প্রতিবন্ধী নারীদের এগোতে দিন

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত

সমাজের মূলধারার সঙ্গে নারী প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করতে নানা চ্যালেঞ্জ আছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় হলেই কেবল সেই চ্যালেঞ্জ উতরানো সম্ভব। প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা পেলে নারী প্রতিবন্ধীরা নিজেরাই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য তাঁদের পিছিয়ে না রেখে সামনে এগোতে দিতে হবে।

‘প্রতিবন্ধী নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা লিওনার্ড চ্যাশায়ার ও প্রথম আলো গতকাল বুধবার এই বৈঠকের আয়োজন করে। সহযোগিতায় ছিল যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা ইউকেএইড।

বৈঠকে প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, যেকোনো দুর্যোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। নারী প্রতিবন্ধীরা আরও বেশি হন। করোনার সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি বলেন, করোনাকালে প্রতিবন্ধী নারীদের অন্যতম সক্ষম হওয়ার উপায় হচ্ছে অনলাইন। এ জন্য প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তিমূলক বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী বিশেষ ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। প্রতিবন্ধী নারীদের সুপ্ত প্রতিভা থাকে। তা বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে। তাঁদের সক্ষমতাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

সভাপতির বক্তব্যে লিওনার্ড চ্যাশায়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর জহির বিন সিদ্দিক বলেন, সবার আগে দরকার শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি। প্রতিবন্ধী নারীরা এগিয়ে যাবেন প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান দ্বারা। প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তা কতটুকু প্রতিবন্ধীবান্ধব, তা ভাবতে হবে। করোনাকালে অনলাইনে সফট স্কিল ও ডিজিটাল স্কেলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বিশেষ অতিথি যুক্তরাজ্যের ফরেন কমনওয়েলথ ডেভেলপমেন্ট অফিসের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার তাহেরা জাবিন বলেন, সারা বিশ্বে এটি অনুমিত, ১০০ কোটি মানুষের প্রতিবন্ধিতা আছে। এর ৮০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাসিন্দা। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক সহযোগিতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে যাঁরা নারী, তাঁরা লিঙ্গবৈষম্য, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হন। এতে তাঁদের জীবন আরও চ্যালেঞ্জিং হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারপারসন তাওহিদা জাহান বলেন, আইন দ্বারা প্রতিবন্ধীদের সাম্য ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনও আছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিবন্ধী নারীরা সাধারণ নারীদের চেয়ে অনেক বেশি বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন। তিনি বলেন, আইনের প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা যথেষ্ট নয়। প্রতিবন্ধী নারীরা যে মানসিক ও শারীরিক, যৌন নির্যাতনের শিকার হন, সেটির বড় বাধা হচ্ছে এই নারীদের ভাষিক (ভাষাগত) দুর্বলতা।

সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এ এইচ এম নোমান খান বলেন, এখনো প্রতিবন্ধী নারীরা
শিক্ষা ও বিভিন্ন পরিষেবায় পিছিয়েছেন। তবে চিত্র কিছুটা হলেও বদলেছে। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকশিতও হচ্ছেন।

গোলটেবিলের শুরুতে বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

দৃষ্টিহীন ও প্রতিবন্ধীদের প্রতিষ্ঠান ডিজঅ্যাবলড চাইল্ডের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন জাহান বলেন, ‘অনেক সময় আমরা বিরূপ সমস্যার মুখোমুখি হই। আত্মবিশ্বাসী ও সাহস না থাকলে আমরা এগোতে পারব না। নিরাপত্তার কথা ভেবে পরিবার প্রতিবন্ধী মেয়েদের ছাড়তে চায় না। পরিবারকে ভূমিকা রাখতে হবে।’

লিওনার্ড চ্যাশায়ারের ইনোভেশন টু ইনক্লুশন (আইটুআই) প্রকল্পের উপকারভোগী নাহিয়ান বুশরা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন গেল বছর। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কখনো দমে যাইনি। তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক দক্ষতা অর্জন করেছি বেসিক ও অ্যাডভান্স পর্যায়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে। সেই অনুযায়ী আমি কাজ করছি।’

নূর সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে ১২ জন প্রতিবন্ধী কাজ করেন। এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুল ইসলাম বৈঠকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী নারীরা অনেকাংশে সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কাজ করে দেখাতে পারেন। কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক বিশ্বস্ত।’

সিবিএম ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা বলেন, ব্যক্তিপর্যায় থেকে রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিবন্ধী নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির জন্য পরিবেশ তৈরির কাজ করতে হবে। ঘরের বাইরের পরিবেশ নিরাপদ করতে হবে।

লিওনার্ড চ্যাশায়ারের আইটুআই প্রকল্পের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সুরাইয়া আক্তার বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে সাত হাজার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চাকরিমুখী করতে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী প্রতিবন্ধীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।

একসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মহুয়া পাল বলেন, খারাপ লাগে যখন দেখা যায়, প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য নেওয়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাঁদের (প্রতিবন্ধী) অনুপস্থিতি থাকে। প্রতিবন্ধী নারীদের কর্মসংস্থানে আরও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল আলম বলেন, প্রতিবন্ধী নারীরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ছেলেদের চেয়ে ভালো করছেন। যেমন মোংলা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের একটি স্থানে এক প্রতিবন্ধী নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথম দিনেই ৮ হাজার টাকা আয় করেছেন। তিনি এখন ঘরে বসে কল সেন্টারে কাজ করছেন ।

বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।