প্রযুক্তিতে মেয়েদের আগ্রহী করতে হবে স্কুল থেকেই

‘আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তিতে কিশোরী’ দিবসের আলোচনায় প্রযুক্তি পেশায় জেন্ডার-বৈষম্য কমিয়ে আনার আহ্বান।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি–বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ মাত্র সিকিভাগ। পেশা হিসেবে এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ আরও কম, ১২-১৩ শতাংশ। দেশের প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের জন্য স্কুলপর্যায় থেকে মেয়েদের প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে এ পেশায় জেন্ডার-বৈষম্য কমিয়ে আনতে উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ, প্রণোদনাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তিতে কিশোরী’ দিবস (ইন্টারন্যাশনাল গার্লস ইন আইসিটি ডে) উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় এ কথা বলেন বক্তারা। তাঁরা বলেন, ‘মেয়েদের জন্য কঠিন’ উল্লেখ না করে ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের প্রযুক্তি শিক্ষায় উৎসাহ দিতে হবে। দ্রুত বর্ধনশীল প্রযুক্তি খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ও এ খাতকে পেশা হিসেবে নিতে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর এপ্রিল মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালন করা হয়।

গ্রামীণফোনের সহযোগিতায় ‘তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কিশোরী ও যুব নারীর অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিতকরণ’ শিরোনামে আলোচনা সভাটি যৌথভাবে আয়োজন করে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প। এতে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলোকিশোর আলো

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক বলেন, এক যুগ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়ার সময় দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ। এখন তা সাড়ে ১১ কোটি। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে সারা দেশে এখন আইসিটি ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখ। তিনি বলেন, স্কুলজীবন থেকেই প্রযুক্তি শিক্ষায় মেয়েদের আগ্রহী করে তুলতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি জানান, জাতিসংঘের সহায়তায় আইসিটি বিভাগ উইমেন আইসিটি ফ্রন্টিয়ার ইনিশিয়েটিভ (ওয়াইফাই) প্রকল্পের আওতায় ৫০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করছে। এসব উদ্যোগে বেসরকারি সংস্থাগুলো সম্পৃক্ত হলে মেয়েদের আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এ দেশীয় প্রতিনিধি অর্লা মারফি বলেন, শিক্ষায় এখনো মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেশি। প্রত্যেক মেয়ের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে, তা নিয়ে যেন সে এগিয়ে যেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারত্বে প্রযুক্তি খাতে জেন্ডার-বৈষম্য কমিয়ে আনতে করণীয় ঠিক করতে হবে।

গ্রামীণফোনের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা সৈয়দ তানভীর হোসেন বলেন, গবেষণায় বলা হচ্ছে, এখন যে প্রজন্ম স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তাদের ৬৫ শতাংশ ভবিষ্যতে যেসব পেশায় ঢুকবে, সেসব পেশা এই সময়ে নেই। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রযুক্তিগত ও উদ্ভাবনী পেশার কথা মাথায় রেখে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিনা এফ জাবীন বলেন, প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের দিক দিয়ে নারী এখনো অনেক পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আনতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নে মেয়েদের এখন নিজেকেই নির্ভরযোগ্য পরামর্শকের অবস্থানে ভাবতে হবে।

প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা নারী ২-৩ শতাংশের বেশি নয়, জানিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে মেয়েদের এক ধরনের ভীতি কাজ করে। ভয়টা আসলে সত্যিকারের ভয় নয়। ছোটবেলা থেকে তাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তি খাতে নারী উদ্যোক্তা বাড়াতে ২ শতাংশ হারে ব্যাংকঋণ, ১০ বছরের করপোরেট কর মুক্ত করা, বেসিসের ফাঁকা জায়গা কম খরচে বা বিনা মূল্যে ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ নারী কর্মী রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্কো) সভাপতি ওয়াহিদ শরিফ বলেন, প্রযুক্তি খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। এ পেশায় বাড়ি থেকে কাজ করা ও খণ্ডকালীন আয় করার যে সুযোগ, তা বিস্তৃত করা প্রয়োজন। এটা ২৪ ঘণ্টার পেশা। অনেক নারীকে রাতে বাড়ি ফেরার সময় নানান হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়। এতেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।

সম্প্রতি একটি কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ বলেন, শুরুতে বলা হচ্ছিল, নারীদের হাতে ডিভাইস কম, তাঁরা বিষয়টি বুঝবেন না। অথচ মাত্র দুদিনের প্রশিক্ষণে ওই নারীদের পুরো বিষয়টি বোঝানো গেছে এবং তাঁরা ভালোভাবে কাজটি চালিয়ে নিচ্ছেন। তাই শুধু অনুমানের ভিত্তিতে নারীদের পিছিয়ে না রেখে একটু শ্রম দেওয়ার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে নেওয়া উচিত।

আলোচনায় যুব প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটির (সিএসআইডি) তুছাব্বের মুনতাহা, ইয়েস বাংলাদেশের ওয়াই মুভস প্রকল্পের আসাদুজ্জামান এবং কিশোর আলোর প্রদায়ক ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাফা জেরিন সুকন্যা।

তোছাব্বের মুনতাহা প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণে ১০-১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী নারীকে সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ করেন। আসাদুজ্জামান ইন্টারনেট সহজলভ্যতার সংকটে থাকা গ্রামের উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ডেটা প্যাকেজ সরবরাহ এবং এই দিবসটিকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি জানান। সাফা জেরিনের মতে, প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীর প্রতি হয়রানি বন্ধেও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। তিনি বলেন, যে ১০-১২ শতাংশ মেয়ে প্রযুক্তি খাতকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে, তাদের মধ্যে ১ শতাংশও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেই। গ্রাম পর্যায়েও অনেক মেয়ে এখন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। তাই সঠিক প্রশিক্ষণ ও পদক্ষেপ নিলে এ খাতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব।