নিউমোনিয়া রুখে যাক, সব শিশু ভালো থাক: নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন সক্ষমতা বাড়াতে হবে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের আয়োজনে ‘নিউমোনিয়া রুখে যাক, সব শিশু ভালো থাক: নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন সক্ষমতা বাড়াতে হবে’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১১ নভেম্বর ২০২১। সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো। গোলটেবিল আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

অংশগ্রহণকারী

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন)

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা

চেয়ারম্যান এনটিডব্লিউসি

ডা. শানজানা ভরদ্বাজ

স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

ডা. মো. শামসুল হক

ডিরেক্টর, ডিজিএইচএস অ্যান্ড লাইন ডিরেক্টর, এমএনসি অ্যান্ড এএইচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মোহাম্মদ শরীফ

পরিচালক, এমসিআরএএইচ অ্যান্ড লাইন ডিরেক্টর, এসসিআরএএইচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

অধ্যাপক শাকিল আহমেদ

অধ্যাপক, শিশুরোগ বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক পলমোনারি ফোরাম

ডা. মুহাম্মাদ শরিফুল ইসলাম

পিএম, এনএনএইচপি অ্যান্ড আইএমসিআই, এমএনসি অ্যান্ড এএইচ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সাব্বির আহমেদ

উপদেষ্টা, নিউমোনিয়া সেন্টেনারি কমিটমেন্ট

ডা. নুরুল ইসলাম খান

জাতীয় পরামর্শক, মা ও শিশুরোগ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

শেখ দাউদ আদনান

উপপরিচালক হাসপাতাল শাখা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর,

শামিনা শারমীন

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ইউনিসেফ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

সুপারিশ

■ অক্সিজেনের সরবরাহ প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন

■ অক্সিজেন সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়

■ নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে

■ সময়মতো অক্সিজেন থেরাপির ব্যবহার নিশ্চিত করা

■ নতুন সেক্টর প্রোগ্রামে নিউমোনিয়াসংক্রান্ত ভালো একটি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করা উচিত

■ ন্যাশনাল বাজেট ফর নিউমোনিয়া ম্যানেজমেন্ট প্রণয়ন করা জরুরি

■ কমিউনিটিকে অক্সিজেন-স্বল্পতার নির্দেশিকা সম্পর্কে জানাতে হবে

■ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য ইনডোর পেডিয়াট্রিক সাপোর্ট ও ইনডোর ম্যানেজমেন্টের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন

■ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় যেকেনো মূলে্য অক্সিজেন খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।

■ অক্সিজেনের অভাবে যেন কোনো শিশুর মৃতু্য না হয়

■ শিশুদের জন্য উপযোগী পালস অক্সিমিটার তৈরি করা প্রয়োজন

■ নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আজকের আলোচনার বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউমোনিয়ার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ও ফুসফুসে প্রদাহ হয়। নিউমোনিয়া ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস থেকে হতে পারে। শিশুদের এ রোগ বেশি হয়। বিশেষ করে নিউমোনিয়ার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু উদ্বেগজনক। এসডিজি অনুসারে নিউমোনিয়ায় মৃত্যু প্রতি হাজারে ২৫-এর নিচে রাখতে হবে। নিউমোনিয়ার কারণে এখন বছরে ২৪ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে।

মুহাম্মাদ শরিফুল ইসলাম

মুহাম্মাদ শরিফুল ইসলাম

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নিউমোনিয়া। প্রতিবছর নিউমোনিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী সাড়ে তিন লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। প্রতিদিন দুই হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে। এর মূল কারণ টিকাসুবিধা না পাওয়া এবং অক্সিজেন ও অ্যান্টিবায়োটিকের মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ সময়মতো না পাওয়া। প্রতিবছর বিশ্বে ৪২ লাখ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে টিকার তেমন সংকট না থাকলেও আফ্রিকার দেশগুলোতে এ চিত্র ভয়াবহ।

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৩৩টি শিশুর মৃত্যু হতো। এদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় মারা যেত ২৫টি শিশু। এখন এ সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ৪৫-এ। এ সময় নিউমোনিয়ার কারণে মৃত্যু হয় প্রতি হাজারে ৮টি শিশুর। দেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর ১৮ শতাংশই নিউমোনিয়াজনিত।

বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় প্রতিবছর ৫ বছর বয়সের কম ২৪ হাজার শিশুর মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে অন্তত ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু হাইপোকশিমিয়ায় মারা যায়। তাদের জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেনের প্রয়োজন হলেও ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। দেশে নিউমোনিয়ায় মৃতদের ৪৫ শতাংশেই ফ্যাসিলিটি পর্যায়ে। এর অন্যতম কারণ হলো দেরি করে হাসপাতালে আসা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশই বাড়িতে চিকিৎসা নেয়। অবস্থা একেবারেই খারাপ হলে তারা হাসপাতাল আসে।

হাইপোকশিমিয়া হলো রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকা। হাইপোকশিমিয়া হওয়ার প্রধান তিনটি কারণ হলো নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা। হাইপোকশিমিয়ার ফলে ব্রেন ড্যামেজ হতে পারে ও শ্বসনতন্ত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। পালস অক্সিমিটার ও ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজারের মাধ্যমে এটি শনাক্ত করা যায়।

আমাদের দুর্বলতা হলো সব জায়গায় অক্সিজেন সহজলভ্য নয়। আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ পদ্ধতি অনেক বেশি জটিল। হাইপোকশিমিয়া শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় পালস অক্সিমিটারের স্বল্পতা ও অক্সিজেন থেরাপি সময়মতো ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। দেশের ৪২টি জেলায় ৪৮টি নবজাতক বিশেষ যত্ন ইউনিট আছে। এসব ইউনিটের প্রতিটি বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা হাসপাতালগুলোর পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডেও অক্সিজেন-সুবিধা সহজলভ্য করা হয়েছে। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সিলিন্ডারের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়া হয়। হাইপোকশিমিয়া ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেনের নিরাপদ ও যৌক্তিক ব্যবহারে একটি জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এগুলো শিগগিরই সহজলভ্য করা হবে। অক্সিজেনের যৌক্তিক ব্যবহারে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

মোহাম্মদ সহিদুল্লা

পৃথিবীতে রোগ থাকবেই। আমাদের রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচতে হয়। অনেক সময় আমরা সে লড়াইয়ে সফল হই। আবার ব্যর্থ হয়ে অনেকে মারাও যান। কিন্তু নিউমোনিয়ার মতো একটি প্রতিকারযোগ্য রোগে শিশুদের মৃত্যু সত্যিই মেনে নেওয়া কষ্টকর। শিশুরা আমাদের প্রাণের সম্পদ। তাদের কিছু হলে আমাদের খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। একটি শিশুর জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি হলো। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। কিন্তু তাকে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে না পারায় তার মৃত্যু হলো। এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।

এসব বিষয় নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি, বলে যাব। কিন্তু যদি আমরা এর সমাধান না করতে পারি, তাহলে অকালে অনেক শিশুকে প্রাণ দিতে হবে। আলোচনায় বারবারই অক্সিজেন-স্বল্পতার বিষয়টি আসবে।

করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৪৭টি সভা হয়েছে। অধিকাংশ সভায় আমরা অক্সিজেনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। অনেক সময় দুর্ভোগ সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়। করোনার কারণে আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। করোনার আগে তীব্র অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর কৃতিত্ব অবশ্যই সরকারের, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ইউনিসেফ ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের।

এখন পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সের শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। আমাদের দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে অকালে অনেক শিশুকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। নতুন সেক্টর প্রোগ্রামে আমাদের নিউমোনিয়াসংক্রান্ত ভালো একটি স্ট্র্যাটেজি, একটি গাইডলাইন, ন্যাশনাল বাজেট ফর নিউমোনিয়া ম্যানেজমেন্ট থাকা বেশ জরুরি। তবে যতক্ষণ না এ কাজগুলো করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অবস্থার উন্নতি হবে না।

শাকিল আহমেদ

শাকিল আহমেদ

শিশুদের ফুসফুসের সঙ্গে বড়দের ফুসফুসের পার্থক্য রয়েছে। শিশুদের ফুসফুস বিকাশমান অবস্থায় থাকে। তাদের ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্র অপরিণত থাকে। তাই তাদের ঝুঁকির মাত্রাও অনেক বেশি। শিশুদের ফুসফুস হঠাৎ চুপসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া তাদের শ্বাসনালিও চুপসে যেতে পারে। আর এ জন্যই পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু বেশি হয়। অল্প মাত্রার সংক্রমণ বড়দের ক্ষেত্রে আতঙ্কের কারণ না হলেও শিশুদের জন্য তা-ও ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় শিশুদের শ্বাস গ্রহণের সময় সংশ্লিষ্ট মাংসপেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। তখন শিশুটি আর শ্বাস গ্রহণ করতে পারে না।

