সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও মৎস্যজীবীদের কল্যাণ

প্রথম আলো ও ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের আয়োজনে ‘সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও মৎস্যজীবীদের কল্যাণ’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয় ৬ আগস্ট ২০২০। প্রথম আলোর ডিজিটাল স্টুডিও থেকে সম্প্রচারিত সেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া আলোচকদের বক্তব্যের সারমর্ম এ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

গোলটেবিলে অংশগ্রহণকারী

এম এ সাত্তার মণ্ডল

ইমেরিটাস অধ্যাপক; সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ)।

মো. আব্দুল ওহাব

টিম লিডার, ইকোফিশ-২, ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ। সাবেক অধ্যাপক, ফিশারিজ অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইশাম ইয়াসিন মুহাম্মদ

ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চ লিডার, ওয়ার্ল্ডফিস হেডকোয়ার্টার, পেনাং

সৈয়দ আরিফ আজাদ

সাবেক মহাপরিচালক,মৎস্য অধিদপ্তর

নিয়ামুল নাসের

অধ্যাপক, প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

রকিবুল আমিন

কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ, আইইউসিএন

মুকিত মজুমদার বাবু

চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

মো. এনামুল হক

জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট


সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী:সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

আমাদের রয়েছে বিপুল সমুদ্র সম্পদ। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এখন আমাদের নিজস্ব সমুদ্র এলাকার বিপুল সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাব। মাছ উৎপাদনে দেশ অনেকটা সমৃদ্ধ হয়েছে। সেটা আরও কাজে লাগাতে পারব, যদি সামুদ্রিক মৎস্য আরও বেশি আহরণ করতে পারি। এ ক্ষেত্রে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

এম এ সাত্তার মণ্ডল

এম এ সাত্তার মণ্ডল

সমুদ্রসীমা জয়ের ফলে অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এটাকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৪ নম্বরের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি। এসডিজিতে বলা আছে, ‘লাইফ বিলো ওয়াটার’ অর্থাৎ পানির নিচের জীবন। বাংলাদেশ এসডিজিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এটি হলো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক ঘোষণা।

বৈশ্বিক দিক থেকে আটটি দেশ মিলে ‘বে অব বেঙ্গল লার্জ মেরিন ইকো সিস্টেম প্রোজেক্ট’ বাস্তবায়ন করছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এটি হয়েছিল। বাংলাদেশ এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে একটি কৌশলগত কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। তারা স্মল-স্কেল ফিশারিজের একটি গাইডলাইনও তৈরি করেছে। এর মধ্যে মৎস্য আহরণের সক্ষমতা নিরূপণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। উপকূলীয় এলাকায় ভারী বস্তু দূষণ দূর করার প্রযুক্তি আছে।

বাংলাদেশের শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান একটি বড় দলিল। এর মধ্যে সরকারের নির্দেশনা রয়েছে। ডেল্টা উন্নয়নে কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত ও কৌশল নির্ধারণের কাজটি ইতিমধ্যে হয়েছে। মেরিন রিসোর্চ সার্ভে সম্পাদন করতে হবে। সি-ফিশিং ও ইকো ট্যুরিজম জোরদার করতে হবে। উপকূল ও সাগর দূষণমুক্ত করার ঘোষণাও এ ডেল্টা প্ল্যানে আছে।

সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ভালো খবর হলো গত পাঁচ দশ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে
এম এ সাত্তার মণ্ডল

ডেল্টা প্ল্যানকে আরও প্রায়োগিক কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসতে হবে। চলমান সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় জোর দেওয়া হয়েছে ওপেন ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের ওপর। অভ্যন্তরীণ স্বাদু পানিতে মাছ চাষ ও উপকূলীয় এলাকায় চিংড়ি ও অ্যাকুয়াকালচারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

এখন দেখা যাচ্ছে,বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু মৎস্য ভোগের দিকে থেকে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড় হিসেবে প্রতিজন প্রতিদিন ৬৩ গ্রাম মাছ ভোগ করছি। কিন্তু অজস্র দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ রয়েছে। এরা তেমন মাছ খেতে পারছে না। বিশেষ করে শহরে যেসব দরিদ্র মানুষ বাস করে, তাদের মাছের ভোগ গ্রামের দরিদ্র মানুষ থেকেও অনেক কম। এ ক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন হলো, মাছ আমরা কার জন্য উৎপাদন করছি। তাহলে আমরা অতিরিক্ত উৎপাদন দিয়ে কী করবো। সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ উৎস—যেখান থেকেই এই উৎপাদন হোক না কেন। অভ্যন্তরীণ বাজারে মাছের বাড়তি চাহিদা আছে কিনা। সাম্প্রতিক বেশ কিছু বছর যাবত মাছের প্রকৃত দাম বাড়েনি, কিন্তু উৎপাদন খরচ ঠিকই বাড়ছে। তাহলে ব্যক্তিখাতে যাঁরা বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা কীভাবে লাভ করবেন? কীভাবে এই ব্যবসায় টিকে থাকবেন। তাহলে সমাধানটা কী?

