পারিবারিক কৃষিতে নারীর শ্রম ও টেকসই কৃষি

একশনএইড বাংলাদেশ ও ডাচ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রথম আলোর আয়োজনে ‘পারিবারিক কৃষিতে নারীর শ্রম ও টেকসই কৃষি’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ২৯ নভেম্বর ২০২০। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

বলাই কৃষ্ণ হাজরা

মহাপরিচালক, সিড উইং, কৃষি মন্ত্রণালয়

মোয়াজ্জেম হোসেন

প্রকল্প পরিচালক, ডিএই, কৃষি মন্ত্রণালয়

ইমানুন নবী খান

সমন্বয়ক, মিসিং মিডল ইনিশিয়েটিভ, (এফএও, বাংলাদেশ)

ওসমান হারুনী

সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজর, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সিকিউরিটি, নেদারল্যান্ডস এম্বাসি

আহমেদ বোরহান

রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর, এএফএসএন

রওশন জাহান মনি

উপনির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএআরই)

আতাউর রহমান মিটন

সচিব, খানি বাংলাদেশ ও কান্ট্রি ডিরেক্টর হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড, বাংলাদেশ অফিস

এ কে এম জাকারিয়া

কৃষিবিশেষজ্ঞ মারিয়া সিড টেকনোলজি

জান্নাতুল মাওয়া

সভাপতি, বিন্দু নারী উন্নয়ন সংস্থা

আমিরুল ইসলাম

রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর, এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন

শামসুন্নাহার ডলি খান

সভানেত্রী, বাংলাদেশ কৃষাণী ফেডারেশন

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সূচনা বক্তব্য ও সভাপ্রধান

ফারাহ্‌ কবির

কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম অালো

আলোচনা

ফারাহ্‌ কবির

ফারাহ্‌ কবির

বাংলাদেশের কৃষিতে কিছু সমস্যা রয়েছে। এগুলো দূর করলে দেশের কৃষক আরও এগিয়ে যেতে পারেন। ‘একশনএইড বাংলাদেশ ফ্যামিলি ফার্মিং অ্যান্ড সাসটেইনেবল অ্যাগ্রিকালচার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি পলিসি ব্রিফ তৈরি করেছে। এ পলিসি ব্রিফে যে সুপারিশ এসেছে, তা তুলে ধরা এবং এখানে যাঁরা বিশেষজ্ঞ আছেন তাঁদের মতামত নেওয়া এ আলোচনার প্রধান উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের শ্রম জরিপ ২০০৫-০৬ সাল অনুযায়ী বাংলাদেশে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ৬৮ শতাংশ নারী।

গৃহস্থালির পাশাপাশি যঁারা কৃষিকাজ করেন, এমন নারী যদি ধরি, তাহলে ৭৪ শতাংশ নারী কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। নারীরা গবাদিপশু পালন করছেন। ৬৩ শতাংশ নারী স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ করছেন। ৪০ শতাংশ নারী শাকসবজি, ফলমূল, শস্য মাড়াই কার্যক্রম ও খাদ্যশস্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছেন। কৃষির ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে।

পারিবারিক কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কোভিডসহ যেকোনো দুর্যোগে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। কোভিডের এই দুর্যোগে পরিবারের শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি মাধ্যমে নারীরা খাবারের ব্যবস্থা করছেন। আজকের আলোচনায় সবাই একমত হয়ে এ বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে যেন বাংলাদেশের উন্নতির জন্য কাজ করতে পারি, সেটাই আমাদের চাওয়া। আজকের আলোচনায় যে যেখান থেকে অংশগ্রহণ করছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি।

আব্দুল কাইয়ুম

কৃষির কথা বললেই মনে হয় এটা পুরুষের কাজ। কিন্তু কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে নারীরা জড়িত। নারীরা এখন মাঠে কাজ করেন। বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে আনা পর্যন্ত কৃষির প্রায় সব ধরনের কাজ নারীরা করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ জন্য নারীকে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। এসব কাজের সঠিক মর্যাদা নারীকে দিতে হবে। তাহলে আমরা টেকসই কৃষিতে উত্তরণ ঘটাতে পারব।

