মেয়েদের স্কুলে ফেরাতেই হবে

১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে ‘মেয়েদের স্কুলে ফেরাতেই হবে’ শীর্ষক ব্র্যাক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চ্যুয়াল সেই সংলাপের নির্বাচিত অংশ এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

অংশগ্রহণকারী

দীপু মনি

মাননীয় মন্ত্রী, িশক্ষা মন্ত্রণালয়

রাশেদা কে চৌধূরী

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান

আরমা দত্ত

সাংসদ ও মানবাধিকারকর্মী

সাদেকা হালিম

অধ্যাপক ও ডিন, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আসিফ সালেহ

নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক

আমেনা বেগম

বিপিএম: অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ

তাহেরা জাবীন

সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাডভাইজার, ব্রিটিশ হাইকমিশন, ঢাকা

সায়মন বাকলে

ফার্স্ট সেক্রেটারি, ডেভেলপমেন্ট, অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন

সঞ্চালনা

নবনীতা চৌধুরী

পরিচালক, জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি, ব্র্যাক

নবনীতা চৌধুরী

নবনীতা চৌধুরী: ‘মেয়েদের স্কুলে ফেরাতেই হবে’ শীর্ষক ব্র্যাক সংলাপে সবাইকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশে ‘জাতীয় কন্যাশিশু দিবস’ পালিত হয়েছে ৩০ সেপ্টেম্বর। আজ ১১ অক্টোবর তা পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। কোভিড-১৯ সংকটের বাস্তবতায় এবারের কন্যাশিশু দিবস পালনে আমরা এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে পুরো সমাজের ভবিষ্যতে। আমরা জানি, বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের স্কুলে ভর্তির হার পুরো পৃথিবীতেই দারুণভাবে প্রশংসিত। প্রায় ৯৯ শতাংশ মেয়েশিশু বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় নিবন্ধিত হয়। কিন্তু অন্যদিকে বাংলাদেশ আবার বিশ্বে বাল্যবিবাহের হারের দিক দিয়ে শীর্ষস্থানীয় ১০ দেশের একটি। কোভিড মহামারীর মধ্যে তা আরো অনেক বেড়েছে। বছরখানেকের বিরতির পর স্কুল যখন আবার খুলবে, তখন বহু বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, আন্দোলন-সংগ্রাম, সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে বাংলাদেশ যে দারুণ সাফল্য অর্জন করেছিল, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তো? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আপনাকে দিয়ে শুরু করতে চাই।

দীপু মনি

দীপু মনি: স্কুল খুলতে যত দেরি হবে, স্কুল খোলা না থাকায় যে সমস্যাগুলো হচ্ছে, সেগুলো বাড়বে। এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা আমাদের অন্য যেসব সমস্যা আছে, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে সেগুলোর সমাধানে কাজ যদি আমরা আরও জোরদার করি তাহলে সেই প্রভাবগুলো কমিয়ে আনতে পারব। তবে স্কুল খোলার ব্যাপারে যে বিষয়টি আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হচ্ছে, সেটি হলো আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও তাঁদের পরিবারের সবার স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি। আমরা এ বিষয়ে নিজের দেশ নয়, সারা বিশ্বের অন্য দেশগুলো কী করছে, সেটিও পর্যবেক্ষণ করছি। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, এ ব্যাপারে যে জাতীয় পরামর্শক কমিটি আছে, তাদেরও মতামতের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি। যখনই আমরা মনে করব, এই ঝুঁকি অনেক কমে গেছে, তখন স্কুল খুলে দিতে পারব। তার আগে তো আসলে
খোলা সম্ভব নয়। কারণ, শিক্ষার্থী, তার পরিবার, তাদের জীবনের ঝুঁকিকে তো হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।

নবনীতা চৌধুরী: আরমা দত্তের কাছে যেতে চাই। বাংলাদেশে শুধু প্রাথমিক পর্যায়েই ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশুর সংখ্যা বেশি ভর্তি হয় তা–ই নয়, মাধ্যমিকেও মেয়েদের ভর্তির হার বেশি। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পর দশম শ্রেণি শেষ করার আগেই ৪২ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। ব্যানবেসের তথ্য বলছে, বাল্যবিবাহ এর অন্যতম কারণ। করোনার করোনায় এই পরিসংখ্যান আমাদের কাছে আছে যে বাল্যবিবাহ বহুগুণে বেড়েছে। আসলে আমরা করোনায় মেয়েশিশুদের অবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ট জানি কি না?

আরমা দত্ত

আরমা দত্ত: পরিস্থিতিটা হচ্ছে—বাস্তব ভার্সেস আকাঙ্ক্ষা। বাস্তবের সঙ্গে আমাদের আকাঙ্ক্ষা মেলাতে হবে। আমরা এখন কোভিড ক্রান্তিকালে আছি। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশই এ সমস্যার মধ্যে রয়েছে। সরকারি–বেসরকারিভাবে আমরা সবাই চেষ্টা করছি।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি যে অনেক মা–বাবা ভাবেন, আহা রে মেয়েটাকে পড়িয়ে কী লাভ? বাল্যবিবাহের কারণ যে দারিদ্র্যের সঙ্গে সব সময় যুক্ত, তা নয়, এর সঙ্গে মানসিক ব্যাপারও জড়িত। আমাদের যে সোশ্যাল ইস্যুজ ও ফ্যাক্টরস আছে—কালচারাল, সোশ্যাল—সবগুলো থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এ বিষয়গুলো রিভিউ করা দরকার। যার কারণে আমরা মনে করি, আমাদের অনেক বেশি কারিগরি শিক্ষার দিকে যেতে হবে। সবাই তো এখানে বিএ–এমএ পাস করবে না। কারিগরি শিক্ষা যদি অষ্টম শ্রেণি থেকে দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের একটা আয়ের পথ হবে। বহু মেয়ে আসে গার্মেন্টস সেক্টরে, আয় করে। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে এরা কিন্তু ঝরে পড়ে না।

মেয়েশিশুদের স্কুলে তো ফেরাতে হবে। আশপাশের দেশগুলো যারা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ, তারা কী ধরনের ফর্মুলা নিচ্ছে, সেটাও দেখা দরকার। সবকিছুর সঙ্গে যেহেতু নিউ নরমালে মানিয়ে নিতে হচ্ছে, বাস্তবতা বিবেচনা করে এ জায়গাটায় ব্যবস্থা নিতে হবে। এককভাবে সরকার হয়তো এটা পারবে না। বিশেষ করে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে, যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে বহু বছর ধরে, তাদের সঙ্গে করে এ ক্ষেত্রে পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

নবনীতা চৌধুরী: আমেনা বেগম, আপনার কাছে যেতে চাই। ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে করোনাকালে সাধারণ ছুটির প্রথম দুই মাসে স্কুলগামী শিশুদের ৩ শতাংশ বলেছে যে তারা নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মনে রাখতে হবে, টেলিফোনে সাক্ষাৎকারভিত্তিক হওয়ায় ঐ গবেষণায় শিশুরা নির্যাতনের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়ার পরিবেশ পায়নি। আর, এমনিতে মনে হবে ৩ শতাংশ কম। কিন্তু ৩ কোটি ১০ লাখ শিক্ষার্থীর ৩ শতাংশ কিন্তু সাড়ে ৯লাখের কাছাকাছি।

