শিশু অভিবাসন: বিশ্ব ও বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ প্রথম আলো ও ইউনিসেফের আয়োজনে ‘শিশু অভিবাসন: বিশ্ব ও বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করা হয়। গোলটেবিল বৈঠকের নির্বাচিত অংশ এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

শেখ রফিকুল ইসলাম: অতিরিক্ত সচিব ও মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর

আবুল হোসেন: প্রকল্প পরিচালক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম ও পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম

ন্যাটালি ম্যাককাউলি: শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

হারুনো নাকাশিবা: প্রোটেকশন অফিসার, ইউএনএইচসিআর

তাসনিম সিদ্দিকী: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট, রামরু

ইশরাত শামীম: প্রেসিডেন্ট, সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ

এ কে এম মাসুদ আলী: নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন বাংলাদেশ

ওয়াহিদা বানু: নির্বাহী পরিচালক, অপরাজেয় বাংলাদেশ

মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম: কান্ট্রি ডিরেক্টর, জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার বাংলাদেশ

আসমা খাতুন: জাতীয় প্রোগ্রাম অফিসার, মাইগ্র্যান্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স ইউনিট, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আজকের আলোচনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের সময় শিশুদের জীবন অনেক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে শিশুদের অভিবাসন তেমন একটা হয় না। তবে দেশের মধ্যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় অভিবাসন হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে আজকের আলোচনা। আলোচনা থেকে সুপারিশ ও পরামর্শ আসবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে বলে আশা করি।

ন্যাটালি ম্যাককাউলি

ন্যাটালি ম্যাককাউলি

শিশু অভিবাসনের বিভিন্ন দিক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কঠিন চ্যালেঞ্জ আছে। শিশু অভিবাসন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যেন বহুমুখী কৌশল প্রণয়ন করতে পারে, সে লক্ষ্যে আইন ও নীতিমালা সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে আলোচনা করা প্রয়োজন। সমাজসেবাকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং বহুমুখী নীতিকৌশল প্রণয়নে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া উচিত।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের তথ্য অনুসারে যাদের বয়স ১৯ বছর অথবা তার নিচে, তাদের মধ্যে নিজের জন্মভূমিতে বাস না করে অন্য দেশে বাস করে, ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার। ২০১৭ সালে বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ।

২০১৭ সালে যত মানুষ অভিবাসী হয়েছে, তাদের প্রায় ১৪ শতাংশের বয়স ১৯ বছর অথবা তার নিচে। বিভিন্ন ধরনের বৈশ্বিক দুর্যোগ যেমন সংঘর্ষ, অর্থনৈতিক মন্দা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে।

ভূমধ্যসাগর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের শিশু-কিশোরদের অভিবাসন হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইরিত্রিয়া, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া, মিসর, গিনি, আইভরি কোস্ট, সোমালিয়া, মালি, সেনেগাল, ঘানা, সুদান, ইথিওপিয়া, ক্যামেরুন, ইরাক, সিরিয়ান আরব রিপাবলিক, আলজেরিয়া, মরক্কো, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্ত অতিক্রম করে যে অভিবাসন হয়, সাক্ষ্যপ্রমাণসহ তার কোনো গবেষণা তথ্য নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে তিন ধরনের শিশু অভিবাসন হয়ে থাকে। শিশু অভিবাসনের প্রথম ক্ষেত্রে হলো, বিভিন্ন মেট্রোপলিটন শহরে অভ্যন্তরীণ শিশু অভিবাসন। এরা দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। সরকারের আইন ও নীতিকৌশলের সঙ্গে এসব শিশুকে যুক্ত করার জন্য এ ক্ষেত্রে প্রায় কোনো তদারকি নেই।

শিশু অভিবাসনের দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে অভিবাসন। ইমিগ্রেশন ছাড়া বিভিন্নভাবে অপ্রচলিত পথে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শিশুরা প্রায় নিয়মিত যাওয়া-আসা করে। পাচারকারীরা অনেক ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও পাচার করে। যেসব শিশু সীমান্ত অতিক্রম করে, তাদের বয়স ১৪ অথবা তার বেশি। ৭ থেকে ৮ বছরের শিশু যারা ভারতের বিভিন্ন পবিত্র স্থানে ভিক্ষা করে, তারাও পাচার হয়। অনেক মেয়ে ভুয়া বিয়ে ও ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে। অবশেষে তাদের শেষ ঠিকানা হয় ভারতের যৌনপল্লিতে।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আসে। এদের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু। একটি দালাল
চক্রের মাধ্যমে কখনো কখনো রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের কিছু মানুষ প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যায়। পরে দালালেরা এদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে, ভীষণ মারধর ও আঘাত করে, খেতে না দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করে। এই বিপজ্জনক অভিবাসন থেকে রক্ষার জন্য কমিউনিটিতে সরকার ও নাগরিক সমাজের দিক থেকে তেমন কোনো কর্মসূচি বা উদ্যোগ নেই।