এখন প্রশ্ন হলো, মাছের উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে, নাকি ভ্যালু এডিশন করতে হবে। নাকি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে যে মাছ উৎপাদন করছি, তার উৎপাদনশীলতা বাড়াব, যাতে একক প্রতি খরচ কমে যায় এবং দরিদ্র মানুষ মাছ কিনতে পারে। তাদের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। আর সমুদ্র থেকে যে মাছ আহরণ করব, তা প্রধানত রপ্তানির জন্য করব।

একসময় বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ মাছের উৎস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে এগুলো আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ওপেন ওয়াটার ফিশারিজ অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেল। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের একটা ভালো খবর হলো, গত পাঁচ–দশ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। এটা বড় রকমের সাফল্যের গল্প। এর একটা বড় কারণ হলো নির্দিষ্ট সময়ে প্রশাসন, সরকার, বিজ্ঞানী, সমাজকর্মী—সবাই জাটকা রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে।

কিন্তু ইলিশ ধরা বন্ধ থাকার সময় মৎস্যজীবীদের জীবিকার কোনো টেকসই ব্যবস্থাপনা এখনো গড়ে ওঠেনি। এখন আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির দরকার। মার্কেট ভ্যালুচেইন সেকেলে হয়ে আছে। সরকারের পরিকল্পনায় সব বিষয়ের কথা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে, সেটা একটা ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনের ভালো প্রযুক্তি বের করেছেন। এখন আমাদের সাগরকেন্দ্রিক মৎস্য আহরণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

মো. আব্দুল ওহাব

মো. আব্দুল ওহাব

আজকের এই আলোচনা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বৈশ্বিকভাবেও। কোভিড–১৯-এর জন্য আমরা বুঝতে পেরেছি প্রোটিন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট শরীরের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। যে সব উপাদান থেকে প্রোটিন পাওয়া যায়, তার মধ্যে মাছ অন্যতম। এ ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছ আরও গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক মাছ খেলে আর জিংক ট্যাবলেট খেতে হবে না। বঙ্গোপসাগর বিশাল এক ইকোসিস্টেম। এই সাগরের ওপর অধিকার রাখে এমন ৮ টি দেশ যত রকমের প্রযুক্তি আছে, সেটা ব্যবহার করে মাছ ধরছে। অন্যান্য জলজ প্রাণীও ধরছে। সব কটি দেশই নদ-নদী ও তাদের শিল্পের মাধ্যমে সাগরকে দূষণ করছে। নানাভাবে ছোট মাছগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে।

অসংখ্য ট্যাংকার এই সাগরের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচল করছে। এসব ট্যাংকারের বর্জ্য সাগরকে দূষিত করছে। যে সময় বঙ্গপোসাগর থেকে অন্যান্য দেশ ৩০–৪০ শতাংশ মাছ কম আহরণ করতে পারছে, সেখানে আমাদের জাটকা ধরা বন্ধের জন্য প্রতিবছর মৎস্য উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সাগরে একদিকে যেমন মাছের উৎপাদন বেড়েছে, অন্যদিকে মাছের আকারও বড় হয়েছে। এখন জেলেদের মুখে হাসি ফুটেছে। সরকারকে ধন্যবাদ জানাই কেননা, যে সময় সাগরে মাছ ধরা বন্ধ ছিল, ঠিক সে সময়েই জেলেদের প্রয়োজনমতো চাল দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করার সময় এসেছে, এখন চালের সঙ্গে জেলেদের কিছু নগদ টাকা দেওয়া যায় কিনা। জাটকা নিধন বন্ধ সময়কালীন জেলেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে যেন জেলে সম্প্রদায় কষ্ট না পায় এবং দুর্ভোগে না পড়ে, তার জন্য একটা টেকসই ব্যবস্থা করা দরকার।

কোভিড–১৯-এ বুঝতে পেরেছি প্রোটিন ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট শরীরের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ
মো. আব্দুল ওহাব