আমেনা বেগম

আমেনা বেগম: লকডাউনের সময়ে আসলেই কী করতে হবে, এটা নিয়ে সবার ধারণা ছিল না। আমাদের এখানে শিশু নির্যাতনের আলাদা ডেটা তৈরি করা হয়। নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুদের মামলাগুলো আমরা তদন্ত করি স্পেশাল কেয়ার নিয়ে। অনেক সময় পুলিশের কাছে এ তথ্য পৌঁছাতে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। আমাদের কিছু স্কুল প্রোগ্রাম আছে। আমরা ব্লগে যেতে চাচ্ছি। যৌন নির্যাতন, শিশু নির্যাতন থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায়, সে ধরনের কিছু মেসেজ আমরা ব্লগে দিয়ে দেব। যেখান থেকে যে কেউ চাইলে লাইভ ভিউ নিতে পারবেন। স্কুলের শিশুদের অনেকেই ইন্টারনেটে, বিশেষ করে ফেসবুক ও জুমে যুক্ত থাকে। এটা খুবই প্রশংসনীয় যে এখন আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে, ভালো স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ—এ ধরনের বিষয়গুলো চলে এসেছে। সেফটি মেজার্সগুলো শিশুদের
আগেই শিখিয়ে দেওয়া দরকার, যেন তারা নির্যাতনের শিকার না হয়। আমরা প্রো–অ্যাকটিভ আটিচিউটে বিশ্বাসী।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বলতে হয়, অনেক সময় মা-বাবাই বিয়ে দিয়ে দেন। আমি নরসিংদীর এসপি থাকাকালে দেখেছি, সেখানে মা নিজেই তাঁর মেয়ের বয়সটা বাড়িয়ে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়েছেন। অনেক মা–বাবা নিরাপত্তার অভাববোধ করেন, মনে করেন কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটা সেফ। আমরা বিভিন্ন জায়গায়ই প্রচার করি যে এটা আসলে সেফ না। আপনি মেয়েকে যদি আত্মনির্ভরশীল করে না দেন, তাহলে কিন্তু তাকে আপনি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। আমাদের দেশে এটা একটা ট্যাবু হয়ে গেছে যে স্কুল শেষ করার আগেই তাকে বিয়ে দিতে হবে, নইলে পাত্র পাওয়া যাবে না। এটা আমার নিজের জীবনেও ফেস করেছি। আমাকেও শুনতে হয়েছে যে এত পড়াশোনা করে কী হবে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন আরেকটু কঠোর হওয়া প্রয়োজন। শাস্তিও খুব দ্রুত করা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ৯৯৯ নম্বরে কল দেওয়ার মেসেজটা আরও বেশি করে জানানো প্রয়োজন। স্কুলের মেয়েদের, বিশেষ করে সপ্তম শ্রেণি থেকেই। তাদের বলা দরকার, যদি তোমার বাড়ির আশপাশে কারও বাল্যবিবাহ হয়, আমাদের জানাও। ৯৯৯ নম্বরে এ বিষয়টি যত বেশি জানানো যাবে বাল্যবিবাহ তত বেশি প্রতিরোধ করা যাবে।

নবনীতা চৌধুরী: আসিফ সালেহ, ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালিত গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে মেয়েশিশুদের ৬৮ শতাংশ এখন ঘরে বসে আছে। সংসদ টেলিভিশনসহ বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠদানের ব্যবস্থার সুবিধা ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী নিতে পারছে না। এর মধ্যেও গ্রামের শিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিক্ষার্থী, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও এথনিক মাইনরিটি অন্তর্ভুক্ত শিশুর সংখ্যা বেশি। মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে, পুরুষের তুলনায় নারীর ইন্টারনেট ব্যবহার প্রায় ৫২ শতাংশ কম। তাহলে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েও তো মেয়েশিশুর কাছে পৌঁছানো অনেক কঠিন।

আসিফ সালেহ

আসিফ সালেহ: আসলে সংকটটা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। শুধু এটা শিক্ষাসংকট হিসেবে দেখলে হবে না, এটা একটা সামাজিক সংকট। যেকোনো সংকটে প্রান্তিক জনগণ আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে। আমরা যদি মেয়েদের এবং আদিবাসী ও দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষদের কথা বলি, তাদের কথা কিন্তু আমরা কেউ শুনতে পাচ্ছি না। সব প্রেক্ষাপট বিচার করে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। স্কুল খোলা হবে নাকি হবে না, এটা খুব দুরূহ সিদ্ধান্ত। আমাদেরকে সামগ্রিকভাবে ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখতে হবে যে আমাদের দূরবর্তী শিক্ষণ, টিভির মাধ্যমে শিক্ষণ, সেগুলো আসলে সবই খুব টেম্পোরারি। এখন যেহেতু ছয়–সাত মাস হয়ে গেছে, এখন এটার কার্যকারিতা ক্রমান্বয়ে কমছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তানের একটি ঘটনা যদি দেখি, পাকিস্তানে ভূমিকম্পের সময়, ওই এলাকার একটা অঞ্চলে স্কুল বন্ধ ছিল পাঁচ মাস। স্কুল খোলার পরে দেখা গেছে ১৪ মাসের লার্নিং লস হয়েছে। তারা নতুন জিনিস শিখছে না শুধু তাই নয়, যা শিখেছিল তাও ভুলে গেছে।

আমরা আশাবাদী, আগামী দিনগুলোতে ভ্যাকসিন আসবে এবং সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতেও বছর দুয়েক লাগবে। আমরা তো তত দিন স্কুল বন্ধ রাখতে পারব না।

আমাদের বহু বছরের পুরুষতান্ত্রিকতার যে ধারণা, সেখান থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। এই যে মেয়েদের স্কুলে আনার ব্যাপারটা, এটা কিন্তু বহু বছরের একটা সমন্বিত চেষ্টার ফল। এখানে সরকার ও এনজিওরা সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। বাসায় বাসায় গিয়ে মানুষকে, মা–বাবাকে বুঝিয়ে বিহেভিয়ার চেঞ্জ করতে হয়েছে। বোঝানো হয়েছে, মেয়েদের বোঝা হিসেবে না দেখে সম্পদ হিসেবে দেখেন এবং তাদের পেছনে ব্যয় করেন। এখন যেহেতু একটা অর্থনৈতিক সংকটও এসেছে। আমরা দেখছি, স্কুল বন্ধ থাকায় এখন অনেক অভিভাবক মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। সে জন্য আমাদের স্কুল খোলার ব্যাপারে এখনই পর্যায়ক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

নবনীতা চৌধুরী: রাশেদা কে চৌধূরী, কিন্তু শুধু শিক্ষার্থীরাই তো হারিয়ে যাচ্ছে না; করোনাকালে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি যে ভাড়া দিতে না পেরে সারাদেশে অনেক স্কুলভবন ছেড়ে দিতে হয়েছে। শিক্ষকেরা ভিন্ন পেশায় গিয়ে টিকে থাকছেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে প্রায় ২০ হাজার বেসরকারি স্কুলে। সারা দেশে ৪০ হাজারের মতো বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন আছে। বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা সাড়ে সাত হাজারের বেশি। তার মানে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার একটা অংশও তো এবার হারিয়ে যেতে পারে। আর এরও একটা বড় ধাক্কা লাগবে মেয়েশিশুদের বেলাতেই।

রাশেদা কে চৌধূরী

রাশেদা কে চৌধূরী: শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। হাজারো বেসরকারি উদ্যোক্তা, যাঁরা সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা কিন্তু অধিকাংশই নিবন্ধিত নন। কিন্ডারগার্টেন হোক, মাদ্রাসা হোক আর স্কুলই হোক তাদের একটা রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থাকতে হবে। আমরা জানি, অনেক শিক্ষক বিপদে আছেন। আমাদের জানামতে, সরকার নন-এমপিও শিক্ষকদের জন্য ব্যবস্থা করেছে। এমনকি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে তারা আশপাশের প্রাইমারি স্কুলে ঢুকতে পারবে। কিন্তু সেটা তো একটা অ্যাডহক ব্যবস্থা। শিক্ষকদের জন্য কিছু করতে হলে আমাদের একটা আইনি কাঠামো লাগবে। বেসরকারি ব্যবস্থা বেসরকারিভাবে পরিচালিত হবে। কিন্তু একটি কাঠামোর ভেতর আনলে তাদের জন্য কাজ করা নীতিনির্ধারকদের জন্য বেশি সহজতর হবে।

আমাদের শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে হবে। ছেলে-মেয়ে সবাইকে। মেয়েরা যেহেতু বেশি করে ঝরে যায়, সে জন্য মেয়েদের স্কুলে ফেরাতে বিশেষ নজর দিতে হবে। স্কুল খোলার প্রস্তুতির জন্য স্যানিটেশন থেকে শুরু করে সবকিছুই তো মেয়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সেকেন্ডারি পর্যায়ে। কিসের ভিত্তিতে আমরা স্কুল খুলব, তার তথ্য–উপাত্ত তো থাকতে হবে। এখানে আমাদের ইমোশনাল হয়ে লাভ নেই। শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানোর সময় অভিভাবকদের কাছে সঠিক বার্তা দিতে হবে। করোনার শুরুতে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, বলা হয়েছিল, ‘সবাই বেড়াতে যাবে না, বাসায় থাকবে।’ কিন্তু আমরা দেখলাম সবাই সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন খুলবে, সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই বার্তাটা ঠিকভাবে দিতে হবে। এখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো বিশেষ কাজ করতে পারে।

সব খাতে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও যেন প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, বৃত্তির পরিধি-পরিসর বাড়ানো, স্কুলে শিশুদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এই সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে।

নবনীতা চৌধুরী: মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, কেউ কেউ এই প্রশ্নটা করছেন যে অনেক দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগেই খুলেছে। স্কুল খোলার প্রক্রিয়াটা এখন শুরু করা দরকার কি না?

দীপু মনি: এই যে বৈশ্বিক সংকট, এই সংকটের সময় প্রথমে নিশ্চয়ই সবার আগে আসবে জীবন। আমাদের দেশে জীবিকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। সরকার সেটি দেখেছে। যে কারণে জীবিকা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা শিক্ষার কথাও ভেবেছি। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবতাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। যেসব দেশের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে, সেসব দেশে একটি শ্রেণিকক্ষে কতজন শিক্ষার্থী বসে, আর আমাদের এখানে একটা শ্রেণিকক্ষে কতজন? পরিবার ও সমাজের মধ্যে সচেতনতা কোন পর্যায়ের? এ সবকিছুই কিন্তু আমাদের ভেবে দেখতে হবে। অন্য দেশ করছে বলেই আমরা ঢালাওভাবে তা করতে পারি না। অনেক দেশে স্কুল খুলে দেওয়া হয়েছিল, আবারও বন্ধ করা হয়েছে। আমরা কোনোভাবেই শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, জীবনের ঝুঁকি নিতে পারি না।

আমরা নানানভাবে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি। শুধু টেলিভিশন নয়, অনলাইন, মোবাইল ফোন, রেডিও—সব মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রমকে যত দূর সম্ভব পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছি। আমরা ১০০ ভাগ পারছি না, হয়তোবা ৯০ ভাগের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছি। সেখানেও ঘাটতি থাকতে পারে। শুরুতে আমরা টেলিভিশনে যে ক্লাস করাচ্ছিলাম, তার মান কীভাবে উন্নত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে করতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই সংকটকালে যাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না, আমরা তাদের কথাও ভাবছি। শিক্ষকেরা প্রয়োজন হলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা গ্রুপ করে কীভাবে তাদের শেখাতে পারেন, সে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। শুধু তো সরকার নয়, বেসরকারি পর্যায়ে নানা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কাজ করছে।

নবনীতা চৌধুরী: সাদেকা হালিম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে, আসলে সামাজিক বিপর্যয়ের একটা বড় দিক এখনো দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করেন কি না। কত মেয়ের বাল্যবিবাহ হলো, কত মেয়ে এই অর্থাভাবের সময় পুষ্টিহীনতার মধ্যে মা হতে বাধ্য হবে, কত মেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে আসলে ভবিষ্যতের সুযোগ হারাবে সেটা আসলে বুঝে উঠতে আরও সময় লাগবে কী? সামাজিক উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলো দিক তো আসলে এবার কন্যাশিশুদের আমরা করোনার ধকল সামলে উঠতে কতটা সহায়তা দিতে পারছি তার ওপর নির্ভর করছে বোধ হয়।