সময়োপযোগী উন্নয়ন দক্ষতার অভাবে শিশু–কিশোরেরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে অপ্রচলিত খাতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে বহুমুখী নীতিকৌশল প্রণয়ন প্রয়োজন। জাতিসংঘ ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় ইউনিসেফ সরকারকে নীতিকৌশল প্রণয়ন ও তথ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সহযোগিতা করতে আগ্রহী।

আলোচকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে শিশু অভিবাসন রোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য।

ইশরাত শামীম

ইশরাত শামীম

আমরা চিলড্রেন অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ থেকে অনেক দিন ধরে পাচার হওয়া শিশুদের নিয়ে গবেষণা করছি। এরা কেউ চাকরির প্রলোভন, নিজের ইচ্ছায় এবং অনেকে পাচারকারী ও মধ্যস্বত্বভোগী দ্বারা পাচার হচ্ছে কিংবা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এসব শিশুকে জোর করে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের অনেককে পতিতালয়ে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকেরা অর্থের জন্য অনেক সময় তাঁদের সন্তানদের অভিবাসন করেন।

আবার কাজের জন্য শিশুরা শহরে আসছে। সমাজসেবা বিভাগ থেকে এসব বিষয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পুলিশের দিক থেকেও শিশুবান্ধব সেবা দিতে হবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। আরও বেশি শিশু ও নারীবান্ধব সেবা দিতে সীমান্ত পুলিশ ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তাঁরা যেন জানতে পারেন, কোন শিশু একা যাচ্ছে, কোন শিশু অভিভাবকের সঙ্গে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া অভিভাবক থাকে। এসব বিষয়ে তাঁদের পর্যাপ্ত ধারণা থাকতে হবে। তাঁদের যদি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থাকে, তাহলে তাঁরা এ ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবেন।

এ বিষয়ে নাগরিক সমাজের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার ও নারী ওয়ার্ড মেম্বারদের বেশি সক্রিয় হওয়া দরকার। অনেক সময় নারীরা শিশু পাচার করে। তাদের কম সন্দেহ করা হয়।

কোনো শিশুকে উদ্ধার করা হলে তাকে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোসহ আনুষঙ্গিক সেবার ব্যবস্থা করতে হবে।

তাসনিম সিদ্দিকী

তাসনিম সিদ্দিকী

বাংলাদেশে আমরা তিন ধরনের শিশু অভিবাসন লক্ষ করে থাকি। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা শিশু, পাচারের শিকার শিশু ও কর্মে নিযুক্ত শিশু অভিবাসী। আমার আলোচনায় আমি তৃতীয় ধরনের শিশু অভিবাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব।

কর্মের উদ্দেশ্যে শিশু অভিবাসন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই ঘটছে। এটি দুই উপায়ে ঘটছে—পরিবারের অন্য সদস্যের সঙ্গে অভিবাসন অথবা শিশুর এককভাবে স্বাধীন অভিবাসন। অনেক বাবা–মা তাদের সন্তানকে কাজের জন্য শহরে পাঠান। মেয়েশিশুরা মূলত পরিবারের ভেতরে গৃহকর্মী হিসেবেই নিযুক্ত হয়।

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও অনেক শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় শহর বিশেষ করে
ঢাকায় চলে আসে। এরা বিভিন্ন রকমের অনানুষ্ঠানিক খাত, যেমন পরিবহন, গাড়ির গ্যারেজ ও দোকানে কাজ করে থাকে। অনেকেই আবার পথশিশু হিসেবে ফুল বিক্রি বা গাড়ি পরিষ্কারের মতো কাজে নিয়োজিত থাকে। সব ধরনের কর্মক্ষেত্রেই রয়েছে কোনো না কোনো শোষণ ও নিরাপত্তাহীনতা।

