প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও জরুরি সহায়তা: কোভিড–১৯ প্রেক্ষাপট

লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল, সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও জরুরি সহায়তা: কোভিড–১৯ প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২১ ডিসেম্বর ২০২০। এ আয়োজনে সহযোগিতায় ছিল ইনক্লুসিভ ফিউচার, ইউকে এইড। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারীরা

রাশেদ খান মেনন, এমপি

সভাপতি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

এ এইচ এম নোমান খান

নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি)

শফিকুল ইসলাম

কান্ট্রি ডিরেক্টর, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ

মুরালি পদ্মানাভান

ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন অ্যাডভাইজার, লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড

মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা

কান্ট্রি ডিরেক্টর, সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল

আসাদুজ্জামান চৌধুরী রাসেল

সভাপতি, রজনীগন্ধা প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা, রাজশাহী

ইতি আক্তার

ডিপিও লিডার ফরিদপুর

আরাফাত সুলতানা লতা

সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন

অসীম ডিও

অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশনস ম্যানেজার, সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল

নুসরাত আইরীন

ন্যাশনাল ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন অফিসার, লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম

সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো, সঞ্চালক

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

কোভিডের সময় এমনিতেই মানুষ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আরও অনেক বেশি অসুবিধার মধ্যে আছে। তাদের জরুরি সহায়তার জন্য কী বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, এসব বিষয়ে আজকের আলোচনা।

কোভিড–পূর্ববর্তী সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া হতো। কিন্তু এখন করোনার সময় সহয়তা অরও বেশি দরকার। কারণ তারা ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না। তারা যেসব আর্থিক সহায়তা পেতেন, তা পাচ্ছেন না। আজকের আলোচনায় এ–সংক্রান্ত সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো কী, কোভিড-১৯ সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তায় কী করা যেতে পারে, সেসব আলোচনায় আসবে।

এ এইচ এম নোমান খান

এ এইচ এম নোমান খান

সাধারণ সময়েও প্রতিবন্ধী মানুষেরা নানা সমস্যার মধ্যে জীবন যাপন করেন। তঁারা পিছিয়ে আছেন। বৈশ্বিকভাবেও প্রতিবন্ধী মানুষের অবস্থান অন্য সব মানুষের চেয়ে পিছিয়ে।

আমাদের দেশেও একই অবস্থা। উন্নত দেশ থেকে শুরু করে সব দেশেই কোভিড প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যে মানুষগুলোকে নির্ভর করতে হয় পরিবার ও সমাজের ওপর তারা এখন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কী? প্রতিবন্ধী মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে এক–দশমাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে তারা প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত।

প্রতিবন্ধী মানুষের কতজন এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ও কতজন মৃত্যুবরণ করেছে, তার সার্বিক চিত্র দেশে নেই। পরিসংখ্যান দিয়ে এ অবস্থাটা তুলে ধরতে পারছি না, যা আমাদের প্রচণ্ড দুর্বলতা।

বেঁচে থাকার অবলম্বন হচ্ছে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন সেবা। স্বাভাবিক সময়ে স্বাস্থ্যসেবায় প্রতিবন্ধী মানুষেরা খুব একটা সুযোগ পান না। বর্তমান কোভিড সময়ে তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা প্রচণ্ড ঝুঁকিতে আছে। তঁাদের পুনর্বাসনসেবায় জোর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে অনেক থেরাপিনির্ভর প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন। একজন মানুষকে প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে থেরাপি দিতে হয়। আজ ১০ মাস ধরে তঁাদের এ থেরাপির সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই নেই।

কোভিড আমাদের শুধু দুঃখ-কষ্টে ফেলেনি, প্রচুর আবিষ্কারের দিকেও নিয়ে আসছে। প্রতিবন্ধী মানুষেরা আগে থেরাপি সেন্টারে এসে থেরাপি নিতেন। এখন সেটা পারেন না। এখন এসব সেবা বাড়িতে দেওয়া সম্ভব। কারণ, এখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অনেক সেবাকেন্দ্র আছে।

