বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ

এদেশের মানুেষর শ্রমে আর স্বেদে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় উন্নয়নের আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত
এদেশের মানুেষর শ্রমে আর স্বেদে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় উন্নয়নের আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত

কত ভাগ্যে বাংলাদেশ নামে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের একটি বই আছে। বইটির শিরোনাম আমাকে খুব আলোড়িত করে। বাস্তবিক পক্ষে আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা বাংলাদেশ নামে এই রাষ্ট্রটি পেয়েছি। পেয়েছি বললে সবটা বলা হলো না। বহু মানুষের স্বেদ, অশ্রু ও রক্তের বদলে দেশটা আমরা অর্জন করেছি। বাংলাদেশ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন অত্যন্ত শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন এক রাজনীতিবিদ-প্রশাসক একে অভিহিত করেছিলেন বাস্কেট-কেস বলে। অর্থাৎ এর অর্থনীতি অত্যন্ত ভঙ্গুর—এটা টেকে কি টেকে না, তা–ই সন্দেহ। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় উন্নয়নের আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত। এটা সম্ভবপর হয়েছে কোনো জাদুর কাঠির স্পর্শে নয়, এ দেশের মানুষের শ্রমে আর স্বেদে। যারা মাটির বুক চিরে ফসল ফলিয়েছে, যারা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরি করেছে, যারা প্রবাসে প্রায় অমানবিক পরিবেশে কঠোর শ্রম দিয়ে মজুরি পেয়েছে এবং নিজের জন্যে যথাসম্ভব কম খরচ করে দেশে টাকা পাঠিয়েছে—সেই সব সাধারণ মানুষই বাংলাদেশের চেহারা বদলে দিয়েছে। নীতিনির্ধারণের এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্ব নিশ্চয় আছে রাজনৈতিক নেতাদের এবং দূরদর্শী প্রশাসকদের, তেমনি আছে কলে-কারখানায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু শেষ বিচারে নায়কের আসন সাধারণ মানুষেরই প্রাপ্য।

এ দেশে আর্থিক বৈষম্য যে প্রবল, সে কথা আমি ভুলিনি। কিন্তু তারপরও আমি বলব যে পাকিস্তান আমলে আমরা যে যেখানে ছিলাম, তার থেকে আজ সব দিক দিয়ে ভালো আছি এবং উন্নয়নের সুফল কেবল সমাজের উঁচু স্তরের লোকেরা লাভ করেনি, তা সমাজের নিচু স্তরেও পৌঁছেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা ছিল, তারা ক্রমশ সেই সীমার ওপরে উঠে আসছে। বাংলাদেশের গ্রামের অবস্থা বিগত কয়েক দশকে উন্নত হয়েছে—সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁেছছে, জীবন ধারণের উপকরণ সহজলভ্য হয়েছে, কৃষকের গায়ে কাপড়, পায়ে অন্তত স্পঞ্জের স্যান্ডেল উঠেছে, এমনকি, ক্ষেত্রবিশেষে শৌখিনতার উপকরণ দেখা দিয়েছে—মেয়েদের দেখা গেছে বই হাতে স্কুলে যেতে—কোথাও আবার সাইকেলে চড়ে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অধিক হারে পড়ছে—এ কি সামান্য অর্জন!

বাংলাদেশের ছেলেরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রিকেট খেলছে এবং ভালোই খেলছে বলতে হবে। বাংলাদেশের মেয়েরা আঞ্চলিক পর্যায়ে ফুটবল খেলছে, ক্রিকেট খেলছে এবং খারাপ খেলছে না। এসব খেলোয়াড় উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। মেয়েরা তো এমন গ্রাম থেকেও এসেছে, যেখানে তারা বিদ্যুৎ দেখেনি—কেবল তাদের আবদারের পর যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তার মানে কী? এদের প্রতিভা আছে এবং সে প্রতিভা বিকশিত করার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ষাটের দশকেও হয়তো এমন প্রতিভাবান ছেলেমেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের প্রতিভা পরিচর্যা লাভ করেনি, তারা সুযোগ পায়নি। বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে বলেই এসব সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের পথ পেয়েছে।