ফুসফুসের প্রধান কাজ হচ্ছে সারা দেহে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের চাহিদা মেটানো। অক্সিজেন জোগানের পরিমাণ কমে যাওয়াই হলো অক্সিজেন-স্বল্পতা বা হাইপোকশিমিয়া। কারও হাইপোকশিমিয়া হলে তা বাড়ি থেকেই বুঝতে হবে। হাসপাতালে এসে বুঝলে ৪৫ শতাংশই মারা যাবে। বাড়ি থেকে দুভাবে এটি বোঝা সম্ভব—পালস অক্সিমিটার ও আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে শরীরের ধমনি থেকে রক্ত নিয়ে তা মেশিনের মাধ্যমে পরীক্ষা করে অক্সিজেনের পরিমাণ জানা যায়। তবে কিছু লক্ষণ দেখেও এটা বোঝা সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে শিশুদের বুকের খাঁচা নিচে দেবে যায়। এটি হলে দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। শিশুর মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে যায়, অক্সিজেন কম থাকে বলে শিশু কাঁদতেই থাকে, শিশু দ্রুত শ্বাস নেয়, তার গলার মাংসপেশি ফুলে যায়।

নিউমোনিয়া প্রতিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রোগের গভীরতা বুঝতে পারা। আর এটি পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে করা সম্ভব। এ জন্য পালস অক্সিমিটার সহজলভ্য করতে হবে। বাংলাদেশে তৈরি করলে কম খরচে এটি বাজারে পাওয়া যাবে। বাইরে থেকে যেসব লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে কোনো শিশুর হাইপোকশিমিয়া হয়েছে কি না, সেগুলো সবাইকে জানাতে হবে। কমিউনিটিকে অক্সিজেন-স্বল্পতার নির্দেশিকা সম্পর্কে জানাতে হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের নানা কর্মসূচির মাধ্যমে কমিউনিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, হাইপোকশিমিয়া হলে হাতে খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। দ্রুত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হয়। তা না হলে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মো. শামসুল হক

মো. শামসুল হক

হাইপোকশিমিয়া ব্যবস্থাপনায় অক্সিজেন সবচেয়ে বড় উপাদান। করোনার কারণে আমাদের অক্সিজেন সক্ষমতা অনেক গুণ বেড়েছে। আমাদের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ সক্ষমতা বেড়েছে। ইতিমধ্যে করোনার প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেনের মজুত ও সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের একজন মানুষও যদি তাঁর সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন, তার জন্য চিকিৎসক ও অক্সিজেন সরকার নিশ্চিত করতে পেরেছে। বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আগে অক্সিজেনের ঘাটতির জন্য সিলিন্ডার না থাকা বা সাপ্লাই চেইনের সমস্যা দায়ী ছিল। আমরা এখন এসব কাটিয়ে উঠেছি।

করোনা পরিস্থিতি আর অবনতির দিকে না গেলে অক্সিজেন সরবরাহ নিয়মিত কার্যক্রমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটি হাসপাতালে জরুরি বিভাগে অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। হাইপোকশিমিয়ার উপসর্গ দেখা দেওয়া শিশুদের হাসপাতালে আনা হলে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আর হাসপাতালে জন্মানো কোনো শিশুর প্রয়োজনে অক্সিজেন সেবার আওতায় আনা যায়। উপজেলা পর্যায়ে লেবার রুমেও অক্সিজেনের নিশ্চয়তা রয়েছে।

আর উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আনা কোনো শিশুর অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না, তা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য চিকিৎসক, নার্স, উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

