
নিরাপত্তা পরিষদের একটি ভেটোতে আমরা আশাহত হয়েছি। আসুন, সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের অক্ষমতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে সৌধ নির্মাণ করি। যেমন কর্ম, তেমন ফল—বাইবেলের এই বাণী বিস্মৃত হওয়া ঠিক নয়। আজ পাকিস্তানের ঘারে কোপ পড়েছে। আমরা আজ গিনিপিগে পরিণত হয়েছি। কিন্তু এরপর আরও অনেকেই গিনিপিগে পরিণত হবেন, আর দেখবেন কী ঘটে। আপনারা দেখবেন, ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে উন্মোচিত হয়। আপনারা চান, আমরা ধূলায় গড়াগড়ি খাই। কিন্তু আমরা সেটা করব না।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স অন্য কোনো ভূমিকা পালনের জন্য ভোটদানে বিরত থেকেছে। এই দুই বড় শক্তির প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে আমি সেদিন বলেছি, এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান খুঁইয়ে বসেছেন। এখন তাঁরা কেবল নির্লজ্জ ধামাধরা চাটুকারের ভূমিকা পালন করতে পারেন। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থেকেছে, এতে আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। গ্যালিক যুক্তি বা অ্যাংলো স্যাক্সন অভিজ্ঞতার কারণে আমরা মারাত্মকভাবে ভুক্তভোগী হয়েছি। বেড়ার ওপর বসে না থেকে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পেছনে তাঁদের শক্তি নিয়ে দাঁড়াত, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। নিরপেক্ষ প্রাণী বলতে দুনিয়াতে অন্য কিছু নেই। আপনারা আপনাদের অবস্থান বেছে নিন। আমরা সেক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার প্রশংসা করি। তাঁরা একটি অবস্থান নিয়েছে, যদিও তা ভুল। এসব বিষয়ে আপনাকে একটি অবস্থান নিতে হবে। আপনাকে হয় ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, নয় তো অন্যায়ের পক্ষে। আপনাকে হয় আগ্রাসনের পক্ষে থাকতে হবে, নই তো আক্রান্তদের পক্ষে। এখানে কোনো তৃতীয় পথ নেই। এখানে শুধু সাদা ও কালোর ব্যাপার, ধূসর বলতে কিছু নেই। আপনি হয় সত্যের পক্ষে বা ভুলের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে বা অন্যায়ের পক্ষে, আগ্রাসনের পক্ষে বা আক্রান্তদের পক্ষে। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যদি তাঁদের পূর্ণ শক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের রায়ের পক্ষে দাঁড়াত, তাহলে আমরা আজ এ অবস্থানে এসে পৌঁছাতাম না। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স উপমহাদেশে ক্লাইভ ও দ্যুপ্লে হিসেবে আসতে চায়, তবে একটু ভিন্ন ভূমিকায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে। তাঁরা এখানেও একটি পা রাখতে চায়, আবার ওখানেও। আমি জানি, পূর্ব পাকিস্তানের তাঁদের চা-বাগান থাকায় গ্রেট ব্রিটেন এ রকম সুবিধাবাদী ভূমিকায় নেমেছে। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের পাট চায়। সে কারণে তাঁরা বেড়ার ওপর বসে আছে।
ফ্রান্সের ভূমিকায় আমি অত্যন্ত ব্যথিত, কারণ তাঁদের সঙ্গে আমরা শুধু ভালো নয়, খুবই ভালো একটি সম্পর্ক তৈরি করেছিলাম। কিন্তু তাঁরা এ অবস্থান নিয়েছে। আর আজ যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্স কেউই কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবে না, কারণ তাঁদের প্রত্যয় যা-ই থাকুক না কেন, পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। পাকিস্তানে ফ্রান্সের প্রতি অপরিমেয় শুভকামনা রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের কাছ থেকে তাঁরা এ রকম কোনো শুভকামনা পাবে না, কারণ সেখানকার পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। যতদিন ভারতীয় সেনাবাহিনী ওখানে অবস্থান করবে, ততদিন মুসলমান বাংলার মধ্যে এই বোধ সৃষ্টি হবে যে, তাঁরা হিন্দু ভারতের অধীনে রয়েছে। আর এর ফলাফল কী হয় আপনারা তা দেখবেন। কেন নয়? সেখানে ঘুরে বেড়াক। তাঁরা যদি পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করতে চায়, তাহলে তাঁদের দখলদার বাহিনী হিসেবে থাকতে দিন। তাঁরা তো দখলদার। কীভাবে তাঁদের উদ্ধারকারী বলা যায়? তাঁরা সেখানে থাকবে আর দেখবে, সময় কীভাবে অন্যদিকে মোড় নেয়।
শেষ কথা হচ্ছে, আমি ছলচাতুরি করার মতো কোনো মানুষ নই। জীবনে কখনো কাউকে আমি ধোঁকা দিইনি। আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, জেলেও পোরা হয়েছে। আমি সব সময় সংকটের মোকাবিলা করেছি। আজ আমি কথা দিয়ে তা না রেখে যাচ্ছি না, তবে আপনাদের এই নিরাপত্তা পরিষদ আমি ছেড়ে যাচ্ছি। এখানে প্রয়োজনের চেয়ে এক মুহূর্ত বেশি থাকাটাকে আমি আমার নিজের ও দেশের জন্য অপমানজনক বলে মনে করি। আমি প্রত্যাখ্যান করছি না। আমি বর্জন করছি না। যেকোনো সিদ্ধান্ত আপনারা চাপিয়ে দিন, ভার্সাইয়ের চেয়ে জঘন্য কোনো চুক্তি করুন, আগ্রাসনকে আইনি মোড়ক দিন, দখলদারিত্বকে বৈধতা দিন, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ঘটা অবৈধ প্রতিটি ঘটনাকে বৈধতা দিন। আমি এর অংশীদার হব না। আমরা যুদ্ধ করব। পিছিয়ে যাব, কিন্তু আবার যুদ্ধ করব। আমার দেশ আমাকে ডাকছে।
আমি কেন নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করব? আমি আমার দেশের একটি অংশের এমন অপমানজনক আত্মসমর্পণের অংশীদার হতে চাই না। আপনারা আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ে থাকুন। (কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে) আমি চললাম।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাবাহিনীর ওয়েবসাইট