প্রতিকার পাওয়ার উপায় সহজ করার দাবি

‘অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে একশনএইড বাংলাদেশ।

অনলাইনে দেশের মানুষের অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সাইবার জগতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৫০ শতাংশের বেশি নারী অনলাইনে সহিংসতার শিকার। এ থেকে প্রতিকার পাওয়ার উপায় আরও সহজ ও দ্রুত করার দাবি উঠেছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে জবাবদিহির আওতায় আনার কথাও উঠে এসেছে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ উপলক্ষে আয়োজিত ‘অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলা হয়। এর আয়োজক একশনএইড বাংলাদেশ এবং সম্প্রচার সহযোগী প্রথম আলো। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এবং শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে একটি শক্তিশালী ‘সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেম’ গড়ে তুলতে হবে। এ ধরনের সহিংসতা রোধে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

করোনার সময়ে প্রযুক্তি সহায়তা করেছে এবং জীবনকেও সহজ করেছে বলে জানান একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির। তবে সমাজে নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের যে চিত্র, সেটারও প্রতিফলন এই সময়ে দেখা গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একশনএইড বাংলাদেশের উদ্যোগে অনলাইন কনটেন্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ অর্গানাইজেশন ই–আরকি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক সুমন রহমান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ফাইজুল করিম।

৮ থেকে ১৮ নভেম্বর পরিচালিত এই অনলাইন জরিপে ৬১১ জন অংশ নেন। সেখানে ৬৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ নারী এবং ৩২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ পুরুষ। দুজন ছিলেন ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ। নারীদের ৫০ শতাংশের বেশি জানিয়েছেন তাঁরা অনলাইনে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ফেসবুকে সহিংসতার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন সার্ভিসে আসা অভিযোগগুলোর বিষয়ে কথা বলেন পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি সেলের এইআইজি মীর আবু তৌহিদ। তিনি বলেন, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া মেয়েরা সাইবার অপরাধের বেশি শিকার। তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভার্চুয়াল জগতে বন্দুক নেই, ইটপাটকেল নেই, লাঠি নেই। কিন্তু অপরাধ আছে। সেই প্রস্তুতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিতে হবে। সাইবার অপরাধের শিকার নারীরা অনেক সময় পুলিশের কাছেও যেতে চান না। তিনি সমাজকে প্রযুক্তিগতভাবে শিক্ষিত করার কথা বলেন।

পুলিশের আরও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার সাইদ নাসিরুল্লাহ। তিনি বলেন, করোনার আগেই সরকার বাংলাদেশের জন্য স্থানীয়ভাবে ফেসবুক থেকে দুজন প্রতিনিধি চেয়েছিল, যাঁরা এখানকার সংস্কৃতি বোঝে এবং অভিযোগগুলোর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে জানা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সরকার চেয়েছিল ফেসবুক যেন তাদের অফিস বাংলাদেশে চালু করে। কিন্তু তারা তা করেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে ডিজিটাল লিটারেসি ও এথিকসের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

অনলাইনে সহিংসতা রোধের আলোচনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেন ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন। সাইবার অপরাধের মামলাগুলো কোন আইনে হয়, তা দেখার কথা উল্লেখ করে সারা হোসেন বলেন, সবাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চলে যেতে চায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারও যে হচ্ছে, সে প্রসঙ্গও মনে করিয়ে দেন তিনি।

অনলাইনে সহিংসতা রোধে অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম না করে একটি প্ল্যাটফর্মকে নির্দিষ্ট করে সেটা ধরে এগোনোর কথা বলেন শিশুসহায়ক জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯৮-এর প্রকল্প পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহায়মেন। তিনি বলেন, অনলাইনে সহিংসতার শিকার হলে মানসিক সমর্থনের প্রয়োজন হয়। ভুক্তভোগীর পাশাপাশি পরিবারকে কাউন্সেলিং করাতে হয়।

ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রযুক্তিগত শিক্ষার অনেক অভাব আছে এবং এ বিষয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের ওরিয়েন্টেশন প্রয়োজন বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন।

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও উইমেন ইন টেকনোলজির ভাইস প্রেসিডেন্ট কানিজ ফাতেমা বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ে নারীদের পড়াশোনার হার ২৫ শতাংশ। কিন্তু এ ধরনের পেশায় নারীর অংশগ্রহণ কম। প্রযুক্তিগত জ্ঞানের একটি জায়গায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে।

কুষ্টিয়ার মুক্তি নারী ও শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মমতাজ আরা বেগম বলেন, অনলাইনে সহিংসতা রোধে দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। পুরো বিষয়টিকে কীভাবে আরও নারী ও শিশুবান্ধব করা যায়, তা ভাবার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও সাইবার টিনের প্রতিষ্ঠাতা সাদাত রহমান বলেন, রাস্তাঘাটের চেয়ে অনলাইনে নারীরা বেশি অনিরাপদ। নিজের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের প্রসঙ্গে বলেন, তাঁরা বন্ধুর মতো ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়ে চলেছেন।

মেয়ে নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা ও অগ্নি ফাউন্ডেশনের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারান বলেন, সহিংসতা রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর কর্তৃপক্ষেরও জবাবদিহি থাকা উচিত। প্রতিকার পেতে পুরো পদ্ধতিকে সহজ করতে হবে।

হলি ক্রস কলেজের শিক্ষার্থী লাবণ্য প্রজ্ঞা সমবয়সীদের হয়রানির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, অনলাইনে অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণের ফিচার সম্পর্কে বেশির ভাগ মা-বাবার ধারণা নেই। তাঁদের এ বিষয়ে জানতে হবে। কারণ, হয়রানির শিকার হলে মা-বাবা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেন না। অভিভাবক ও শিক্ষকদের এই বিষয়ে বুঝতে হবে এবং তাদের জানাতে হবে।