বলাই কৃষ্ণ হাজরা

বলাই কৃষ্ণ হাজরা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে কতগুলো অগ্রাধিকার ঠিক করে দিয়েছেন। আমাদের মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি অগ্রাধিকার আছে। এগুলো হলো আমার বাড়ি আমার খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম, বিনিয়োগ বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষা। কৃষিতে যে নারীর প্রয়োজন, এ বিষয়ে উচ্চপর্যায় থেকে আমাদের নির্দেশনা রয়েছে।

আমি আমার পরিবার থেকে মা-বোনসহ প্রায় সবাইকে দেখেছি ফসল বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গে তঁারা খুব ভালোভাবে গুছিয়ে রাখেন। সরকারিভাবে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বীজ সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় ৭৫ শতাংশ বীজ পারিবারিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়। আর এ কাজটি নারীরাই করে থাকেন। আমাদের মন্ত্রণালয়ে জীব সংরক্ষণের জন্য ৫০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প চলমান আছে। এবার পাঁচটি বন্যায় অনেক ক্ষতির পর মন্ত্রণালয় চিন্তা করেছে পারিবারিক কৃষির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নারীরা সেখানে অনেক ভূমিকা রাখতে পারবেন।

এ জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে ৩২টি পারিবারিক পুষ্টির বাগান করে দিয়েছি। এখান থেকে গ্রামের মানুষের নিরাপদ পুষ্টির জোগান হয়। মুজিব বর্ষে আমাদের পরিকল্পনা হলো প্রতিটি ইউনিয়নে ১০০টি করে পারিবারিক পুষ্টিবাগান করে দেওয়া। মন্ত্রণালয় থেকে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার দেয়। এ পুরস্কার নারী-পুরুষ সবাই পান। এ বছর থেকে আমরা অ্যাগ্রিকালচার ইম্পরট্যান্ট পারসন চালু করেছি (এঅইপি)। নারী-পুরুষ সবাই এ পুরস্কার অর্জন করবেন।

আহমেদ বোরহান

আহমেদ বোরহান

একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি গবেষণা ও নীতি কাঠামো পর্যালোচনা করা হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল পারিবারিক কৃষির সঙ্গে অন্যান্য কৃষির কী সামঞ্জস্য এবং কোনো অসংগতি আছে কি না, সেটা দেখা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পারিবারিক কৃষির কথা বলা হয়েছে। পারিবারিক কৃষি স্থায়িত্বশীল, জলবায়ুসহনশীল, খাদ্যব্যবস্থার সুরক্ষা ও খাদ্যনিরাপত্তার একটি মডেল।

জাতিসংঘ তার ৭২তম অধিবেশনে ২০১৯ থেকে ২০২৮ সালকে পারিবারিক কৃষি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসনে ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে পারিবারিক কৃষির গুরুত্ব তুলে ধরা। পারিবারিক কৃষি হচ্ছে প্রধান খাদ্য বিনিয়োগকারী। পারিবারিক কৃষিতে একটি শক্তিশালী নীত কাঠামের কথা বলা হয়েছে। যুবাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের কথা বলা হয়েছে। লিঙ্গসমতা ও নারী নেতৃত্বের বিকাশের কথা বলা হয়েছে। কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে আর্থসামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

আমাদের যেসব গুরুত্বপূর্ণ নীতিকাঠামো আছে, সেটা পর্যালোচনা করেছি। এর মধ্যে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা আছে। পরিবেশবান্ধব কৃষি আছে। ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের স্কেলিং আপ অ্যাগ্রো ইকোলজিকে গুরুত্ব দিয়েছি। জাতীয় কৃষিনীতি, কৃষি বিপণন আয়, বীজ আয়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ও একটি বাড়ি একটি খামার কর্মসূচিকে এই পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত করেছি।

