মহামন্দা চলছেই

২০০৮ সালে আর্থিক খাতে ধসের পর থেকে বর্ষশেষের সালতামামি লিখতে বসলে মন ভারি হয়ে ওঠে। বটেই, আমরা দ্বিতীয় মহামন্দা এড়াতে পেরেছিলাম, কিন্তু তা থেকে এক মহা অসন্তুষ্টির জন্ম হয়েছে। উন্নত দেশগুলোয় অধিকাংশ মানুষেরই আয় বাড়েনি। ২০১৪ সালেও একই অবস্থা বজায় থাকবে বলে ধারণা করা যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্য আয়ের মানুষের আয় প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। পুরুষ শ্রমিকদের আয় ৪০ বছর আগের মজুরির চেয়েও নিচে নেমে গেছে। ২০১৩ সালে ইউরোপের টলায়মান মন্দা কেটে গেছে। তবে এমন কথা বলা যাবে না যে, সেখান থেকে কোনো উত্তরণ ঘটেছে। গ্রিস ও স্পেনের প্রায় ৫০ শতাংশ তরুণ এখন বেকার। আইএমএফের ভাষ্য অনুযায়ী, আগামী বছরগুলোতে স্পেনে বেকারত্বের হার ২৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, সেখানে একধরনের আত্মতুষ্টি জেঁকে বসার সম্ভাবনা রয়েছে। সময় যত গড়াবে, ইউরো অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের গতি ততই শ্লথ হয়ে আসবে। উদাহরণস্বরূপ, আর্থিক ইউনিয়নের জন্য প্রকৃত ব্যাংকিং ইউনিয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। কেবল সাধারণ তদারকি নয়, ডিপোজিট বিমা প্রণয়ন ও অভিন্ন সমাধান প্রক্রিয়া বিকশিত করতে হবে। ইউরোবন্ড বা এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার মাধ্যমে ঋণের ঝুঁকি কমাতে হবে। এ দুইয়ের কোনোটির বাস্তবায়নের নিরিখেই ইউরোজোন এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে অগ্রসর হতে পারেনি।
যেসব কঠোর নীতির কারণে ইউরোপে এই টলায়মান মন্দা সৃষ্টি হয়েছিল, এখন আবার নতুন করে সে দিকে ঝোঁকার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ইউরোপের এই বিরাজমান স্থবিরাবস্থা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বাজে। কিন্তু ইউরোজোনের আরেকটি দেশ নতুন করে সংকটে পতিত হওয়ায় অসম্ভব ঝুঁকির মধ্যে আছে। আগামী বছর তা না হলেও ভবিষ্যৎ খুব দূরে নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্রতর হওয়ায় তারা তুলনামূলকভাবে একটু ভালো অবস্থায় আছে। যদিও সেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমে বাড়ছে। অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেশি। এটা শুধু আশাই করা যেতে পারে যে, রিপাবলিকান পার্টির উন্মাদেরা—যারা সরকারকে সবকিছু বন্ধ করে দিতে বাধ্য করে দেশকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছিল—তারা এ পুনরাবৃত্তির বিপক্ষে দাঁড়াবে।
তারা তা করলেও পরবর্তী ধাপের কঠোর নীতিজাত সংকোচনের ফলে প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসবে। এই কঠোর নীতির কারণে ২০১৩ সালে জিডিপির ১-২ শতাংশ পয়েন্ট খোয়া গেছে। তার মানে, চাকরির বাজারে নতুন করে ঢোকা মানুষকে হয়তো কোনোক্রমে চাকরি দেওয়া সম্ভব হবে। কর ফাঁকি দেওয়া গতিশীল সিলিকন ভ্যালি ও বর্ধিষ্ণু হাইড্রোকার্বন খাত এই কঠোর নীতির ঝাঁজ কমাতে পারবে না।
ফেডারেল রিজার্ভের দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ (তথাকথিত কিউই বা কোয়ান্টেটেটিভ ইজিং) ক্রয়ের পরিমাণ হয়তো কমতে পারে। তবে কম করে হলেও ২০১৫ সালের আগে সুদের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
নিম্ন সুদের হার কমানো এখন যথার্থ হবে না। কিউইর কারণে মার্কিন অর্থনীতি কিছুটা লাভবান হলেও বিদেশে তাতে নানা ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৩ সালের আলোচনার মাধ্যমে কিউই সংকোচনের মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতির টলায়মান অবস্থার নিরসন ঘটে। বিশ্বপরিসরে অর্থনীতিতে পরস্পর নির্ভরশীলতার মাত্রা এর মাধ্যমে বোঝা যায়।
