তারুণ্যের শিল্পী প্রীতম হাসান

প্রীতম হাসান। ছবি: খালেদ সরকার
প্রীতম হাসান। ছবি: খালেদ সরকার

‘মিউজিকের প্রতি আমার কোনো আগ্রহই ছিল না। ঘরভর্তি ছিল খেলনা রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক, গুলি—এসব। ছোটবেলায় বলতাম, আর্মি অফিসার হব। ভীষণ দুষ্টু ছিলাম। বাড়িতে কেউ বকা দিলেই বাবাকে ফোন করে নালিশ করতাম। বাবা বলতেন, তুমি ক্যালেন্ডারে লিখে রাখো, আমি এসে বিচার করব।’

এই কথাগুলো গায়ক ও সংগীত পরিচালক প্রীতম হাসানের। আশির দশকের সাড়া জাগানো গায়ক প্রয়াত খালিদ হাসান মিলুর ছোট ছেলে তিনি। কিন্তু বাবার পরিচয়ে নয়, প্রীতম হাসান নিজের প্রতিভার গুণেই এখন বাংলাদেশের সংগীতজগতের এক পরিচিত নাম। তাঁর বড় ভাই প্রতীক হাসানও গান করেন। ডানপিটে শৈশবে তাঁর গানের জগতে আসার কোনো সম্ভাবনাই দেখা দেয়নি। তিনি বলেন, ‘আব্বু যখন বেঁচে ছিলেন, তখন ভাইয়া আর আমাকে প্রায়ই অনুশীলন করাতেন। ভাইয়া খুব সিরিয়াস। কিন্তু আমার খুব একটা মনোযোগ ছিল না। আব্বু মারা যাওয়ার পর আমি গেমস নিয়েই পড়ে থাকতাম।’ তারপর একটা সময় বড় ভাই প্রতীকেরঅনুপ্রেরণাতেই প্রীতমের সংগীতের জগতে পা রাখা।

প্রীতমের জন্ম ঢাকায়। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ১৭ কি ১৮ বছর বয়সে ফুফুর কিনে দেওয়া কম্পিউটারে কম্পোজিশনের অনুশীলন শুরু হয় রিদমের প্যাটার্ন তৈরির মাধ্যমে। প্রীতম বলেন, ‘তারপর একটা সময় মজা করে একটা–দুটো প্যাটার্ন করা শুরু করি। রবীন্দ্রসংগীত রিমিক্স করি।’

>একনজরে প্রীতম হাসান 
 জন্ম: ২৭ জানুয়ারি, মহানগর প্রজেক্ট, ঢাকা
 মা: ফাতেমা হাসান পলাশ
 বাবা: প্রয়াত খালিদ হাসান মিলু
 বড় ভাই: প্রতীক হাসান 
 প্রথম স্কুল: ক্যাপিটাল হিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, মগবাজার
 পড়াশোনা: স্নাতক (ইংরেজি) দ্বিতীয় বর্ষ, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি
 জনপ্রিয় গান: ‘আসো মামা হে’, ‘লোকাল বাস’, ‘বেয়াইন সাব’, ‘জাদুকর’, ‘রাজকুমার’, ‘গার্লফ্রেন্ডে’র বিয়া
 অভিনীত নাটক: ইমোশনাল ফুল, ৭০০ টাকা।
 চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা: অস্তিত্ব, রাজনীতি ও দেবী
 প্রাপ্তি: মানুষজন আমাকে আমার নামেই চেনে । বাবার নামে নয়।

