ভাষা আন্দোলনের ছবি তোলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভাষা সংগ্রামীদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ছবি: রফিকুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভাষা সংগ্রামীদের ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ছবি: রফিকুল ইসলাম

শুরুটা হয়েছিল একটা ‘কোডাক’ ‘সিক্স টোয়েন্টি বক্স ক্যামেরা’ নিয়ে ঢাকার রমনায়, ১৯৪৩ সালে। থাকতাম রমনায় ফজলুল হক হলের উল্টো দিকে, রেল কলোনিতে। রমনা তখন বাগিচা শহর বা ‘নিউ টাউন’। ইংরেজরা বানিয়েছিল পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানীরূপে। জানি না কোন ইংরেজ স্থপতি রমনার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি যে একজন প্রকৃতিপ্রেমিক শিল্পী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রমনার কোনো রাস্তায় ছিল অর্জুন, কোনো রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া, কোনো রাস্তায় শিরীষ আবার কোনোটায় বা জারুলগাছের সারি। রমনার এই সৌন্দর্যকে ধরে রাখার জন্য হাতে ক্যামেরা তুলে নিয়েছিলাম। সে কালে আমার ক্যামেরায় এক রোল ফিল্মে আটটা সাদা-কালো ছবি উঠত, সে ছবি ডেভেলপ ও প্রিন্ট করার জন্য নবাবপুর রোডে ‘ডস্’ স্টুডিওতে যেতে হতো।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগ এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক উৎসব হলো কার্জন হলের সামনের মাঠে। পূর্ব বাংলার নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পানির পাইপ দিয়ে তৈরি ‘ফ্ল্যাগমাস্ট’-এ একটি চাঁদতারাখচিত সবুজ মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করলেন। ‘শিখ’ রেজিমেন্টের একটি দল (তখনো ভারতে যায়নি) একজন ব্রিটিশ অফিসারের কমান্ডে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করল। কবি জসীমউদ্দীনের নেতৃত্বে কলকাতা থেকে আগত বাংলাদেশ সরকারের ‘সংপাবলিসিটি’ ডিপার্টমেন্টের আব্বাসউদ্দীন আহমদের পরিচালনায় সোহরাব হোসেন, বেদারউদ্দিন আহমদ, হাসান আলী খান, শমসের আলী প্রমুখ শিল্পী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইলেন কবি গোলাম মোস্তফা রচিত ‘পাকিস্তানের অভাব কী’? আর কবি জসীমউদ্দীনের ‘আমার সোনার পাকিস্তান, আমার পূর্ব পাকিস্তান’। ব্যস, পাকিস্তান হয়ে গেল। আমি ওই অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তুলেছিলাম কিন্তু সেগুলো ভালো হয়নি। ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ আর তাঁর বোন ফাতেমা জিন্নাহ্ ঢাকায় এসে রমনায় ঘোড়দৌড় মাঠে জনসভায় যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, আমি আমার বক্স ক্যামেরায় তার ছবি তুলেছিলাম কিন্তু সে ছবিও ভালো হয়নি।
ভাগ্যক্রমে ১৯৪৯ সালের দিকে আমার এক বিলাতফেরত ভাইয়ের কাছ থেকে একটি ভালো জার্মান ক্যামেরা উপহার পাই। ক্যামেরাটি ছিল ‘ভয়েগ ল্যান্ডার’ ‘ফোর পয়েন্ট ফাইভ ল্যান্সরিফ্লেক্ট ক্যামেরা’। এই ক্যামেরা দিয়ে আমি যথার্থ ফটোগ্রাফি শুরু করি। যদিও এই ক্যামেরাটি ‘রোলি ফ্ল্যাস্ক’ বা ‘রোলি কড’-এর মতো অটোমেটিক ছিল না এবং ‘অ্যাপারচার’, ‘ডিসটেন্স’ ও ‘টাইমিং’ হাতে ঠিক করতে হতো। তবুও এই ক্যামেরা দিয়ে আমি অনেকের চমৎকার পোর্ট্রেট তুলেছিলাম। যেমন শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান এবং গায়ক কলিম শরাফী, কামেলা শরাফী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের। ১৯৫০ সালে ঢাকা ‘আর্ট গ্রুপ’-এর উদ্যোগে ঢাকা হলসংলগ্ন ‘লিটন হল’-এ ঢাকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে যেসব চিত্রকলা স্থান পেয়েছিল তার প্রায় সব ছবিই আমাকে তুলতে হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল জয়নুল আবেদিন, শফিউদ্দিন আহমদ, কামরুল হাসান, শফিকুল আমিন, আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর, হামিদুর রহমান, আবদুর রউফ, সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্রমুখ শিল্পীর শিল্পকর্ম। আমার তোলা ছবিগুলো শিল্পীদের পছন্দ হয়েছিল এবং একজন আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। সুগায়ক কলিম শরাফী তখন ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে। পোর্ট্রেট ছবিতে আমার হাত দেখে তিনি আমাকে একটি ‘ভয়েগ ল্যান্ডার’ থ্রি পয়েন্ট ফাইভ ‘কালার্স স্কোপার ল্যান্স’সহ একটি ফোল্ডিং ক্যামেরা উপহার দেন।
