শুধু আইন কি বাল্যবিবাহ রোধে যথেষ্ট

গার্লস নট ব্রাইডসের (জিএনবি) আয়োজনে ও পিএসটিসি, এফপিএবি, ওয়ার্ল্ড ভিশন ও তেরে দেস হোমস নেদারল্যান্ডসের সহযোগিতায় ‘শুধু আইন কি বাল্যবিবাহ রোধে যথেষ্ট?’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৮ ডিসেম্বর ২০২০। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারীরা

আবুল হোসেন

প্রকল্প পরিচালক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

জেরিন আখতার

বিপিএম পুলিশ সুপার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা

সীমা মোসলেম

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

নাছিমা আক্তার জলি

সম্পাদক, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম ও ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম), দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ

তাসলিমা ইয়াসমীন

শিক্ষক ও গবেষক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাবুল চন্দ্র সরকার

ধর্মপুর ইউনিয়ন, বিরল উপজেলা, দিনাজপুর জেলা

সঞ্জীব আহমেদ

পরিচালক, (প্রোগ্রাম) বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি (এফপিএবি), ঢাকা

সুস্মিতা আহমেদ

টিম লিড, হ্যালো আইএম

বুলি হাগিদক

পরিচালক, ইন্টিগ্রেটেড থিমেটিক সলিউশন, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

রহিমা সুলতানা কাজল

নির্বাহী পরিচালক, আভাস, বরিশাল

বিউটি খাতুন

বিবাহিত কিশোরী ও চেঞ্জমেকার, কুড়িগ্রাম তেরে দেস হোমস, নেদারল্যান্ডস

সঞ্চালনা

কাশফিয়া ফিরোজ

পরিচালক, গার্লস রাইটস, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ

আলোচনা

কাশফিয়া ফিরোজ

কাশফিয়া ফিরোজ

গার্লস নট ব্রাইডস বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। এটা একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, যা বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে এর সহযোগী হিসেবে যুক্ত আছে ২৯টি সংগঠন। তারা সবাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন, বিধিমালা ও জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় গার্লস নট ব্রাইডস ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। সবার সম্মিলিত উদ্যোগে বাল্যবিবাহ কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু করোনা আমাদের আশঙ্কার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ, করোনাকালে স্কুলগুলো বন্ধ আছে। অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি বারবার সামনে এসেছে। এসব বাল্যবিবাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী আগামী এক দশকে অতিরিক্ত আরও ১ কোটি ৩০ লাখ মেয়ের বাল্যবিবাহের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেটা সরাসরি প্রভাব ফেলবে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার ওপর।

গার্লস নট ব্রাইডসের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংগঠনগুলোর অনেক প্রতিবেদন ও মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে এসেছে যে এ সময় অনেক প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন। আর এ সুযোগটা অভিভাবকেরা নিতেও চেয়েছেন। ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চাননি। ফলে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোনোরকম রেজিস্ট্রেশন ছাড়া তাঁদের সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।

করোনাকালে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা খুব কঠিন ছিল। তারপরও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ওয়ার্ল্ড ভিশন ম্যারেজ ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ৫৩টি জেলা থেকে টেলিফোন জরিপের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের অবস্থা কী রকম, সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে। সেখানে দেখা যায় যে বাল্যবিবাহ হচ্ছে এবং আগের তুলনায় বাল্যবিবাহ বন্ধের হার ক্রমশ কমে এসেছে। জুনে এ হার ছিল সবচেয়ে কম।

ওয়ার্ল্ড ভিশনের ম্যারেজ ট্র্যাকিং রিপোর্টে এসেছে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসে বাল্যবিবাহের হার কম থাকলেও পরবর্তী সময়ে জুন ও জুলাই মাসে এ হার অনেক বেশি বেড়ে গেছে। বাল্যবিবাহ নিয়ে কথা বললেই আইন ও আইনের প্রয়োগ বিষয়টি আসে। ২০১৭ সালে হওয়া নতুন আইনে আগের তুলনায় শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ আইনের মাধ্যমে বিয়ে পরিচালনাকারী ও বিয়ের রেজিস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

