একটি সমবায়ী স্বপ্ন

জসিম উদ্দিন শেখ। ছবি: আলম পলাশ
জসিম উদ্দিন শেখ। ছবি: আলম পলাশ

১৯৯৮ সাল। আমার বয়স তখন ১৮ বছর। ফরিদগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে মাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছি। ১০ ভাইবোনের মধ্যে আমি পঞ্চম। বাবা সরকারি পানি উন্নয়ন বোর্ডে ছোটখাটো চাকরি করতেন। ফলে আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য বাবার ছিল না। বড় ভাইও ডিগ্রি পাস করে বেকার বসে আছেন। চাকরি খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। এসব দেখে আমি কর্মসংস্থানের জন্য ছুটে যাই ঢাকায়। কিন্তু কোনো কাজ পাইনি। আবার ফিরে আসি চাঁদপুরে। ভাবতে থাকি কী করা যায়।
১৯৯৮ সালের ওই সময়টা সারা দেশ বন্যায় প্লাবিত। চাঁদপুরও তখন বন্যার পানিতে থইথই করছে। বাড়ির পাশেই পাউবোর বেড়িবাঁধ। একদিন ঘর থেকে বের হয়ে বাঁধের ওপর এসে বসেছি। ভাবছি নিজেকে নিয়ে। কী করব? কোথায় যাব? একদিকে অর্থসংকট, অন্যদিকে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো, একটা সমিতি করি।
যেই ভাবনা, সেই কাজ। এলাকার ১০ জন শিক্ষিত তরুণকে নিয়ে একদিন বসে পড়লাম বৈঠকে। সেখানে ‘শিক্ষিত বেকার যুব কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সমিতি গড়ার প্রস্তাব উঠল। এতে সদস্যরা প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে জমা দেবেন। যেমন কথা, তেমন কাজ। শুরুতেই আমি সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পেলাম। পরের দুই মাসের মধ্যে সমিতির সদস্য ১০০ জনে এসে দাঁড়াল। সদস্যরা সবাই মাধ্যমিক পাস।
এভাবে এক বছর পর মূলধন হিসেবে সমিতির তহবিলে জমা হলো ৬০ হাজার টাকা। এবার ওই টাকা দিয়ে আরম্ভ করলাম ঋণদান কার্যক্রম। যেমন এলাকার একজন রিকশাচালক ভাড়ায় রিকশা চালাতেন। তাঁকে ডেকে এনে রিকশা কেনার পরামর্শ দিয়ে তাঁকে সমিতি থেকে টাকা ঋণ দিলাম। তাঁকে ঋণের টাকা পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হলো এক বছরের মধ্যে। এভাবে এই সমিতির মাধ্যমে এলাকার অনেক লোকের কর্মসংস্থান ও আয়ের পথ বের করে দিই আমরা।

রাতারাতি কিছু হয়ে যাব বা করে ফেলব, এমন চিন্তা নিয়ে আমি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নিইনি