সাগরের পেলাজিক অঞ্চলে বাস করা ছোট মাছগুলোতে সবচেয়ে বেশি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও ওমেগা-৩ আছে। ট্রলারের জেলেরা অনেক সময় এসব মাছ ধরেও নির্বিচারে ফেলে দেয়। ছোট এ মাছগুলোকে বাজারে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর এবং মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে ৫টি সংরক্ষিত এলাকা (সাংচুয়ারি) ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৪ সাল থেকে মৎস্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ইকোফিশ প্রকল্পের গবেষণা ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে বরিশালের হিজলা মেহেন্দীগঞ্জে আরেকটি সংরক্ষিত এলাকা যুক্ত হয়েছে। এর আয়তন হলো ৮২ বর্গ কিলোমিটার। আইন প্রণয়ন করে এ ৬টি সংরক্ষিত এলাকায় মাছ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। অক্টোবর মাসে ২২ দিন মা-ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে। এ জন্য মা-ইলিশ মাছ রক্ষা পেয়েছে। বছরের মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাসে জাটকা রক্ষা করা হয়ে থাকে যার সুফল আমরা ইতোমধেই আমরা পেয়েছি। বর্ষার নতুন পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে জাটকা সাগরে চলে যায়। জাটকা নিধন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে নদ-নদী ও সাগরে ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মেরিন ফিশিং বন্ধ করা হয়েছে। যার ফলে ইলিশসহ সাগরের অনেক মাছের উৎপাদন বেড়েছে।

সাগরে মাছ ধরা বন্ধের সময়সীমা নিয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। ওয়ার্ল্ডফিশ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে সাগরে মাছ ধরা বন্ধের তারিখ ও সময়সীমা পুন:নির্ধারণ করতে সরকারকে সহায়তা করতে পারে।

মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। যার ফলে এখন থেকে ইলিশ ধরার জালের ফাঁস হবে ৬ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। আগে যা ছিল ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। এর ফলে জাটকা রক্ষা করা সহজ হবে এবং ইলিশের উৎপাদন আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দেশের ইলিশ রক্ষায় দেশের জেলে সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রেখেছে।

উল্লেখ্য যে, মৎস্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় বিগত কয়েক বছর ইলিশ রক্ষায় চাঁদপুর, বরিশাল সহ প্রধান প্রধান নদ-নদীর কৌশলগত স্থানগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সফল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল। সবার সহযোগিতায় কারেন্ট ও বেহুন্দি জাল বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। সেই সফলতার হাত ধরে আজ সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র ও মাছ রক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

২০১৬ সালে প্রথম আলো বলেছিল, ‘ইলিশ বেড়েছে, রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।’ আর আজ আমরা একই সুরে বলতে চাই ‘সাগরের মাছ বেড়েছে, রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরও’। এ বিষয়ে নানামুখী উদ্যোগ এখনই নিতে হবে। বহুমুখী প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে সাগরের মাছ বিদেশেও রপ্তানি করার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন ৬০ থেকে ৬৫ হাজার নৌকায় সাগরে মাছ ধরা হচ্ছে। ৬ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাগর থেকে বছরে ১৩ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা সম্ভব।

জেলেদের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ইকোফিশ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা মডেল ভিলেজ করেছি। সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য নিরাপদ খাবার পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানা নির্মাণ ও গরু-ছাগল দেওয়া হয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য গঠন করা হয়েছে তহবিল- এতে তারা স্বাবলম্বী হয়েছে। আসুন আমরা সবাই মিলে সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদ রক্ষা করি এবং জেলে সম্প্রদায়ের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখি।

সৈয়দ আরিফ আজাদ

সৈয়দ আরিফ আজাদ

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম সমুদ্রে মৎস্য জরিপ হয়। বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে মি. ওয়েস্ট এ জরিপ করেন। তিনি সমুদ্র থেকে কী পরিমাণ মাছ আহরণ করা যাবে, তার একটা সুপারিশ করেন। সেখানে তিনি বলেছেন, তলদেশীয় মাছ (ডেমার্সাল ফিশ) আহরণ করা যাবে ২ লাখ ৬৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে ৩ লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন। চিংড়ি আহরণ করা যাবে ৯০ হাজার মেট্রিক টন। এরপর ড. পেন ১৯৮৩ সালে আরেকটা জরিপ করেন। এ জরিপ অনুযায়ী তলদেশীয় মাছ আহরণ করা যাবে ২ লাখ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। পনির ওপরের স্তরের (পেলাজিক) মাছ আহরণ করা যাবে ১ লাখ ৬০ হাজার টন থেকে ২ লাখ টন। এটা হলো জরিপের প্রতিবেদনের সুপারিশ।