মোহাম্মদ শরীফ

মোহাম্মদ শরীফ

অনেক সমস্যার পরও ফসলভাবে আমরা এগোচ্ছি। আমরা যদি কিছু পূর্বপ্রস্তুতি নিই, তাহলে নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা পাব। কমিউনিটিতে আমাদের পরিবারকল্যাণ সহকারীসহ অনেক মাঠকর্মী আছেন। তাঁরা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের ইউনিয়ন, জেলা, উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কাজ করছে। ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা দিচ্ছে। নিউমোনিয়ার কারণগুলো হলো অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা, অপুষ্টি ও বায়ুদূষণ। এসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। মায়ের দুধ পানের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সঠিকভাবে মায়ের দুধ পান করলে ১৫ থেকে ২৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া জরুরি। কোনোভাবেই
শিশুদের সামনে ধূমপান করা যাবে না। রান্নাঘর ও শোবার ঘরের দরজা-জানালা খুলে রাখতে হবে। শিশুদের ভিটামিন এ পাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নিলে আমরা নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা পাব। আগে পরিবার পরিকল্পনা বলতে পিল, কনডমসহ বিশেষ কিছু সেবার কথা ভাবত। এখন মা ও শিশুস্বাস্থ্য, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ অনেক ধরনের সেবা আমরা দিচ্ছি। আমাদের প্রায় ছয় হাজার পরিবারকল্যাণ সহকারীসহ সবাইকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। একসময় অক্সিজেনের কথা জানতও না।

এবার কোভিডের জন্য ব্যাপকভাবে অক্সিজেনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এ ক্ষেত্রে শিল্প অক্সিজেন নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আইসিইউতে আমরা শিল্প অক্সিজেন দিতে পারি না। অ্যান্টিবায়োটিকের ভারসাম্য ব্যবহার নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। পালস অক্সিমিটার বাংলাদেশে বানানো হোক। যেন এটা সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবাই মিলে কাজ করলে স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি উন্নতি করতে পারব

নুরুল ইসলাম খান

নুরুল ইসলাম খান

২০১৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর নিউমোনিয়া অ্যান্ড ডায়রিয়ার প্রকল্প গ্রহণ করে। এটার মূল উদ্দেশ্য হলো নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার কমানো। প্রকল্পটি শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে নিরাপত্তার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কীভাবে কাজ করতে হবে, তার শিক্ষা দেয়। নিউমোনিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ এই প্রকল্পটি গ্রহণ করে। প্রকল্পটি শিশুদের সঠিকভাবে মাতৃদুগ্ধ ও অন্যান্য সুষম খাদ্যের মাধ্যমে তাদের সুস্থ রাখার শিক্ষা নিশ্চিত করে। নিউমোনিয়ার টিকা এবং আক্রান্ত শিশুদের যথাযথ যত্ন ও চিকিৎসার বিষয়টি প্রকল্পটির একটি বড় উদ্যোগ।

যদি রোগটি মারাত্মকভাবে আক্রমণ করে, তবে তখন তাদের অ্যান্টিবায়োটিক ও অক্সিজেন দিতে হবে। বাংলাদেশ, ভারত, কেনিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়াসহ বেশ কিছু দেশ সমন্বিতভাবে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। এ ছাড়া আরও অনেক দেশ তাদের দেশে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নবজাতকদের নিয়ে কাজ করছে, যাতে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা যায়। কারিগরি সাহায্য, নির্দেশনা ও পরামর্শকের মাধ্যমে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

শামিনা শারমীন

শামিনা শারমীন

নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া এবং শিশুদের অন্য যেসব রোগ হয়, সেগুলো নিয়ে ইউনিসেফ কাজ করছে। জনগণের সচেতনতার পরও এখনো পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ মারাত্মক নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়ায় যত শিশু মারা যাচ্ছে এর ৪৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে হাসপাতালেই। শিশুরা নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে এলে তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন থেরাপির ব্যবস্থা না দেওয়া গেলে মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। আমরা সব সময় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নতুন আবিষ্কারগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমার মনে হয়, আমরা জনসচেতনতার স্বার্থে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য ইনডোর পেডিয়াট্রিক সাপোর্ট ও ইনডোর ম্যানেজমেন্টের দিকে আরও একটু নজর দিতে পারি।

শিশুরা অসুস্থ হলেই মায়েরা কমিউনিটি ক্লিনিকে চলে যাচ্ছে, যেখান থেকে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল এবং হায়ার সেন্টারে। কমিউনিটি ক্লিনিক বা উপজেলা হেলথ সেন্টারে আমাদের সার্ভিস প্রোভাইডারদের অবশ্যই কিছু ব্যাপারে জানতে হবে।

শিশুর হাইপোকশিমিয়া আছে কি না, সেটা অনেক সময় দেখে বলা যায় না। আমরা যাতে চিকিৎসা এবং নজরদারির জন্য নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করতে পারি, সেই বিষয়ে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে। আমাদের এখন প্রপার অক্সিজেন থেরাপির গাইডলাইন তৈরি হয়েছে এবং এ বিষয়ে ট্রেনিং শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক দূর যেতে হবে। ১৩টি জেলা এই পর্যন্ত কাভার করা গেছে।