আগে সেবাকেন্দ্রে মানুষ আসতেন। এখন সেবাকেন্দ্র থেকে প্রতিবন্ধী মানুষের বাড়িতে যেতে হবে, কারণ তাঁরা আসতে পারছেন না। অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী মানুষের অভিভাবক ও সেবাদাতাদের কাছে এ সেবার দক্ষতা পৌঁছে দিতে পারি। কারণ, প্রতিবন্ধী মানুষটির সেবা, থেরাপি ও কাউন্সেলিং দরকার।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাটি হচ্ছে শিক্ষা। সারা দেশে স্কুল–কলেজ বন্ধ। প্রতিবন্ধী মানুষদের শিক্ষামুখী করতে বছরের পর বছর সময় লেগেছে। কিন্তু কোভিড সময়ে তারা একেবারেই ঝরে পড়েছে। ১০ মাস শিক্ষার বাইরে থাকায় শিক্ষার যে ঘাটতি হয়েছে, তা অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনোভাবে পূরণ করবে। কিন্তু প্রতিবন্ধী শিশুরা এক বছর পিছিয়ে গেলে ঝরে পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা আছে। ভ্যাকসিন প্রয়োগে অগ্রাধিকার তালিকায় প্রতিবন্ধী মানুষদের বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

আসাদুজ্জামান চৌধুরী রাসেল

আসাদুজ্জামান চৌধুরী রাসেল

উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যথাসাধ্য ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট ছিল না। ত্রাণ পেতে প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষদের সমস্যা হয়েছিল। যেখানে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়, সেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম থাকে। ফলে প্রতিবন্ধী মানুষদের সেখানে যেতে সমস্যা হয়। পরে যদি আবারও আগের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে হয়তো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। এসব ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাড়ি ত্রাণসহায়তা দেওয়া হলে, ত্রাণসহায়তা থেকে বাদ পড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারত।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কিছুটা সহজে ত্রাণসহায়তা পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সংগঠনের বাইরে অনেকে জানতেন না যে কোন জায়গায় গেলে সহায়তা পাবেন। বিভিন্ন সময় যাঁদের থেরাপি দেওয়া হয়, তাঁদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হতো।

মুরালি পদ্মানাভান

মুরালি পদ্মানাভান

৩০ বছরের বেশি পুরোনো সংগঠন লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও চক্ষু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। আমরা প্রায় প্রতিটি মহাদেশেই কাজ করছি। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে ও জরুরি পরিস্থিতিতে আমরা লাখো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তঁাদের পরিবারের কাছে পৌঁছেছি।

আমরা মূলত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিই। জরুরি পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা যেকোনো মানবিক সংকটে সহায়তা দিতে তৎপর। আমরা সব মানুষ বিশেষ করে প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। আমরা এমন একটা পৃথিবী চাই যেখানে সবাই অন্তর্ভুক্ত থাকবে, কেউই পেছনে পড়ে থাকবে না। সে জন্য আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও ২০৩০ সালের অ্যাজেন্ডার প্রতি অত্যন্ত জোর দিচ্ছি। আমরা সব জাতীয় আইন নিয়েও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামসহ বিভিন্ন বার্ষিক অনুষ্ঠানে আমরা সহায়তা করে থাকি।

ইউকে এইড ও বাংলাদেশের অন্য কারিগরি অংশীদারদের সমন্বয়ে আমরা শিক্ষাসহায়তা ও জীবিকার ক্ষেত্রে সরাসরি কাজ করছি। এ ছাড়া আমরা নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও কাজ করতে চাই। যেন যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী মানুষেরা পিছিয়ে না থাকে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে তাদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তারা শুধু আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং তাদের প্রতিবন্ধিতার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা কমিউনিটি পর্যায়ে কাজ করা মূলধারার সংগঠনগুলোকেও এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করি।

আমরা প্রতিবন্ধী মানুষের সমস্যাগুলোকে তিনটি ভিন্ন দিক থেকে দেখি। প্রথমত, তারা সমাজে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। নিয়মিত সেবা নিতে পারছে না। যেটা কোভিডের কারণে আরও বাড়ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে কোভিডের কারণে সৃষ্ট নতুন বাধাগুলো। এ প্রভাবগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। তৃতীয়ত, করোনাকালে কিছু নতুন সুযোগও তৈরি হয়েছে, যেমন অনলাইন শিক্ষা। ডিজিটাল জ্ঞান, অনলাইন শিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার কাছে পৌঁছাতে এখনো দীর্ঘ পথ যেতে হবে। সে জন্য আমরা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। আমরা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।