বাংলাদেশে কাজে নিয়োজিত শিশুর ওপর খুব বেশি গবেষণা নেই। সুমাইয়া খায়ের ২০০৮ সালে এবং আমি ও জালালউদ্দিন সিকদার শিশু গৃহকর্মীদের ওপর একটি গবেষণা করি, যা পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে রামরু প্রকাশ করে। আফ্রিকায় শিশু অভিবাসনের ওপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে। সেখানে শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করে, তার শিক্ষার অধিকার সমুন্নত রেখে শিশুদের অভিবাসনে অংশগ্রহণকে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসৃষ্টির দক্ষতা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে দেখা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমনটি ঠিক বলা যায় না। এখানে রাষ্ট্রের তেমন কোনো নীতিমালা না থাকায় শিশুদের বিকাশের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়।

কাজের জন্য শিশুর অভিবাসন কমাতে হলে নিজ এলাকায় কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার পাশাপাশি তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। দুর্যোগ ও জলবায়ুসৃষ্ট অভিবাসন কমানো এবং দুর্যোগের পরে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের জন্য সরকার কৌশলপত্র তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে শিশু বাস্তুচ্যুতির বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শহরে আসা পরিবারগুলোতে মা–বাবা দুজনেই কাজে থাকে। তাদের সন্তানের জন্য শিশুযত্নকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থাও শিশুকে কর্মে ঢুকে পড়া থেকে বিরত করবে। সামাজিক সচেতনতাও এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।

এ কে এম মাসুদ আলী

এ কে এম মাসুদ আলী

অভিবাসনের সঙ্গে অর্থনীতির একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। জাতীয় পর্যায়ে যে সংস্কৃতিতে শিশুরা বেড়ে উঠছে, এর ওপর নির্ভর করে তার নিরাপত্তা ও চলাচল। অর্থনীতির চাকার সঙ্গে শিশুরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে, সেটা অভিবাসনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী স্বল্প মজুরির শ্রমের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শিল্পের যে চাকা, তা যেন শিশুর শ্রম ছাড়া ঘুরছে না।

এটা শিশুদের শহরমুখী করছে। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের অবস্থা প্রায় একই। শিশুরা যখন অন্যায়ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়, এটা আর অভিবাসনের পর্যায়ে থাকে না। তারা এক অর্থে পাচার হয়। একটি অপরাধী চক্র তাদের ঝুঁকিপূর্ণ ও যৌন কাজে ব্যবহার করছে। অনেক সময় পরিবারসহ অভিবাসন হচ্ছে। সিলেটে পাথরখনিতে একটা নির্দিষ্ট সময় শিশুরা তাদের পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করে। অভিভাবকেরা তাঁদের শিশুদের পাথর উত্তোলনের কাজে ব্যবহার করছেন। একইভাবে ইটভাটায় কাজ করছে। এরা অনেক ক্ষেত্রে আগাম শ্রম বিক্রি করে দেয়। তখন তাদের আর কোনো সুযোগ থাকে না। শ্রম দিতে বাধ্য হয়।

শিশুরা যখন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে, তখন তারা ভাবছে, ভবিষ্যতে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে উঠবে। আসলে তারা দক্ষ হতে পারছে না। একসময় অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে শ্রমবাজারে ভিড় করছে।

তারা প্রায় কোনো ক্ষেত্রে সাফল্য পাচ্ছে না। সরকার দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হতে পারবেন। যে শিশু ঝরে পড়েছে, তাকে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এটি দুরূহ কাজ।

শেষে এটা বলতে চাই, শিশুকে যদি অভিবাসী শিশু হিসেবে দেখি, তাহলে তাদের মূল সমস্যা আড়ালে থেকে যাবে।

শিশু যদি একা থাকে, তাহলে তাকে বলতে হবে পরিবারবিচ্ছিন্ন শিশু। আবার অনেকে পরিবারের সঙ্গে থেকেও সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত। তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আসমা খাতুন

আসমা খাতুন

নিরাপদ, বিধিসম্মত ও নিয়মিত অভিবাসনের বৈশ্বিক চুক্তির অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে শিশুদের প্রতি সংবেদনশীলতা। এই চুক্তিতে সব সময় শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করা হয়। এখানে অভিবাসনের সব পর্যায়ে সঙ্গীহীন ও বিচ্ছিন্ন হওয়া শিশুদের সুরক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। অংশীদারিই হচ্ছে এই চুক্তির মূলভিত্তি।