ক্রমবর্ধমান লোকসংখ্যা এবং ক্রমহ্রাসমান কৃষিজমি নিয়েও আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলমূল-তরিতরকারিতে আমরা উদ্বৃত্ত। বিদেশে আমরা খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি করতে পারছি। যে কৃষককুলকে রক্ষণশীল মনে করা হতো, কৃষিক্ষেত্রে তারা বিদেশি পদ্ধতি ও স্বদেশি উদ্ভাবন সহজেই গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের ছাত্ররা বিদেশে গিয়ে সুনাম অর্জন করছে, বিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে নানা রকম উদ্ভাবন করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছে। হিজাবের আধিক্য সত্ত্বেও নারীরা অনেক ধরনের কাজ করতে গৃহকোণের বাইরে—এবং অনেক ক্ষেত্রে দেশের বাইরে—বের হচ্ছে, রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করছে।

বাংলাদেশে যোগাযোগব্যবস্থার যে বিকাশ ঘটেছে, তা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। রেলপথ ও নৌপথের আরও উন্নয়ন হওয়া উচিত ছিল, তবে সড়কপথ বিস্তৃত হয়ে মানুষে মানুষে, অঞ্চলে অঞ্চলে সংযোগের যে সুবিধে তৈরি করেছে, তা দেশবাসীর একটা বড় অংশের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। পথঘাটের নির্মাণ মানুষে মানুষে সেতুবন্ধের কাজ করেছে, বিদ্যুৎ-সংযোগ অনেক কুসংস্কার দূর করেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ—বিশ্বব্যাংকের অলীক অভিযোগ এবং বাস্তব বাধাদানের জুতসই জবাব।

স্বাস্থ্য খাতেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। যেসব রোগ ও অব্যবস্থার কারণে মৃত্যুহার ছিল অধিক, তার অনেকটাই দূর করা সম্ভবপর হয়েছে। তাই গড় আয়ের মতো আমাদের গড় আয়ুও বেড়েছে।

যোগােযাগের ক্ষেত্রে আমােদর সবচেেয় বড় সাফল্য নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ
যোগােযাগের ক্ষেত্রে আমােদর সবচেেয় বড় সাফল্য নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ

ভালো অনুবাদের স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশের সাহিত্য বহির্বিশ্বের তেমন মনোযোগ পায়নি। তবে আবাসী বা অনাবাসী বাংলাদেশি লেখক, যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা করেন, তাঁরা কেউ কেউ বিদেশে আগ্রহের সঙ্গে পঠিত হচ্ছেন। সংস্কৃতিক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে সাফল্য এসেছে স্থাপত্যে। আমাদের বেশ কয়েকজন স্থপতি তাঁদের কাজের জন্যে আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে দেশের জন্যে সম্মান বয়ে এনেছেন।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের কথা যখন উঠল, তখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নানান বাহিনীর কথা বলতে হয়। এই বাহিনীর সদস্যেরা সুনাম অর্জন করেছেন, এঁদেরই জন্যে সিয়েরা লিওনে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে এবং একাধিক দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে সড়কের নামকরণ হয়েছে।

বাংলাদেশের পরিচয় এখন আর দুর্ভিক্ষলাঞ্ছিত খরাপীড়িত বন্যাদুর্গত দেশ বলে নয়। সমুদ্রমেখলা তেরোশত নদীবিধৌত সুজলা সুফলা শ্যামস্নিগ্ধ বাংলাদেশ আধুনিকতার পথে অভিযাত্রী এক জনপদ। আমরা জানি, আত্মশ্লাঘার সুযোগ আমাদের নেই। দেশে এমন সব শক্তি আছে, যারা আমাদের পেছন দিকে টেনে নিতে চায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়, জঙ্গিবাদের উত্থান চায়, বহু রকম অনৈতিকতার জালে দেশকে বেঁধে রাখতে চায়। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে আমাদের ভরসা। তারা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখতে দেবে না।

আনিসুজ্জামান জাতীয় অধ্যাপক