১৯৫২ থেকে ’৫৭ সালের মধ্যে আমি এই নতুন ভয়েগ ল্যান্ডার ক্যামেরা দিয়ে অনেক ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় ছবি তুলেছি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বাংলা ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৩ সালের প্রথম শহীদ দিবস উদ্যাপন, ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক সাহিত্য সম্মেলন, ১৯৫৫ সালে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ঢাকা সফর এবং বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। এ ছাড়া পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃতি সংসদ’, ‘ডাকসু’ এবং ‘ড্রামা সার্কেল’ মুনীর চৌধুরী ও নুরুল মোমেনের পরিচালনায় যেসব নাটক মঞ্চস্থ করেছিল, তার প্রায় সবগুলোরই ছবি তুলেছিলাম। ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর পূর্ব বাংলায় প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। এই সময় ঢাকায় দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বুলবুল একাডেমীর মাহমুদ নুরুল হুদার উদেযাগে শান্তিনিকেতন থেকে আগত বিশ্বভারতীর সংগীত ও নৃত্যভবনের শ্যামা নৃত্যনাট্য প্রদর্শনী। অপর একটি ছিল কলকাতার ‘বহুরূপী’ নাট্য সম্প্রদায়ের বিখ্যাত নাটক রক্তকরবীর (শম্ভু মিত্রের পরিচালনায়) মঞ্চায়ন। শ্যামা ও রক্তকরবীর নৃত্য ও অভিনয়ের অনেক সুন্দর ছবি আমি তুলেছিলাম, যেগুলো শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র খুবই পছন্দ করেছিলেন। এ ছাড়া পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী তাঁর নৃত্যদল নিয়ে ঢাকায় যে অভিনব নৃত্যানুষ্ঠানসমূহ প্রদর্শন করেছিলেন, তার অনেক ছবিই আমার তোলা ছিল, যা বুলবুল চৌধুরী ও আফরোজা বুলবুল খুব প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সব অনুষ্ঠানের ছবি তুলেছিলাম। ১৯৫৭ সালে আমরা ‘ডাকসু’ থেকে একটি সাংস্কৃতিক দল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান সফর এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকীতে যোগ দিয়েছিলাম। ওই সব সফরের অনেক ঐতিহাসিক ছবি আমার তোলা ছিল।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের অনেকটা সময় কেটেছে বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং ফটো তোলা ও নাটক করার মধ্য দিয়ে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯৫২, ’৫৩, ’৫৪ ও ’৫৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলি ক্যামেরাবন্দী করা। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় পুনরায় ঘোষণা দিলেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সমাজসচেতন ও আন্তর্জাতিক চেতনাসম্পন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের প্রথম সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্রসমাজ ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির প্রথম ‘প্রতিবাদ দিবস’ এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ‘পতাকা দিবসে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেছিলেন। আমি ওইসব প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার ছবি তুলেছিলাম।