তাঁকে টানে কেবল মানুষ

চট্টগ্রাম নগরে প্যারেন্টস লাউঞ্জে আড্ডায় বড়দের সঙ্গে ছোটরাও।  জুয়েল শীল
চট্টগ্রাম নগরে প্যারেন্টস লাউঞ্জে আড্ডায় বড়দের সঙ্গে ছোটরাও। জুয়েল শীল

লাকি আক্তারের জীবনে হঠাৎ এক ঝড় এল ২০০৮ সালে। তখন তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এইচএসসি পরীক্ষার। তাঁর বাসচালক বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়ের বিয়ে দেবেন। বরটিও গাড়ি চালান। এতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন লাকি। পড়ালেখা করে অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন তাঁর। তাই বাবার প্রস্তাবে রাজি হননি। তাতে রেগে গিয়ে বাবা তাঁর পড়ালেখাই বন্ধ করে দেন। এরপর শুরু হয় লাকির একা পথচলার সংগ্রাম। বাসচালককে বিয়ে করেননি। লাকি এমন একজনকে খুঁজছিলেন, যে তাঁর স্বপ্নের সহযাত্রী হবে। যে তাঁর পড়ালেখায় উৎসাহ দেবে। তাঁকে বুঝবে। তাই সে রকমই একজন মানুষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন।

কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাঁর পদে পদে বাধা হয়ে আসছিল। একদিকে সংসার, সন্তান, অভাব অনটন। জীবনটাকে কিছুতেই এগিয়ে নিতে পারছিলেন না লক্ষ্যের দিকে। সেই সময় লাকির পাশে এসে দাঁড়ায় ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন ‘পে ইট ফরোয়ার্ড’। সংগঠনটি তাঁর পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়। জীবনের বেশ কয়েকটি বছর পার করে এখন তিনি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। লাকি বলেন, ‘পে ইট ফরোয়ার্ড না থাকলে কখনো আমার স্বপ্ন পূরণ হতো না। আমার জীবন যখন থেমে গিয়েছিল, তখন আমি পে ইট ফরোয়ার্ডের উদ্যোক্তা বাদল সৈয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি যেন জাদুর ছোঁয়ায় আমার কাজটা সহজ করে দিলেন।’

বাদল সৈয়দ
বাদল সৈয়দ

বাদল সৈয়দের মাথা থেকেই এসেছে পে ইট ফরোয়ার্ডের ধারণাটি। ফেসবুকভিত্তিক এই সংগঠন ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ধরে রাখে, তাদের পড়াশোনার খরচ জোগায় দাতাদের অনুদানে। এখন তারা চার শ শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ জুগিয়ে যাচ্ছে। শুধু পড়ালেখা নয়, অনেক থমকে যাওয়া মানুষের জীবনকে এগিয়ে চলার পথ দেখাচ্ছে পে ইট ফরোয়ার্ড।
বাদল সৈয়দের নেতৃত্বে এর ২১ হাজার মানুষ মানবসেবার ব্রত নিয়ে একটি মঞ্চে যেন এক হয়েছেন।

শুধু পে ইট ফরোয়ার্ড নয়, বাদলের সদাসক্রিয় সৃজনশীল মস্তিষ্ক থেকে উঠে এসেছে আরও কয়েকটি এ রকম অভূতপূর্ব সেবামূলক সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ‘অনেস্ট’। এটিও ফেসবুকভিত্তিক ১ হাজার ৬০০ সদস্যের একটি সংগঠন। অভাবী কিন্তু মেধাবী ও সৃজনশীল তরুণেরা যাতে কোনো বিনিয়োগ ছাড়া কিছু আয় করতে পারেন, তার জন্য এ উদ্যোগ। সোজা কথায় এটি একটি পণ্য কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানই। কিন্তু ব্যতিক্রমটা হলো, এখান থেকে যে যা কেনেন, সে টাকার কিছু অংশ ফেরত পান। বেশি দামে নয়, বরং বাজার থেকে সব সময় এখানে কম মূল্যে পণ্য পাওয়া যায়। এ প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট কোনো মালিক নেই। যাঁরা কেনাবেচা করেন, তাঁরাই মালিক। এতে অনেকে মূল্যবান জিনিসপত্র দান করেন। সেটি বিনা মূল্যে অথবা ন্যূনতম মূল্যে চাহিদাসম্পন্ন গ্রাহকদের দেওয়া হয়। বাজার থেকে দরকারি পণ্য কিনে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে বিক্রি করে অনেস্ট।

