ভুতুড়ে শহরেও কাজ করেছেন তিনি

আনিকা জাহিন
ছবি: কবির হোসেন

করোনাকালে সবাই তখন ঘরবন্দী, ঢাকা এক ভুতুড়ে নগরী। ঘরের দরজা খুলে সিঁড়ির গোড়ায় যেতেও মানুষের ভয়। সেই কঠিন সময়ে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন আনিকা জাহিন। যথাযথ সুরক্ষা মেনে করে গেছেন নিজের কাজ। লকডাউনে শুটিং হওয়া একটা আস্ত সিনেমার নেপথ্যে কাজ করেছেন তিনি।

অনেকে এরই মধ্যে একটি খবর হয়তো পড়েছেন, অভিনেত্রী জয়া আহসান করোনাকালে নির্মাতা পিপলু আর খানের তৈরি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নাম ঠিক না হওয়া সেই চলচ্চিত্রের কস্টিউম ডিজাইনার আনিকা। পুরো শহর যখন ঘরবন্দী, আনিকা তখন ছুটেছেন সিনেমার কস্টিউম জোগাড়ে। আনিকা বলেন, ‘ওই সিনেমার শুটিং করতে সময় লেগেছে ১৫ দিনের মতো। কিন্তু আমার জোগাড়যন্ত্র চলেছে আরও অনেক দিন। প্রতিটি জিনিস সেই আকালের মধ্যে জোগাড় করে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন, নাটক ও সিনেমা পাড়ায় নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীদের কাছে আনিকা এখন পরিচিত মুখ। সাধারণ মানুষের তাঁকে চেনার কথা নয়। তবে তাঁর কাজ দেখেননি, এমন সাধারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। নাটক, বিজ্ঞাপন, সিনেমা আর তথ্যচিত্র মিলে আনিকা প্রায় ৪০০ কাজ করেছেন তাঁর ছয় বছরের পেশাজীবনে।

কক্সবাজারে বেড়ে ওঠা আনিকা উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনা করতে ঢাকায় আসেন। আইনজীবী বাবা ইউছুফ মোহাম্মদ শামসুল হুদা আর শিক্ষক মা সেলিনা মুশতাক ছোটবেলা থেকে মেয়েকে বড় করেছেন সাংস্কৃতিক আবহে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে বায়োটেকনোলজি নিয়ে পড়ে সে বিষয়েই পেশাজীবন গড়ার ইচ্ছে ছিল আনিকার।। তবে পড়া শেষ হওয়ার আগেই ইয়াং বাংলা প্রকল্পে নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমনের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠন করার সুবাদে এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। সেখানে কাজ করতে গিয়েই ভালোবেসে ফেললেন ‘কালারফুল’ এই বিনোদন জগৎ। পড়াশোনার শেষে তাই ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করলেন মেজবাউর রহমান সুমনের প্রতিষ্ঠান ফেসকার্ডে।

দেবী চলচ্চিত্রে মিসির আলির চরিত্র পর্দায় আনতে বেশ ভাবতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় এই চরিত্রের চুলে–পাকা ভাব আনতে শুরুতে কয়েক দফা মেকআপ আর পরচুলা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। মনমতো হচ্ছিল না। তারপর ভয়ে ভয়ে চঞ্চল চৌধুরীকে প্রস্তাব দিলাম, চুলগুলো সত্যিই সাদা করে ফেলুন। তিনি আমার ওপর আস্থা রাখলেন। এভাবেই চরিত্রটি দাঁড়াল।
আনিকা জাহিন

নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপনের কোনো কাজ পাওয়ার পর আনিকা প্রথমে ভাবতে বসেন। প্রতিটি চরিত্রের মেজাজ ধরে সেভাবে পোশাক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চেহারা বা ‘লুক’ ঠিক করেন। তরুণ এই কস্টিউম ডিজাইনার বলেন, ‘দেবী চলচ্চিত্রে মিসির আলির চরিত্র পর্দায় আনতে বেশ ভাবতে হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় এই চরিত্রের চুলে–পাকা ভাব আনতে শুরুতে কয়েক দফা মেকআপ আর পরচুলা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। মনমতো হচ্ছিল না। তারপর ভয়ে ভয়ে চঞ্চল চৌধুরীকে প্রস্তাব দিলাম, চুলগুলো সত্যিই সাদা করে ফেলুন। তিনি আমার ওপর আস্থা রাখলেন। এভাবেই চরিত্রটি দাঁড়াল।’

ইউনিলিভার, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি, স্কয়ার, নেসলের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনচিত্রের পোশাক পরিকল্পনা করেছেন আনিকা। করেছেন অসংখ্য নাটকের কাজ। চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন দেবী-তে। এরপর হাওয়া চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন ২০১৯ সালের শেষে। এই চলচ্চিত্রের কাজ করতে গিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছিল। আনিকা বললেন, ‘চলচ্চিত্রটির কাজ হয়েছে সেন্ট মার্টিনে গভীর সমুদ্রে। এর মধ্যে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাত। আমরা তখন সমুদ্রের ভেতর ট্রলারে। ঘাটেও ভিড়তে পারছিলাম না, কী এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!’

এরই মধ্যে নিজেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে প্রমাণ করার মতো একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ পেয়েছিলেন আনিকা। জানালেন, দেশে করোনাভাইরাস শুরুর আগে বলিউড-হলিউডের এই সম্মিলিত প্রকল্পের জন্য নির্বাচিত হন। প্রাথমিক কাজও এগিয়ে নিয়েছিলেন। আপাতত প্রকল্পটি স্থগিত আছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আবার শুরু হবে। এই প্রকল্পে প্রি-প্রোডাকশন দলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আনিকা বুঝেছেন, বাইরের দুনিয়ায় কাজের সুযোগ কত বড়। ভাবনা ও বাজেট—দুটোই বিশাল। তিনি এখন তাই নিজেকে তৈরি করছেন সেভাবেই। শিগগিরই নিজের একটা পরিপূর্ণ স্টুডিও অফিস তৈরির স্বপ্ন দেখেন আনিকা জাহিন। সেখানে তিনি কাজ করবেন বিদেশি কস্টিউম ডিজাইনারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।