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা আইন সভার বাজেট অধিবেশন শুরুর দিন রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালনের ঘোষণা, ৪ ও ১১ ফেব্রুয়ারির সভাও শোভাযাত্রা থেকেই ঘোষিত হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নুরুল আমিন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ছাত্রসমাজ ফেটে পড়ে। স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানব না’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সেদিন সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা, পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা বা না-করা সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা কলাভবনের পেছনের দেয়াল টপকে আমতলায় সমবেত হতে লাগলেন। বেলা ১১টার দিকে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহদ্বারের বন্ধ করা লোহার গেটের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইতিহাস বিভাগের কৃতী ছাত্র হাবিবুর রহমান (শেলী) আর ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্র ছিলেন ফজলুল হক হলের কৃতী ফুটবল খেলোয়াড় আবদুল জলিল। ওই দিন যথারীতি আমার সঙ্গে আমার প্রিয় ক্যামেরাটি ছিল। আমি ঠিক করেছিলাম আমতলায় অনুষ্ঠিত সভা এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ছবি তোলার জন্য আমাকে কলাভবনের ছাদে উঠতে হবে। কিন্তু সমস্যা ছিল এই যে ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি ছিল না, ছিল একটা ছোট ফোকর। ওই ফোকর দিয়ে আমার বন্ধুরা আমাকে ছাদে তুলে দিল। আমি সেখান থেকে আমতলার সভার এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন দলের লম্বা লাইনের ছবি তুলতে লাগলাম। আমার ক্যামেরা অটোমেটিক ছিল না। কড়া রোদের মধ্যে অ্যাপারচার, টাইমিং এবং ডিসট্যান্স আমাকে বারবার ঠিক করে নিতে হচ্ছিল। ক্যামেরায় এক রোলে ফিল্ম ছিল মাত্র আটটি। পকেটে ছিল আরেকটি মাত্র রোল। একটা রোল শেষ হয়ে গেলে সেটা খুলে আর একটা রোল ভর্তি করতে অন্ধকার জায়গার প্রয়োজন। প্রখর সূর্যতাপে ছাদের ওপরে ছায়া কোথায়? শার্টের নিচে ক্যামেরা খুলে ফিল্ম বদলে নিলাম। এভাবে সেদিন সভা ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মাত্র ১৬টি ছবি তুলতে পেরেছিলাম। তবে দুর্ভাগ্য আমার যে ফিল্ম না থাকায় একুশের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের গুলিবিদ্ধ মস্তিষ্কের খুলি উড়ে যাওয়া ও ঘিলু গড়িয়ে পড়া রক্তাক্ত লাশটি সামনে দেখতে পেয়েও তার ছবি আমি তুলতে পারিনি। সে ছবি তুলেছিলেন মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে আমার বন্ধু আলোকচিত্র শিল্পী আমানুল হক। তাঁর ক্যামেরায় তখনো ফিল্ম এবং ঝুলিতে ফ্ল্যাশগান ছিল। লাশটি মেডিকেল কলেজের পেছন দিকে একটি ঘরে রাখা হয়েছিল। সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিস্ আমাদের সেখানে গোপনে ডেকে নিয়ে যান এবং আমানুল হক ক্যামেরায় ফ্ল্যাশগান ফিট করে অত্যন্ত সতর্কভাবে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ছবিটি তোলেন। পরে লাশটি নুরুল আমিন সরকার গুম করে ফেলে। কিন্তু ছবিটি গুম করতে পারেনি।
২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চালনা এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকার সব দোকানপাট, অফিস-আদালত এমনকি বেতারকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি কোনোক্রমে সেকেন্ড গেট এলাকায় অবস্থিত ‘জায়দিস্’ নামে আমার পরিচিত একটি ফটো স্টুডিওতে আমার তোলা ফটোর দুটি রোল ডেভেলপ করতে গিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি দুজন আইবি চর আমার জন্য অপেক্ষমাণ। এই দুজন গোয়েন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নজর রাখতেন। তাঁরা দেখতে ছিলেন কুচকুচে কালো এবং লম্বা প্রকৃতির। তাঁদের কথা শুনে মনে হতো কলকাতার উর্দুভাষী মুসলমান। তাঁরা জানতে চাইলেন আমি আজকে যেসব ছবি তুলেছি সেসব ফিল্ম কোথায়? আমি তাঁদের বললাম, ‘আমার ক্যামেরায় কোনো ফিল্ম ছিল না, আমি স্টাইল করার জন্য ছবি তোলার ভান করছিলাম।’ তাঁরা আমার পকেট সার্চ করলেন এবং ক্যামেরা খুলে দেখলেন ক্যামেরায় ফিল্ম আছে কি না। তারপর হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। আমার তোলা সেদিনকার ছবিগুলো পরে মিজানুর রহমান সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকা এবং কেজি মোস্তফা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা প্রথম শহীদ দিবস পালন করি। সেদিন আমি অনেক ছবি তুলেছিলাম, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কলাভবনের ওপর কালো পতাকা উত্তোলন এবং ছাত্রীদের প্রভাতফেরির ছবি, আজিমপুর গোরস্থানে শহীদ আবুল বরকতের কবরের পাশে মুর্শিদাবাদ থেকে আগত বরকতের মা এবং ঢাকার নয়াপল্টন নিবাসী বরকতের বোন ও দুলা ভাইয়ের ছবি। সেদিন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের পেছনে অবস্থিত ঢাকা কলেজের পুরোনো ক্যাম্পাসে ঢাকা ও ইডেন কলেজের ছাত্র ও ছাত্রীদের শহীদ মিনার তৈরি এবং ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল শামসুজ্জামান চৌধুরী, উর্দু প্রফেসর আহ্সান আহমদ আশ্ক ও ইডেন কলেজের প্রিন্সিপাল মিসেস ফজিলতুন্নেসা জোহা কর্তৃক ছাত্রছাত্রীদের বাধা দেওয়া এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনের ২১ দফার ভিত্তিতে ‘হক-ভাসানী’-সোহ্রাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের বিজয়লাভ ও সরকার গঠনের পর এপ্রিল মাসে ঢাকার ‘কার্জন হল’-এ ঐতিহাসিক সাহিত্য সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমি তার অসংখ্য ছবি তুলেছিলাম, যার মধ্যে কলকাতা থেকে আগত সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং দীপ্তেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। প্রথম যেখানে ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা রাতারাতি প্রথম শহীদ মিনার বানিয়েছিলেন এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি সেটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল, কালো কাপড়ঘেরা সেই স্থানটিতে কলকাতার ওই সাহিত্যিকদের শ্রদ্ধা নিবেদনের চিত্র আমি তুলেছিলাম। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে এবং ৯২ (ক) ধারা জারি করে পূর্ব বাংলায় জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জাকে গভর্নর নিয়োগ করা হয়েছিল। সে বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদ দিবস পালনের ওপর নিষেধজ্ঞা জারি করা হয়, সে আদেশ অমান্য করে পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ব্ল্যাংক ফায়ার সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শহীদ দিবস পালনের ফটো আমি তুলেছিলাম, পরে ৯২ (ক) ধারা উঠে গেলে যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’র সরকার গঠন করেছিলেন আবু হোসেন সরকার। ১৯৫৫ সালেই আবু হোসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহীদ আবুল বরকতের মা বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন, যার ছবিও আমি তুলেছিলাম। ওই কালে আমি ভাষা আন্দোলন নিয়ে যেসব ছবি তুলেছিলাম, সেগুলোর এবং ঢাকা আর্ট স্কুলের শিল্পীদের আঁকা ভাষা আন্দোলনের ছবি নিয়ে ১৯৫৪ সালের সাহিত্য সম্মেলনের সময় পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সরকারি বাসভবন ‘বর্ধমান হাউসে’ যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, তার উদ্বোধন করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। সে ছবিও আমার তোলা। স্মরণীয় যে ১৯৫৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লিগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমি ‘বর্ধমান হাউস’ ছেড়ে দেন, তখন ‘বর্ধমান হাউস’ পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের দখলে চলে যায়। ১৯৫৪ সালের সাহিত্য সম্মেলনের সময় বাড়িটি আমরা অধিকার করি।