শিশুমৃত্যুর হার কমাতে যাতে আমরা এই সেবা সারা বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারি, সে ব্যাপারে সরকারি পরিকল্পনা দরকার। করোনার কারণে যে সাহায্যগুলো পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অক্সিজেন সিস্টেম উল্লেখযোগ্য। সরকার ও পার্টনারদের অনুরোধ, যাতে এই করোনা পরিস্থিতিকে আমরা সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাই। লিকুইড অক্সিজেনের যে ব্যবস্থাটা দরকার, সেটা যাতে সম্পূর্ণ বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে পারি, তা নিশ্চিত
করতে হবে।

করোনাভাইরাস সব সময় থাকবে না; কিন্তু শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা—এসবের জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা সব সময় থাকবে। ইউনিসেফ সব সময়ই সরকারের সঙ্গে কাজ করবে।

সাব্বির আহমেদ

সাব্বির আহমেদ

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই যে শিশুমৃত্যুর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী নিউমোনিয়া। সারা বিশ্বে প্রতিদিন দুই হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যাচ্ছে। কী করতে হবে, তার সমাধানটা আমরা জানি। এই সমাধানটাকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—নিরাপত্তা, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা। আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও কিন্তু নিউমোনিয়ার ভালো চিকিৎসা রয়েছে। হাতের কাছে পালস অক্সিমিটার, অক্সিজেন সেবা—সবকিছু থাকলেও সচেতনতার ক্ষেত্রে একটা বিরাট ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। তার ওপর যারা হাসপাতালমুখী হচ্ছে, তাদের একটা বড় অংশ যাচ্ছে ইনফরমাল প্রোভাইডারদের কাছে। যার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাতেও আমাদের একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয় বিবেচনা করে ২০২০-এ বার্সেলোনাতে একটা গ্লোবাল সামিট অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের ডিরেক্টর ও পিএম সেখানে ছিলেন। সামিটে দেখা যায়, নাইজেরিয়া নিউমোনিয়া প্রতিরোধে অনন্য কাজ করেছে। তারা নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছে। সামিট থেকে মোট ছয়টি ঘোষণা এসেছিল। প্রথমটি ছিল অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করবে। ডিরেক্টর ও পিএম সেখান থেকে এসে ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থানুসারে নিজেদের কৌশল উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। আমরা সেভাবেই আমাদের দেশে কাজ করব। তাহলেই আমরা সফল হতে পারব। নিউমোনিয়া প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতার একটা বিরাট ভূমিকা আছে। একই সঙ্গে টিকাও বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। বায়ু ও পরিবেশদূষণ রোধ করা গেলে অনেকাংশে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণে আসবে।

শেখ দাউদ আদনান

শেখ দাউদ আদনান

নিউমোনিয়া যদি তাড়াতাড়ি শনাক্ত করা যায়, তবে খুব দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমরা যদি হাইপোকশিমিয়া চিনতে এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সাহায্য করি এবং যদি অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করি, তাহলে আমরা শিশুমৃত্যু কমাতে পারব। ইতিমধ্যে কোভিডের কারণে আমরা বাড়তি পালস অক্সিমিটার ও অক্সিজেন পেয়েছি। সেগুলো কমিউনিটিকে প্রদান করা হয়েছে। এই অক্সিমিটার শিশুদের জন্যও প্রযোজ্য কি না, তা আমি জানি না। আমাদের পালস অক্সিমিটারগুলোতে শিশুদের আঙুল ফিট করে কি না বা তারা ব্যথা পায় কি না, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু পালস অক্সিমিটার দিয়ে যে অক্সিজেন মাপা যায়, সেটার বদৌলতে মানুষজনের প্রথাগত চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার সমস্যাটা কমবে।

আমরা জানি যে চোখ বসে গেলে ডায়রিয়া বোঝা যায়। ঠিক যদি আমরা এমন কিছু ক্যাম্পেইনের আয়োজন করতে পারি, যেখানে হাইপোকশিমিয়ার লক্ষণগুলোর চিত্র মানুষদের জানানো যাবে, তবে কাজটা সহজ হয়ে যায়। আমরা শিশুদের জন্য উপযোগী পালস অক্সিমিটার আনতে পারি। নিউমোনিয়া হলেই অক্সিজেন লাগবে, সেটা কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে নিউমোনিয়ার কারণ হলো মারাত্মক নিউমোনিয়ায় শরীরে অক্সিজেন–স্বল্পতা হয়। আর এর জন্যই অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়।

কোনো রোগ ছড়িয়ে পড়লে আইসিডিডিআরবি থেকে সেটা বলে দেওয়া হতো। আগে থেকে বলে দেওয়া হতো যে এখন এই ফ্লুটা চলছে। তখন আমরা সে অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা পরিবর্তন করতাম। ভাইরাল সিজন আর ব্যাক্টেরিয়াল সিজন ছয় মাস পরপর পরিবর্তন হয়ে যায়। এই নজরদারি যদি চালু থাকে, তাহলে আমাদের জন্য পরিকল্পনা করা অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়। অক্সিজেনের ক্ষেত্রে যদি কোনো বাড়তি প্রশিক্ষণ লাগে, আমার মনে হয়, সেটার আয়োজন করা উচিত।

আর বেসরকারি সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সরকারি সুযোগ-সুবিধাও বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসাতে ছয় মাসের মতো লাগে। আমাদের রিসেন্ট প্ল্যান চাইলে আমরা এক দিনে পরিবর্তন করতে পারব না। আমাদের যে পরিকল্পনাটা আছে, সে অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে সিঙ্গেল প্রোডাক্ট হিসেবে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি হবে না। সেটা নিউমোনিয়া হোক অথবা বা অন্য কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব হোক।

শানজানা ভরদ্বাজ

শানজানা ভরদ্বাজ

আমরা ইতিহাসের একটি কঠিন সময়ে এসে একত্র হয়েছি। আমরা জানি যে গ্লাসগোতে কপ ২৬ সম্মেলন চলছে। এই জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে বাংলাদেশ একটি প্রথম সারির দেশ। জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশদূষণ, অপরিচ্ছন্নতার মতো মারাত্মক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বিষয়গুলো নিউমোনিয়ার সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত। আমরা এখানে আজ একত্র হয়েছি এবং একই ধরনের দুটো চলমান বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। নিরাময়যোগ্য
একটা রোগে যে এত শিশু মারা যায়, এটা আসলেই দুঃখজনক একটি বিষয়।

এটা বিশ্বাস করা কষ্টকর যে প্রতি ১৩ সেকেন্ডে আমরা পৃথিবী থেকে একটি করে শিশু নিউমোনিয়ার কারণে হারাই। আমরা সবাই এর বিরুদ্ধে কিছু করতে চাই। কেন না, আমরা জানি যে এটা প্রতিরোধ করার মতো। এটা বলতে হয় যে করোনা মহামারি আমাদের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। অনেকেই এটা নিয়ে কথা বলেছেন। করোনাকালে মানুষ অক্সিজেন সেবার মতো কাজ দিয়ে দেশকে মহামারি প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত করেছে। এই করোনা আমাদের স্বাস্থ্যসম্বন্ধীয় অনেক ঘাটতি ও অসংগতিকে তুলে ধরেছে। এমন কিছু মারাত্মক বিষয়ে আমাদের সচেতন করেছে, যেগুলোকে মানুষ আগে হালকাভাবে নিত। শেষে আমি বলতে চাই, আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

করোনা প্রতিরোধে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন, জনসাধারণ সর্বোপরি আমরা যেভাবে কাজ করেছি, সেটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। আমাদের সেই একই প্রেরণা ও শক্তি দরকার নিউমোনিয়াকে রুখে দিতে। সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো সব সংগঠনই একে অপরের খুব শক্তিশালী সহযোগী। বাংলাদেশের জন্য আমাদের এই সহযোগিতার হাত আরও প্রশস্ত করতে হবে। আমরা যদি একসঙ্গে নিউমোনিয়ার বিরুদ্ধে তৃণমূলে কাজ করতে পারি, উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে পারি, তাহলে আমরা এটিকে প্রতিরোধ করতে পারব। আমরা জানি যে ঘরের অভ্যন্তরের দূষণের জন্যই নিউমোনিয়া হয়। আমরা এ ব্যাপারে সর্বস্তরের মানুষকে একসঙ্গে সচেতন করতে পারি।

পাশাপাশি আমাদের এ বিষয়ে বিনিয়োগের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। আমরা জানি নিউমোনিয়া কেন হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে এবং কীভাবে একে প্রতিরোধ করা যায়। আমাদের শুধু একত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে।

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা

যেকোনো ধরনের দিবস উদ্‌যাপন সচেতনতা তৈরিতে বড় একটি ভূমিকা রাখে। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বের মানুষ বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে ও সচেতন হয়—এ দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখেই আমরা আলোচনা করব। করোনা আমাদের যতখানি সংকট দিয়েছে, সেটাকে আমরা সুযোগে রূপান্তর করে অনেক জায়গায় সক্ষমতা অর্জন করেছি।

একসময় জেলা পর্যায়ে এই সক্ষমতা ছিল না, এখন জেলা পর্যায়ে প্রায় সব হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম আছে। লিকুইড অক্সিজেনের বিষয়ে আমরা আগে জানতামও না, সেটার ব্যবস্থাও অনেক জায়গায় আমরা করে ফেলেছি। অল্প সময়ের মধ্যে সব জেলায় সেটার জোগান দেওয়া যাবে। করোনার সর্বশেষ ঢেউয়ের সময় টিএসএ প্ল্যান্ট সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। সারা পৃথিবীতে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা কতখানি।

করোনা না এলে কেউ অনুভব করত না। অক্সিজেন যে আমাদের মৌলিক চাহিদা, করোনা না এলে কেউ তা বুঝত না। শুধু অক্সিজেন হলেই হবে না, অক্সিজেনের যৌক্তিক ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ। সে দৃষ্টিকোণ থেকে কার অক্সিজেন লাগবে এবং কতটা অক্সিজেন লাগবে—দুটো বিষয় একসঙ্গে নজরে রাখা দরকার। এই গাইডলাইনটি সবার জানা গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অক্সিজেন স্টোরেজ নিয়ে ভেবেছি এবং অক্সিজেন সাপ্লাই দিতে যে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাই লাগে, এটাও আমরা পর্যায়ক্রমে উপলব্ধি করেছি।

আগে আমাদের ধারণা ছিল, অক্সিজেন আইসিইউ পর্যন্ত থাকলেই চলে। কারণ, ওখানেই ক্রিটিক্যাল রোগী থাকে। কিন্তু পরে দেখা গেল অক্সিজেন এমন একটা বেসিক ট্রিটমেন্ট, রোগীর আইসিইউতে যাওয়া রোধ করার জন্যই আবার অক্সিজেন দরকার। তখন আমরা ওই সক্ষমতাটাকে সেদিকে নিয়ে গিয়েছি। এরপর আমরা দেখলাম যে অক্সিজেন উৎপাদনে আমরা বাইরের উৎসের ওপর নির্ভরশীল। সেই জায়গাটায় সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করছি। প্রতিটি মেডিকেলে পিএসএ প্ল্যান্ট স্থাপন করা ছাড়াও মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তত বড় বড় শহরে, বিশেষ করে বিভাগীয় পর্যায়ে যাতে আমরা অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করতে পারি।

এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক টেকনিক্যাল বিষয় আছে, যেটিকে বিচার–বিশ্লেষণ করেই আগাতে হয়, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। অক্সিজেন দুর্ঘটনা ঘটার একটা বিরাট মাধ্যম, যেটি আমরা করোনা পরিস্থিতিতে দেখেছি। আমাদের দেশেও দু-একটা ছোট ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অপরিকল্পিত অক্সিজেন সক্ষমতা বাড়াতে গিয়ে অন্যান্য দেশে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটি হাসপাতালের অবকাঠামো যদি উপযোগী না হয়, সেখানে হঠাৎ অক্সিজেন বাড়ালেই হবে না, অন্যান্য বিষয়ের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। সে বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা করেছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করেছি।

এই সক্ষমতা অর্জন আমরা জেলা পর্যায়ে যতটা করতে পেরেছি, উপজেলা পর্যায়ে ঠিক ততটা করতে পারিনি। যদিও কিছু কিছু উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। পরবর্তী ধাপ, বিশেষ করে বেশি অক্সিজেন লাগলে মেনিপোল সিস্টেমের মাধ্যমে অক্সিজেন দেওয়ার বিষয়েও বেশ কিছু উপজেলাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি শতভাগ উপজেলাতে কার্যকর করতে হবে। আমরা সবাই একমত হয়েছি যে অক্সিজেনের পেছনে যদি আমরা বিনিয়োগ করি, সেটা অপচয় হবে না, বরং এর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

ফিরোজ চৌধুরী

নিউমোনিয়া নিয়ে সবার আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ । নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আশা করি। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।