বাল্যবিবাহ বন্ধে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিক বিচারের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতকে এ আইনের আওতায় যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু অসংগতিও দেখা যায়। অসংগতি হলো এ আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিবাহ গ্রহণযোগ্য হবে। সে ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতিরও একটা বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বিশেষ পরিস্থিতির কোনো সুনির্দিষ্ট বর্ণনা বা সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কোন ক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতি বলে গণ্য হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা আমরা দেখতে পাইনি এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের মতামতের বিষয়টিও আমরা সেখানে দেখিনি। কত বয়স থেকে আমরা তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করব, তা আইন বা বিধিমালায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়নি। শুধু আইনই কি বাল্যবিবাহ বন্ধে যথেষ্ট, নাকি এ জন্য অন্য আরও উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে, তার ওপর আজকের আলোচনায় জোর দিতে চাই। এখন এ বিষয়ে এ আলোচনা করবেন সঞ্জীব আহমেদ।

সঞ্জীব আহমেদ

সঞ্জীব আহমেদ

এফপিএবি (বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি) অনেক পুরোনো একটা সংস্থা। ১৯৫৩ সালে এফপিএবি বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে। শুরুতে পরিবার পরিকল্পনার ওপর জোর থাকলেও আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তা যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকারভিত্তিক সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে এফপিএবির কার্যক্রমে তরুণদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকারে জোর দেওয়া হয়। এফপিএবি বিশ্বাস করে যে তরুণেরা হলো ভবিষ্যতের বার্তাবাহক।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থাকে আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলছি। এ ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়স্ক জনসংখ্যাকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে ২০৩৭ সাল পর্যন্ত আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের (মোট জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি থাকা) সুযোগ–সুবিধা পেতে থাকব। বাংলাদেশে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের কথাটা শুনলেই সবাই কেমন যেন একটা পিছপা হয়ে যায়। সেটা অভিভাবক, স্থানীয় ও ধর্মীয় নেতা, তরুণ এমনকি আমাদের শিক্ষকেরাও।

আমি কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে মাঠপর্যায়ে বিবাহিত কিশোরী খুঁজলে পাওয়া যাবে না। কারণ যে কিশোরীর বিয়ে হয়ে গেছে তাকে বাবার বাড়িতে পাবেন না। তাকে পাওয়া যাবে শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরবাড়িতে তাকে আবার কিশোরী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। ভুয়া সনদ দিয়ে তাকে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এফপিএবির ২১টি শাখায় তারার মেলা নামে একটা প্ল্যাটফর্ম আছে। যুবারাই এ প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। আমরা তাদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের শিক্ষা দিই। আমাদের উদ্দেশ্য থাকে তাদের মধ্যে সুকুমার বৃত্তি জাগ্রত করা।

এফপিএবির তারার মেলা থেকে গত বছর ৭৭ হাজার তরুণ-তরুণীদের কাছে আমাদের বার্তা পৌঁছেছে। সেখান থেকে একটিও বাল্যবিবাহ হয়নি। শুধু কমিউনিটিতে না সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। এখান থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন করতে হবে। তাহলে শিক্ষকেরাও এ বিষয় পড়াবেন ও শিক্ষার্থীরাও পড়বে।

বুলি হাগিদক

বুলি হাগিদক

ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হলো শিশু। শিশুদের সার্বিক উন্নয়ন ও বাল্যবিবাহ বন্ধে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সব ধরনের স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কাজ করে চলেছে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ খুবই ধর্মপরায়ণ ও ধর্মভীরু। এখনো মানুষ ধর্মীয় নেতাদের কথা শোনে ও তাঁদের মতামতের গুরুত্ব দেয়। এ জায়গা থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধে ধর্মীয় নেতাদের যুক্ত করতে পারলে খুবই ফলপ্রসূ একটা ফল পাওয়া যায়।

সব ধর্মে ধর্মীয় নেতারাই বিয়ে পড়িয়ে থাকেন। সাধারণত তাঁদের উপস্থিতি ছাড়া বিয়ে সম্ভব না। তাঁদের আমাদের সব কাজের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। তাহলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি আইন, বেসরকারি উদ্যোগ ও ধর্মীয় নেতাদের অংশগ্রহণ থাকলে বাল্যবিবাহ অনেকখানি কমিয়ে আনতে পারব।

এ ক্ষেত্রে তাঁদের করণীয়গুলো কী? ধর্মীয় নেতারা বিয়ে পড়ানোর আগে যেন বয়স দেখেন সে জন্য ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ তাঁদের উৎসাহিত করে। বয়স নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে ধর্মীয় নেতাদের উচিত স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নেওয়া।

বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা বিশেষ করে শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবার আগে বাল্যবিবাহের কুফল ও সরকারি আইন নিয়ে সাধারণ জনগণকে জানালে মানুষ সচেতন হবে।

আইন সম্পর্কে অনেকেই জানে না। আইন সম্পর্কে জানলে তাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করবে, সচেতনতা আসবে। ফলে তারা নিজেরাও বাল্যবিবাহ করবে না ও অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করবে না। আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধে সারা দেশে ৩০টি জেলায় কাজ করছি। আরেকটা বিষয় হলো পুরুষের অংশগ্রহণ। পুরুষেরা যদি ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকে বিয়ে না করেন, তাহলেই তো বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহের সিদ্ধান্ত এখনো পুরুষেরা নিয়ে থাকেন। তাঁদের ভূমিকাই বেশি। বাল্যবিবাহ বন্ধে সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের সোচ্চার আন্দোলনে তাঁরাও অংশীদার হতে পারে।

রহিমা সুলতানা কাজল

রহিমা সুলতানা কাজল

আমি প্রায় তিন বছর ধরে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি বাস্তবায়নের জন্য প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে কাজ করছি। এ কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জানে যে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন হয়েছে। সে আইনের ধারাগুলোও তারা জানে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়নে নেতাদের অনীহা আছে।

এটা তারা জানে কিন্তু বিশ্বাস করে না। এ আইন হওয়ার আগে হয়তো তারা জন্মনিবন্ধনে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দিত। কিন্তু ইদানীং অনেক বিয়েতে কাবিনই হয় না। তারা মৌখিকভাবে বিয়ে করে, যখন ১৮ বছর হয় তখন তারা কাবিন করবে। দক্ষিণাঞ্চলে এ রকম একটা ভয়াবহ অবস্থা আমাদের চোখে পড়ছে।

কিছুদিন আগে আমরা একটা জরিপ করেছি। যেখানে কাজির কাছ থেকে এ তিন মাসে বিয়ে হয়েছে এ রকম ১১৩টি মেয়ের তথ্য নেওয়া হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এ ১১৩টি বিয়ের মধ্যে ৯৭ জন মেয়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে। কিন্তু কাজির কাছে দেওয়া সনদে তাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি দেওয়া আছে। বাড়ি ও স্কুলের তথ্যানুযায়ী তাদের ১৮ বছর হয়নি। করোনাকালে বাল্যবিবাহের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। সবাই মনে করে এটা ইউএনও ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার দায়িত্ব। বাল্যবিবাহে সহযোগিতা করা সবার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ না করলে, তাদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান নেই। এ রকম কিছু থাকলে এ আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ হতো।

সাবুল চন্দ্র সরকার

সাবুল চন্দ্র সরকার

বাল্যবিবাহের কোনো খবর পেলে তা ঠেকানোর জন্য আমরা প্রথমেই চৌকিদার পাঠাই। চৌকিদারের মাধ্যমে তাদের নিষেধ করা হয়। তারপরও না শুনলে ওই এলাকায় চৌকিদার পাহারা বসাই। এর পাশাপাশি আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানায় বিষয়টি জানাই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তারা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করছি। শুধু একজনের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করায় আমার এলাকায় বাল্যবিবাহ অনেক কমে গেছে। কিন্তু করোনাকালে কোথায় বিয়ে হচ্ছে, কীভাবে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হচ্ছে, এসব তথ্য আমরা কম পাচ্ছি। আমার ইউনিয়নে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও আদিবাসী রয়েছে। আমরা চৌকিদারের মাধ্যমে বাধা দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধের চেষ্টা করি। কিন্তু তারপরও অনেক সময় দেখা যায় কিছুদিন পর তাঁরা অনানুষ্ঠানিকভাবে অন্য জায়গায় মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন। তাই বাল্যবিবাহ বন্ধে আইনের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শহরের মানুষ তুলনামূলক সচেতন তাই শহরের চেয়ে গ্রামে বাল্যবিবাহ বেশি।

বিউটি খাতুন

বিউটি খাতুন

আমার বয়স তখন ১৪ বছর। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সে সময় আমার বিয়ে হয়। এখন আমার বয়স ২০ বছর। আমার বাবা-মা আমার মতামত না নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন। জন্মনিবন্ধনে আমার বয়স ১৮ বছর দেখানো হয়। বিয়ে হলেও আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থেকে অনুমতি পাইনি। বরকে যৌতুক দিতে হয়েছিল। বিয়ের পর আমার এলাকায় ইমেজ-প্লাস প্রকল্প কাজ করে বাল্যবিবাহের সমস্যা নিয়ে অনেক কিছু শিখতে পারি। চেঞ্জমেকার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে অনেকগুলো বাল্যবিবাহ বন্ধ করি। আমি মেয়েদের বাবা–মাকে বোঝাই যে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হলে মেয়েদের স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হয়। সন্তান জন্মের সময় অনেক ক্ষেত্রে মায়ের মৃত্যুও হতে পারে। আপনারা মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেবেন না।

দারিদ্র্যের জন্য মানুষ বাল্যবিবাহ দেয়। অল্পবয়সী মেয়েদের বয়স বাড়িয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ জোগাড় করে। আবার প্রশাসনের ভয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে গোপনে বিয়ে দেয়। অনেক সময় নিরাপত্তার অভাবে বিয়ে দেয়। বর্তমান সময় আর একটি কারণ হলো করোনার জন্য স্কুল–কলেজ বন্ধ তাই অনেক বাবা–মা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। আমার মনে হয়, প্রশাসন যদি বিষয়টি আর একটু গুরুত্বের সঙ্গে দেখে, তাহলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে।

সুস্মিতা আহমেদ

সুস্মিতা আহমেদ

‘হ্যালো আইএম’ ছয়টা উপজেলা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে কাজ করে আসছে। পিএসটিসি চেষ্টা করে কমিউনিটিকে যুক্ত করে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। হ্যালো আইএম সে রকম একটি প্রকল্প। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুব জরুরি। এর আওতায় আমরা কিশোর-কিশোরী ও অভিভাবকদের রাখি। বাবা-মায়েরাই প্রথমে চিহ্নিত করে যে মেয়ের মাসিক হয়ে গেছে, এখন তাকে বিয়ে দিতে হবে। সে জন্য পরিবারের সচেতনতা খুবই জরুরি।

সে জন্য অনেক অভিভাবককে যুক্ত করে আইনের বিষয়টিও তাঁদের মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করেছি। মাঠপর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে আইন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেল বাল্যবিবাহ দেওয়া যে অন্যায়, তা অনেকে জানতেনই না। এটা যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও এর জন্য জেল-জরিমানা আছে, তা তাঁরা জানতেন না।

আমরা ছয়টি উপজেলায় কাজ করি। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল হলো নেত্রকোনার দুর্গাপুর, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা। এগুলো একেবারে হাওর অঞ্চল। এসব এলাকার লোকজন জানে যে বাল্যবিবাহ রোধে কিছু আইন আছে। এ ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সচেতনতা শুরু করা উচিত। সে জন্য আমরা অভিভাবকদের জন্য খুব সহজ ভাষায় প্যারেন্টস মডিউল করে সেখানে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করেছি।

