শতাব্দীর সেরা অগ্রগতি খাওয়ার স্যালাইন

.
.

বিখ্যাত জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট ১৯৭৮ সালের ৫ আগস্ট সম্পাদকীয়তে বলেছিল, ওআরএসের আবিষ্কার চিকিৎসার ক্ষেত্রে শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ওআরএস তীব্র ডায়রিয়া চিকিৎসায় তরল খাওয়ানোর রাস্তা খুলে দিয়েছে।
|
জীবন রক্ষাকারী নতুন চিকিৎসাপ্রযুক্তি বা পদ্ধতি সাধারণত জটিল হয়। শুরুতে নতুন ওষুধ বা চিকিৎসাযন্ত্র ব্যয়বহুল হয় এবং অনেকের নাগালের বাইরে থাকে। ব্যতিক্রম ওআরএস। ওআরএস বা ওরাল রিহাইড্রেসান সলিউশন এখন বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারে পরিচিত একটি পণ্য।

আধা লিটার পানিতে এক প্যাকেট স্যালাইন গুলিয়ে খেতে হয়। এই তরলে শরীরের পানিশূন্যতা দূর হয়। হাতের কাছে স্যালাইনের প্যাকেট না থাকলে আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে এক মুঠ চিনি বা গুড় এবং এক চিমটি লবণ গুলিয়ে খেতে হবে, একই কাজ হবে। এই প্রযুক্তি বিশ্বব্যাপী ডায়রিয়া চিকিৎসার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, কোনো পরিবার খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করতে জানলে বা কোনো পরিবারে স্যালাইনের প্যাকেট মজুত থাকলে ওই পরিবারের কোনো সদস্য ডায়রিয়ায় মারা যাবে না।

সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি) ১৯৮৫ সাল থেকে ওআরএস বাজারজাত করছে। তারা দাবি করেছে, বাংলাদেশে ওআরএস এ পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী ১২ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা করেছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওআরএস বিশ্বব্যাপী পাঁচ কোটি শিশুর জীবন রক্ষা করেছে।

ওআরএস এল কোথা থেকে

ওআরএস নিয়ে গবেষণা, আবিষ্কার, মানুষের কাছে পৌঁছানোর কৌশল, মানুষকে ওআরএস বানাতে শেখানো—এর সব হয়েছে বাংলাদেশে। মূল গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা। আইসিডিডিআরবির সাবেক পরিচালক কে এম এস আজিজ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘শুধু আইসিডিডিআরবি নয়, পুরো বাংলাদেশই ছিল ওআরএসের গবেষণাগার। এখন পুরো বিশ্ব এর সুফল পাচ্ছে।’

রাজধানীর মহাখালীতে গত শতকের ষাটের দশকে কলেরা গবেষণার জন্য কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি (বর্তমানে আইসিডিডিআরবি) স্থাপন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের সঙ্গে বাংলাদেশি গবেষকেরা এখানে কাজ শুরু করেন।

আইসিডিডিআরবি থেকে সংগ্রহ করা কাগজপত্রে দেখা যায়, ১৯৬৪ সালে ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাল মেডিকেল রিসার্চ ইউনিট গ্লুকোজ, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও বাই কার্বোনেট ব্যবহার করে কলেরা রোগীর ওপর একটি গবেষণা করে। তার ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৬৭ সালে ঢাকা ও কলকাতায় কলেরা রোগীদের গ্লুকোজ খাইয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। একই সময়ে চট্টগ্রামে মাঠপর্যায়ে গবেষণা হয়েছিল, তবে পদ্ধতিগত ত্রুটি থাকায় ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।

খাওয়ার স্যালাইন নিয়ে টাইম সাময়িকী ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে
খাওয়ার স্যালাইন নিয়ে টাইম সাময়িকী ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে

এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় মতলব ও ঢাকায়। মূল গবেষক ছিলেন বিজ্ঞানী ডেভিড আর নেলিন ও রিচার্ড এ ক্যাস। অনেকে এ দুজনকে ওআরএসের উদ্ভাবক মনে করেন। তাঁদের সঙ্গে রিসার্চ ফেলো হিসেবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশি রফিকুল ইসলাম ও মজিদ মোল্লা। ওই গবেষণার ফলাফল ১৯৬৮ সালের আগস্টে ল্যানসেট–এ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, কলেরা রোগীদের গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম বাই কার্বোনেট ও পটাশিয়াম ক্লোরাইডের দ্রবণ খাওয়ানো হয়। ভালো ফল পাওয়া যায়। এরপর থেকে আইসিডিডিআরবির মহাখালীর কলেরা হাসপাতালে ডায়রিয়ায় পানিশূন্যতা দূর করতে ওআরএস ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ভারতের শরণার্থীশিবিরে ওআরএস ব্যবহার করা হয়েছিল।

আইসিডিডিআরবির একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সাবেক একাধিক বিজ্ঞানী প্রথম আলোকে বলেছেন, একক কোনো বিজ্ঞানীর কৃতিত্বে ওআরএসের উদ্ভাবিত হয়নি। বিষয়টি রিলে রেসের মতো। গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা তৈরির আগে অনেকে অনেক কাজ করেছেন।

যেমন তরল খাইয়ে কলেরা নিয়ন্ত্রণের গবেষণা কলকাতায় শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে। ল্যানসেট ১৯৫৩ সালের ২১ নভেম্বর সংখ্যায় গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করে। কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের কলেরা ওয়ার্ডের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক হেমেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জির লেখা প্রবন্ধে দেখা বলা হয়, ১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে কলেরায় আক্রান্ত কিছু রোগীর বমি ও পানিশূন্যতা দূর করার জন্য অ্যাভোমিন ট্যাবলেটের সঙ্গে পাথরকুচিপাতার রস খাওয়ানো হয়েছিল এবং তাতে ফলও পাওয়া গিয়েছিল।

ছড়াল সবখানে

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সবখানে খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। ছোট মুদি বা ওষুধের দোকানেও বিক্রি হয়। কিনতে ব্যবস্থাপত্র লাগে না। বাংলাদেশের মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শেরও প্রয়োজন বোধ করছে না। ডায়রিয়া দেখা দিলে ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব, শিক্ষিত, নিরক্ষর—সবাই ওআরএসের প্যাকেট কিনে পানিতে মিশিয়ে খেয়ে নিচ্ছে, শিশুকে খাওয়াচ্ছে। কায়িক পরিশ্রমের পর অনেকেই নিয়মিত ওআরএস খান। অনেক পরিবারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সঙ্গে ওআরএসের প্যাকেট মজুত থাকে। তবে এক দিনে এমন হয়নি।

আশির দশকে প্রায় প্রতিটি পরিবারকে স্যালাইন তৈরি করতে শেখানোর কাজটি করেছিলেন ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা।

মাঠকর্মীরা প্রতিটি খানার অন্তত একজন সদস্যকে পানি, লবণ ও গুড়ের দ্রবণ তৈরি করা শেখান। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এ ব্যাপারে নিয়মিত প্রচার চালায়। এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি, স্যালাইন তৈরিতে এই ফর্মুলার সাফল্য নিয়ে টাইম সাময়িকী ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে।

শিশির মোড়ল: (সাংবাদিক)