সাদেকা হালিম

সাদেকা হালিম: বাংলাদেশে যে সূচকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে, সেটা হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন। কোভিড-১৯–এর যে প্রভাবগুলো দেখতে পাচ্ছি, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় একটা জায়গা হচ্ছে জীবিকার সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা খুবই সম্পৃক্ত। আমরা শিক্ষা বিষয়টির আলাদা করে সমাধান দেখতে পারি না। সবটা সার্বিকভাবে দেখার প্রয়োজন।

পরিসংখ্যান বলছে যে প্রায় ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। এদের মধ্যে কিন্তু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীর পরিবারের উপস্থিতি আছে। সেখানে এসএসসি এবং এইচএসসি মিলে প্রায় ৭২ শতাংশ পরিবার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন ৪০ শতাংশের ওপরে মেয়েশিক্ষার্থী আসছে। এ পরিবর্তনের একটা বড় কারণ হচ্ছে বর্তমান সরকারের শিক্ষাবান্ধব কার্যক্রম। তারা উপবৃত্তি, উৎসাহ ও মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে কিছু মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। আমরা জেনেছি যে এইচএসসিতে প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। আমি ঠিক জানি না যে এর মধ্যে কী পরিমাণ মেয়েশিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারেনি। সেটা আমাদের জানা প্রয়োজন। আর একটা বড় জায়গা হচ্ছে অভিভাবকেরা নারীশিক্ষায় বিনিয়োগ করবেন কি না? তাঁরা এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক ভঙ্গুর অবস্থায় আছেন। অনেকের উৎকণ্ঠা যে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। এটা তো অবশ্যই একটা বড় ভাবনার বিষয়। এই সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ের সবাইকে কাজ করতে হবে। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে ডিভাইসের জটিলতা, ইন্টারনেট অভিগম্যতা—এসব নিয়েও ভাবা জরুরি।

নবনীতা চৌধুরী: তাহেরা জাবীন, বাংলাদেশের মেয়েশিশুদের স্কুলে আনার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় যে অর্জন, করোনাকালে তা থেকে বাংলাদেশে যেন পিছিয়ে না পড়ে, সে ক্ষেত্রে আপনাদের ভাবনাটা কী?

তাহেরা জাবীন

তাহেরা জাবীন: মহামারির কারণে পরিবারের আয় কমেছে। মেয়েশিশুরা ঝরে পড়ছে। যার কারণে বাল্যবিবাহ বাড়ছে। মেয়েশিশুদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু নারীশিক্ষার কথা চিন্তা করলেই হবে না, একই সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের দিকেও নজর দিতে হবে। গত দশক ধরে আমরা নারীশিক্ষা ও লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে অনেক জোর দিয়ে আসছি।

ইতিমধ্যে ১০০টির বেশি দেশে স্কুল খুলে গেছে। বিভিন্ন দেশে সরকার যখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কুল খুলছে, তখন মূল ফোকাস হলো নিরাপদে স্কুল খোলা। সরকার থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে হয়তো একটা বড় নির্দেশিকা দেওয়া হবে। সেটার মূল্যায়ন জরুরি। ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে ওই এলাকার মহামারির চিত্রটা কী? এলাকার চিত্রটা স্কুলপর্যায়ে নির্দেশ করতে হলে আমাদের কী ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে, তার পরিকল্পনা করতে হবে। সেখানে পরিবারের অন্তর্ভুক্তি খুবই জরুরি। পরিবারকে বাদ দিয়ে যদি স্কুল পুনরায় খোলার কথা চিন্তা করি, তাহলে কতটুকু অর্জন করতে পারব, আমি নিশ্চিত নই। আমাদের যেকোন দুর্যোগে রেজিলিয়েন্ট এডুকেশনের কথা ভাবতে হবে। সেটা শুধু স্কুল খুলে দেওয়ার নিরাপদ পরিবেশের জন্য নয়। ভবিষ্যতে আমাদের আরও সংকট আসতে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতিও আমাদের থাকা দরকার।

নবনীতা চৌধুরী: সাইমন বাকলে, আমরা কি এই সংকটকালে মেয়েদের কথা ঠিকভাবে শুনছি? আমরা এটাই–বা কীভাবে নিশ্চিত করব যে ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে না, বরং তারা সমতার দিকেই এগিয়ে যাবে?