এখন বাল্যবিবাহের কারণগুলো কী? এত দিন ধরে আমরা জেনে এসেছি বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের প্রধান কারণ দারিদ্র্য। কিন্তু আসলে কি তাই? আমাদের অভিজ্ঞতা তা বলে না। অনেক বিত্তশালী পরিবার মেয়েদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তাদের তো আর্থিক সমস্যা নেই। তাহলে কেন দিচ্ছে? এর কারণ হলো সামাজিক নিরাপত্তার অভাব।

আশপাশে বখাটে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করছে। সেখানে আমাদের আইনের প্রয়োগ আরও কঠোর করা দরকার। সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে অনেক মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে।

তাসলিমা ইয়াসমীন

তাসলিমা ইয়াসমীন

বাল্যবিবাহ রোধে আইন একমাত্র সমাধান হতে পারে না। বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সবার সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। যদিও এটি একমাত্র সমাধান নয়। কিন্তু একটি যথাযথ আইন, সেই আইনের সফল বাস্তবায়নের সঙ্গে তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বাল্যবিবাহ বন্ধের লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। যেহেতু আইনটা মাত্র হয়েছে। এর রুলও ২০১৮ সালে এসেছে। সে জন্য গার্লস নট ব্রাইডস দেখতে চেয়েছে নতুন এ আইন ও বিধিমালা কতটুকু কার্যকর। কেন সেটা প্রচার করা দরকার। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এখনো কিছু কিছু জায়গায় আরও সেফ গার্ডিং মেকানিজম দরকার ছিল।

পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহের বয়সসীমা কেন ভিন্ন রাখা হলো, তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ আমি খুঁজে পাইনি। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ আমল থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধে কাজ শুরু হয়। বাল্যবিবাহ যেহেতু অনেকটা গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতি ছিল, তাই ধরেই নেওয়া হতো প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ ১০ বছরের শিশুকে বিয়ে করবেন! তাই প্রথমে আইনে মেয়ে শিশুর জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১০ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে সেটা সংশোধন করে ১২ বছর করা হয়। এ ক্ষেত্রে পুরুষের বিয়ের বয়স কিন্তু ১৮ বছরই ছিল।

মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম এ বয়স রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ১২ বছর থেকে ১৮ বছর হয়। ফলে নারী ও পুরুষের বিয়ের ন্যূনতম বয়স সমান হয়ে যায়। আমাদের সংস্কৃতির নিয়মে আমরা ধরেই নিই যে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেকে অবশ্যই বড় হতে হবে। তাই নারীর বিয়ের বয়স যখন ন্যূনতম ১৮ করা হয়, তখন পুরুষের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১ করে দেওয়া হয়। এ কারণে আইনের বাস্তবায়নে লিগ্যাল অ্যানামলি বা আইনি অসংগতি তৈরি হতে পারে।

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবস্থা একটা বড় কারণ। এসব ক্ষেত্রে তাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

আবুল হোসেন

আবুল হোসেন

আমি দুটি বিষয়ে জোর দেব। একটা হলো সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা যে যেখানে আছি সবাই যেন তার ভূমিকাটা পালন করি। জাতীয় পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থা ও এসবের অধীন কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

সমন্বিত উদ্যোগের দুটি ক্ষেত্র আছে। প্রথমত, জাতীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি আছে। এসব কমিটিতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোক, স্থানীয় প্রতিনিধি ও এনজিওর লোকবল আছেন। এ প্ল্যাটফর্ম সচল করতে পারলে সবার সমন্বিত উদ্যোগ দৃশ্যমান হবে। এ কমিটির সদস্যরা যেন তাঁদের ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানেন। তাঁদের মধ্যে সামাজিক, নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করতে পারলে এ কমিটিগুলো সচল করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, কার কী দায়িত্ব, তা বোঝানোর জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা। বাল্যবিবাহ রোধে প্রথম থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গার্লস নট ব্রাইডসের সব কটি সংগঠন এ–সংক্রান্ত সব কাজে সম্পৃক্ত ছিল। আপনাদের দৃশ্যমান ও কার্যকর সংশ্লিষ্টতার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় আমাদের করণীয়, বিধান, আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি, বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক এসেছে।

