপান গত ৩০ বছরের চেষ্টায় তাদের দেশের ভবনকে ভূমিকম্প সহনীয় করতে পেরেছে। জাপানে ১০ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও তাদের ভবন ধসে পড়ে না। ৫০ বছরে তিন ধাপে আমাদের দেশে জাইকা কাজ করবে। আমাদের ভবনগুলো ধীরে ধীরে ভূমিকম্প সহনীয় হতে থাকবে।

আমরা আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় অটো শাটডাউন টেকনোলজির বিষয়ে আলোচনা করেছি। ভূমিকম্প হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন যেন স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্র করার জন্য আমরা জাইকার সঙ্গে যে ৫০ বছরের চুক্তি করেছি, এর মধ্যে অটো শাটডাউন টেকনোলজির বিষয়টি আছে।

‘দুর্যোগ মোকাবিলায় ভলান্টিয়ারিজমের গুরুত্ব’ শিরোনামে অামরা ওয়েবিনার করেছি। এ আলোচনায় ভলান্টিয়ারদের জন্য বাজেট বরাদ্দ ও তাঁদের সম্মানী দেওয়ার বিষয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি এটা অনুমোদন করেছে।

সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের ভলান্টিয়ার বাড়ানোর ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। রানা প্লাজা ধসের সময় ভলান্টিয়ারদের ভূমিকার কথা আপনারা জানেন। এ ছাড়া সাইক্লোন দুর্যোগে তাঁরাই সবার সামনে থাকেন। আমাদের দেশে সব মিলিয়ে ৪২ লাখ ভলান্টিয়ার আছেন। বিশ্বের অনেক দেশে ৪২ লাখ মানুষ নেই। এ জন্য বিশ্বে আমরা প্রশংসিত হয়েছি।

আমরা ভলান্টিয়ার নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও তাঁদের সরঞ্জাম দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। বছরে দুবার আমাদের জাতীয় দুর্যোগ কমিটির সভা হয়। তা ছাড়া যেকোনো দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলেই জাতীয় দুর্যোগ কমিটির সভা হয়। সব মিলিয়ে বছরে ছয় থেকে আটটি সভা হয়।

ভূমিকম্প সহনীয় নগর করার জন্য জাপানের সঙ্গে যে ৫০ বছরের চুক্তি করেছি, এর আলোকে তারা ঢাকা মহানগরসহ দেশের অন্যান্য শহরে ১০০ থেকে ৪০০ বছরের যেসব পুরোনো ভবন আছে, সেগুলো ভেঙে ফেলবে। তারপর সেখানে তাদের সহযোগিতায় ভূমিকম্প সহনীয় ভবন করে দেবে। আর বহুতলসহ যেসব ভবন থাকবে, সেগুলোর মধ্যে যে ভবনগুলো

ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো রেক্টোফিটিংয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী করবে। আমাদের প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেবে, যেন তাঁরা জাতীয় নির্মাণ বিধির সঙ্গে সমন্বয় করে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ করতে পারেন। করোনা না হলে আমরা এত দিনে কাজ শুরু করতাম।

আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করার আগে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করেছি। তাদের সুপারিশ নিয়ে এটা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ পরিকল্পনার কপি প্রিন্ট হয়ে এলে আমরা সবাইকে নিয়ে একটি গোলটেবিলের আয়োজন করব।

সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করে একটা দুর্যোগ সহনীয় নগর গড়ে তোলা সম্ভব। মাননীয় মেয়র অাতিকুল ইসলাম, মাননীয় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি।

ফিরোজ চৌধুরী

নগরকেন্দ্রিক দুর্যোগের নানা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি কার্যকর সমন্বয় ব্যবস্থাপনা থাকলে নগরকেন্দ্রিক ঝুঁকি মোকাবিলা করা সহজতর হবে।

আজকের গোলটেবিল থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেবে বলে আশা করি। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে কমিউনিটি ভলান্টিয়ারদের নগরের ওয়ার্ড পর্যায়ে কাজে লাগাতে হবে।

  • মাটির নিচে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ যেসব ইউটিলিটি সেবা আছে, সেগুলোর সমন্বয় জরুরি।

  • বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে মাটির নিচের অপরিকল্পিত গ্যাসলাইন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হতে পারে। তাই গ্যাসলাইনগুলো সেক্টর ভিত্তিতে জোনিং করে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

  • শহরকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফেরাতে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

  • ভূমিকম্পসহ যেকোনো দুর্যোগে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন যেন অটো শাটডাউন হয়, সে ব্যাপারে উদে্যাগ নিতে হবে।

  • পরিকল্পিত নগরের জন্য কে কোন সংস্থায় আছি, কার অধীনে আছি, সেটা বড় কথা নয়। সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

  • শহরে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খোলা জায়গা অবশ্যই রাখতে হবে। এ বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে শহরে খালি জায়গা পাওয়া যাবে না।

  • নগরগুলোকে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় আপৎকালীন পরিকল্পনা প্রণয়ন, পর্যালোচনা ও বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।

  • ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসে রমনা পার্ক বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো পার্ক অথবা খোলা জায়গা তৈরি করতে পারেনি। বিষয়টিতে এখনই গুরুত্ব দিতে হবে।