আবার আশির দশকে করিম কমিটি নামে একটা কমিটি হয়েছিল। তারা সুপারিশ করেছিল, যদি সহনশীল মাত্রায় মেরিন ফিশ আহরণ করতে হয়, তাহলে ৭৫টি ট্রলারের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ফিশিং করছে ২৫৫টি ট্রলার। বোট আছে প্রায় ৬৭ হাজার।

গত বছরের হিসাবমতে, সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৭ মেট্রিক টন। অথচ তলদেশীয় এবং পানির ওপরের স্তরের মোট মাছের যে জরিপ হিসাব ছিল, সে অনুযায়ী আহরণ করার কথা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টন। চিংড়ি আহরণ করা হয়েছে ৪৮ হাজার মেট্রিক টন। চিংড়ি আহরণ এখনো রেঞ্জের মধ্যে আছে। মৎস্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে করা হচ্ছে, সেটা একটা বড় বিষয়।

সমুদ্রের ৪০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত ট্রলারে মাছ ধরা নিষেধ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অধিকাংশ ট্রলার ৪০ মিটারের মধ্যে মাছ ধরে। পনির ওপরের স্তরের মাছের অবদান অনেক বেশি। এটা প্রায় ৮৭ শতাংশ। ইঞ্জিন ও ইঞ্জিনছাড়া দুই ধরনের জলযানই এই মাছ আহরণ করে।

বাংলাদেশের সমস্যা হলো যেখানে বেশি বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে সেখানে সেটা করা হয় না। একটা ডিজিটালাইজড সিস্টেম অব মনিটরিং, কন্ট্রোল অ্যান্ড সার্ভিলেন্স চালু করার চেষ্টা করেছি। চিটাগংয়ে একটা সার্ভার বসানো হয়েছে। সেখানে ভেসেল ট্রাকিং, মনিটরিং ও সার্ভিলেন্স পদ্ধতি চালু করেছি ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে। এটাকে কার্যকর করা না গেলে ২৫৫টা ট্রলারকে মনিটর করা যাবে না। ট্রলারগুলোয় যদি প্রয়োজনীয় ডিভাইস বসানো না থাকে, তাহলে তেমন কিছুই করা সম্ভব হবে না।

টুনাজাতীয় মাছ আহরণের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে
সৈয়দ আরিফ আজাদ

বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক অর্থনীতির কথা আলোচনা করতে গেলে ইলিশ মাছের আলোচনা করতে হবে। চিংড়ি চাষের আলোচনা করতে হবে। ইলিশ উৎপাদনে আমরা একটা ভালো অবস্থানে আছি। এর বেশির ভাগ ভূমিকা মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। ইকোফিশের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। সমুদ্র থেকে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রায় মাছ আহরণ করতে হবে (ম্যাক্সিমাম সাসটেইনেবল ইল্ড)। কোন পয়েন্টে মজুত কেমন আছে, কোন জায়গায় ফাইটোপ্লাংটন (মাছের খাবার) বেশি, এসব গবেষণা ওয়ার্ল্ডফিশ করেছে। ওয়ার্ল্ডফিশ একটা পথনির্দেশ দিয়েছে। তাদের জন্যই বরিশালে ৬ নম্বর মৎস্য সংরক্ষিত এলাকা (অভয়াশ্রম) করতে পেরেছি।

আমরা চিংড়িতে ভালো অবস্থায় নেই। উৎপাদন খুব কম। ভ্যালু চেইনটা খুব সুখপ্রদ নয়। বাংলাদেশে আড়াই ফুট পানিতে চিংড়ি চাষ হয়। চিংড়ির আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। সে জন্য এর রপ্তানিও বাড়ছে না। ফিশারিজের অন্যতম রক্ষাকবচ হচ্ছে সুন্দরবন। সুন্দরবন হলো বড় ইকোসিস্টেম। সুন্দরবনে অতিরিক্ত মাছ ধরা হচ্ছে। যেসব জাল দিয়ে মাছ ধরার কথা নয়, সেগুলো দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে। এখানে যৌথ ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার।

মেরিন ও সুন্দরবন ব্যবস্থাপনায় আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। সরকারের একটা ভালো সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নতুন করে ফিশিং ট্রলারের কোনো লাইসেন্স দিচ্ছে না। টুনাজাতীয় মাছ আহরণের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জাতীয় মাছ হাইলি মাইগ্রেট করে। ২০১৮ সালে টুনাজাতীয় মাছ আহরণের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব মৎস্য অধিদপ্তর থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছিল। আজও এর কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না করতে পারলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।

ইশাম ইয়সিন মোহাম্মদ

ইশাম ইয়সিন মোহাম্মদ

আমি মনে করি, এটা একটা ভালো প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আমার ভাবনা প্রকাশ করতে পারব। আজকের আলোচকদের কাছ থেকে অনেক বিষয় জানতে পেরেছি। আজ আমি ওয়ার্ল্ডফিশ অফিসে আমার চিন্তা শেয়ার করেছি। জলবায়ু পরিবর্তন জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এটা পানির স্তরের ওপরও প্রভাব ফেলছে। আমরা দেখছি, দিন দিন তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রের পানির স্তর বাড়ছে। এখন জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় ইস্যু। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করা আজ একটি বড় প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাচ্ছে। প্রাণীর স্থানান্তরপ্রক্রিয়া আগের থেকে বেশি হচ্ছে। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত, সেসব দেশ মৎস্য ও অন্যান্য প্রাণীর ভবিষ্যতে ‍ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এই অঞ্চলের মৎস্য ও প্রাণীর মাইগ্রেশন বেশি হবে। কারণ, এসব দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অন্যান্য দেশ থেকে বেশি। বিশেষ করে সাগরে যে জীববৈচিত্র্য রয়েছে, তার পরিবর্তন হবে। বাংলাদেশও এ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।

জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করা আজ একটি বড় প্রশ্ন
ইশাম ইয়সিন মোহাম্মদ

বাংলাদেশের মানুষ মাছ পছন্দ করে। এ দেশে একটা জেলে সম্প্রদায় আছে। তারা মাছ ধরে ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের জীবন-জীবিকাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। এটা ধীরে ধীরে মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যপ্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। সবাই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনে একটা বড় ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এখন বঙ্গোপসাগরের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন। এ ছাড়া সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ। নদী-নালা, শিল্পের বর্জ্যসহ বিভিন্নভাবে দূষণ, সমুদ্র উপকূলে মানুষের বসবাস এবং তাদের জীবনপদ্ধতি—এ সবকিছু সাগরের জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এসব বিষয়ে এখন থেকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে।

নিয়ামুল নাসের

নিয়ামুল নাসের

নদ-নদীর একটা স্বাভাবিক অবস্থা আছে। এর একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। এটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে এর ওপর নির্ভরশীল প্রাণীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া নদীনির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সমস্যা তৈরি হবে। ইলিশের ওপর কাজের অভিজ্ঞতা আছে। ভারতের ভাগীরথী নদী দিয়ে পানি বের হয়। বাংলাদেশের মেঘনা নদী দিয়ে পানি বের হয়। এই দুই নদীর পানির মানে পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে যখন মাছ মাইগ্রেশন করে, তখন তারা মেঘনা নদীকে বেছে নেয়। ভারত বিভিন্ন উৎস থেকে মাছ পায়। তারা আরব সাগর থেকেও মাছ পায়। আমাদের নদ-নদী নষ্ট হলে আমরা সংকটে পড়ে যাব।

আমাদের দেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষিকাজে অনেক কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। এসব রাসায়নিক নদীতে আসে। এটা মাছের শরীরেও এসে যায়। পুকুরে যে মাছ চাষ করা হয়, এ মাছের আসল উৎস হলো নদী। নদীগুলো এখন খুব একটা ভালো নেই। আমাদের অনেক বিল নার্সারি গ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে। সুন্দরবন নার্সারি গ্রাউন্ড হিসেবে কাজ করে। এসব জায়গা নষ্ট করা যাবে না। আলোচনায় এসেছে, ইলিশ বেশি উৎপাদিত হচ্ছে। এটাতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। আমরা যদি সচেতন না হই, যত্ন না নিই, তাহলে ভবিষ্যতে এটা কমে যেতে পারে। ইলিশের ছয়টা সংরক্ষিত এলাকা আছে। এখানে যেন মাছের আসা–যাওয়া, প্রজনন নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সমুদ্রে যাওয়া-আসার পথে তাদের ধরে ফেলছে কি না, এ বিষয়গুলো ঠিকভাবে তদারক করা প্রয়োজন। শুধু জাটকা নয়, কম বয়সী কোনো মাছই ধরা যাবে না। এদের সংরক্ষণ করতে হবে। তাহলে আমাদের নদীগুলো মাছে ভরে যাবে।

