মানসিক স্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার চাই

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।

দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু–কিশোরদের ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। করোনাকালে দেশে আত্মহত্যাসহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়েছে। কিন্তু সমস্যা প্রকট হলেও এ খাতে সরকারের বরাদ্দ খুবই কম। দেশের মোট স্বাস্থ্য বাজেটের দশমিক ৫০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রয়েছে। আবার এ খাতে দক্ষ জনবলেরও স্বল্পতা আছে। তবে গত কয়েক বছরে এ খাতের উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আগের চেয়ে আগ্রাধিকার পাচ্ছে, এ খাতে আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

‘সকলের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতি ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ভার্চ্যুয়ালি এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘কমিউনিটি বেইজ্ড মেন্টাল হেলথ সার্ভিসেস প্রকল্প’ এবং প্রথম আলো। এ আয়োজনে সহায়তা করেছে ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট এবং ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন।

আলোচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বড় বড় হাসপাতাল না বানিয়ে বিদ্যমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ আরও বাড়ান। পাবনা মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানের ইনস্টিটিউট করার বিষয়টিও রয়েছে। তিনি বলেন, চিকিৎসাবিষয়ক বিভিন্ন কোর্স, কারিকুলাম এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সংযোজন করা জরুরি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্যনীতির খসড়া মন্ত্রিসভায় উত্থাপনের অপেক্ষায় আছে বলে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল অনু বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খান। তিনি বলেন, নীতি প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নে বাজেটের কোনো সমস্যা হবে না। জেলা হাসপাতালগুলোতে একজন চিকিৎসক ও দুজন নার্সকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ পেতে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।

প্রবীণ জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মানসিক স্বাস্থ্যসংকটে থাকে বলে আলোচনায় উল্লেখ করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (এনডিডি ও অটিজম) শবনম মুস্তারী। তিনি বলেন, বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আলাদা একটি ইউনিট গঠনের সুপারিশ করেন তিনি।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। ইশারা ভাষায় গোলটেবিলের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন আরাফাত সুলতানা।

বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের পরিচালক (কান্ট্রি ডিরেক্টর) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে এখন মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। এখন বিষয়টিকে সঠিক গন্তব্যের দিকে নিতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের কত মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে, তার সঠিক তথ্য নেই। জনশুমারিতে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে সুপারিশ করেন তিনি।

বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান। তিনি বলেন, করোনাকালে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিলে তা শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সূচকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জাতীয় পরামর্শক (মানসিক স্বাস্থ্য) হাসিনা মমতাজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব নেই। তবে দক্ষ জনবল এবং বাজেটস্বল্পতা আছে। এ খাতে বিনিয়োগ কীভাবে বাড়ানো যায়, পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার সুযোগ তৈরিসহ বিভিন্ন কাজ চলমান আছে বলে জানান তিনি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ দেশের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র একেবারে হতাশাজনক নয় বলে উল্লেখ করেন। এ খাতে দক্ষ জনবল বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি স্কুলগুলোতে কাউন্সেলর নিয়োগ করা হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা, হতাশা কমে যাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি সোসাইটির সভাপতি শামীম এফ করিম।

সূচনা ফাউন্ডেশনের লিড কো-অর্ডিনেটর নাজিশ আরমান বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকার বা গুরুত্বের তালিকায় আছে। কয়েক বছর ধরে এ খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের দিকে নজর বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ মেন্টাল হেলথ নেটওয়ার্কের সহসভাপতি অধ্যাপক ফারুক আলম বলেন, দেশে সরকারি–বেসরকারি মিলে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালে মানসিক স্বাস্থ্যের বিভাগ ও দক্ষ জনবল আছে। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখভালের জন্য আলাদা ইউনিট গঠনের সুপারিশ করেন।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জন্য সমাজকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক তৈরিতে আরও গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি মাহমুদুর রহমান।

গোলটেবিল বৈঠকে বাগেরহাটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন মো. হাবিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কামাল চৌধুরী, ডিজঅ্যাবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন জাহান, যশোর প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের জেলা প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তা মুনা আফরিণ প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।