এসব বিষয়ে কাজ করায় আমরা হয়তো অনেক কিছু বুঝি। কিন্তু গ্রামের দরিদ্র নারী বা অভিভাবক হয়তো ভাবছেন মেয়েকে বিয়ে দিলে ভালো হবে। কিন্তু ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিলে ভালোর চেয়ে যে খারাপ বেশি হচ্ছে, কোনো ক্ষেত্রে যে সহিংসতার শিকার হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে এসে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে, এ বিষয়গুলো বেশি করে তুলে ধরা উচিত।

আইনের পাশাপাশি শিশুদের ভবিষ্যতের বিষয়গুলো বেশি প্রচার করতে হবে। তারা যখন বুঝতে পারবে শিশুর ভবিষ্যৎ তারা যেমন ভাবছে তেমন আলোকিত না। এটা অন্ধকার। তখন হয়তো বাল্যবিবাহ থেকে তারা ধীরে ধীরে সরে আসবে।

এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার একটা বিষয় জড়িত। মেয়েরা যদি কিছু শিখতে পারে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে পরিবারে সহায়তা করতে পারে তাহলে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। ন্যাশনাল চিলড্রেন টাস্কফোর্স, ইয়েস বাংলাদেশ, ইয়ুথ ফর ডেভেলপমেন্ট এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিশুরা নিজেরা বাল্যবিবাহ তো করেই না বরং প্রতিবাদ করে। এর কারণ হলো তারা একটা নেটওয়ার্কের মধ্যে আছে।

আমরা চাই যে বাল্যবিবাহ না হোক। কিন্তু বাল্যবিবাহ হয়ে যাওয়ার পর তারা স্কুলে যেতে পারে না, ওই পরিবারে মানিয়ে নিতে পারে না বা তাদের কোনো কাউন্সেলিং থাকে না। মুহূর্তের মধ্যে তারা স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়ে। সে জন্য বিবাহিত শিশুদের জন্য আমাদের কিছু করা দরকার।

গত মাস থেকে আমরা কাউন্সেলিং স্কিল ফর এভরি ডে লাইফ নামে একটা কোর্স চালু করেছি। যে কেউ বিনা মূল্যে এ কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এটা তাদের জীবনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

নাছিমা আক্তার জলি

নাছিমা আক্তার জলি

আমাদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ আত্মনির্ভরশীল একটা দেশ হবে। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহের ফলে আমাদের কন্যাশিশুরা শুধু শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নয়, মানসিক ও আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাল্যবিবাহের ফলে কন্যাশিশুর মেধা হারাচ্ছি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কিশোরী মায়ের মৃতু্যঝুঁকি প্রায় তিন গুণ বেশি একজন ২০-২২ বছর বয়সী মায়ের থেকে।

নওগাঁর একটি এলাকায় একটি শিশু বাল্যবিবাহের তিন দিনের মধে্য আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার পেছনে কী কারণ ছিল? প্রথমত, সে এটা মেনে নিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, তার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই বলা হয়, ‘আজকে তোমার
বিয়ে। প্রস্তুত হয়ে নাও’। মানুষ যখন মানসিকভাবে প্রস্তুত না হয়, তার শরীরও তখন শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয় না।

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অনেক সময় মানসিক বিপর্যস্ততার কারণে আমাদের কন্যাশিশুরা আত্মহত্যা করছে। তাই শারীরিক স্বাস্থে্যর সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

সীমা মোসলেম

সীমা মোসলেম

বাল্যবিবাহ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটা প্রধান বাধা। এটা এখন আমরা সবাই জানি। বাল্যবিবাহ রোধে আইন হয়েছে। কিন্তু আইনে থাকা একটি ধারা ভিন্ন বার্তা দেয়। তার কিছু অভিঘাত আমরা ইতিমধ্যে দেখতেও শুরু করেছি।

বাল্যবিবাহ রোধে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ভুয়া জন্মনিবন্ধনের মধ্যমে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি এ জন্মনিবন্ধন সনদ দেন। সুতরাং স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির এখানে বড় জবাবদিহির ব্যাপার আছে।

