উপাচার্যের চেয়ার যেখানে নড়বড়ে

দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে কারা নিয়োগ পান, কীভাবে নিয়োগ পান এবং অতীতে কারা পেয়েছেন—এসব নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ। শেষ পর্ব পড়ুন কাল। প্রতিবেদনগুচ্ছ তৈরি করেছেন শরিফুজ্জামান
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার  l ছবি: প্রথম আলো
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার l ছবি: প্রথম আলো

মেধা, দক্ষতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হওয়ার মাপকাঠি নয়। সেখানে এই শীর্ষ পদে টিকে থাকতে চাইলে প্রথমেই সহকর্মী শিক্ষকদের সামাল দেওয়ার দক্ষতা থাকতে হবে।
রাজনৈতিক-সংশ্লিষ্টতা, আঞ্চলিকতা বা শিক্ষকরাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় কাজে লাগে না। ১৯৯০ সালের পর থেকে বেশির ভাগ সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি অস্থির ছিল উপাচার্য অপসারণ বা নিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বাইরের অধ্যাপককে সেখানে ‘বহিরাগত’ মনে করা হয়। শিক্ষকদের একাংশ ছাড়াও সরকারি ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করা হয় উপাচার্য বিতাড়নের জন্য।
প্রায় ৭০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা ছিল চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধের পর সৈয়দ আলী আহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন। শুরুতেই তিনি নতুন বিভাগ খোলা ও শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেন। সেই শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সালাউদ্দিন আহমেদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আই চৌধুরী, কাজী সালেহ আহমেদ প্রমুখ। তখন স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে ক্যাম্পাসে পরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয়।
শুরুটা ভালো হলেও সাম্প্রতিক সময়ে উপাচার্য নিয়োগ, শিক্ষকরাজনীতি, ছাত্রী নির্যাতন, সরকারি ছাত্রসংগঠনের সহিংসতাসহ বিভিন্ন বেআইনি ও অনৈতিক কাজে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবদান চাপা পড়ে গেছে। এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ১৮ জন উপাচার্যের মধ্যে পাঁচজন আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন।
ছাত্রদলের এক নেতাকে বহিষ্কারের ঘটনায় ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রদলের ক্যাডাররা। এ ঘটনার জের ধরে পদত্যাগ করেন কাজী সালেহ আহমেদ। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কারণে আলাউদ্দিন আহমেদকে অপসারণ করে সরকার। তখনকার সহ-উপাচার্য আবদুল বায়েস পরে উপাচার্য হন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আবদুল বায়েসকে অপসারণ করে। এ প্রসঙ্গে আবদুল বায়েস লিখেছেন, ‘এই অভাগা দেশে সরকার বদলালে উপাচার্য বদলায়। নিয়তির এই পরিহাস মেনে নিয়ে আমি ফিরে এলাম আমার নিজের নীড়ে—অর্থনীতি বিভাগে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ওম শান্তি!’ (উপাচার্য উপাখ্যান, আবদুল বায়েস, বণিক বার্তা, ১৬ অক্টোবর, ২০১৬)
অবশ্য অধ্যাপক বায়েসের কাছ থেকে মধ্যরাতে চেয়ার কেড়ে নিয়ে উপাচার্য জসীমউদ্দিন আহমেদও মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। শিক্ষক আন্দোলনের মুখে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ঘোষণা করেন এবং তাতে হেরে তিনি বিদায় হন।
২০১২ সালে জুবায়ের হত্যার পর বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিকতায় পদত্যাগ করেন শরীফ এনামুল কবির। আন্দোলনের মুখে ও অবরুদ্ধ থেকে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনও ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন। ওই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ লিখেছেন,বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কিছুসংখ্যক শিক্ষক কায়েমি স্বার্থে আন্দোলনে নেমে বারবার হোঁচট খেয়ে এখন হতাশ। ফলে তাঁরা যেভাবে কূপমণ্ডূকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের স্বাভাবিক চিন্তার প্রকাশ নয়।’(দয়া করে আমাদের ভুল বুঝবেন না, প্রথম আলো, ১৪ আগস্ট, ২০১৩)।

গত বছরের ১৩ জানুয়ারি আনোয়ার হোসেন আচার্যকে দেওয়া চিঠিতে লেখেন, ‘উপাচার্যের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সংসদে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশসমূহে প্রয়োজনীয় সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।’

এ প্রসঙ্গে গত রোববার সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল বায়েস লিখেছেন, ‘১৯৭৩ অধ্যাদেশ অধ্যুষিত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দল হচ্ছে সবচেয়ে বড় বল। যার দল যত বড়, শত অনিয়ম করেও তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে। দল ছোট হলে কিংবা দল না থাকলে শত পাণ্ডিত্য ও প্রতিভা নিয়েও পাততাড়ি গুটাতে হয়। এখানে অর্থনীতির সূত্র কাজ করে, গিভ অ্যান্ড টেক, মুনাফার বিনিময়ে সমর্থন বিনিয়োগ।’

এদিকে স্কুলশিক্ষক থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হনবাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ ড. এনামুল হক। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে উপাচার্যের দায়িত্ব নেন তিনি। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা নিয়ে যে সাম্প্রদায়িক হঠকারিতা করেছিল, তিনি তার বিরোধিতা করেন। এনামুল হক পাকিস্তান সরকারের ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি নিয়ে ১৯৬৯ সালে তা বর্জন করেন।

সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও যে উপাচার্য হওয়া যায় না, তার প্রমাণও আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৪ সালে নির্বাচিত উপাচার্য প্যানেলে ছিলেন আখলাকুর রহমান, আবু ইমাম ও আ ফ ম কামালউদ্দিন। কিন্তু এইচ এম এরশাদ পছন্দ করেন তৃতীয় অবস্থানে থাকা কামালউদ্দিনকে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তিনি মারা যান। তাঁর নামে তৈরি হয় কামালউদ্দিন হল।

উপাচার্য কাজী সালেহ আহমেদের সময়ে চারবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৩ সালের পর গত ২২ বছরে আর নির্বাচন হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন ১৭ জন উপাচার্য, যাঁদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং ছাত্র বা শিক্ষক আন্দোলনের কারণে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ১৮তম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফারজানা ইসলাম। তাঁর আগে মুহাম্মদ এনামুল হক, মোহাম্মদ নোমান, আলাউদ্দিন আহমেদ, আবুল হোসেন, মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান ও এম এ মতিন কমবেশি এক বছর উপাচার্য ছিলেন। উপাচার্যদের মধ্যে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী দুই মেয়াদে আট বছর এবং কাজী সালেহ আহমেদ, আমিরুল ইসলাম চৌধুরী ও খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান এক মেয়াদ পূরণ করেন। এ ছাড়া সৈয়দ আলী আহসান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও আলাউদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন উপাচার্যের সততার স্মৃতি রয়েছে।প্রথম উপাচার্য রসায়নবিদ মফিজউদ্দিন আহমদ দায়িত্ব নেওয়ার আগে গুলশানে তাঁর নিজ বাড়ির নির্মাণকাজ চলছিল। প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকতে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে তিনি নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে গাড়ি ব্যবহার করে আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আমিরুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ব্যবহার করতেন না। বাসায় আপ্যায়নের খরচ বা টেলিফোন বিলও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেননি। প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ প্রথম আলোকে বলেন, একজন উপাচার্য যদি চিন্তায় ও আর্থিকভাবে সৎ থাকেন, তাহলে অনেক সমস্যাই তাঁকে স্পর্শ করবে না।