আমরা যদি কৃষিতে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ দেখি, তাহলে এ ক্ষেত্রে দেখা যায় মাছ চাষ, মাছ আহরণ—দুই ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আছে। গৃহপালিত পশুপালনে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় পুরুষের সমান। এখনে কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন লিজ নেওয়া জমি। নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এখনো ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

কৃষিকাজের অর্থনৈতিক দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি পরিবারের কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা আছে। কিন্তু তারা মনে করছে কৃষিটা তাদের জন্য লাভজনক না।

কৃষির প্রায় সব কাজে নারীর অংশগ্রহণ আছে। কিন্তু পণ্য বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তাঁর অংশগ্রহণ খুব কম। আমরা কৃষির পরিবেশগত দিক জানতে চেয়েছিলাম। তাঁরা প্রায় সবাই বলেছেন, অত্যধিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য জমির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। পারিবারিক ও ক্ষুদ্র কৃষির আরও উন্নতি করতে হলে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রচার অভিযান চালাতে হবে। একটি পারিবারিক কৃষি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে।

তৃণমূল পর্যন্ত যেসব কৃষক সংগঠন আছে তাদের সংগঠিত করতে হবে। পারিবারিক কৃষিতে একটি বাড়ি একটি খামারের কথা অনেকেই বলেছেন। এটাকে একটি মডেল হিসেবে সম্প্রসারণ করতে হবে। নারী উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা করা দরকার।

মোয়াজ্জেম হোসেন

মোয়াজ্জেম হোসেন

আমার প্রকল্পের নাম ‘প্রডাকশন, স্টোরেজ অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন অব কোয়ালিটি সিডস অব রাইস, হুইট, জুট অব ফারমার্স লেভেল থ্রু মডার্ন টেকনোলজি’। এ প্রকল্পে ১৫ জন চাষিকে নিয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করি। এ গ্রুপে ১০ জন পুরুষ ও ৫ জন নারী থাকেন। ৬টা ক্লাসের মাধ্যমে তঁাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তঁাদের প্রযুক্তির ধারণা দিই। উৎপাদনের ক্ষেত্রে তঁারা নারী-পুরুষ যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এখানে নারীর ক্ষমতায়ন হয়। উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় দুজন সিদ্ধান্ত নিলে উৎপাদন ভালো হয়। কৃষির সৃষ্টি হয়েছে নারীর হাত দিয়ে। নারী বীজ সংগ্রহ করে ফলমূল, শাকসবজি ও ফসল উৎপাদন করেছেন। এভাবে তঁাদের মাধ্যমে কৃষির অগ্রযাত্রা এসেছে। এখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করি। তঁাদের ধারণার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ধারণার সমন্বয় করা হয়। খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ও বীজ সংরক্ষণের মধ্যে পার্থক্য আছে। বীজ সংরক্ষণে সতর্কতার প্রয়োজন হয়। নারীরা এটা করে থাকেন।

আমাদের সংরক্ষিত বীজ প্যাকেটজাত করে কৃষককে বিতরণ করি। এক কেজি ধানের দামের প্রায় দ্বিগুণ এক কেজি বীজধানের দাম। বীজ সংরক্ষণের মাধ্যমে নারীরা লাভবান হন। সরকারি মাধ্যম বিএডিসি ও ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান থেকে বীজ সরবরাহ হয়। এসব বীজে অনেক সময় সমস্যা হয়।

কৃষকদের মাধ্যমে বীজ সরবরাহ হলে বীজ সংরক্ষণের প্রক্রিয়া মানুষ জানতে পারবে। আস্থার সঙ্গে বীজ কিনতে পারবে। নারী ছাড়া কৃষিকে চিন্তা করা যাবে না। কিন্তু তঁাদের মূলধারায় নিয়ে আসা ও ক্ষমতায়ন করার দায়িত্ব আমাদের। আমাদের অনেক গ্রুপে নারীদের টিম লিডার করেছি। নারীর মাধ্যমেই টেকসই কৃষি অর্জন সম্ভব। ধান-গম চাষের জন্য আমাদের আট হাজার গ্রুপ আছে। ভবিষ্যতে পরিকল্পনা হলো চার হাজার নারী ও চার হাজার পুরুষ টিম লিডার করা।