প্রীতম তখনো অচেনা। প্রথম সুযোগটা আসে হাবিবের করা একটা মুঠোফোনের জিঙ্গেলে গান গাওয়ার মাধ্যমে। তিনি বলেন, ‘হাবিব ভাই ওই গানটির জন্য প্রতীক ভাইকে ডাকলেন। কিন্তু ভয়েস দেওয়ার পর তিনি ভাইয়াকে বললেন, আমি এমন একটা গলা চাই, যার কণ্ঠ ওপরের দিকে যেতে একটু কষ্ট হয়। ভাইয়া তখন বললেন, আপনি আমার ছোট ভাইকে দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এরপর গানটি গাইলাম। হাবিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্য হলো। প্রতিদিন রামপুরা–বনশ্রী থেকে গ্রিন রোডে হাবিব ভাইয়ের স্টুডিওতে সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম। তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে খুব ভালো লাগত। একবার তাঁর সঙ্গে শ্রীমঙ্গল যেতে যেতে গাড়িতে কথায় কথায় বললাম, একটা গান করেছি। গানের রিদমটা মুখেই তাঁকে শোনালাম। তিনি রিদম শুনেই বুঝলেন, আমার মধ্যে রিদম সেন্স আছে। বললেন, তুমি যেহেতু রিদম করো, আমার একটা গানের বিট বানাতে হেল্প করবে? আমি তখনই রাজি। ওটা একটা ফিল্মের গান ছিল।’
হাবিবের সঙ্গে বেশ কটা কাজ করেন প্রীতম। প্রথম সফল কাজ একটি মুঠোফোনের জন্য করা ক্রিকেটের গান ‘চলো বাংলাদেশ’। তিনি হাবিবের ‘হারিয়ে ফেলা ভালোবাসা’র রিদম করেন।
কম্পোজিশন বা রিদম করলেও প্রীতমের ইচ্ছা গান করার। কিন্তু নিজের স্টুডিও নেই। বললেন, ‘একদিন কথায় কথায় হাবিব ভাইকে বললাম, আমার তো গান করার ইচ্ছা। কিন্তু বনশ্রী থেকে গ্রিন রোড অনেক দূর হয়ে যায়। আপনার আশপাশে কোথাও হলে আমার জন্য ভালো হয়। হাবিব ভাই বললেন, কোনো চিন্তা কোরো না, তুমি এখানে চলে আসো। ওই সময় অদিত (সুরকার ও সংগীত পরিচালক) ভাইও ছিলেন। তিনি বললেন, আমার এখানে একটা রুম আছে। আমি খালি করে দিচ্ছি, তুমি আসো। যেদিন বাসা ছেড়ে আমি স্টুডিওতে চলে আসব, সেদিন আম্মু অনেক কান্নাকাটি করলেন। ভাইয়াও মন খারাপ করে বসে রইলেন। আমি গানের জন্য বাসা ছেড়ে পান্থপথের স্টুডিওতে চলে এলাম।’
শুরু হলো সংগীত নিয়ে প্রীতমের সংগ্রাম। কুদ্দুস বয়াতির সঙ্গে করা ‘আসো মামা হে’ গানটি দিয়ে তাঁকে সবাই চিনতে শুরু করল। প্রীতম মনে করেন, এই গানটাই তার টার্নিং পয়েন্ট। সেই ধারাবাহিকতায় করলেন ‘লোকাল বাস’, ‘জাদুকর’, ‘রাজকুমার’, ‘বেয়াইন সাব’ ইত্যাদি। তিনি বলেন, ‘এই গানগুলোতে আমি বাংলা সুর ব্যবহার করেছি। কারণ আমি চাই শ্রোতারা এই গান শুনে বাংলা সুরের সৌন্দর্য উপলব্ধি করুক।’
প্রীতম চলচ্চিত্রের জন্যও কাজ করেছেন। প্রথম গানটি করেন অস্তিত্ব চলচ্চিত্রে। তারপর রাজনীতি। সর্বশেষ দেবী ছবিতে মমতাজের কণ্ঠে ‘দোয়েল পাখি’ গানটি এখন চারদিকে শোনা যাচ্ছে।
অভিনয়ের পোশাকও প্রীতমের পরা হয়েছে। তাঁর অভিনীত প্রথম নাটক ইমোশনাল ফুল। দ্বিতীয় নাটক নুহাশ হুমায়ূনের পরিচালিত ৭০০ টাকা। তবে প্রীতম বলেন, তাঁর আগ্রহ গান নিয়ে, অভিনয় করার ইচ্ছা ছিল না। করেছেন অনুরোধ রক্ষার জন্য। কিন্তু অভিনয়েও তাঁর সহজাত প্রতিভার প্রকাশ ঘটেছে।
প্রীতমের স্বপ্ন নতুন প্রজন্মের জন্য ভালো মানের গান করা। তিনি বাংলা গানকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের বাউলশিল্পী ও আন্তর্জাতিক শিল্পীদের নিয়ে যৌথ কাজ করার ইচ্ছা আছে আমার। বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের সংগীতের নতুন স্বাদ পৌঁছাতে চাই। আর আমার সংগীত তারুণ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।’

 কবির বকুল গীতিকার এবং প্রথম আলোর ইভেন্ট অ্যান্ড অ্যাকটিভেশন বিভাগের ব্যবস্থাপক