পুকুরে যে মাছ চাষ করা হয়, এ মাছের আসল উৎস হলো নদী
নিয়ামুল নাসের

আমরা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) থেকে একটা গবেষণা করেছি। এটা ভারত গ্রহণ করে সুফল পাচ্ছে। ভারতের হুগলী নদীর পানি এখন আগের থেকে ভালো। এ জন্য বঙ্গোপসাগরের কিছু ইলিশ এখন ওদের নদীতে যাচ্ছে। আমাদের ওপর ভারতের ইলিশের নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে। সমুদ্রের মাছের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। দূষণসহ কোনো কারণে যদি একবার সমুদ্রের মাছ চলে যায়, তাহলে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাব।

তাই সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

রকিবুল আমিন

রকিবুল আমিন

সমুদ্র সংরক্ষণে বাংলাদেশের কিছু লক্ষ্য আছে। এর মধ্যে একটি হলো: ১০ ভাগ সমুদ্র সংরক্ষণের ঘোষণা করতে হবে। মৎস্যসম্পদ, মৎস্য উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, ব্লু ইকোনমি—সব মিলিয়ে সাগরে একটা বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। মাছ একটা পণ্য। এই পণ্যের কারখানা হলো সাগর। কারখানা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে পণ্য উৎপাদিত হবে না। সমুদ্র আমাদের একটি বিশাল সম্পদের জায়গা। এর ইকোসিস্টেম যেন বজায় থাকে। ইকোসিস্টেম বজায় থাকার একটা মাধ্যম হচ্ছে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া।

আইইউসিএন থেকে ছয় ধরনের সংরক্ষিত এলাকার কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে নিঝুম দ্বীপকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি যেন শুধু ঘোষণার মধ্যে না থাকে, নিঝুম দ্বীপ যেন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে কার্যকর হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের একটি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা আছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এটি পর্যালোচনা করছে। এর পেছনে ওয়ার্ল্ড ফিস, আইইউসিএন, ডব্লিউসিএন, মৎস্য অধিদপ্তরসহ দেশের বরেণ্য বিজ্ঞানীরা আছেন। নিঝুম দ্বীপকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বন অধিদপ্তর সেন্টমার্টিন এলাকা ঘিরে আরেকটি সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার চেষ্টা করছে। আমাদের আইনে এখনো মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া বলা নেই, বলা আছে মেরিন রিজার্ভ। আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। এরপর আমরা মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া বলতে পারব।

নিঝুম দ্বীপ যেন সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে কার্যকর হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে
রকিবুল আমিন

সংরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনার জন্য সমন্বয় দরকার। এটা শুধু মৎস্য অধিদপ্তরের একার কাজ নয়। এখানে মৎস্য ও বন অধিদপ্তর, কোস্টগার্ড ও নেভির সমন্বয় একটি ব্যবস্থা পর্ষদ করা দরকার। এখানে নেভির সহযোগিতা লাগবেই। কারণ, গভীর সমুদ্রে গিয়ে আইন প্রয়োগ করার মতো সক্ষমতা দুই অধিদপ্তরের কারও নেই। নিঝুম দ্বীপে অনেক মানুষ বাস করে। তাদের জীবিকার কথা ভুলে গেলে চলবে না। একটা মেরিন স্পেশাল প্ল্যানিং হবে অর্থাৎ কোন জায়গায় মাছ ধরা যাবে, কোথায় ইকো ট্যুরিজম হবে ই্যত্যদি। সংরক্ষিত এলাকার কিছু উদ্দেশ্য থাকে। একটা উদ্দেশ্য হলো ইলিশ মাছের বংশবৃদ্ধি। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো তিমি, ডলফিনসহ জলজ প্রাণীকে রক্ষা করা। এখানে শুধু বাংলাদেশকে একা কাজ করলে হবে না, সমুদ্রসংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।

মুকিত মজুমদার বাবু

মুকিত মজুমদার বাবু

সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখা যতই কঠিন হোক, আমাদের সেটা করতে হবে। অনেক দেশ তাদের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের অসাবধানতার জন্য, অতিরিক্ত আহরণের হন্য। বিশ্বের প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। সমুদ্র ৫০ শতাংশ অক্সিজেন দিচ্ছে। ১০ গিগা টন কার্বন শুষে নিচ্ছে। এই সমুদ্র নিয়ে আমরা তেমন সজাগ নই, বিশেষ করে বাংলাদেশের কথা যদি বলি। সারা পৃথিবীতে সমুদ্র নিয়ে সমস্যা আছে। কিন্তু আমাদের এখানে অতিরিক্ত সমস্যা। আমাদের সমুদ্রের ব্যবস্থাপনা কী হবে, সেটা পরিষ্কার নয়। যেসব আইন আছে, তার সঠিক প্রয়োগ নেই।