শামসুন্নাহার ডলি খান

শামসুন্নাহার ডলি খান

আমরা কৃষি কাজ করি। একই সঙ্গে বীজ সংরক্ষণ করি। আমাদের দেশের বীজ হারিয়ে যাচ্ছে। এ বীজ যদি সংরক্ষণ করতে পারি তাহলে এটা আমাদের জন্য ভালো হবে। এবার আমাদের ফসল ভালো হয়নি। গতবার ভালো হয়েছিল। আমাদের একটা বীজ ভান্ডার থাকলে গতবারের বীজ আমরা ব্যবহার করতে পারব।

কেনা বীজের মান ভালো না। আমরা নিজেরা যে বীজ সংগ্রহ করি, সেটার মান ভালো। এটা পরীক্ষা করে দেখেছি। তাই কৃষকেরা নিজেরাই যেন বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন, সে ব্যাপারে সবার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এ কে এম জাকারিয়া

এ কে এম জাকারিয়া

গত ৩০ বছর ধরে গ্রামীণ নারী ও পুরুষদের নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশের কৃষি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রধান সমস্যা হচ্ছে বীজ সংরক্ষণ। আমি গবেষণা করতে গিয়ে দেখলাম, বীজের পুরো বিষয়টি দেখেন গ্রামীণ নারী। বগুড়া জেলার মারিয়া গ্রামে দীর্ঘদিন গবেষণার কাজ করি। আমরা এখানে বীজ সংরক্ষণের একটা ভালো মডেল উদ্ভাবন করলাম। এই গ্রামবাসীর সম্মানার্থে নাম দিলাম মারিয়া মডেল। এ গ্রামের মানুষদের আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। দেখেছি তাঁদের বীজের মান সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতোই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক ভালো।

একপর্যায়ে দেখলাম তাঁরা আমাদের থেকেও ভালো শিখে ফেলেছেন। এটাকে তঁারা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে আয়, কর্মসংস্থান হচ্ছে। মারিয়া গ্রাম হলো নারীর ক্ষমতায়নের একটি মডেল। প্রথম আলো একবার মারিয়া গ্রামের সফলতা নিয়ে লিখেছিল। এর মাধ্যমে সারা দেশের মানুষ তঁাদের সফলতা জেনেছিল।

মারিয়া মডেলে একজন নারী বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল ঘরে আনা পর্যন্ত যে কাজ করেন, তাতে জিডিপিতে তিনি দুই লাখ টাকার অবদান রাখেন। তঁার কাজের মাধ্যমে ২০ শতাংশ বেশি উৎপাদন হয়। কিন্তু এই নারী সামজের কাছ থেকে কী পাচ্ছেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এই নারীদের প্রকাশ্যে সম্মান জানানো প্রয়োজন, তঁারা দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। উন্নত বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন থেকে সরে যাচ্ছে। আমরা নারীদের কৃষিকাজে লাগিয়ে খাদ্য রপ্তানি করে বিশাল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। থাইল্যান্ড থেকে এক কেজি পেঁপের বীজ ৬০ হাজার টাকায় আনি। অথচ আমাদের নারীরা পেঁপের বীজ উৎপাদন করে থাইল্যান্ডে পাঠাতে পারেন।

জান্নাতুল মাওয়া

জান্নাতুল মাওয়া

আমরা গ্রামের নারীদের নিয়ে কাজ করি। কারোনাকালে সরকার কৃষকদের প্রণোদনার কথা বলেছে, সেখানে নারী কৃষকদের কথা বলা নেই।