ভবিষ্যতে জরুরি পরিস্থিতির সব কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্তিমূলক করা প্রয়োজন। লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড এ ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ।

অসীম ডিও

অসীম ডিও

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিবন্ধী। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে দেশে বিভিন্ন রকমের তথ্য রয়েছে। যেমন ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬’ অনুযায়ী দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আবার সমাজসেবা অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২১ লাখ ৬১ হাজার ২৮১ জন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত ও মূলধারার সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে সরকার বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এর মধ্যে অন্যতম।

বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত কোভিড-১৯ মহামারিতে বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিড অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (এনএডব্লিউজি) ও ইনোভেশন প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দুর্যোগকালের মতো নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষ কোভিড-১৯–এর বিরূপ প্রভাবের কারণে মানসিক চাপে ভুগছেন। পর্যাপ্ত তথ্য ও সচেতনতার অভাবে সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। পাশাপাশি লকডাউন ও স্বাভাবিক চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় ৬৯ শতাংশ প্রতিবন্ধী পুরুষ ও ৭৯ শতাংশ নারী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

সর্বোপরি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) প্রাক্কলন অনুযায়ী কোভিড-১৯ মহামারির নেতিবাচক প্রভাবের কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে।

এ ক্ষেত্রে সরকার বরাবরের মতো জরুরি সেবা ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে ছিল, যা জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদের ধারা ১১ (ঝুঁকিপূর্ণ ও মানবিক জরুরি অবস্থা) ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩–এর ধারা ১৬ (প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারসমূহকে) সমর্থন করছে। এ সময় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তায় নিরলসভাবে কাজ করছে। এর মধ্যে লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সিবিএম ইন্টারন্যাশনাল ও সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) উল্লেখযোগ্য।

এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা, প্রতিবন্ধকতা ও শিখনসমূহ সবার সঙ্গে শেয়ার করা। অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো আমরা সরকারের পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থান ও কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সহযোগী সংস্থা ও প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনগুলোকে (ডিপিও) সঙ্গে নিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে।

নিজ নিজ কর্ম এলাকায় বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাজীবন হুমকির মধ্যে পড়েছে। অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তঁাদের জীবিকা হারিয়েছেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাজীবন ও জীবিকা চলমান রাখতে ১৭৭ জনকে শিক্ষা ও জীবিকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির এই সময় সমন্বিত উদ্যোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।

নুসরাত আইরীন

নুসরাত আইরীন

কোভিড সময়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তার লক্ষ্যে ইউকে এইডের আর্থিক সহায়তায় লাইট ফর দ্য ওয়ার্ল্ড, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও সিডিডি ছয় মাসব্যাপী একটি জরুরি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যার মূল লক্ষ্য হলো এ দুর্যোগের সময়ে প্রতিবন্ধী মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি, বিভিন্ন জরুরি সেবা ও সহায়তায় অন্তর্ভুক্তি, আর্থিক সহায়তা এবং শিক্ষা ও জীবিকামূলক সহায়তা প্রদান করা।

এ প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী ও ফরিদপুর জেলায় স্থানীয় ডিপিওদের সহযোগিতায় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বেশ কিছু অ্যাডভোকেসি সভা পরিচালনা করা হয়। যেখানে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, এনজিও, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও ডিপিও সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। এ আলোচনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছে সহজে জরুরি সেবা ও সহায়তা পৌঁছে দিতে বিভিন্ন সুপারিশ এসেছে। এ ছাড়া সেবা ও সহায়তায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধার কথাও আসে।

স্থানীয় সরকারের কাছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হালনাগাদ তথ্য না থাকা একটি বড় বাধা। হালনাগাদ তথ্য থাকলে ত্রাণ বিতরণে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সহজ হয়। দেশব্যাপী লকডাউনে গুরুতর ধরন ও মাত্রার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতায়াত একটি বড় বাধা। যে কারণে তাঁরা বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে সেবা ও সহায়তা গ্রহণ করতে পারছিলেন না। পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদে লোকবলের যথেষ্ট অভাব ছিল। ফলে তাঁরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বাড়ি বাড়ি এ সেবাগুলো পৌঁছে দিতে পারেননি। যার ফলে গুরতর ধরন ও মাত্রার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনেকাংশে এ সেবা থেকে বাদ পড়েছেন।

