যুবাদের স্বাস্থ্যসেবায় নজর জরুরি

বৈঠকের আয়োজক ইউবিআর বাংলাদেশ অ্যালায়েন্স ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাস।

দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীই বয়সে কিশোর-কিশোরী। এই অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তাদের স্বাস্থ্যসেবায় আরও নজর দেওয়া দরকার। এই কিশোর-কিশোরী ও যুবাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে, তারা যে সময়ে সেবা চায়, সে সময়েই সেবা পৌঁছে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ ও অংশীজনদের সমন্বয় প্রয়োজন।

‘যুববান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে নীতিনির্ধারকসহ আলোচকেরা এসব কথা বলেন। যৌথভাবে এই বৈঠক আয়োজন করে ইউনাইট ফর বডি রাইটস (ইউবিআর) বাংলাদেশ অ্যালায়েন্স ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাস।

বৈঠকে সম্মানিত অতিথি ছিলেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু। তিনি বলেন, সারা দেশে বর্তমানে ৯০৩টি কৈশোরবান্ধব কেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্র থেকে তরুণদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। পুরো দেশে এমন কেন্দ্রের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের জন্য সেবা কার্যক্রম চালাতে সরকারের পরিকল্পনা আছে। কিন্তু উদ্যোগের পাশাপাশি সচেতনতাও জরুরি।

সাহান আরা বানু জানান, তরুণদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা–সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে এবং করোনাকালে এই সেবা পৌঁছে দিতে ১৬৭৬৭ কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতি উপজেলায় দুটি কেন্দ্র স্থাপন করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। শিল্প এলাকায় তরুণ-তরুণীদের জন্য স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএন-সিএএইচ লাইন ডিরেক্টর মো. শামসুল হক বলেন, কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলছে। তরুণ-তরুণীদের এই সেবা নিশ্চিতে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিশোরীদের জন্য ১৫০টি বিদ্যালয়ের দেড় হাজারের বেশি ফার্স্ট এইড বক্স দেওয়া হয়েছে। কিশোর-কিশোরীদের জন্য এসব উদ্যোগ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা আছে। সামনের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যুববান্ধব কর্মসূচিতে আরও জোর দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) নির্বাহী পরিচালক ও ইউবিআর অ্যালায়েন্সের সভাপতি নূর মোহাম্মদ বলেন, ২০১০ সাল থেকে ইউবিআর অ্যালায়েন্স কিশোর-কিশোরী ও যুবাদের স্বাস্থ্যসেবা, যুববান্ধব কেন্দ্র তৈরি এবং স্থানীয় তরুণদের সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কাজ করছে। এগুলো বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবে কাজ করছে। ১২টি উপজেলায় ইউবিআর অ্যালায়েন্সের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে যুব ও তরুণ-তরুণীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগের সমন্বয় দরকার। ইউবিআর অ্যালায়েন্সভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে আরএইচ-স্টেপ, পিএসটিসি, ডিএসকে, বাপসা, বিএনপিএস এবং এফপিএবি।

স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যুবাদের অভিগম্যতা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দেন নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার বিভাগের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার মাশফিকা জামান সাতিয়ার। তিনি বলেন, যুববান্ধব কেন্দ্রগুলোয় এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে সেখানে যুবারা আসতে কোনো সংকোচ বোধ না করে। যুবারা প্রজননস্বাস্থ্যসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা ও এ–সংক্রান্ত তথ্য সহজেই যেন পায়, তা সবার আগে নিশ্চিত করা জরুরি। শারীরিক স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি কিশোর-কিশোরী ও যুবদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যাতে ভালো থাকে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এমসিআরএএইচ) ও পরিচালক (মা ও শিশুস্বাস্থ্য) মোহাম্মদ শরিফ বলেন, ১০ বছর থেকে ২৫ বছর হচ্ছে যুববান্ধব সময়। মানুষের জীবনে ভালো বা খারাপ যেকোনো কিছু এ সময়ে আসতে পারে। এ সময়ে তরুণদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। তিনি বলেন, তরুণদের স্বাস্থ্যশিক্ষাটা আরও যুববান্ধব করতে হবে। এর জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ একসঙ্গে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে, অঙ্গীকারের সঙ্গে কাজ করলে যুববান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশে যুবাদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে নানা কুসংস্কার ও বাধা আছে উল্লেখ করে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) মাতৃ ও কৈশোর স্বাস্থ্যসেবার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বলেন, অনেক যুবাই তার চাহিদা বোঝে না, সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। স্বাস্থ্যসেবার প্রসঙ্গ যখন ওঠে তখন সেখানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কথাও বলতে হবে। তরুণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আন্তমন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমগুলোর মধ্যে সমন্বয় দরকার।

ইউবিআর-২–এর এইচআইএ প্রজেক্টের প্রকল্প ব্যবস্থাপক তৌফিক-উল করিম চৌধুরী বলেন, ইউবিআরের একটি প্রকল্পের আওতায় ১২টি উপজেলায় যুববান্ধব সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী এসব কেন্দ্র থেকে তরুণ-তরুণীরা প্রজনন, যৌনস্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্যের নানা সেবা পেয়েছে। তবে সারা দেশের জন্য এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, চেষ্টামাত্র। যুবদের জন্য এই সেবাকেন্দ্র যাতে চলমান থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, এতে যুবারা নিজেদের সুশিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।

ইউবিআর বাপসার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক জোবায়ের মিয়া বলেন, ইউবিআরের যুববান্ধব সেবাকেন্দ্রের প্রকল্পের মাধ্যমে যুবাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া তরুণদের মধ্যে একটা আন্দোলনের মতো ছিল। প্রকল্প শেষ হয়ে গেছে। তবে এই যুবাদের সেবাকেন্দ্রগুলো সরকারের যুব কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে।

বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শিক্ষায় ও সামাজিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে দেশের জন্য কাজে লাগানো যাবে। এটা দেশের জন্য একটি বিরাট ব্যাপার হবে। সমাজের জন্য যুবসমাজ যেন গর্ব হয়, সেটিই দেখতে হবে।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী