নিরাপদে থাকুক অভিবাসী শিশু

শিশু অভিবাসন নিয়ে আয়োজিত এ আলোচনা সভায় সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মিলিত উদ্যোগের তাগিদ দেওয়া হয়।

শেখ রফিকুল ইসলাম,ন্যাটালি ম্যাককাউলি ,আবুল হোসেন ও হারুনো নাকাশিবা

দেশে তিন ধরনের অভিবাসী শিশুর সুরক্ষায় অংশীজনদের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সবার আগে সমসাময়িক তথ্য-উপাত্তভিত্তিক একটি জরিপ করা দরকার। জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যের মাধ্যমে এসব শিশুর অভিবাসনের কারণ, গতি-প্রকৃতি ও চাহিদা বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের মিলিত উদ্যোগে করণীয় নিয়ে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

গতকাল বুধবার ‘শিশু অভিবাসন: বিশ্ব ও বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। আলোচনায় তিন ধরনের অভিবাসী শিশু বোঝাতে মানব পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া শিশু, পথশিশু এবং প্রয়োজনের তাগিদে পরিবারহীন বা পরিবারসহ স্থানান্তরিত শিশুদের শ্রেণিভুক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও প্রথম আলো এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২৪৮টি শিশুকে পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই বর্তমানে পুনর্বাসনকেন্দ্রে রয়েছে। সারা দেশে ৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র (শেল্টার হোম) আছে। তাতে এসব পরিবারহীন শিশুর শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে বাস্তবতা হলো, ১০ বছরের বেশি বয়সের শিশুরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে চায় না। রাস্তায় যেসব পথশিশু আছে, তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিলে কান্নাকাটি করে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, নানা কারণে শিশুরা পরিবারছাড়া হচ্ছে। যখন একটি শিশু পরিবারছাড়া হয়, তখনই তার ক্ষতি শুরু হয়। যৌন হয়রানিতে পড়া ও শিক্ষা-চিকিৎসা না পাওয়া শুরু হয়। তিনি বলেন, এসব শিশু যাতে রাষ্ট্রের বোঝা না হয় সে জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ—সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আলোচনায় সূচনা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এবং সঞ্চালনা করেন সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান ন্যাটালি ম্যাককাউলি। তিনি বলেন, শিশুর অভিবাসন খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয় এবং বাংলাদেশে এটি আরও জটিল। সারা বিশ্বে মোট অভিবাসীর ১৪ শতাংশই শিশু। বাংলাদেশে অভিবাসী শিশুদের নিয়ে গবেষণা একেবারেই নেই বললেই চলে।

ন্যাটালি ম্যাককাউলিই উল্লেখ করেন যে শিশুর অভিবাসন তিন ধরনের। তিনি বলেন, দারিদ্র্যের কারণে দেশের ভেতরে অভিবাসন হয়। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহরে আসা, পরিবারসহ বা পরিবার ছাড়া এসব শিশু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে কাজ করে। পথশিশুরা ময়লা কুড়ায় বা ভিক্ষা করে। কখনো কখনো তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। শিশু অভিবাসনের দ্বিতীয় ধরনটি হলো মানব পাচার। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোতে এ দেশের শিশুরা পাচার হয়। ৫ থেকে ১২ বছরের এসব শিশু দালালের খপ্পরে পড়ে। মেয়েদের বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নেওয়া হয়। তৃতীয় ধরনটি হলো, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু। এরাও এখন অপহরণ ও মানব পাচারের ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ভূমিকা রাখছে। তবে আরও মনোযোগ দেওয়া দরকার।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রোটেকশন অফিসার হারুনো নাকাশিবা বলেন, সাধারণভাবে, জীবিকা নির্বাহ এবং শিক্ষার অভাবে রোহিঙ্গা শিশু, কিশোর–কিশোরীদের হতাশা আসতে পারে। এটাকে সহজেই কাজে লাগাতে পারে পাচারকারীরা।

ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী বলেন, বিশ্বব্যাপী শিশুর অভিবাসনের সঙ্গে অর্থনীতির চাকা জড়িত। শিশুকে স্বল্প মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। এ কারণে দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে বেশিসংখ্যক শিশু নিয়োজিত। তিনি বলেন, অনেক শিশুই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। কখনো একা, কখনো পরিবারের সঙ্গে। বাড়িছাড়া শিশু পরবর্তী সময়ে পূর্ণ বয়সে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে না।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে শিশুরা অভিবাসী হওয়ার মূল কারণ পারিবারিক দারিদ্র্য। এ কারণে শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তখন পরিবার শিশুকে কাজে নিয়োগ করে আয়ের উপায় খোঁজে। তিনি বলেন, শিশুদের পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়া ঠেকাতে সরকার অনেক কাজ করেছে। তবে এই বিষয়ে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) মাইগ্র্যান্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যাসিসটেন্স ইউনিটের জাতীয় প্রোগ্রাম অফিসার আসমা খাতুন বলেন, যেকোনো শিশুর অভিবাসী হওয়া ঠেকাতে অংশীজনদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করাই হবে প্রথম ধাপের কাজ।

অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, দেশে কত পথশিশু রয়েছে তার জাতীয় পর্যায়ের কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত ২০০৫ সালের। তিনি বলেন, পথশিশুদের দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানো হয়। তারা শারীরিক ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি নেই। অথচ দিন দিন পথশিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তিনি ব্যয়বহুল প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে পথশিশুদের সুরক্ষায় অর্থ দেওয়ার পরামর্শ দেন।

সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট ইশরাত শামীম বলেন, সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকায় তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করা হয়। পাচার হওয়া শিশুদের উদ্ধারের পর সেখানে রাখা হয়। তিনি বলেন, অনেক সময় অভিভাবক সেজে দালালেরা শিশুদের পাচার করে। এটা ঠেকাতে সতর্ক হতে হবে। সীমান্তবর্তী এলাকায় পাচার হওয়া শিশুদের উদ্ধারের পর নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, পাচার হওয়া শিশুদের আইনি সহায়তার পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে উৎসাহ দেওয়া দরকার। প্রয়োজনে তাদের মানসিক ‘কাউন্সেলিং’ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌথভাবে চুক্তি করে এই উদ্যোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়ার পর শিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।