আলোচনায় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, কর্মকর্তা ও উপস্থিত সুশীল সমাজ প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি আসে। যেকোনো ধরনের সেবা-সহায়তা ও কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন একটি সামগ্রিক পূর্বপরিকল্পনা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির তথ্য নির্দিষ্টভাবে হালনাগাদ থাকা জরুরি।

বিভিন্ন জরুরি ত্রাণসহায়তার পাশাপাশি দুর্যোগ–পরবর্তী দীর্ঘকালীন সহায়তায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ত্রাণসহায়তার পাশাপাশি চিকিৎসাসেবা ও বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কোভিড-১৯ পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

দেশে বিদ্যমান মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক করে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।

মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা

মুহাম্মদ মুশফিকুল ওয়ারা

কোভিডের সময় ও কোভিড–পরবর্তীকালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার খুব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।

সিভিল সোসাইটির সমন্বয়ে একটা সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ খুবই জরুরি। যেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নীতিমালা ও তার বাস্তবায়নের সুফল অর্জন করতে পারে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মরত উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করা খুবই প্রয়োজন। সে জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা, প্রয়োজন ও অধিকার—তিনটি জিনিস নির্দেশ করা খুবই জরুরি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিশেষ চাহিদাগুলো স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে নির্দেশ করা কোভিড–পরবর্তী সময়ে ‘বিল্ড ব্যাক বেটার’–এ সহযোগিতা করবে। এ জন্য আন্তমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো দরকার। তাহলে কোভিডে সরকারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেকগুলো ফেডারেশন আছে। সব কটি ফেডারেশন একে অপরের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে এলে তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় সরকার ও জনগণের সম্পৃক্ততায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ ও তাদের কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, সেগুলো নির্দেশ করা যাবে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকার বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা ও তাদের কাছে সেবা কতখানি পৌঁছাচ্ছে, তা আলোচনায় আসতে হবে। এখানে যেসব উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, তাদেরও একসঙ্গে কাজ করার দরকার আছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই প্রতিবন্ধীদের বিচিত্র রকমের চাহিদা নিশ্চিত করতে পারি।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ভিন্নতা আছে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদা বিভিন্ন রকমের হয়। সে জন্য তাদের চাহিদা বোঝা, তা নীতিমালায় আনা, পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তদারকি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরীক্ষা, চিকিৎসা ও ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে সব কটি হেল্প সেন্টারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ন্যূনতম প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

ইশারা ভাষা না জানা, ফিজিক্যাল ও অকুপেশনাল থেরাপিস্ট না থাকা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কীভাবে সহযোগিতা করতে হবে, এসব বিষয় জানা না থাকার কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাঁদের প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যদিও তাঁদের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যসেবা ও ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিকল্পনায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বরাদ্দ রাখা দরকার। এভাবে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারের সঙ্গে আরও সহযোগিতার মাধ্যমে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।

কোভিডকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাব। কোভিড অবশ্যই আমাদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। কিন্তু আমরা তা থেকে অনেক কিছু শিখেছিও। এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। যার মাধ্যমে আমরা কোভিডের বিরূপ প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে উঠতে পারব। তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন। সবার জন্য যেন আমাদের পরিকল্পনা ও সেবা নিয়ে যেতে পারি। তাহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারব।

ইতি আক্তার

ইতি আক্তার

কোভিড-১৯ সময়ে উপজেলায় গিয়ে আমাদের অনেক সময় অনেক সমস্যা পড়তে হয়েছে। প্রথম দিকে তিন মাস আমরা ঘর থেকে বের হতে পারিনি। এরপর যখন আবার যোগাযোগ করেছি, তখন দেখা যায় অনেক কর্মকর্তাই আসেননি। অর্থাৎ যাঁদের কাছে আমাদের কথাগুলো তুলে ধরব, তাঁরা আসেননি।

অনেক সময় যারা প্রতিবন্ধী না তাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের সে সুযোগ দেয়নি। যখন আমরা চ্যালেঞ্জ করি যে আমাদের কথাগুলো তুলে ধরব, তখন কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। আমাদের উপজেলায় হুইলচেয়ারের প্রবেশগম্যতা নেই। ফলে হুইলচেয়ারে থাকা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সেখানে যেতে পারেননি।

কোভিড-১৯–এর কারণে আমরা আর্থিকভাবে অচল হয়ে গেছি। আমরা চাই না যে কেউ আমাদের ২০০, ৫০০ বা ১ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করুক। আমরা চাই আমাদের জন্য যেন আয়ের একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। যেন আমরা নিজে চলতে পারি এবং আমাদের পরিবার চালাতে পারি। পরিবার যেন আমাদের বোঝা মনে না করে। প্রতিবন্ধী ছেলে বা মেয়ের মাধ্যমে পরিবারের কিছু আয় হলে, পরিবার তাকে আর বোঝা মনে করবে না।

শফিকুল ইসলাম

শফিকুল ইসলাম

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অনেকগুলো সমস্যা আছে। এটা আমরা সব সময়ই শুনে আসছি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমাধান করারও চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই সমাধান যে একবারে সবগুলো করে ফেলেছি, তা আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। স্বল্প সময়ের জন্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর মতো অনেকগুলো উদ্যোগ ছিল। যখন পুরোদমে দেশ লকডাউন ছিল, তখন সরকারি পর্যায়ে অনেক প্রাথমিক ত্রাণসহায়তা ছিল।

পরবর্তী পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। যদিও যেসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়মিত ভাতা পান, তঁারা এ প্রণোদনার মধ্যে যুক্ত হবেন কি হবেন না, সেটি নিয়ে দ্বিধা ছিল। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে এ দ্বিধা অনেকটাই পরিষ্কার করা হয়েছে। ফলে অনেকেই সে প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে যুক্ত হয়েছেন।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাহায্য সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা বা অভিগম্যতার একটি সমস্যা প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। সেটি এ কোভিডকালে বেশি হয়েছে, তা না। কোভিডকালে আরও বেশি চোখে পড়ছে। যেহেতু ত্রাণসামগ্রী নেওয়া অথবা অন্য কোনো সেবা গ্রহণের জন্য তাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে হয় বা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, এ বিষয়টি বিকল্পভাবে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিশেষ করে যেসব চরম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাড়িতে অথবা তাদের কাছাকাছি এসব সেবাগুলো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদ অনেক জায়গায় একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দিয়ে এ সেবাগুলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা এখন কোভিডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আছি। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার হার বাড়ছে। মৃত্যুও হচ্ছে।

মানুষ এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন হচ্ছে, তা এখনো আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। কোভিডের লক্ষণ প্রকাশ পেলে পরীক্ষা করার জন্য তাঁরা কাছের কোনো পরীক্ষাকেন্দ্রে যাচ্ছেন কি না? এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বড় রকমের বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা ও তঁাদের নজরদারির মধ্যে আনা দরকার। যেন বর্তমানে কোভিডে আক্রান্তের হার বাড়ার বিষয়ে তঁাদের সচেতন করতে পারি।

কেউ আক্রান্ত হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কাছে যেন দ্রুত সহযোগিতা পৌঁছে দিতে পারি। এসব সেবা মানুষের কাছাকাছি কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ ও এ–সংক্রান্ত অন্যরা যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করছেন।

কবে নাগাদ কোভিড মহামারি শেষ হবে, তা এখনো আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। কোভিড–পরবর্তী সময়ে দিনমজুর, ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থা কী হবে? সে জন্য এখন থেকেই তাদের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ও সহযোগিতার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। বাংলাদেশে এখন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আছে। সেটিকে কোভিড বাস্তবতায় আবার বিশ্লেষণ করা দরকার।

রাশেদ খান মেনন, এমপি

রাশেদ খান মেনন, এমপি

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় অনেক কিছু করা হয়েছে। তবু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কতটুকু করতে পেরেছি, এ প্রশ্নটা রয়েছে। প্রথম দিকে সরকার প্রান্তিক জনগণের জন্য ত্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু আমি দেখলাম, ত্রাণ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাদ পড়ে যাচ্ছেন।