কিউই প্রণয়নের কারণে মুদ্রার মূল্যায়ন ত্বরান্বিত হয়। এর শেষ ঘোষণার মাধ্যমে অবমূল্যায়ন শুরু হয়। ভালো খবর হলো, উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সৃষ্টি করেছে। তাদের অর্থনীতি এ ধাক্কা সহ্য করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে।
তবু উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়াটা হতাশাজনক। আর তা এ কারণেও যে ২০১৪ সালজুড়ে এটি অব্যাহত থাকবে। প্রতিটি দেশের গল্পই স্বতন্ত্র। ভারতের নিম্নগতির পেছনে নয়াদিল্লির রাজনৈতিক সমস্যাকে দায়ী করা হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে (তবে এ কথা বিশ্বাস করার কারণ নেই যে, সুদের ঊর্ধ্বগতি পেঁয়াজের দামে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে, ভারতে মূল্যস্ফীতির পেছনে একে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়)।

ব্রাজিলের সামাজিক অস্থিরতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, দারিদ্র্য নিরসনে ও অসাম্য হটাতে গত এক দশকে সেখানে কিছু উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সচ্ছলতা আনতে হলে সেখানে আরও বহু কিছু করতে হবে। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত সমাজে সেখানে ক্ষোভের যে ঝড় উঠেছে, সেটিকেও ওখানকার বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখাই সংগত।
চীনে প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি পণ্যের মূল্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তার প্রভাব পড়েছে সারা দুনিয়ায় পণ্যের রপ্তানিকারকদের ওপরও। তবে চীনে প্রবৃদ্ধির নিম্ন হারকে বুঝতে গেলে তাকে একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। এই নিম্নগতি সত্ত্বেও অনেকেরই যাতে চোখ টাটায়, তা হলো চীন এক টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটা শুরু করেছে। এ উন্নয়নের গতি ধীর হলেও আখেরে তা চীন ও সারা দুনিয়ার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
আগের বছরগুলোর মতো ২০১৩ সালেও বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সমন্বিত চাহিদার অভাব। তার মানে এই নয় যে, অভাব নামক প্রপঞ্চটির মৃত্যু ঘটেছে। একটি উদাহরণ দিলে বলতে হয়, তার কিছুটা ঘটেছে অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে। আরও বড় পরিসরে বললে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় এ চাহিদার অভাব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এমন ক্ষমতা নেই যে, তা সারা দুনিয়ার উদ্বৃত্তকে কাজে লাগিয়ে এ অভাব মেটাতে পারে। বিরাজমান ব্যবস্থা আমাদের বিকল্প ব্যবস্থার কথা চিন্তাও করতে শেখায় না।
আমাদের একটি বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতি রয়েছে, যা মোটেই কাজ করছে না। বহু অভাব এখনো অপূর্ণ রয়েছে, বহু সম্পদ আজও অব্যবহূত। সমাজের বৃহত্তর অংশটিই এ ব্যবস্থার উপকার পাচ্ছে না। ২০১৪ সালে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতির লক্ষণ নেই। অদূর ভবিষ্যতেও তার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। জাতীয় ও বৈশ্বিক—উভয় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা এমন কোনো পরিবর্তনের সূচনা করতে পারবে না, সংস্কারের মধ্য দিয়ে যা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বনিয়াদ তৈরি করতে পারে।
২০১৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ২০১৩ সালের তুলনায় কিছুটা ভালো হতে পারে। আবার তা না-ও হতে পারে। বিরাজমান মহামন্দার বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে, উভয় বছরই নষ্ট হওয়া সুযোগের বছর হিসেবে পরিগণিত হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন