
কবির বকুল: মমতাজ উঠে এসেছেন গ্রাম থেকে। গান করতে করতে জায়গা করে নিয়েছেন শহুরে মধ্যবিত্তের মনে। শহরে বড় হওয়া রাহুল শহুরে মধ্যবিত্তের জন্য গাইলেও গান খুঁজতে হাত বাড়িয়েছেন গ্রামে।
মমতাজ: বাবা মধু বয়াতি ছিলেন বাউলশিল্পী। বাবা বৈঠকি, মুর্শিদি গান গাইতেন। সেই গান শুনে ঝরঝর করে চোখের পানি পড়ত। দয়াল কে, মুর্শিদ কে, সৃষ্টিকর্তা কে, দীনবন্ধু কে—এসব তাঁর কাছ থেকে শেখা। প্রথমে আমি পালাগান গাইতাম।
রাহুল আনন্দ: আমার গানবাজনার শুরুও পরিবার থেকে। বাড়িতে ঠাকুমা থেকে শুরু করে বাবা—সবাই গান করতেন। সকাল-বিকেল চর্চা করতে হবে বা দুটো গান গাইতে হবে। কিন্তু এ বিদ্যা যে আলাদাভাবে শিখতে হয়, এটা বুঝতে পারি কলেজে ওঠার পর। আমি বাঁশি বাজাই, পাশাপাশি গান গাইতে পারি বলে দেখলাম আমার প্রতি সবাই একটু আলাদাভাবে নজর দিচ্ছে। চারুকলায় পড়ার কারণে দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে আমার। দেশকে চেনা, দেশকে জানা, প্রকৃতিকে জানা হলো একটু বেশি করে। বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশ মানে ঢাকা শহর নয়।
মমতাজ: আমার গান যেমন আমার দাদা, চাচা, বয়োজ্যেষ্ঠরা—আধ্যাত্মিক গান যাঁরা পছন্দ করেন—শোনেন, একইভাবে আমি চাই নতুন প্রজন্মও আমার গান শুনুক। আমাদের সময়ে যাঁরা গান লিখতেন বা সুর করতেন, তাঁরা বললেন, মমতাজ এটা ঠিক করল না। আমি যে একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হাঁটছি, এটা অনেকেই নিতে পারেননি। তাঁরা বলাবলি শুরু করলেন, মমতাজ এত দিন উঠেছে, এবার নামবে। আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি।
বকুল: ‘জলের গান’ বা রাহুল—ওঁদের গান, ওঁদের পরিবেশনা আপনার কেমন লাগে?
মমতাজ: ওরা নিজেদের গানটা নিজেদের মতো করেই করছে। ওদের বাদ্যযন্ত্র, কথা, সুর, পরিবেশনা—সবই ভালো লাগে। আর ওদের একটা গান তো আমার খুবই প্রিয়, ‘বকুল ফুল বকুল ফুল/ সোনা দিয়া হাত কানও বান্ধাইলি।’ কিন্তু একটা প্রশ্ন, ‘শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফোটে লো’—এ গানে ফুলের যদি লাজই না থাকবে, তবে সে রাতে ফুটবে কেন? হা হা হা।
বকুল: মমতাজের গাওয়া কোন গান ভালো লাগে রাহুলের?
রাহুল: আপার ‘মা’কে নিয়ে একটা গান আছে, ওটা। আচ্ছা আপা, ‘মা’ গানটি যখন করেন, তখন আপনার আশপাশে কি উজালা বেগম (মমতাজের মায়ের নাম) এসে দাঁড়ান?
মমতাজ: আমার পুরোটাজুড়েই উজালা বেগম থাকেন। কখনো কখনো কোনো অনুষ্ঠানে গান করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমার বাসাভর্তি কত মানুষ। সবাই ঘুমায়। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার আগেই দেখি, মা এসে গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘মাটির গানের মায়ায়’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০১৭