আমরা ব্লু ইকোনমির কথা বলছি, সমুদ্র বিজয়ের কথা বলছি, কিন্তু সমুদ্র রক্ষা করার কথা, সঠিক সমুদ্র ব্যবস্থাপনার কথা বলছি না। সমুদ্রের সম্পদ কীভাবে সুষ্ঠুভাবে আহরণ করব, তার কোনো সরকারি পরিকল্পনা আমরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না।

সমুদ্রে মৎস্য আহরণের সময় কাছিম উঠছে, হাঙ্গর উঠছে। একটা হাঙ্গর ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে। অলিভ রিডলি (জলপাইরঙা) কাছিমও জালে ওঠে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত, সেগুলো তারা ছেড়ে দেয়, কারণ এগুলোর তেমন বাজারমূল্য নাই।

আমাদের সমুদ্রে যে ধরনের ব্যবস্থাপনা চলছে, আমাদের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র এক সময় হারিয়ে যেতে পারে। আমাদের অবস্থা কি থাইল্যান্ডের মতো হবে? থাইল্যান্ডের সমুদ্রে এখন আর কোনো মাছ পাওয়া যায় না। তাদের সম্পূর্ণভাবে চাষ করা মাছের ওপর নির্ভর করতে হয়।

সমুদ্র ৫০ শতাংশ অক্সিজেন দিচ্ছে। ১০ গিগাটন কার্বন শুষে নিচ্ছে
মুকিত মজুমদার বাবু

আমাদের এত বড় সমুদ্র, সেখানে যে সম্পদ আমরা পেয়েছি, তা রক্ষা করতে হবে। আমি নিজের চোখে তিমি দেখেছি, ডলফিন দেখেছি, আমি নিজেই ক্যামেরা দিয়ে শুট করেছি। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের সমুদ্র জীববৈচিত্রে ভরপুর। এই সম্পদকে আমরা যদি সুষ্ঠুভাবে রক্ষা না করতে পারি, আমাদের সমুদ্রও জীববৈচিত্রশূন্য হয়ে যাবে। বড় বড় প্রাণী ও মাছ শূন্য হয়ে যাবে।

আমরা সমুদ্রকে রক্ষা করতে চাই। সেজন্য এটার একটা ভালো ব্যবস্থাপনা চাই। প্লাস্টিকের বর্জের বিষয়ে সচেতেন হতে হবে। অতিরিক্ত আহরণের বিষয়ে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। যেভাবে আহরণ হচ্ছে, সেই ব্যবস্থাপনাটাও পরিবর্তন করতে হবে। শুধু মাছ নয়, মাছের পাশাপাশি অনেক সম্পদ রয়েছে সমুদ্রে। সামুদ্রিক সম্পদকে যদি রক্ষা করতে হয়, আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ যেমন গোলটেবিল আলোচনা হচ্ছে, এমন আলোচনা আরও বেশি করে হওয়া প্রয়োজন।

আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ক্ষমতা আছে, তার সাথে কিছু মমতা নিয়ে কাজ করতে হবে। এ দেশকে ভালো রাখার জন্য, এ দেশের সম্পদকে ভালো রাখার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

এনামুল হক

এনামুল হক

সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি নিয়ে আমাদের অনেক গবেষণা করতে হবে। এর পেছনে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। সরকার সামুদ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নে অনেকগুলো প্রকল্প নিয়েছে। মেরিন সেক্টরে আমাদের গবেষেণা, বিনিয়োগ—দুটোই কম। আমাদের সক্ষম লোকবলের অভাব রয়েছে। ২০১৬ সালে মৎস্য অধিদপ্তর একটা জরিপ জাহাজ এনেছে। এটা দিয়ে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তারা প্রায় ২২ বার ৭ থেকে ১০ দিন করে সাগরে অবস্থান করে মাছের মজুত নির্ণয়ে চেষ্টা করেছে।

সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত যে সব মাছ আহরণ করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে লাক্ষ্যা, সার্ডিন, পোয়া, চান্দা, হরিণা চিংড়ি ইত্যাদি। এসব মাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো মেরিন ফিশ প্ল্যানিং, যেটি ২০১৫ সালে শুরু হয়েছে। মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা আছে। এতে মাছের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

একসময় সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন কমেছিল, এখন সেটা বাড়ছে
এনামুল হক