করোনাকালে পুরুষেরা গ্রামে ফিরেছেন। সে সময় গ্রামের নারীরা তঁাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে পারিবারিক কৃষি একটা বিশাল ভূমিকা রেখেছে। পারিবারিক কৃষির সম্পূর্ণ আবদান নারীদের। কিন্তু সেই নারীতো এই দুর্যোগে কোনো সহযোগিতা পাননি। নারী কৃষকেরা সাধারণত বাজারে পণ্য বিক্রি করতে যান না বা যাওয়ার পরিবেশ থাকে না। তাই তিনি বাড়ির আশপাশের মানুষের কাছে তাঁর পণ্য বিক্রি করেন। এ জন্য নারী কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না বললেই চলে।

রওশন জাহান মনি

রওশন জাহান মনি

কৃষির সংজ্ঞা নিয়ে সমস্যা আছে। কৃষি বলতে শুধু ধান-পাট, লাঙল–জোয়াল না। এখানে নারী খুঁজতে গেলে সেভাবে এখন আর নারীদের পাওয়া যাবে না। কারণ এখন পুরুষেরাও আর আগের মতো কৃষিকাজ করেন না। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু তারপরও পণ্য উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে।

একজন নারী যদি তঁার পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে না পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে কৃষিকে ধারণ করবেন। পুরুষ কৃষি দিয়ে সংসার চালাতে পারেন না বলেই বিভিন্ন জায়গায় অন্য কাজের পেছনে ছুটছেন। সেখানে কৃষির হাল ধরেছেন নারীরা। কৃষির প্রধান উপকরণ জমি। কিন্তু জমিতে নারীর কতটুকু অধিকার আছে, সেটা আজ একটা অনেক বড় প্রশ্ন। একজন অসহায় নারীর খাসজমি পেতে হলে তঁার একজন পুত্রসন্তান লাগবে। এই বিধানটি অবশ্যই পরিবর্তন করা দরকার।

কৃষি নীতিমালায় এসেছে, নারী একজন কৃষিশ্রমিক, কৃষক না। নারী যতক্ষণ পর্যন্ত কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি না পাবেন, ততক্ষণ কৃষির সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। নারীদের জন্য একটা কৃষি ব্যাংকের প্রয়োজন। এখান থেকে যেন তঁারা খুব কম সুদে ঋণ পান। দুর্যোগে যেন নারীরা সাহায্য পান। তাঁদের জন্য শস্যযবিমা করতে হবে। কো–অপারেটিভ নীতিমালা সহজ করতে হবে। সমতল, আদিবাসীসহ বিভিন্ন কৃষিকে আলাদাভাবে দেখতে হবে।

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত সংগঠন হলো নারী। কৃষির অধিকাংশ কাজ নারী করেন। ৭০ শতাংশের বেশি নারী কৃষির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু কৃষক হিসেবে নারীর স্বীকৃতি নেই। আমাদের প্রধান চাওয়া হলো কৃষক হিসেবে নারী যেন স্বীকৃতি পান, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া। নারীর অবদান জিডিপিতেও যুক্ত হয় না। ২০১৮ সালে কৃষিনীতি হয়েছে। এটা বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি–বেসরকারি প্রকল্পে কিছু কাজ হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলে তাদের তেমন কিছু করণীয় থাকে না।

জাতিসংঘ ঘোষিত কৃষি দশক চলছে। এখানে কয়েকটি বিষয়কে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেমন অ্যাগ্রো ইকোলজি, ফরেস্ট্রি, ইনডিজেনাস পিপল, মাউন্টেন ফ্যামিলি, গ্রামীণ নারী প্রভৃতি। গ্রামীণ নারী ও অ্যাগ্রো ইকোলজি, এ জায়গায় আমাদের শক্তভাবে কাজ করা দরকার। তাহলে একটা মূলধারার অর্থনীতিতে আমরা যেতে পারব।

