নন্দিত-নিন্দিত উপাচার্যরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা l ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলা l ছবি: প্রথম আলো
দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে কারা নিয়োগ পান, কীভাবে নিয়োগ পান এবং অতীতে কারা পেয়েছেন—এসব নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ। শেষ পর্ব পড়ুন কাল। প্রতিবেদনগুচ্ছ তৈরি করেছেন শরিফুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা দুই-ই আছে। নন্দিত উপাচার্য যেমন ছিলেন, তেমনি নিন্দিতও ছিলেন।

আশির দশকের মাঝামাঝি স্বৈরশাসনের সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ-প্রক্রিয়া ও নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে, এমনকি বর্তমান সময়েও তা অব্যাহত আছে। অভিযোগ উঠেছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার মান নিম্নগামী হওয়ার অন্যতম কারণ যোগ্য নেতৃত্বের অভাব।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়েও অনেক পেছনে অবস্থান করছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বিশ্বের ৯৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সর্বনিম্ন ৩০০টির মধ্যে | এই তালিকায় ভারতের ১৪টি ও পাকিস্তানের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। এর আগে গত জুনে প্রকাশিত টাইমস হায়ার এডুকেশন বিশ্ববিদ্যালয় সূচকে বিশ্বের ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল ৬০১।

বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারছে না এই প্রাচীন ও বড় বিশ্ববিদ্যালয়টি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করি, তখন ধারণা ছিল নিয়োগে মেধাই হবে আসল যোগ্যতা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, যা দুঃখজনক।’ তাঁর মতে, একদিকে মেধাবীদের অনেকে শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না, অন্যদিকে মেধাবীদের অনেককে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে।

.
.

পাঁচ উপাচার্যের সম্মানজনক পদত্যাগ
বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচজন উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। এঁদের একজন মাহমুদ হুসেইন। তিনি ভারতের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেইনের ভাই। ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাকির হুসেইন।

১৯৬২ সালে প্রাদেশিক গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ঢাকা কলেজে ছাত্রবিক্ষোভের মুখে পড়েন। এরপর মোনায়েম খান ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু উপাচার্য মাহমুদ হুসেইন বলেন, ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ঘটেনি, তাই বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারবহির্ভূত। এতে মোনায়েম খান সন্তুষ্ট না হওয়ায় মাহমুদ হুসেইন পদত্যাগ করেন।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করে। একাত্তরের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে, তখন তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভায় ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রের মৃত্যুর খবর পেয়ে পদত্যাগ করেন।

১৯৮৬ সালে মোহাম্মদ শামসুল হক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের অন্যায় আদেশ না মেনে পদত্যাগ করেছিলেন। আর ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের চাপে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী।

১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তনের পর একজন প্রভোস্ট নিয়োগকে কেন্দ্র করে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মরহুম এ এস এইচ কে সাদেকের সঙ্গে মতবিরোধের জের ধরে পদত্যাগ করেন উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। জানতে চাইলে এমাজউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নেওয়ার স্বার্থে সেদিন পদত্যাগ করেছিলাম।

অসম্মানজনক পদত্যাগ

২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর দিনের বেলা দায়িত্ব নিয়ে মধ্যরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দেন আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। তখনকার উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরী অনেকটা বাধ্য হয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেন, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে ইউজিসির চেয়ারম্যান হন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে দায়িত্ব নেওয়ার নয় মাসের মধ্যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। পরে তাঁকে রাষ্ট্রদূত করে বিএনপি সরকার।

এরশাদের সময়ে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিঞা বিএনপি সরকারের প্রায় আড়াই বছরের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে অবশ্য তাঁকে সেনেগালের রাষ্ট্রদূত করা হয়। তখনকার উপাচার্য প্যানেলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সেই সময়ের সহ-উপাচার্য এ কে এম সিদ্দিকের নাম ছিল। কিন্তু এরশাদ মনিরুজ্জামান মিঞাকেই নিয়োগ দেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতায় ঘাটতির বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা ছিল। তাঁর সময়েই সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়। এরশাদের সময়ে উপাচার্য প্যানেলে নাম থাকলেও প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

স্বাধীনতাপূর্ব ১২ উপাচার্য

স্বাধীনতার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন ১২ শিক্ষাবিদ ও বিচারপতি। প্রথম উপাচার্য হিসেবে ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর যোগ দেন স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ। তিনি এর আগে ১৭ বছর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা রেজিস্ট্রার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সদস্য ছিলেন। পাঁচ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টির মজবুত ভিত রচনা করে হার্টগ অবসর নেন। এরপর জিএইচ ল্যাংলি, স্যার এ এফ রহমান, রমেশ চন্দ্র মজুমদার (আর সি মজুমদার), মাহমুদ হুসেইন, এস এম হোসাইন, ডব্লিউ এ জেনকিনস উপাচার্য ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ও মুসলমান উপাচার্য ছিলেন স্যার এ এফ রহমান। এর প্রায় ৩০ বছর পর উপাচার্য ছিলেন ওসমান গণি। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়া আরও দুই বিচারপতি উপাচার্য ছিলেন। এঁরা হলেন বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ও বিচারপতি হামুদুর রহমান।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন ১৫ উপাচার্য। তাঁদের মধ্যে রয়ছেন মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, আবদুল মতিন চৌধুরী, মুহাম্মদ সামসুল হক, এ কে এম সিদ্দিক, মো. শামসুল হক, আবদুল মান্নান, শহীদউদ্দিন আহমেদ, এস এম এ ফায়েজ প্রমুখ।

মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী ভাষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও বাকশালের নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। বিজ্ঞানী চৌধুরী আবদুল মতিন শিক্ষাজীবনে শুধু প্রথম শ্রেণি ছাড়াও দেশে-বিদেশে দুবার পিএইচডি করেছেন। পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের সদস্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞান উপদেষ্টা ছিলেন।

আছে দলীয় প্রতিপক্ষ

বর্তমান উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সমর্থক নীল দলের প্রভাবশালী শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, হারুন-অর-রশীদ, মীজানুর রহমান, অহিদুজ্জমান চানসহ কয়েকজন শিক্ষক নেতা আরেফিন সিদ্দিকের বিপক্ষে অবস্থান নেন। পরে এই চারজনকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আরেফিন সিদ্দিকের সুসম্পর্ক তাঁকে এই বিপদসংকুল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করে।

আরেফিন সিদ্দিকের বড় সাফল্য, তাঁর সময়ে সেশনজট প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। সন্ত্রাসও বেশ কমেছে। তবে ডাকসু নির্বাচন করতে না পারা তাঁর বড় ব্যর্থতা। কিছু শিক্ষক নিয়োগ এবং নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে তিনি সমালোচিত হয়েছেন।