এ চুক্তির উদ্দেশ্য হলো আইনি, প্রশাসনিক ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় অভিবাসী শিশুদের সুরক্ষার বিভিন্ন নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করা। নারী, ছেলে-মেয়ে অভিবাসীদের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা চিহ্নিত করে নীতিমালা প্রণয়ন করা। অসহায় পরিস্থিতিতে থাকা অভিবাসীদের চাহিদাগুলো তুলে ধরে জাতীয় কর্মসূচি উন্নত করতে নীতিমালা প্রণয়ন করা। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় সংহতি, সুরক্ষা ও সমন্বয় নিশ্চিত করা।

এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রমকারী সঙ্গীহীন এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিশুদের স্বার্থরক্ষার বিষয়ে শিশু সুরক্ষা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে দ্রুত অবহিত করা এবং তাদের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি নিশ্চিত করা দরকার।

অভিবাসন প্রক্রিয়াগুলোর নির্ভরযোগ্যতা ও পূর্বাভাসের ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। প্রবেশের স্থানগুলোয় সঙ্গীহীন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অভিবাসী শিশুদের দ্রুত চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনে শিশু সুরক্ষা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো নিশ্চিত করা।

অভিবাসনবিষয়ক বৈশ্বিক চুক্তি ছাড়াও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিশুসহ সবার জন্য উপযুক্ত সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

অসুস্থতাজনিত আর্থিক ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ, কার্যকর আর মানসম্মত ওষুধপ্রাপ্তি এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্য অর্জন করা। ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধ করা।

একইভাবে সপ্তম জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নে শিশুদের সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আইওএম বর্তমানে অভিবাসনসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে সরকারকে নীতিনির্ধারণে সহায়তা করছে। শিশু সুরক্ষার বিষয়টি সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যসেবাসহ শিশু উন্নয়নের সব কর্মপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

শিশুর অনিয়মিত অভিবাসন বা স্থানান্তর রোধে সব অংশীজনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং এ বিষয়ে তথ্য–উপাত্ত জোগাড় করাই হবে প্রথম ধাপের কাজ।

ওয়াহিদা বানু

ওয়াহিদা বানু

আমরা প্রায় ২৫ বছর ধরে সারা দেশে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো, জাতীয় পর্যায়ে কাজে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো তথ্য নেই। ২০০৫ সালের তথ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখানে বলা হয়েছিল, ১০ থেকে ১৫ বছরে পথশিশুদের সংখ্যা হবে প্রায় ২৪ লাখের বেশি। এ সময়টা কিন্তু আমরা এখন পার করছি। এই শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঘুরতে থাকে। তারা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে, আবার একা একা ঘুরতে থাকে। পথে বসবাস করার মতো তাদের একধরনের দক্ষতা তৈরি হয়।

স্থানীয় পর্যায়ের খারাপ মানুষগুলো এদের অনেক ধরনের অসামাজিক কাজে ব্যবহার করে। দেশে বড় ধরনের কোনো সমাবেশ বা মেলা হলে এই শিশুরা দল বেঁধে চলে যায়, আবার দল বেঁধে ফিরে আসে। পথশিশুর প্রত্যেকেই কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়। বিশেষ করে প্রত্যেক মেয়েশিশু অনেকবার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

তাদের কাউন্সেলিংও শিক্ষার মাধ্যমে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা গুরুত্ব দিই। পথশিশুর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা আমরা জানি না। তাই হয়তো তাদের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাত থেকে তারা কিছু সাহায্য পায়। এটা দিয়ে তারা রাস্তার যেখানে–সেখানে বসে খরচ করে। এসব শিশুকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যদি মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ হবে একটি শিশুবান্ধব দেশ।

হারুনো নাকাশিবা

হারুনো নাকাশিবা

ইউএনএইচসিআর হলো জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা। আমাদের প্রাথমিক কাজ সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার শরণার্থীদের ‍সুরক্ষা দেওয়া। শরণার্থী জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হলো শিশু। বিশ্বব্যাপী এ সংখ্যা অনেক। এরা নানাভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।

শরণার্থী শিশু হচ্ছে এমন ধরনের শিশু, যাদের জন্য বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। শরণার্থী শিশুদের চ্যালেঞ্জ, টিকে থাকা অন্য শিশুদের থেকে আলাদা। এদের ভবিষ্যৎ, নিরাপত্তা প্রায় অনিশ্চিত। তারা অধিকাংশ সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়।

২০১৮ সালের শরণার্থীসংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনে বলা হয়েছিল, যেসব দেশ থেকে শরণার্থীরা আসে, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তারা যেন এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের কল্যাণে কাজ করে।