২০০৮ সালে জাপানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম পরিবারিক কাজ করার জন্য অর্থ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম বছরে দেখা গেল অনেকে দিয়েছেন। অনেকে দেননি। সরকার থকে বলা হলো, পারিবারিক কাজের জন্য যে অর্থ দেওয়া হবে তার ওপর কর নেই। তবুও তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। তারপর বলা হলো, তঁাদের ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে এর রসিদ দেখাতে হবে। আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যেন নারীরা তাঁর কাজের স্বীকৃতি পান। এ জন্য নারীদের সংগঠিত করা হলো একটি বড় কাজ। হাজার বছর ধরে নারীরা কৃষিকে ধরে রেখেছেন। ভবিষ্যতে তঁারাই কৃষিকে এগিয়ে নেবেন।

আতাউর রহমান মিটন

আতাউর রহমান মিটন

জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৪ শতাংশ। বর্তমান সরকারের কাছে কৃষি অগ্রাধিকার। সরকার এখন কৃষিপণ্য রপ্তানির কথাও ভাবছে। এ বছর ১৪ হাজর ৫০০ কোটি টাকার বাজেট কৃষিতে দেওয়া হয়েছে। এটা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। কৃষির জন্য অনেক প্রচেষ্টা রয়েছে। সেখানে নারীর অংশগ্রহণ কতটুকু, সেটা ভাবা দরকার।

আবহমানকাল থেকে নারী কৃষির সঙ্গে জড়িত। পারিবারিক পুষ্টি জোগাচ্ছে নারী। পারিবারিক কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আমাদের কী করা প্রয়োজন, সে অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে আসতে হবে। মারিয়া মডেল থেকে শুরু করে কয়েকটি মডেলের কথা শুনেছি। আমাদের আজকের কৃষি প্রযুক্তির দিকে যাচ্ছে। কৃষি প্রযুক্তি, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে নারী কীভাবে যুক্ত হবেন বা এসব ক্ষেত্রে নারী টিকতে পারবেন কি না, সেটিও আলোচনার বিষয়।

সব ক্ষেত্রে নারীকে সম্পৃক্ত করে পরিকল্পনা করতে হবে। আমাাদের দেশে সার তৈরির জন্য কেঁচো চাষ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন গ্রামের ২০ থেকে ২২ হাজর নারী এর সঙ্গে জড়িত। এই মেরুদণ্ডহীন প্রাণীটি তাঁদের আর্থিক সচ্ছলতা দিয়েছে।

এবার বাজেটের ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ৮ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে শুধু রাসায়নিক সারের ভর্তুকির জন্য। অথচ এই যে কেঁচো চাষের সঙ্গে যঁারা জড়িত, তঁারা একটি টাকাও পাবেন না। এই ৮ হাজার কোটি টাকার ২৫ শতাংশ যদি পারিবারিক কৃষির সঙ্গে যেসব নারী জড়িত, তঁাদের জন্য বরাদ্দ থাকত, তাহলে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নে বিরাট ভূমিকা রাখত।

ইমানুন নবী খান

ইমানুন নবী খান

সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে যারা কোনো সুবিধা পান না, তঁারাই মিসিং মিডল হিসেবে অভিহিত। আমি গারোদের কিছু সংগঠন নিয়ে কাজ করছি। এঁরা আনারস, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য চাষ করেন। এঁরা আসলে প্রচণ্ড সমস্যার মধ্যে আছেন। তঁাদের ফসল ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য না। ফলে এঁরা ব্যাংক থেকে কোনো সহযোগিতা পান না। নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০০ কোটি টাকার একটা ঋণ প্রকল্প ছিল। এর গ্রেস পিরিয়ড ছিল ১৪ মাস। কিন্তু এখানে নারীর অংশগ্রহণ খুব কম। পারিবারিক কৃষির প্রায় ৮৫ ভাগই ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তঁারা একা একা চলতে পারেন না। তঁাদের প্রয়োজনেই তঁাদের সংগঠিত হতে হবে। সরকারি নীতিমালা ভালো। কিন্তু বাস্তবায়নে আরও মনোযোগ দিতে হবে।

প্রায় ২ লাখ কৃষক সংগঠন রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প শেষ হলে এসব সংগঠনের অনেককে পাওয়া যায় না। প্রশিক্ষণ, পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর প্রভৃতি দিয়ে আমরা কৃষক সংগঠন গড়ে তুলি। এখানে তঁাদের বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এসব সংগঠন উদ্যোগ নিলেই কিন্তু পণ্যের মূল্য ও আনুষঙ্গিক অনেক বিষয় ঠিক করতে পারে। বাংলাদেশে ব্যাংকের নীতিমালায় আছে, প্রান্তিক কৃষকদের দলীয় ভিত্তিতে ঋণ দিতে হবে। কিন্তু কোনো ব্যাংক কৃষক সংগঠনকে কোলাটারেল হিসেবে মানতে চায় না। আমরা আট বছর ধরে এ নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছি।

করোনাকালে জনে জনে সার আনা, পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা, লেনদেন করা যখন ঝুঁকিপূর্ণ হলো, তখন আমাদের নারী অপারেটররা দারুণ কাজ করেছেন। ফাও যঁাদের ফুড হিরো হিসেবে ঘোষণা করেছে, তঁাদের মধ্যে এঁরা আছেন। আমাদের নারীরা সংগঠনের হিসাবরক্ষণ থেকে শুরু করে সব কাজে সফলতা দেখাচ্ছেন। তাঁদের জন্য আরও সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া প্রয়োজন।

আমিরুল ইসলাম

আমিরুল ইসলাম

কৃষকদের সম্ভাবনার জায়গা হলো কো-অপারেটিভ। কৃষিঋণ থেকে শুরু করে বাজার ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত নারীদের অংশগ্রহণ জরুরি। কৃষি নীতিমালা বাস্তবায়ন করে নারী কৃষকদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। একজন নারী একই সঙ্গে কৃষি ও গৃহস্থালির কাজ করেন। তাঁকে যদি গৃহস্থালির কাজে সহযোগিতা করা যায়, তাহলে তিনি কৃষি কাজে আরও বেশি সময় দিতে পারেন।

কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রমে নারীদের সম্পৃক্ত করা জরুরি। পুরুষ সম্প্রসারণ কর্মীরা নারীদের কথা খুব একটা ভাবেন না। তাই তঁাদের প্রায় অংশগ্রহণ থাকে না। নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। এই করোনাকালে সংগঠনের গুরুত্ব আরও অনেক বেশি করে সামনে এসেছে। কৃষক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করতে পারলে কৃষির নতুন মাত্রা তৈরি হবে।

ওসমান হারুনী

ওসমান হারুনী

নেদারল্যান্ডসের জমির পরিমাণ হলো বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শাকসবজি রপ্তানিকারক দেশ। এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? তারা প্রযুক্তি, জ্ঞান ও দক্ষতায় আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পারিবারিক কৃষিকে বিস্তৃত পরিসরে দেখেতে হবে। পারিবারিক কৃষি বলতে শুধু শাকসবজি, ফলমূল না, এর মধ্যে লাইভস্টক, অ্যাাকুয়াকালচারসহ আরও অনেক বিষয় থাকতে পারে। বসতবাড়ি ও মাঠ দুজায়গায়ই কৃষিতে নারীর ভূমিকা রয়েছে। অধিকাংশ নারী নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করেন।

নারীকে যদি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করি, তাহলে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী তিনি উৎপাদন করবেন। এ ক্ষেত্রে বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবেন। তঁার কর্মসংস্থান হবে। আয় বৃদ্ধি পাবে। আরেকটি প্রকল্প আছে, ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন’। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা নারীদের বাজারের সঙ্গে যুক্ত করেছি।

একশনএইডের একটি প্রকল্প থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বাজার কমিটিতে কোনো নারী নেই, সাবই পুরুষ। একশনএইড বাজার কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর কাজ করেছে। তখন বাজারে নারীদের জন্যও জায়গা তৈরি হয়েছে। ফলে নারীরা তঁাদের পণ্য সেখানে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারছেন।