একসময় সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন কমেছিল। এখন সেটা বাড়ছে। সামুদ্রিক মাছ কালচার নিয়ে আমাদের গবেষণা করতে হবে। আমাদের দুটো জনপ্রিয় মাছ হলো ভেটকি ও মুলেট। এ দুটো মাছকে মেরি কালচারে (সমুদ্রের মধ্যে বড় খাঁচা করে চাষ) সংযোজন করা যায় কি না দেখতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে সি–উড একটা শিল্প হিসেবে পরিগণিত। এশিয়াতে কোরিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চায়না ইত্যাদি দেশে সি–উড শিল্প আছে। আমাদের সমুদ্রেও সি–উড পাওয়া যায়। এটার ব্যবহার আগে জানতাম না। গবেষণার মাধ্যমে সি–উড কালচারের উন্নয়ন করেছি। মৎস্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই সি–উড কালচারে এগিয়ে আসছে। সি–উডের একটা শিল্পমূল্য রয়েছে। আবার মৎস্যজীবীদের কল্যাণে কাজ করতে পারে। পেলাজিক, ডেমার্সেল, শার্ক, শাপলাপাতা মাছ, শ্রিম্প কী পরিমাণ আছে, আমরা জানি না। আমাদের মজুত কী আছে, কয়েক দশক এর মূল্যায়ন হয় না। অবশ্যই মজুতের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তাহলে বুঝতে পারব, কী পরিমাণ মাছ আমাদের আছে, আর কী পরিমাণ ধরতে পারব। আমার কথা হলো সরকার এসব বিষয়ে ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এম এ সাত্তার মন্ডল

সমুদ্র নদী-নালা, সবমিলে আমাদের বিশাল মৎস্য সম্পদ আছে। এর ওপর নির্ভর করছে অনেক মানুষের জীবিকা। উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকার বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। তাঁদের একটি বাস্তবধর্মী কার্যকর পরিকল্পনায় আনতে হবে।

আজ মাছ উৎপাদনের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সমুদ্র নিয়ে দেশে ও বৈশ্বিক পরিসরে অনেক আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় বিনিয়োগের বিষয়টি আসে না। সরকারের দলিলপত্রেও বিনিয়োগের কথা তেমন বলা হয়নি। কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্য উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সরকারের পাশাপাশি আমাদের দেশে উদীয়মান বেসরকারি খাত আছে। এরা বিদেশেও বিনিয়োগ করছে। নীতি সহায়তা দিয়ে তাদের সম্পদ এ দেশে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা দরকার। আগামী ৫ বা ১০ বছরের জন্য সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের জন্য একটা কার্যকর পরিকল্পনা করতে হবে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করে যেতে হবে। আজ একটা একাডেমিক আলোচনা হলো। এখান থেকে আরেকটু সামনে গিয়ে তথ্যভিত্তিক পলিসি ডিবেট করতে হবে। এ বিতর্কে বিজ্ঞানী, পরিকল্পনাবিদ, নীতি প্রণয়নকারী ও বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করবেন। এভাবে আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে একটা কার্যকর বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও ক্ষেত্র তৈরি হবে।

মো. আব্দুল ওহাব

বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর একটি অন্যতম পুষ্টিসমৃদ্ধ জলাভূমি। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, হিমালয় থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার চীন, তিব্বত মালভূমি হয়ে এই বিশাল ভূবন প্লাবিত করে পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়েছে বঙ্গোপসাগর। আমরা যদি পরিবেশ ভালো রাখি, তাহলে বঙ্গোপসাগর হবে মাছের খনি। শুধু মাছ নয়, জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ, মেগাফোনাসহ বিভিন্ন জীবের আবাসস্থল এই বঙ্গোপসাগর। এদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

শুশুক, শার্ক এবং অন্যান্য মেগাফোনাকে রক্ষা করতে হবে। এসডিজি ২-এ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে মাছ হতে পারে অন্যতম খাদ্য উপাদান । আমদের সবাইকে পরিমাণমতো মাছ খেতে হবে। আবার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ স্বাদু পানির মলা, ঢেলার মতো সাগরেও প্রায় ৪০ প্রজাতির ছোট পেলাজিক মাছ রয়েছে যে গুলোর সুষ্ঠু আহরণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

ফিরোজ চৌধুরী

আমরা ইলিশের যত্ন নিয়েছি। ইলিশ এখন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদে পরিণত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড ফিশ এবং সরকারের নীতি–নির্ধারকদের অবদান রয়েছে। সমুদ্রকেন্দ্রিক মৎস্যসম্পদের পাশাপাশি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। সমুদ্র উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের কল্যাণে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।