ত্রাণ তৎপরতায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা না থাকায় এ বিষয়টি বণ্টনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নজরের বাইরে ছিল। সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এখানে মূলত কাজ করা দরকার জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও এনডিডি ট্রাস্টের। এনডিডি ট্রাস্ট ত্রাণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে।

শারীরিক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কিছু করা গেছে। কিন্তু অটিস্টিকদের জন্য একটি বিপদের জায়গা তৈরি হয়ে আছে। যেসব সংগঠন থেকে অটিস্টিক শিশুরা সেবা পেত, সেসব সংগঠন তাদের কার্যক্রম চলমান রাখতে পারেনি। বাড়িতে থেকে সেবা নিতে হওয়ায় এ ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেল।

আমাদের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা নিয়েই বিবাদ আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ডব্লিউএইচওর মতে, ১০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। আর সমাজসেবা অধিদপ্তরের মতে, মাত্র ২ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রতিবন্ধী। সরকারের তরফ থেকে অনেকগুলো প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য তাদের সংখ্যাগত দিকটি প্রথমেই ঠিক করা দরকার।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ধরন অনুযায়ী পরিসংখ্যানও করা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। আজকের আলোচনা সুনির্দিষ্ট সুপারিশ আকারে সামনে এলে সমাজকল্যাণ–সম্পর্কিত স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় তা একটি বিষয় আকারে নিয়ে আসতে পারব।

কোভিড এখনই শেষ হচ্ছে না। ভ্যাকসিনেশনের পরও আমাদের মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। টিকা পাওয়ার একটি অগ্রাধিকার তালিকা করা হয়েছে। টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তালিকায় বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যুক্ত করা দরকার। এ সংখ্যাটা খুব বড় না। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে ‘নোবডি ইজ টু বি লেফট বিহাইন্ড’ (কাউকে বাদ দিয়ে নয়)। এর মধ্যে যেমন দরিদ্র মানুষ রয়েছে তেমনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও রয়েছে। এ বিষয়টি নজরে রাখা দরকার।

আমি প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনকে ইতিমধ্যে বলেছি যে এ ক্ষেত্রে তাদের নেতৃস্থানীয় অবস্থান নিতে হবে। কেননা তাদের হাতে বহু প্রতিবন্ধী সেবা ও সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে। এ সেবাকেন্দ্রগুলো সেভাবে কার্যকর না।

অনেকগুলো গাড়ি আছে, যেগুলো দিয়ে বিভিন্ন জেলায় থেরাপি দেওয়া হয়। এসব গাড়ি এখন উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত যায়। এগুলোকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত পাঠিয়ে দিতে হবে। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন এসে সেবা নিতে পারে, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

কোভিড-১৯ একটি বিশেষ পরিস্থিতি। সব ক্ষেত্রেই এখন একটা বিশেষ বাস্তবতা বিবেচনা করা হচ্ছে। এই বিশেষ পরিস্থিতি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য আলাদা মনোযোগ দাবি করে।

আলোচনায় অংশগ্রহণ করায় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • ভ্যাকসিন প্রয়োগে অগ্রাধিকার তালিকায় প্রতিবন্ধী মানুষদের বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

  • স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাড়িতে ত্রাণসহায়তা দেওয়া যেতে পারে

  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নেওয়া সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সব উদ্যোগের মধে্য সমন্বয় দরকার

  • কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হালনাগাদ তথ্যভান্ডার তৈরি করা জরুরি

  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ত্রাণসহায়তার পাশাপাশি কোভিড–১৯ পরীক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন

  • সামাজিক সুরক্ষা খাতের বিভিন্ন স্কিমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার

  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য নেওয়া জাতীয় কর্মপরিকল্পনা কোভিড–১৯ প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন

  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রণোদনা দেওয়ার জন্য তঁাদের সংখ্যাগত দিকটি প্রথমেই ঠিক করা দরকার

  • প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ভিন্নতা আছে। সে জন্য তাঁদের চাহিদা বোঝা, তা নীতিমালায় আনা, পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তদারকি করা গুরুত্বপূর্ণ

  • কতজন প্রতিবন্ধী মানুষ করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই