আড়ংয়ের চার দশক

সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘চালশে’ গানের শেষ পঙ্ক্তিটা অনুরণিত হচ্ছে: ‘আজ কে যে শিস দিয়ে গান গায়/যেন গান গেয়ে ওঠে কাল সে/ চোখ থেকে খুলে নিয়ে চশমা/ মন থেকে মুছে দিয়ে চালশে/ কাল সে।’
১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৮। অসীমে দৃষ্টি রেখে যে বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ মহিরুহ। সূচনার দিন যাঁরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন এই অনন্য অভিযাত্রায়, তাঁদের অনেকে আজও সমান উৎসাহে যুক্ত থেকে গিয়েছেন ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠা দেশের সর্ববৃহৎ ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ডের সঙ্গে। সেসব কুশীলব সময়ান্তরে জ্যেষ্ঠ নাগরিক হয়েছেন বটে, ঘটেছে তাঁদের প্রজন্মান্তর কিন্তু চালশে ভর করেনি। বরং বলতেই হয়: চোখ থেকে খুলে নিয়ে চশমা, মন থেকে চালশে বিদায় করে তাঁরা মুখর হচ্ছেন সাফল্যের জয়গানে। শামিল হয়েছেন চল্লিশের উদ্যাপনে।
দেশীয় কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে, দেশের আদি, অকৃত্রিম হস্ত ও কারুশিল্পের পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়ে কারুশিল্পীদের জীবনমানের উন্নয়নই ছিল মূল লক্ষ্য। সেই অঙ্গীকারে সূচনার পর একের পর এক মাইলফলক পার করে আড়ং উপস্থিত সাফল্যোজ্জ্বল বর্তমানে। দীর্ঘ চার দশক সময়ে অসংখ্য অসহায় মানুষ পেয়েছেন নতুন জীবনের সন্ধান। দেশের নানা প্রান্তে তৈরি হয়েছে অনিঃশেষ কর্মসংস্থান। আর প্রান্তিক কারুশিল্পী, কলাকুশলী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তৈরি হয়েছে সম্পর্কের অমলিন মেলবন্ধন। আড়ং আজ তাই কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বেই এক বিস্ময়; অনুসরণীয় উদাহরণ।

তখনো আড়ংয়ের জন্ম হয়নি। তারও আগে থেকে মানিকগঞ্জ ও জামালপুরে নিজেদের কারুশিল্পীদের তৈরি পণ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করত ব্র্যাক। পরে সিদ্ধান্ত হয় একটি দোকান পরিচালনা করার। এই উদ্যোগের নেপথ্যে ছিলেন ব্র্যাকের চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। এই প্রকল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৭৭ সালে ব্র্যাকের সঙ্গে এমসিসির চুক্তি হয়। যৌথভাবে এক বছর ওই কারুপণ্য বিপণি পরিচালিত হয়। পরের বছরের (১৯৭৮) ১৮ ডিসেম্বরে পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আড়ং। আড়ং নামটি দিয়েছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদের চাচি ফরিদা হাসান। ডিজাইন অফিস তখনো ছিল ঢাকার মগবাজারে, আড়ংয়ের বর্তমান শাখার পেছনের একটি বাড়িতে। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিল আড়ংয়ের কার্যালয়। তখন ডিজাইনার ছিলেন তিনজন। ১৯৮৩ সালে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয় একযোগে। মগবাজারে আড়ং শাখা খোলে। মানিকগঞ্জে শুরু করে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম। আর অফিস মগবাজার থেকে নিয়ে আসে সোবহানবাগে, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেনের বাড়িতে। দোতলা ভবন। এখানেও একটা শাখা খোলা হয়। নিচে দোকান, ওপরে অফিস। সঙ্গে গ্যারেজে টেইলারিং বিভাগ।
কলেবর বাড়ায় ১৯৮৫ সালে পাশের বাড়িটিও নেওয়া হয়। এটা ছিল তোবারক হোসেনের একজন আত্মীয়ের বাড়ি। এই বাড়ির দোতলায় মাননিয়ন্ত্রণ শাখা খোলা হয়। নিচে ডিজাইন স্টুডিও। তবে আড়ংয়ের পরিসর ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ১৯৮৮ সালে সোবহানবাগ থেকে অফিস চলে যায় শ্যামলীতে। তারপর আরও কিছুদিন আড়ং নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় নেয়। সাত বছর পর আবার ঠাঁইনাড়া হয় আড়ংয়ের অফিস। ১৯৯৬ সালে স্থানান্তরিত হয় মহাখালীর আড়ং ভবনে। এরপর সেখান থেকে তেজগাঁওয়ের আড়ং সেন্টারে আসে ২০০৮ সালে।