ইউএনএইচসিআরের একটা প্রধান কাজ হলো শরণার্থীদের প্রত্যেককে নিবন্ধিত করা। এটা তাদের পরিবারগুলোকে একত্রে থাকতে, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রত্যেককে বিশেষ সহযোগিতা দিতে সাহায্য করবে। কতজন শরণার্থীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এদের মধ্যে কতজন নারী-পুরুষ ও ছেলে-মেয়ে—সবার তালিকা নিয়ে কথা বলা যাবে। প্রকৃত তথ্য সমাজসেবীদেরও সাহায্য করবে তাদের সত্যিকার সেবা দিতে।

শরণার্থীরা শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তবে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ শিশু পাচার। রোহিঙ্গা শিশুরাও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয়।

অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ কাজে ব্যবহারের জন্য রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের পাচার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও সচেতনতা তেমন নেই। পাচারকারীরা এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে। এদের মধ্যে নারী ও শিশু পাচারের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

এক তথ্যে দেখা যায়, সমুদ্রপথে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের প্রায় অর্ধেক নারী। ৪০ জন শিশু আছে, যাদের বয়স ১০ বছর। সমুদ্রপথে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা কোনোভাবেই থামছে না। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শিশু পাচারের অনেক ঘটনা অজানা থেকে যাচ্ছে। এগুলোর বিশ্লেষণ ও গবেষণা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শিশুদের উদ্ধার করতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের দিকটি দেখতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যা অনুধাবন করতে হবে।

মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম

মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম

শিশু অভিবাসন নিয়ে তেমন গবেষণা নেই। ২০১১ সালে সংযোগ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গবেষণা করেছিল। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ২০টি জেলা থেকে শিশুরা বিভিন্ন কারণে ভারতে যাওয়া–আসা করে। এদের ৬৬ শতাংশ ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। ৭ শতাংশ কখনো স্কুলে যায়নি। সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর—এমন ৩২টি জায়গা দিয়ে তারা ভারতে যাওয়া–আসা করে।

এদের অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। আমাদের শিশুরা যদি অন্য দেশে আটক হয়, তাহলে কী হয়? ভারতে একটি বিচারিক বোর্ড আছে। শিশু–কল্যাণ কমিটি আছে। যারা একদম শিশু, তাদের শিশু-কল্যাণ কমিটির কাছে দেওয়া হয়। দোষী না হলে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে দেওয়া হয়। দুই বছর আগে উত্তর দিনাজপুরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যুক্ত ছিলাম। তখন ৪৬ জন শিশুকে ফেরত এনেছিলাম, যারা তিন বছর ভারতে ছিল। কিন্তু তারা কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল না।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর হয়েছে, ১৮ জন শিশু তিন বছর ধরে ভারতে আটক ছিল। দুই দেশের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবশেষে ছাদ ছিদ্র করে সেখান থেকে তারা পালিয়ে যায়। তারপর বাংলাদেশে ফেরত আসে।

এখনো সাতজন শিশু ওখানে আছে। এক বছর ধরে চেষ্টার পরও বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে তাদের ফিরে আসার তারিখ ঠিক হচ্ছে না। বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে একটা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর তৈরি হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ হাইকমিশন যেন শিশুদের আইনি সহায়তা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও বিএসএফের মধ্যে হস্তান্তর প্রক্রিয়াসহ সবকিছু যেন দ্রুত করা হয়। যেসব শিশুকে উদ্ধার করা হয়, তাদের শিশুবান্ধব পরিবেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

আবুল হোসেন

আবুল হোসেন

২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।

মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবে, এটা হলো তার সাধারণ প্রবণতা। প্রাণিজগতেও এটা আছে। আমাদের কাজ হলো শিশুর সঠিক নিরাপত্তা নিয়ে। কোনো না কোনো পরিস্থিতিতে শিশু পথে আসে। তখন তার জীবনের প্রায় প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি তৈরি হয়। একজন পথশিশু রাষ্ট্র, সমাজ ও তার নিজের জন্য সমস্যা। সমাজে যখন সে পুনর্বাসিত হতে না পারে, তখন এরা রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে যায়।

বিষয়টির প্রতি আমরা সব সময় গুরুত্ব দিই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছয়টি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এ কার্যক্রমের আওতায় কারওয়ান বাজার ও কমলাপুরে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৫০০ পথশিশুকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

