মাঠের বাইরেও ছক্কা

বিনা মূল্যে মেয়েদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেন আরিফা জাহান
ছবি: মঈনুল ইসলাম

বউ সেজে বসে ছিলেন আরিফা জাহান। কিন্তু বর আর আসেননি। সদ্য এইচএসসি পেরোনো মেয়েটি সেদিন কীভাবে সব সামলেছিলেন, তিনিই জানেন। অভাব–অনটনের মধ্যে বড় হয়েছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি মুদিদোকানে কাজ করতে হতো। সংসার আর সংগ্রাম তাঁর কাছে সমার্থক। এত কিছুর মধ্যেও তিনি ক্রিকেটার হয়েছেন। ইনজুরির কারণে নিজের খেলার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেলেও পিছপা হননি। বিনা মূল্যে মেয়েদের জন্য ক্রিকেট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। আর করোনাকালে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে।

করোনাকালের দুর্যোগে গর্ভবতীদের সেবার জন্য ফেসবুকে সবার কাছ থেকে সহায়তা আহ্বান করেছিলেন আরিফা জাহান। পেয়েছেন ব্যাপক সাড়া। গত এক বছরে চার হাজারের বেশি অসহায় ও সন্তানসম্ভবা নারীকে সেবা দিয়েছেন তিনি। তাঁদের ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন চাল, ডাল, তেল, লবণ, ফল, দুধ, ডিম, হরলিকসসহ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার। আরিফার সহযোগিতা ও সেবা পেয়ে অভিভূত রংপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকার বাসিন্দা পলি আক্তার বলেছিলেন, ‘করোনার দুর্যোগের মধ্যে তিনি আমাদের খোঁজ নিতে এসেছেন, এটাই তো একটা অনেক বড় ব্যাপার।’

দেশের বিভিন্ন এলাকায় নারীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার। ভাবছিলাম এই টাকা দিয়ে একটি স্কুটি কিনব। কিন্তু পরে এ টাকা দিয়েই সেবা দিতে শুরু করি।
আরিফা জাহান

সেবামূলক কাজের শুরুটা কীভাবে হলো? আরিফা জাহান বললেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকায় নারীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার। ভাবছিলাম এই টাকা দিয়ে একটি স্কুটি কিনব। কিন্তু পরে এ টাকা দিয়েই সেবা দিতে শুরু করি।’ নিজের কার্যক্রমের কথা ফেসবুকে প্রচার করেছিলেন তিনি। তখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটারসহ অনেক সাধারণ মানুষ। আরিফা সাহস পেয়েছেন আরও। বেড়েছে কাজের গতি। ১৯ জন অসহায় নারীকে করোনার সময়ে সেলাই মেশিন দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন তিনি। ঘরহীন ৬ জন বৃদ্ধ মাকে বানিয়ে দিয়েছেন ঘর। সহায়–সম্বলহীন ২১ জন ছাত্রীকে কলেজে ভর্তির জন্য টাকাও দিয়েছেন।

এর আগে মেয়েদের জন্য ক্রিকেট একাডেমি করতেও তাঁকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল ঘুরে আগ্রহী মেয়েদের খুঁজে বের করে শুরুতে ৩০ জনকে নিয়ে রংপুর স্টেডিয়ামে বিনা মূল্যে খেলা শেখানো শুরু করেছিলেন। একসময় এই উদ্যোগই আত্মপ্রকাশ করেছে উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি নামে।

একসময় আরিফা জাহান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে খেলেছেন। ঢাকার ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাব, কলাবাগান, রায়েরবাজার ক্রিকেট দলে ১ নম্বরে ব্যাট করতে নামতেন তিনি। ২০১৭ সালে অসুস্থতার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে পেশাদার ক্রিকেট থেকে বিদায় নিতে হয়।

আরিফা জাহান
মঈনুল ইসলাম

২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে নারীদের জন্য ক্রিকেট একাডেমি শুরু করেন আরিফা। এখন সেখানে ২৫০ জন নারী বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

রংপুর শহরের নুরপুর এলাকায় থাকেন ক্রিকেটার আরিফা জাহান। স্বেচ্ছাসেবার পাশাপাশি তিনি সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের মানবিক বিভাগে শেষ বর্ষে পড়ছেন। নিজে অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন বলে অন্যের কষ্ট তিনি বোঝেন। আরিফা বলছিলেন, ‘দেশের স্বনামধন্য ক্রিকেটারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে যাঁরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ। তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই আমার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’

রংপুর জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক চায়না চৌধুরী বলেন, ‘আরিফার ক্রিকেট একাডেমি আমাদের অঞ্চলে সাড়া ফেলেছে। মেয়েদের আশা দিয়েছে। অনেক কষ্ট করে এই একাডেমি চালিয়ে যাচ্ছে ও। আমরা তার মঙ্গল কামনা করি।’