ব্লাডপ্রেশার মেশিন, ডায়াবেটিস পরীক্ষার মেশিন, হরলিক্স—এ রকম অনেক পণ্য অভাবী মানুষ এখান থেকে কিনতে পারেন কম মূল্যে। অনেস্টের দেওয়ানবাজার অফিসে দু–তিনজন কর্মীর তত্ত্বাবধানে চলছে এই কর্মযজ্ঞ।
বাদল সৈয়দের কর্মের পরিধি আরও বিস্তৃত। পে ইট ফরোয়ার্ড ও অনেস্টের মতো আরও অনেক সংগঠনের সঙ্গে তাঁর নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মূল উদ্যোক্তা তিনি এবং প্রতিটি সংগঠন অভিনব কাজকর্মে সারা দেশে উদাহরণ সৃষ্টি করে চলেছে। চট্টগ্রাম শহরে সাড়া জাগানো প্রতিষ্ঠান প্যারেন্টস লাউঞ্জ, ডোনেট ইট ফরোয়ার্ড, মুক্ত লাইব্রেরি পলান সরকার, আই হ্যাভ আ ড্রিম, লার্নিং অ্যান লার্নিং প্রভৃতি সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান অথবা ক্লাব, যা–ই বলি না কেন—এসব উদ্যোগ চমকপ্রদ, অভিনব এবং নিঃসন্দেহে সৃজনশীল। সবকিছুর মূলে রয়েছে মানুষের কল্যাণ।

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম বাদল সৈয়দের। চাকরিজীবী বাবার ঘরে রেডিও বা টেলিভিশন ছিল না। ছিল শত শত বই। অফিস শেষে ঘরে ফিরে বাবা বইয়ে মগ্ন হয়ে যেতেন। গার্হস্থ্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে মায়ের হাতে শোভা পেত নীহাররঞ্জন গুপ্ত বা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের বই। বাবা–মায়ের সূত্রে বাদল পাঠাভ্যাস তো পেয়েছেনই, তাতে বাড়তি যোগ হয়েছে লেখালেখি। বাদল শুধু বই পড়েন না, নিজে বই লেখেনও। কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসেবে একটা পরিচিতিও গড়ে উঠেছে তাঁর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে পড়াশোনা করার সময় থেকেই লেখালেখির শুরু। কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তাঁর প্রথম বই গদ্যের। তাঁর জন্মজয় ও জলের উৎস নামের দুটি গ্রন্থ পাঠক সমাদৃত হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অলৌকিক আঙুল, সাধুসংঘ ও মাটির পিঞ্জিরার মাঝে।

পেশাগত জীবনে সরকারি কর্মকর্তা। ১৯৯৪ সালে সিভিল সার্ভিসে (কর ক্যাডার) যোগ দিয়ে এখন কর কমিশনার পদে কর্মরত বাদল সৈয়দ। ২০১৩ সাল থেকে জাতিসংঘের ট্যাক্স নিয়ে গঠিত প্যানেলে খণ্ডকালীন কাজ করছেন।
তাঁকে বলি, আপনি সরকারি আমলা। মা, স্ত্রী, কন্যা নিয়ে সংসার। এসব নিয়েই তো নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে পারতেন। এরপরও এত দায় মাথায় নিলেন কেন?

সরাসরি কোনো জবাব দেননি বাদল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্মৃতিচারণা করলেন এক শিক্ষকের, বললেন, ‘আমার মহিউদ্দিন স্যার একদিন খুব ভোরে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাঁর প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গী করলেন। সেই দিনটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন।’

প্রাতর্ভ্রমণে হাঁটতে হাঁটতে স্যার তাঁকে বলেছিলেন, ‘বাদলা বেটা, তুই সারা জীবন পড়াশোনা করেছিস হয় ফ্রিতে, নয়তো অতি অল্প পয়সায়। সরকার তোর পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছে। সেই পয়সা কোত্থেকে এসেছে জানিস? এই যে গরিব রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস কর্মী—এদের ট্যাক্সের টাকা থেকে। অথচ এদের ছেলেমেয়েরা পড়ার সুযোগ পায় না টাকার অভাবে। এরা নিজেরা ছেলেমেয়েকে না পড়িয়ে, তাদের বঞ্চিত করে তোকে পড়িয়েছে। এ কথাটা সব সময় মনে রাখিস। কর্মজীবনে কোনো সমস্যা হবে না।’

বাদল বললেন, ‘স্যারের কথায় আমার সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। মনে হলো আমি আসলে আমার জন্য নয়, মানুষের জন্য জন্মেছি। বড় চাকরি, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ—কিছুই আমাকে টানে না। টানে কেবল মানুষ।’