জন্মনিবন্ধন সনদের আধুনিকায়ন করে একটা তথ্যভান্ডারে নিয়ে আসতে হবে। ফলে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন দিয়ে বাল্যবিবাহ করাতে চাইলে সেটা যাচাই করা যাবে।

জেরিন আখতার

জেরিন আখতার

আমরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে চাচ্ছি। কিন্তু বাবা–মা কেন চাচ্ছেন না। একজন কন্যাশিশুর বাবা কেন বুঝতে পারছেন না যে বাল্যবিবাহ দিলে তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। সে জন্য আইনের পাশাপাশি পরিবারগুলোর মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখতে হবে। বাল্যবিবাহের মতো একটি সামাজিক সমস্যা সমাধানে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।

আমরা শুধু আইন প্রয়োগ করে বাল্যবিবাহের মতো একটি সামাজিক সমস্যা সমাধান করতে পারব না। বাল্যবিবাহ রোধে পুলিশ, প্রশাসন, সমাজকর্মী, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, এনজিওসহ সবাই একসঙ্গে কাজ করছি। তাহলে আমরা সবাই মিলেও কেন বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারছি না? তার মানে যাদের নিয়ে উদ্যোগ, তারা নিজেরা সচেতন হয়নি।

তারা নিজেরা সচেতন না হওয়ার কারণগুলো কী? তাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো আমাদের তুলে ধরতে হবে। তারা মানসিকভাবে ভাবছে কন্যাশিশুটিকে বিয়ে দিলেই সে ভালো থাকবে। কোনো বাবা–মা তো তাঁর সন্তানের খারাপ চান না। অর্থাৎ সে সন্তানের ভালো চেয়েই বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। বাল্যবিবাহ যে তাঁর সন্তানের জন্য ভালো হচ্ছে না, এটা আমরা বাবা–মাকে বোঝাতে পারছি কিনা। পুলিশের কাজ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা। সে ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সঙ্গে আপনারা অনেকেই আছেন। যাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করছেন।

কী করলে বাল্যবিবাহ থেকে বাবা–মা ও শিশুরা নিজেরাও সচেতনভাবে বেরিয়ে আসতে পারবে, তা নিয়ে আমাদের কাজ করার দরকার আছে। বান্দরবান একটা দুর্গম এলাকা। যেখানে অনেক জায়গায় পৌঁছাতে অনেক সময় তিন থেকে চার ঘণ্টা হেঁটে যেতে হয়। সে জন্য বাল্যবিবাহের খবর পেলে ছুটে গিয়ে তা আটকানো কঠিন হয়। এ সত্ত্বেও ২০২০ সালে আমরা বেশ কিছু বাল্যবিবাহ বন্ধ করছি। আমাদের সঙ্গে প্রশাসনের লোক ছিল। তাদের জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানা করা হলে একটা সুবিধা হয় যে ওই এলাকায় এ ধরনের ঘটনা আর তেমন ঘটে না। আমরা বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চালাচ্ছি। ফলে পুলিশের একজন উপপরিদর্শক তাঁর সঙ্গে দু–একজন পুলিশ সদস্য নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়নে যাচ্ছেন। প্রতিটি ইউনিয়নে অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে তিনি বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন রোধে কাজ করছেন। তবে আইন প্রয়োগের সঙ্গে আমাদের সচেতনতা চালিয়ে যেতে হবে।

কাশফিয়া ফিরোজ

আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

সুপারিশ

  • জন্মনিবন্ধন সনদের আধুনিকায়ন করে কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে নিয়ে আসা প্রয়োজন

  • শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার

  • বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও প্রচারণা চালানো যেতে পারে

  • নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে, যেন তাঁরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারেন।

  • বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা জরুরি।

  • আইন বাস্তবায়নের সঙ্গে এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকাও জরুরি।

  • যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে আনতে হবে।

  • আইন প্রয়োগে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগগুলোর মধ্যে সমন্বয় দরকার

  • বাল্যবিবাহ রোধে সবার মধ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

  • বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।