স্কুল খুলতে চাই নিরাপদ পরিবেশ

ইউনিসেফ এই সংলাপের আয়োজন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে সংক্রমণ রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন বক্তারা।

মহিবুল হাসান চৌধুরী, রাশেদা কে চৌধূরী, মোমিনুর রশিদ আমিন, সৈয়দ গোলাম ফারুক

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সাত মাসের বেশি সময় ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে শিক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়া কমানো, ভর্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব অর্জন হয়েছিল; দীর্ঘ বন্ধের কারণে সেগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে স্কুল খোলা দরকার। আবার করোনার সংক্রমণের বাস্তবতাও আছে। তাই স্কুল খোলার আগে অবশ্যই ভেবেচিন্তে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে পরিবেশ নিরাপদ করতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ইউনিসেফের উদ্যোগে আয়োজিত ‘নিরাপদে স্কুল খোলা: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। এই সংলাপে সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশের অনেকগুলো অর্জন হুমকির সম্মুখীন। গত ১১ বছরের অনেক অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শিক্ষার প্রসারের কারণে বাল্যবিবাহ কমানোসহ নারীর উন্নয়ন হয়েছে। এসব অর্জন যাতে ধূলিসাৎ না হয়, সে জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা নিতে হবে।

সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে করোনাভাইরাসের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ মেনে চলছে বলে জানান উপমন্ত্রী। তিনি বলেন, অংশীজনদের মতামতসহ বাস্তবতা মেনে আংশিকভাবে হলেও বিদ্যালয় খোলার পথে হাঁটতে হবে। তবে যাদের জন্য এই ঝুঁকির কথা ভাবা হচ্ছে তারা (শিক্ষার্থীরা) দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এ জন্য সবচেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে এবং তা শুরু করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই।

ইউনিসেফের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ইউনিসেফ যেসব প্রস্তাব দেবে, সেটি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ভেবেচিন্তে এবং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে স্কুল খুলতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সবার কথা বিবেচনায় রেখেই ঝুঁকি প্রশমন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। এ জন্য স্কুলগুলোকে সেভাবে প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তথ্য-উপাত্ত ঠিকভাবে সংগ্রহ করা। কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে বা পিছিয়ে আছে, সেগুলো জানা জরুরি।

সরকারের কাছে অনুরোধ রেখে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, পুনরায় স্কুল খোলার সময় উৎসব করা দরকার। যেন সবার কাছে এই বার্তা যায় যে স্কুলগুলো প্রস্তুত। সবাই যাতে আস্থা ফিরে পায়, সে রকম বার্তা দিতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদ আমিন বলেন, স্কুলের বিকল্প বাড়ি হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকল্প অনলাইনও নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেবল পড়াশোনাই হয় না, সহ–শিক্ষা কার্যক্রম এবং শেয়ারিং-কেয়ারিংয়ের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু মহামারির কারণে এটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বন্ধ রাখতে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

স্কুল খোলার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করে মোমিনুর রশিদ আমিন বলেন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার কথা ভাবতে হবে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, এখন যে শিক্ষকদের প্রয়োজন, তাঁরাই কেবল স্কুলে যাচ্ছেন। তাঁরা ল্যাবগুলো ঠিক আছে কি না এবং প্রতিষ্ঠানের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি তদারকি করছেন। স্কুল খোলার সময় কী করতে হবে এবং কীভাবে সেগুলো মানা হবে, তার পরিকল্পনা এখন শেষ পর্যায়ে আছে বলে জানান মহাপরিচালক।

অনুষ্ঠানের শুরুতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইউনিসেফের তৈরি করা একটি ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। তাতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়ার আগ্রহের কথা বলেছে।

ভার্চ্যুয়াল সংলাপে এ দেশে ইউনিসেফের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ কেনেথ এ রাসেল শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ওপর করোনার প্রভাবের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, করোনাকালের দীর্ঘ বন্ধের কারণে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, ঝরে পড়া বাড়তে পারে। এ ছাড়া শেখার ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে।

এ সমস্যাটি বিশ্বব্যাপী বলে উল্লেখ করে কেনেথ এ রাসেল বলেন, বিশ্বে এখন ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে। পড়াশোনার মধ্যে আছে ৪১ শতাংশ।

জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির পরিচালক ইউসুফ আলী বলেন, কোভিড-১৯ (করোনা) পরিস্থিতির কারণে অনেকে শহর থেকে গ্রামে চলে গেছেন। আবার যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে, তখন অনেকে আগের জায়গায় ফিরে আসবে। ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা আছে। তাই সক্ষমতা ও পরিচালনার কথা বিবেচনা রেখেই খোলার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

বাল্যবিবাহ বন্ধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন শাখার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সামিয়া আহমেদ।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওয়াশ প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ মেহজাবিন আহমেদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আলাদা শৌচাগার, হাত ধোয়া ও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বিষয়ে দুর্গম এলাকার কথা বেশি করে ভাবতে হবে।

করোনার কারণে শিশুদের ওপর প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে ইউনিসেফের শিক্ষা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহসীন বলেন, শিশুদের ‘আর্লি লার্নিং ক্যাপাসিটি’ (প্রারম্ভিক শিখনযোগ্যতা) যথাযথ না হলে তা সারা জীবনে পূরণ হওয়ার নয়। পুনরায় স্কুল খোলার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে স্কুল চালু করলেও অনলাইনে পড়াশোনার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। এমনও হতে পারে যে সপ্তাহে তিন দিন সশরীর এবং তিন অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হলো।