পথশিশুরা সাধারণত বস্তি থেকে আসে। আমরা ৪ হাজার শিশুকে বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা করেছি। ৪০০ শিশুকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কারিগরি শিক্ষা দিয়েছি প্রায় ১০০ শিশুকে। ২৩৮ জন শিশুকে তাদের পরিবারে হস্তান্তর করেছি। সাধারণত দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল থেকে বেশি শিশুরা আসে। নদীভাঙন, ঝড়, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন কারণে পরিবারের সঙ্গে কিংবা একা শিশুরা চলে আসে। অভিবাসন বন্ধ করার জন্য সরকার উন্নয়ন সহযোগীসহ সবাই মিলে একটা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রথম আলোকে ধন্যবাদ দিই যে তারা কোভিডের জন্য আমাদের ১০৯ সহ অনেকগুলো নম্বর প্রচার করে মানুষের সেবা করছে।
আমরাও কয়েকটি নম্বর প্রচার করছি। যেকোনো একটা নম্বরে ফোন করলেই নিশ্চিত সেবা পেয়ে যাবে। পথশিশুদের সুরক্ষার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে হবে অথবা পরিবারের কাছে ফেরত দিতে হবে। নাচ-গান ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শিশুদের পুনর্বাসনের কাজ করি।

সারা দেশে দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা দেওয়া দরকার। পরিবার স্বাবলম্বী হলে সে তার শিশুর সুরক্ষা দিতে পারবে। এ জন্য আমরা ১৫৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিচ্ছি। সবাই মিলে একটা কমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সমন্বিতভাবে এমন একটা কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, যেন শিশুরা পথে না আসে।

শেখ রফিকুল ইসলাম

শেখ রফিকুল ইসলাম

এই সরকার অত্যন্ত শিশুবান্ধব সরকার। ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে শিশু অধিকার আইন আছে। ২০১০ সালে বর্তমান সরকার এই আইন আধুনিকীকরণ করে। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর শিশু অধিকার নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। যেসব শিশু পাচার হয়, আমরা তাদের উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। পুনর্বাসনসহ যত ধরনের সেবা দেওয়া দরকার, সেটা আমরা করে থাকি।

আমাদের গ্রামীণ সামাজিক সেবা নামে একটি প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সেবা দিয়ে থাকি। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দিই। আমরা শিশু অভিবাসনের নানা ক্ষতিকর দিক তুলে ধরি, সচেতনতা সৃষ্টি করি। সে অভিবাসন দেশের ভেতরে ও বাইরে—যেখানেই হোক। আমরা উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিভাগ ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা করি।

আমাদের ১০৯৮ একটি সাহায্যকারী নম্বর আছে। ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪৮ জন শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। এরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়ে যায়। এদের মধ্যে ৫০ জনকে পুনর্বাসনে সহযোগিতা দিয়েছি। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের ২২৬টি পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে। দরিদ্র শিশুদের জন্য ৮৫টা আশ্রয়কেন্দ্র আছে। এখানে ছেলে-মেয়েরা আশ্রয়, শিক্ষাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।

নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও গাজীপুরে আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে পথশিশুদের সহযোগিতা করা হয়। তাদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পথশিশুদের বিষয়ে আমরা অবগত আছি।

দেশের উত্তর ও দক্ষিণাংশে দারিদ্র্য বেশি। দক্ষিণাংশে সাধারণত নদীভাঙন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ দরিদ্র হয়। একজন দরিদ্র শিশু যখন ঢাকা শহরে আসে, সে হয়তো কড়াইল বস্তিতে বাস করা শুরু করে। পরে সে হয়তো চলে যায় আগারগাঁও, তারপর নারায়ণগঞ্জে। এটা হলো পথশিশুদের ধরন।

পথশিশু ছাড়া অন্য বিভিন্ন ধরনের শিশু বাসস্টেশন, রেলস্টেশন, লঞ্চস্টেশনসহ আশপাশে ঘোরাফেরা করে। এদের অধিকাংশই ১০ বছরের ওপরে। তারা কোনোভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চায় না। এক জায়গায় থাকতে চায় না। তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ দরকার।

শুরুতেই বলেছি, এই সরকার খুবই শিশুবান্ধব। আমাদের একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার শিশুদের পুনর্বাসন করছে।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের ভার্চুয়াল গোলটেবিল আলোচনায় অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আশা করি, সরকার ও সংশ্লিষ্টজনেরা এই আলোচনার পরামর্শ ও সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।