ভবানীপুরের কিংবদন্তি

ভবানীপুরের প্রাচীন মন্দিরের অবশেষে জমা আছে অনেক কিংবদন্তি। ছবি: সোয়েল রানা
ভবানীপুরের প্রাচীন মন্দিরের অবশেষে জমা আছে অনেক কিংবদন্তি। ছবি: সোয়েল রানা

৫০ বছর আগের শারদীয় উৎসব আর এখনকার উৎসবের বিস্তর পার্থক্য। আগের দিনে এখানকার উৎসব ছিল হিন্দু-মুসলমানদের মিলনমেলা। দুই মাস আগে থেকে পূজার প্রস্তুতি চলত। মহালয়ার দিন থেকে দশগ্রাম জুড়ে রীতিমতো উৎসবের আমেজ পড়ে যেত। ঢাকের বাদ্য শুরু হতো মণ্ডপে। শারদীয় উৎসবে মেলায় তখন হিন্দু-মুসলমান সবার বাড়িতে মেয়ে-জামাই নাইওর আসত। সেকি জমজমাট উৎসব! পাঁচ থেকে ছয় মণ চালের ভোগ হতো। এখনো উৎসব হয়। মেয়ে-জামাইও নাইওর আসে। কিন্তু উৎসবের সেই জলুস আর নেই। এভাবেই হারানো দিনের উৎসবের স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুর মন্দিরের নায়েব অমূল্য চন্দ্র চক্রবর্তী। অর্ধশতাব্দী ধরে তিনি এ মন্দির দেখভাল করছেন।

ভবানীপুর মন্দিরের ফটকে ৬০ বছর ধরে দেবীর ভোগ ও পূজার সামগ্রী নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন সুশীল চন্দ্র দাস। মন্দিরের সামনেই কেটে গেছে তাঁর জীবনের ৮৫টি বছর। মন্দিরকে ঘিরে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি। স্মৃতিতে এখনো অম্লান ভবানীপুরের সেই দূর কালের শারদীয় উৎসব। চারদিকে উৎসব আমেজ ছড়িয়ে পড়ত। বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন যোগ দিতেন উৎসবে। হিন্দু-মুসলমানের সর্বজনীন ছিল সেই উৎসব। মুসলমান তরুণেরা দিনের পর দিন উৎসব সফল করতে মন্দিরে পড়ে থাকতেন।

কত দিন ধরে এ মন্দিরে শারদীয় উৎসব হচ্ছে? সুশীল চন্দ্র স্মৃতি হাতড়িয়ে বলেন, চৌদ্দ পুরুষের আমল থেকে ভবানীপুরের উৎসব হচ্ছে। সুশীল চন্দ্রের এই বক্তব্য সমর্থন করে মন্দিরের পুরোহিত রথীন্দ্র নাথ ভাদুরী বলেন, পুরাণে উল্লেখ আছে, সত্যযুগে দক্ষযক্ষের পর স্বামী মহাদেবের অপমান সইতে না পেরে সতী দেহ ত্যাগ করেন। মহাদেব প্রাণহীন স্ত্রীর দেহ নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করলে দেবতারা ভীত হয়ে পড়েন। বিষ্ণুদেব সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীদেহকে ৫১ ভাগে ছেদন করলে দেবীর দেহখণ্ডের বাঁ তল্প বা বাঁ পাঁজর বা মতান্তরে ডান চোখ এসে পড়ে করতোয়া নদীর অদূরবর্তী ভবানীপুরে। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের শেরপুর উপজেলার সেই ভবানীপুর উপমহাদেশের সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে শক্তিপীঠ বা তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, নানা কিংবদন্তি আর কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই মন্দির। উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মের ভক্ত-পূজারিরা আসেন সতীদেবী অর্পণা (ভবানী) ও তাঁর স্বামী বামনের (মহাদেব) পূজা-অর্চনা দিতে। শারদীয় দুর্গোৎসব ছাড়াও মাঘী পূর্ণিমা, মহানবমী, দ্বীপান্বিতা শ্যামা পূজা এবং নবান্ন উৎসবে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানসহ উপমহাদেশের হাজার হাজার ভক্ত, পূজারি ও পুণ্যার্থীর ঢল নামে এখানে।