দ্রুতই চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের চান্দ্রা বাজার ও আশপাশের এলাকায় এই সমিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল জেগে উঠল। ২০০১ সালে সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি এটিকে নিবন্ধন করার সিদ্ধান্ত নিল। ২০০১ সালের ১৭ জুন ‘চান্দ্রা শিক্ষিত বেকার যুব বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে সমিতি নিবন্ধন পেল। আমি পেলাম এর সভাপতির দায়িত্ব।
২০০২ সালে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সমিতির মূলধন দিয়ে সদস্যরা কিস্তির মাধ্যমে পরিবহন, কম্পিউটার, ফটোকপি মেশিন, সেলাই মেশিন কিনতে শুরু করলেন। আরম্ভ করলেন মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন, নার্সারি গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজ। কাজ বেড়ে যেতে শুরু করল। ২০০২ সালের মে মাসে চান্দ্রা বাজারে একটি অফিস নিয়ে সেখানে ছয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে হলো। আমাকে নিয়োগ দেওয়া হলো এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ। সমিতির আয় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ২০ টাকা করে নির্ধারণ করা হলো। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার সম্মানী ভাতা হলো মাসে ৮৪ টাকা।
সমিতির কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ সদস্য হয়ে এখানে টাকা আমানত রাখা শুরু করেন। এভাবে ২০০৩ সালে আমাদের মূলধন হয় ১৭ লাখ টাকা। ওই বছরই আমাদের সমিতি জাতীয় সমবায় পুরস্কার পায়। এই পুরস্কার আমাদের সমিতির কর্মকর্তা ও সদস্যরা আরও উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
২০০৫ সালে আমরা ‘স্বনির্ভর ও দারিদ্র্য বিমোচন’ নামে একটি প্রকল্প চালু করি। এই প্রকল্পের সাতটি শাখা অফিস খুলে এতে ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করি। এরপর ২০০৮ সালে চাঁদপুরে সমবায় বাজার স্থাপন করি। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন, বিপণন ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, আবাসন প্রকল্প, সমাজ ও জনকল্যাণ তহবিল ইত্যাদি বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালু করি। প্রতিটি প্রকল্পই লাভজনক হয়ে ওঠে।
২০০৮ সালে আমি সারা দেশে যুব শ্রেণিতে শ্রেষ্ঠ সমবায়ীর জাতীয় পুরস্কার পাই। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১০ সালে চান্দ্রা শিক্ষিত বেকার যুব বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড জাতীয় সমবায় পুরস্কার পায়। ২০১১ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার ও সনদ গ্রহণ করি।
রাতারাতি কিছু হয়ে যাব বা করে ফেলব, এমন চিন্তা নিয়ে আমি সমিতি গঠনের উদ্যোগ নিইনি। অনেক চিন্তাভাবনা করে স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির মাধ্যমে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করেছি। সমিতির দায়িত্ব এর সদস্যদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করা। সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকার যেন কোনো অপচয় না হয়, সে ব্যাপারটি আমরা কঠোরভাবে দেখে থাকি। সদস্যরা লাভের জন্য এসে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেটাই আমাদের প্রথম চিন্তা। যেকোনো পদক্ষেপ অথবা শাখা স্থাপনের পর কঠোর তদারক করা হয়। লক্ষ রাখা হয়, যাতে কোনোভাবেই কোনো প্রকল্প লোকসানের মুখে না পড়ে।
বর্তমানে এ সমিতিতে প্রায় ৫০ কোটি টাকার মূলধন রয়েছে। প্রতি মাসের আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতি মাসে শেষ করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে প্রতিটি শাখা ও প্রকল্প আলাদাভাবে হিসাবের মধ্যে এনে মাসিক চূড়ান্ত জমা-খরচ, লাভ-ক্ষতির হিসাব জেলা ও উপজেলা সমবায় কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমবায় সমিতির সার্ভিস রুল অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এই সমিতির মাধ্যমে এরই মধ্যে সরাসরি ৫০০ শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব মিলিয়ে ধরলে সমিতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের।
আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে সমবায় আন্দোলনে ভূমিকা রাখা, আরও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োজিত হওয়া এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা। সমিতিকে একটি মডেল হিসেবে গড়ে তোলা, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে উৎপাদক ও ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলাও আমাদের আরেকটি লক্ষ্য। আমরা চাই প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বাজার স্থাপন করতে। সেখানে ক্রয় ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকবে। ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ইউনিয়নের উৎপাদিত পণ্য কেনা এবং বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ভোক্তাদের মধ্যে ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা হবে। এ বিষয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন, বিপণন ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। সেটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
দেশের শিক্ষিত যুবসমাজকে নানা চিন্তা মাথায় ঘোরাঘুরি করে। আমরা তো বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে সমবায় বাজার স্থাপনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সমবায় হাসপাতাল খোলার স্বপ্ন দেখছি। এ লক্ষ্যে ৬৪টি জেলায় ৬৪ জন সমবায় উদ্যোক্তা খুঁজছি। সামর্থ্য হলে ও সহযোগিতা পেলে বাংলাদেশকে সুশৃঙ্খল, দুর্নীতিমুক্ত ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কাজ সবার সঙ্গে মিলে করে যাব।
জসিম উদ্দিন শেখ: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চান্দ্রা শিক্ষিত বেকার যুব বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড, চাঁদপুর