১৯৮৮ সালে সোবহানবাগ থেকে অফিস শ্যামলীতে যাওয়ার আগের বছর দোকানও সরিয়ে ফেলা হয়। চলে আসে লালমাটিয়ার আদেল প্লাজায়। সেটা জুলাই ১৯৮৭। এই সময়ের মধ্যে শাখার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২১। এর মধ্যে ১৩টি ঢাকায়। ঢাকার বাইরে আড়ংয়ের উপস্থিতি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও খুলনায়। আগামী বছর এই কাফেলায় যোগ হবে আরও দুটি। ঢাকায় আরও একটি এবং অন্যটি ঢাকার বাইরে।
নিরন্তর উৎকর্ষের ধারায় ভোক্তাকে আকর্ষণ ও মানসম্পন্ন পণ্য উপহার দিতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন প্রোডাক্ট লাইন। এমনকি বিভিন্ন সহ-ব্র্যান্ড যোগ করে মাত্রা দেওয়ার প্রয়াসও দেখা যায়। তাই তো তাগা থেকে হারস্টোরি হয়ে তাগা ম্যান—সহ–ব্র্যান্ডের তালিকা বাড়ছেদিনে দিনে আড়ংয়ের উৎপাদন কেন্দ্রও বেড়েছে। মানিকগঞ্জের পর পর্যায়ক্রমে জামালপুর, যশোর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জের বানিয়াচং, গড়পাড়া, পাবনা, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৪টি উৎপাদন কেন্দ্র, ৬টি উৎপাদন–সহায়ক কেন্দ্র এবং ৭০৪টি উপকেন্দ্র। বর্তমানে ফাউন্ডেশনের স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ৭০০। ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আরও সংশ্লিষ্ট আছেন ২০ হাজারের বেশি নারী। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন ছাড়া আড়ংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন অন্তত ৬৫ হাজার স্বাধীন হস্তশিল্পী। তাঁরাও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র। তাঁতজাত পণ্য, মৃৎসামগ্রী, গয়না, বাঁশ ও বেতজাত পণ্য, কাগজজাত পণ্য, কাঠের তৈরি পণ্য, মোমবাতি, ধাতবপণ্য ইত্যাদির বড় অংশই আসে স্বাধীন উদ্যোক্তার কাছ থেকে।
আড়ংয়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে এই হস্তশিল্পীদের সক্রিয় অবদান। আড়ং ডিজাইন স্টুডিও থেকে ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে আসা নকশা অনুযায়ী নমুনা তৈরি করে পাঠানো হয় আড়ংয়ে। নমুনা অনুমোদনের পর বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মীদের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করা হয়। তারপর শুরু হয় উৎপাদনের মূল কাজ।
আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের অধীনে যেসব কর্মী কাজ করছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশই নারী। সংশ্লিষ্ট হস্তশিল্পীরা জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি আড়ং থেকে পাচ্ছেন চিকিৎসা, স্বল্পমেয়াদি ঋণ, প্রশিক্ষণ, পরিবহন ইত্যাদি নানা রকম বাড়তি সেবা ও সুবিধা।
বাংলাদেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে একই সুতোয় গেঁথে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে উপস্থাপনের প্রয়াস অব্যাহত রেখে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। আড়ংয়ের কল্যাণে নকশিকাঁথার মতো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প এখন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।
এত দিন আড়ং কেবল হয়েছে ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড। কারণ, ফ্যাশন পণ্যের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত জীবনযাপনের দৃষ্টিনন্দন সব পণ্য আড়ংয়ের সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে। নিরন্তর উৎকর্ষের ধারায় ভোক্তাকে আকর্ষণ ও মানসম্পন্ন পণ্য উপহার দিতে যোগ হয়েছে নতুন নতুন প্রোডাক্ট লাইন। এমনকি বিভিন্ন সহ-ব্র্যান্ড যোগ করে মাত্রা দেওয়ার প্রয়াসও দেখা যায়। তাই তো তাগা থেকে হারস্টোরি হয়ে তাগা ম্যান—সহ–ব্র্যান্ডের তালিকা বাড়ছে। সমকালীন থাকার অভিলাষে আড়ং যুক্ত করছে আরও একটি উজ্জ্বল পালক। অচিরেই আড়ং আনতে যাচ্ছে সৌন্দর্যচর্চার পণ্য। বলা যেতে পারে, চল্লিশে এসে নতুন উদ্যমে আড়ং পৌঁছাবে সম্মানিত গুণগ্রাহী ও ভোক্তার কাছে। কেবল দেশের নয়, বিদেশের ক্রেতাদের টানতে অনলাইনভিত্তিক কেনাকাটার জায়গাকে আরও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এর সুফল অচিরেই পাবেন আড়ংয়ের ভোক্তারা।
শেখ সাইফুর রহমান : ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল কলামিস্ট এবং এটিএন নিউজের বার্তা সম্পাদক