বাজার কমিটিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। নারীরা বেশি করে বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে নিজেরাই দর কষাকষি করে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন। আমাদের সফল নামে একটা প্রকল্পে ১ লাখ ক্ষুদ্র কৃষি পরিবার আছে। এর ৬৫ শতাংশ নারী কৃষক। প্রুফ নামে আমাদের একটা প্রকল্পে ৮০ হাজার কৃষি পরিবার ছিল। এর সদস্যরা প্রায় সাবই নারী। এঁদের আমরা বাজারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করেছি। এখন দামদর তঁারা নিজেরাই ঠিক করতে পারছেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন।

ফারাহ্‌ কবির

আমি সবার সঙ্গে একমত পোষণ করছি। সবাই ভালো আলোচনা করেছেন। সবাই বলেছেন নারীরা কৃষিতে ব্যাপক অবদান রাখছেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করব। এ ক্ষেত্রে আপনারা সুপারিশ দিয়েছেন। সব সুপারিশ আমরা একা বাস্তবায়ন করতে পারব না। নারীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তাঁঁরা নিজেরাই অনেক কিছু এগিয়ে নিচ্ছেন।

এখন যে আধুনিক কৃষি ও প্রযুক্তি আসছে, সেখানে নারীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এফএওসহ সবার কাছে কীভাবে বিষয়টি নিয়ে যাব, সে জন্য সবার সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

নারীদের সংঘবদ্ধ করা খুব জরুরি। অনেক সময় কৃষিপণ্য গুদামজাত করার অভাবে নষ্ট হয়। এখানেও আমাদের কাজ করতে হবে। নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, বরাদ্দ ঠিকমতো পাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে কার্যকর তদারকি প্রয়োজন।

জাতীয় জৈব কৃষিনীতির ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। আমার কে কী করতে পারি, সে রকম একটা কমিটমেন্ট নিয়ে এগোতে হবে। আমরা আমাদের কাজকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা লাগবে। তাই সরকারের সঙ্গে আমাদের ওতপ্রোতভাবে কাজ করে যেতে হবে। আমাদের কাজগুলো তখনই সফল হয়, যখন কমিউনিটি আমাদের কাজকে সমর্থন দেয়। সবার সহযোগিতায় পারিবারিক কৃষি আরও এগিয়ে যাবে বলে আশা করি।

ফিরোজ চৌধুরী

পারিবারিক কৃষি নিয়ে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হলো। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ।

সুপারিশ

  • কৃষিতে নারীর অবদান ৭০ ভাগের বেশি, তাই তঁাদের মূলধারায় নিয়ে আসা ও ক্ষমতায়ন করার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

  • নারী কৃষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি,পরিষেবা, গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং বাজারজাতকরণের জন্য একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করা।

  • পারিবারিক ও ক্ষুদ্র কৃষির উন্নতি করতে হলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পারিবারিক কৃষির বিকাশে স্থায়িত্বশীল নয়, এরূপ কৃষিচর্চা থেকে বের হয়ে আসার জন্য এবং জলবায়ুসহনশীল কৃষির চর্চা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

  • মোট বীজের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করছেন গ্রামীণ কৃষক। ‘বীজ আইন, ২০১৮’ অনুযায়ী কৃষকের এ অবদান স্বীকৃত নয়। কমিউনিটিভিত্তিক কৃষকের বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিনিময়ের বিষয়টি এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

  • বীজ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী কমিউনিটিভিত্তিক কৃষকের উৎপাদিত বীজ সার্টিফিকেশনের বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

  • নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার থেকে ভ্যালুচেইন সংযোজন, টয়লেট, ব্রেস্টফিডিং কর্নার, ডে-কেয়ার সেন্টার প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

  • নারী কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

  • যুব ও নারী কৃষকের সংগঠনকে শক্তিশালী করার দিকে নজর দিতে হবে।

  • জিডিপিতে নারীর অবদান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।