বাংলা ভাষার মুক্ত বিশ্বকোষে (উইকিপিডয়া)এই প্রাচীন মন্দিরকে ঘিরে কিংবদন্তির উল্লেখ আছে। এই কিংবদন্তি হলো একতলার জীর্ণ মন্দির থেকে দেবী অর্পণা-ভবানী প্রতিদিন দুপুর বেলা মন্দিরসংলগ্ন জঙ্গলঘেরা পুকুরের উত্তর পারে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বালিকা বধূ সাজে ধুলোমাটি নিয়ে খেলা করতেন। এ সময় জঙ্গলঘেরা ওই পথ দিয়ে শাঁখা বেচতে যাচ্ছিলেন এক শাঁখারি। বালিকা বধূটি তখন শাঁখারিকে ডেকে একজোড়া শাঁখা কিনতে চাইলেন। শাঁখার দাম চাইলেন শাঁখারি। বালিকা তখন জানালো, সে নাটোরের রাজবাড়ির কন্যা। রাজবাড়িতে গিয়ে মহারানীকে যেন বলেন যে প্রাসাদের একটি ঝুড়িতে কিছু পয়সা রাখা আছে, সেখান থেকে যেন শাঁখার দাম দিয়ে দেন। শাঁখারি খুশি হয়ে বালিকাকে শাঁখা দিয়ে দিলেন। নাটোরের মহারানী ভবানীর কাছে গিয়ে মেয়েটির কথা বলতেই রানী হতবাক, রাজবাড়ির কোনো মেয়ে তো বগুড়ার ভবানীপুর নেই! কিন্তু কথামতো মহলের একটি ঝাঁপি খুলে কিছু টাকা পেলেন। রহস্য উদ্ঘাটনে মহারানী শাঁখারিকে নিয়ে মেয়েটির খোঁজে দ্রুত রওনা দিলেন ভবানীপুরে।

জঙ্গলঘেরা সেই পুকুর পাড়ে ধুলোমাটি মিললেও কোনো বালিকা বধূকে সেখানে দেখা গেল না। মহারানী তখন শাঁখারির ওপর খেপে গেলেন।

রাজরোষে ভীত শাঁখারির প্রার্থনা শুনে সতী ভবানী পুকুর থেকে দুই হাতের শাঁখা তুলে দেখালেন। এতে মহারানী ও সঙ্গে আসা রাজবাড়ির লোকজন দারুণ বিস্মিত হলেন। মা ভবানীর মহিমার কথা উপমহাদেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সেই থেকে তীর্থযাত্রীরা শাঁখা-পুকুরে পুণ্যস্নান শুরু করল। নাটোরের মহারানী সতীর মহিমায় মুগ্ধ হয়ে পুকুরসংলগ্ন পুরোনো মন্দির সংস্কার করলেন। মহারানীর নামানুসারে সংস্কার করা এই মন্দিরের নাম ভবানী মন্দির রাখা হয়েছিল বলেও কেউ কেউ মনে করেন।

 বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে সতের ও আঠার শতকে নাটোরের রাজা রামকৃষ্ণ ভবানীপুরে ১১টি হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে কিছু পুরাতন মন্দির রয়েছে।

প্রায় ১২ বিঘা এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীরঘেরা ভবানীপুর মন্দিরের প্রাচীন জরাজীর্ণ মূল মন্দিরটি এখনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। পাশেই বেশ কয়েকটি মন্দিরে সংস্কারের পর আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। মূল মন্দিরের শ্বেতবর্ণ কষ্টিপাথরে দেবীর ত্রিভুজ প্রসন্ন দৃষ্টি বিদ্যমান। বাইরে সুদৃশ্য বেদীতে দেব-দেবীর শ্বেতপাথরের বেলবরণ তলা, একটি ভৈরব শিবমন্দির, তিনটি শিবমন্দির, একটি করে গোপাল, বাসুদেব ও নাট মন্দির। উত্তর পাশে নর-নারায়ণ সেবা অঙ্গন, দুটি অতিথিশালা, পুণ্যস্নানের শাঁখা-পুকুর, দুটি স্নানঘাট এবং প্রাচীরের বাইরে আরও চারটি শিবমন্দির এবং একটি পঞ্চমুণ্ড আসন।

পুরোহিত রথীন্দ্রনাথ ভাদুরী বললেন, শারদীয় উৎসব ছাড়াও প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ ভক্ত-পূজারি আসেন এই মন্দিরে। প্রভাতী ও বাল্যভোগ, দুপুরে পূজা ও অন্নভোগ, সন্ধ্যায় আরতি ও ভোগ দেওয়া ছাড়াও ভক্তদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। মাঘ-ফাল্গুন মাসে মাঘী পূর্ণিমা উৎসব, চৈত্র-বৈশাখ মাসে রাম নবমী উৎসব, দ্বীপান্বিতা শ্যামাপূজা ও নবান্ন উৎসবে হাজারও ভক্ত-পুন্যার্থীর ঢল নামে এবং মেলা বসে। শাঁখা-পুকুরে পুণ্যস্নান উপলক্ষে মেলায় শাঁখা-সিঁদুরের পশরা সাজিয়ে বসেন শাঁখারিরা। হয়তো তাদের বিশ্বাস, বালিকা বধূ বেশে দেবী শাঁখা কিনতে দুহাত মেলে ধরবেন। ভক্তের আশা, হয়তো শাঁখা-পুকুরে আবার কোনো শুভক্ষণে শাঁখা-পরা দেবীর দুটি হাত ভেসে উঠবে। কাল বদলায়, বিশ্বাস প্রতীকে আর কিংবদন্তিতে বেঁচে থাকে ভবানীপুরে।