সায়মন বাকলে

সাইমন বাকলে: আমরা তখনই শিশুদের কথা শুনতে পারব, যখন আমরা তাদের কথা বলার সুযোগ দেব। শিশুদের কথা বলার জায়গা সাধারণত তাদের পরিবার, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং কখনো কখনো খেলাধুলার মতো সামাজিক জমায়েত। কিন্তু এখন স্কুল বন্ধ, তারা বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না। কন্যাশিশুদের কথা বলার সুযোগ আরো কমে এসেছে।

আমি মনে করি, কন্যাশিশুরা যেন তাদের নিজেদের কথাগুলো বলতে পারে, সে জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে উৎসাহিত করা। এর একটি উপায় হতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে এখানে শিশুদের নিপীড়নের শিকার হওয়া, তথ্য চুরিসহ নানা ধরনের ঝুঁকিও রয়েছে। এ জন্য শিশুদের নিরাপদভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে।

শিক্ষাই সম্ভবত শিশুদের এবং বিশেষত কন্যাশিশুদের দারিদ্র্য থেকে বের করে নিয়ে আসার সবচেয়ে ভালো উপায়। স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্ত রেখে শিশুদের স্কুলে ফেরানো দরকার। আর শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক ও মা–বাবার প্রচেষ্টা দরকার। মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন আরও পিছিয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুঃখজনকভাবে, এমনটি হলে বাল্যবিবাহসহ এমন অন্যান্য ঘটনা বেড়ে যাবে, এসব কারণে কন্যাশিশুদের স্বাস্থ্য ও জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

নবনীতা চৌধুরী: আসিফ সালেহ, সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন দেখেন কি না? মেয়ে শিশুদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা ঠেকাতে এখনই কি উদ্যোগ নেওয়া দরকার?

আসিফ সালেহ

আসিফ সালেহ: আমার মনে হয়, এখন থেকে ঠিকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা উচিত। এখানে মানুষকে বোঝানোর ব্যাপার আছে। তারপর স্কুল খোলার আগে প্রস্তুতির ব্যাপার আছে। সেই জায়গাগুলোতে প্রচার ও জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এসব জায়গায় এনজিও খুব ভালো কাজ করতে পারে। হুট করে কিন্তু খুলে দেওয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে দেখে বুঝে খুলতে হবে। আমরা চাই শিক্ষা খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেই জায়গাতে এনজিওগুলো একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

নবনীতা চৌধুরী: মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আপনি আলোচনা শেষ করবেন। বাল্যবিবাহের সংখ্যা বৃদ্ধির খবর, অর্থনৈতিক সংকট, নিরাপত্তার অভাব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া—অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের কথা আলোচিত হলো। সব বাধা পেরিয়ে স্কুল খুললে, আমরা মেয়েদের ফিরিয়ে আনতে পারব কি?

দীপু মনি: সমস্যা, সংকট আসবে। সংকট থেকে উত্তরণের পথও আমাদের বের করতে হবে। এ জন্য সর্বোত্তম কী করতে পারি, সেটার ওপরে অনেক বেশি জোর দিতে চাই। আমরা বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে আছি। এটি তো আমাদের মানতে হবে। তাতে আমরা কী করে খাপ খাওয়াব, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

আমাদের পাঠ্যক্রমও বদলাচ্ছি। নারী অধিকারের বিষয়গুলো, প্রজনন ও নারী স্বাস্থ্যের বিষয় এবং নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়গুলো কারিকুলামে এখন এসেছে। একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী ক্লাসে নিতে তার যে দক্ষতা প্রয়োজন, যে জ্ঞান থাকলে পরবর্তী ক্লাসে সে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক বেশি পরীক্ষানির্ভর ও সনদসর্বস্ব একটা শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমরা সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। মূল্যায়ন হবে। সে মূল্যায়ন পদ্ধতি এমন হবে যে পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য শুধু পড়ছি, এটি যেন না হয়। জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা অর্জন, সঠিক মানসিক গঠন—এগুলো যেন আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়। পরীক্ষাভীতি যেন আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে না থাকে। তারা যেন আনন্দ নিয়ে পড়াশোনা করে। শুধু কোভিডের সময়ের জন্য নয়, সব সময়ই আমরা তা করতে চাই।

আজকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে রেখে তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও যুগোপযোগী করার সেই সুযোগ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রাখতে হবে। আপনারা জেনে খুশি হবেন যে আমরা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটি কারিগরি শিক্ষা কারিকুলাম রোল আউট করতে যাচ্ছি। নবম-দশম শ্রেণিরটাও অচিরেই হবে।

আমাদের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ নির্মিত হচ্ছে। এগুলোয় মেয়েরা তো পড়তে পারবেই। এ ছাড়া প্রতিটি বিভাগে শুধু মেয়েদের জন্য পলিটেকনিক স্থাপিত হচ্ছে। আমরা কারিগরি শিক্ষাকে একেবারে সব জায়গায় বিস্তৃত করতে চাইছি।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কতগুলো কথা হয়েছে। আমাদের এখন ইউনিয়ন পরিষদগুলো ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। আমার নির্বাচনী এলাকায় তো এক মাসের মধ্যে পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে যাবে। তখন সেখান থেকে কেউই জন্মসনদ ভিন্ন করে নিয়ে বাল্যবিবাহ দেবে, সেই সম্ভাবনা কমে যাবে। এ প্রচারণায় ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, পরিবার—সবার ভূমিকা আছে।

কন্যাশিশু নিয়ে শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে না, আরও অনেকগুলো মন্ত্রণালয় করে। এগুলো আমরা সমন্বিতভাবে যেন করতে পারি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়, ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সবার কাজকে সমন্বিত করে আমরা যেন কন্যাশিশুদের এমন একটা প্যাকেজের মধ্যে নিয়ে যেতে পারি, যেন তারা সব ধরনের বিকাশের সুযোগ পায়। সেই পাওয়াটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা যেন পায়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

একজন কন্যাশিশুর জন্য তার পরিবারের ভেতরের জায়গাটুকু, সামাজিক পরিসরের জায়গাটুকু, বিদ্যালয়—এই তিন জায়গায় তার শারীরিক, মানসিক, আর্থিক বিকাশের জন্য, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য, তার বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করার জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আমাদের ছেলেমেয়েরা খেলতে খেলতে শিখবে। আনন্দের মধ্য দিয়ে শিখবে। মানুষ হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার মানুষ হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়বে। এই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।

নবনীতা চৌধুরী: শিক্ষা ও অন্য সবকিছুর সমান সুযোগ সৃষ্টি করলেই সমতার বাংলাদেশ, সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা যাবে। মাননীয় মন্ত্রী, আপনার কথা দিয়েই শেষ করি যে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কাজে আমরা যেন কন্যাশিশুর কথা মাথায় রেখে, নারীর কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করি এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারি। সেই আশাবাদ ও প্রত্যাশা রেখে শেষ করি আজকের আলোচনা। সবাইকে কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • স্কুল খোলা না থাকায় যেসব সমস্যা বাড়ছে; সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সবাই মিলে সেসব সমাধানে কাজ জোরদার করতে হবে।

  • মেয়েশিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে কারিগরি শিক্ষার দিকে যেতে হবে।

  • বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ৯৯৯ নম্বরে কল দেওয়ার বার্তাটি আরও বেশি করে জানানো প্রয়োজন।

  • স্কুল খোলার প্রস্তুতির জন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থা মেয়েদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • স্কুলে শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার, বৃত্তির পরিধি বাড়ানো দরকার।

  • মেয়েদের স্কুলে ফেরানোর বার্তা প্রচারে এবং স্কুল খোলার প্রস্তুতি নিতে বেসরকারি সংস্থাগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।

  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও যেন শিশুদের জন্য নিরাপদ হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

  • চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সামনে রেখে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও যুগোপযোগী করতে হবে।

  • বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, পরিবার—সবার ভূমিকা রাখতে হবে।